শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে বাধা দিলে হরতাল-গণ-অনশন থেকে খালেদা জিয়ার হুঁশিয়ারি

নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা এলেই বিএনপি সরকারের সঙ্গে সংলাপে বসবে। অন্যথায় আগামী ১০ জুনের ঘোষিত সময়সীমার পর আন্দোলনের কর্মসূচি দিয়ে সরকারকে ওই দাবি আদায়ে বাধ্য করা হবে। গতকাল রবিবার গণ-অনশন কর্মসূচিতে এ হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন বিরোধীদলীয় নেতা ও বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া।


শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে বাধা দিলে ফের হরতাল দেওয়ারও পরোক্ষ হুমকি দেন তিনি।
গতকাল রবিবার সকাল সোয়া ১০টায় মহানগর নাট্যমঞ্চ (আবুল বাশার মিলনায়তন) প্রাঙ্গণে স্থাপিত মঞ্চে কোরআন তিলাওয়াতের মাধ্যমে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটের গণ-অনশন কর্মসূচি শুরু হয়। খালেদা জিয়া দুপুর পৌনে ১২টার দিকে গণ-অনশনস্থলে পৌঁছান। বিকেল ৫টা থেকে প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা খালেদা জিয়া বক্তব্য দেন। এরপর নিখোঁজ ইলিয়াস আলীর মেয়ে সাইয়ারা নাওয়াল বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়ার মুখে পানি তুলে দিয়ে অনশন ভাঙায়।
খালেদা জিয়া তাঁর বক্তব্যে বলেন, 'সংলাপে বসে আমরা আলোচনা করতে চাই। এর আগে অবশ্যই নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের বিষয়ে সুস্পষ্ট ও লিখিত ঘোষণা সরকারকে জানাতে হবে। কোনো এজেন্ডা ছাড়া আমরা কোনো আলোচনায় বসব না।' তিনি বলেন, 'সরকার মুলা ঝুলিয়েছে রাষ্ট্রপতির অধীনে নির্বাচন হবে। আমরা বলে দিতে চাই- এই রাষ্ট্রপতি দলীয় রাষ্ট্রপতি। তাঁর অধীনে নির্বাচন মেনে নেওয়া হবে না।'
হরতাল কর্মসূচি প্রসঙ্গে খালেদা জিয়া বলেন, 'আমরা হরতাল, লগিবৈঠা কিংবা গান পাউডার দিয়ে মানুষ হত্যার রাজনীতিতে বিশ্বাস করি না, করবও না। কিন্তু আওয়ামী লীগ ওই রাজনীতি করেছে। সরকারকে বলতে চাই- আমাদের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি, সভা-সমাবেশ, গণমিছিল, মানববন্ধন করতে বাধা দেবেন না। এসব কর্মসূচি করতে দেওয়া না হলে, হরতাল ছাড়া আমাদের কোনো বিকল্প থাকবে না।' তিনি বলেন, 'সরকার শনিবার সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত আমাদেরকে গণ-অনশনের জায়গার অনুমতি দেয়নি। যখন আমরা বলেছি, জায়গা না হলে একটাই পথ হরতাল হবে। তখন শেষ মুহূর্তে অনুমতি দিয়েছে।'
খালেদা জিয়া দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুলসহ সিনিয়র নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা ও গ্রেপ্তারের কথা তুলে ধরে বলেন, 'গত হরতালে মিথ্যা মামলা দিয়ে আমাদের নেতাদের গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠানো হয়েছে। তাঁদের অবিলম্বে মুক্তি দিন, অন্যথায় কঠোর কর্মসূচি দিতে বাধ্য হব।'
সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া অভিযোগ করে বলেন, 'প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সামনে কে বা কারা গাড়ি পুড়িয়েছে, তা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে বসানো সিসিটিভিতে বন্দি আছে। প্রধানমন্ত্রীকে বলব, ওই সিসিটিভিতে দেখেন, কারা গাড়ি পুড়িয়েছে। আমার দলের নেতা-কর্মীরা সেখানে যাননি। বরং আপনার (প্রধানমন্ত্রী) দলের লোকজনই ওই স্থানে গাড়ি পুড়িয়েছে।'
কর্মসূচিতে সভাপতির বক্তব্যে খালেদা জিয়া আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, হত্যা-গুম, সাংবাদিক দম্পত্তি সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডসহ বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরেন। তিনি বলেন, 'ইলিয়াসের স্ত্রী তাঁর সন্তানদের নিয়ে বাসায় একা থাকেন। গত বৃহস্পতিবার রাত পৌনে ১টায় তাঁর বাসায় সাদা পোশাকে গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন গেট ভেঙে ঢোকার চেষ্টা করে। এত রাতে কারো বাসায় এভাবে কেউ প্রবেশ করার কোনো অধিকার কাউকে দেওয়া হয়নি। মনে হচ্ছে, এই কাজের পেছনে তাদের খারাপ কোনো উদ্দেশ্য ছিল। এখন শুনছি, ইলিয়াস আলীর বাসার সামনে সিসিটিভি ক্যামরাও বসানো হয়েছে।'
খালেদা জিয়া অবিলম্বে নিখোঁজ ইলিয়াস আলীকে সুস্থ শরীরে পরিবারের কাছে ফেরত দেওয়ার দাবি জানিয়ে বলেন, 'সরকারের এজেন্সি, র‌্যাব ও সরকারি দলের লোকজনের একটি বিশেষ বাহিনী ইলিয়াস আলীতে তুলে নিয়ে গেছে। এর আগেও সরকার অনেক গুম করেছে, কিন্তু এবার একটু বেশি করে ফেলেছে। যেভাবে যে স্থান থেকে ইলিয়াসকে নিয়ে গেছেন, সেভাবে সেই স্থানে ফেরত দিন।' তিনি দাবি করেন, সম্প্রতি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ছাত্র, সিলেট ছাত্রদলের দুই কর্মীকে গুম করা হয়েছে। সাড়ে তিন বছরে ১২২ জনকে গুম করা হয়েছে। এসব গুমের জন্য অবশ্যই সরকারকে জবাবদিহি করতে হবে।
সরকারের বিরুদ্ধে দলীয়করণের অভিযোগ এনে খালেদা জিয়া বলেন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব আইন ভেঙে সরকার অন্য একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দলীয় একজনকে উপাচার্য নিয়োগ দিয়েছে। একইভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দলীয় লোককে উপাচার্য নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়েও উপাচার্যের দলীয় লোককে নিয়োগ দেওয়া নিয়ে দীর্ঘদিন অচলাবস্থা চলেছে।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ ১৮ দলীয় জোটের শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার ও নিঃশর্ত মুক্তি, বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক এম ইলিয়াস আলীর সন্ধান দেওয়া ও নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি পুনর্বহালের দাবিতে এ গণ-অনশন কর্মসূচি পালিত হয়। রাজধানী ঢাকা ছাড়াও সারা দেশের জেলা ও উপজেলায় গণ-অনশন কর্মসূচি পালন করে বিএনপি ও ১৮ দলীয় জোট।
গতকাল সকাল থেকেই বিএনপি ও শরিক দলের নেতা-কর্মীরা সকাল থেকেই মিছিল নিয়ে অনশনস্থলে আসতে থাকেন। একপর্যায়ে রাজউক মোড় থেকে গুলিস্তান মোড় পর্যন্ত পুরো এলাকা নেতা-কর্মীতে ভরে ওঠে। অনশন শুরুর পর বিএনপিসহ ১৮ দলীয় জোটের নেতারা মঞ্চ থেকে সরকারের ব্যর্থতার কঠোর সমালোচনাসহ নেতা-কর্মীদের মুক্তির দাবি জানিয়ে বক্তব্য দেন। বিএনপি নেতাদের মধ্যে বক্তব্য দেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ আহমদ, মাহবুবুর রহমান, তরিকুল ইসলাম, জমিরউদ্দিন সরকার, রফিকুল ইসলাম মিয়া, নজরুল ইসলাম খান. আবদুল মঈন খান প্রমুখ।
পেশাজীবীদের মধ্যে বক্তব্য দেন সুপ্রিম কোর্টের প্রবীণ আইনজীবী রফিক-উল হক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ, অধ্যাপক মনিরুজ্জমান মিয়া, অধ্যাপক আবু আহমেদ, অধ্যাপক জিন্নাতুন নেসা তাহমিনা বেগম, অধ্যাপক সদরুল আমিন, অধ্যাপক ইউসুফ হায়দার, সাবেক সচিব আসাফ উদ দৌলা প্রমুখ। কারাগারে আটক নেতাদের ছেলেমেয়েদের মধ্যে বক্তব্য দেন ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেনের ছেলে খন্দকার মারুফ হোসেন, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের মেয়ে অপর্ণা রায়, আন্দালিব রহমান পার্থের ছোট ভাই আশিকুর রহমান শান্ত। কর্মসূচির কার্যক্রম পরিচালনা করেন বিরোধীদলীয় চিপ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুক ও মহানগর বিএনপির সদস্যসচিব আবদুস সালাম।
বিকল্পধারার সংহতি প্রকাশ : বিকল্পধারার মহাসচিব অবসরপ্রাপ্ত মেজর আবদুল মান্নান গণ-অনশন কর্মসূচির প্রতি পূর্ণ সমর্থন ও একাত্মতা প্রকাশ করে বলেন, 'দেশে কোনো আইনের শাসন নেই।'
সংস্কারপন্থীরাও গেলেন : ২০০৭ সালের জরুরি অবস্থার পর সংস্কারপন্থী বলে পরিচিত নেতা সরদার সাখাওয়াত হোসেন বকুলসহ বেশ কয়েকজন নেতা দলের নেতা-কর্মীদের নিয়ে গণ-অনশনে যোগ দেন। সাবেক প্রতিমন্ত্রী লুৎফর রহমান খান আজাদ, সৈয়দ আবুল হোসাইন, সাবেক সংসদ সদস্য শাহ মো. আবু জাফর প্রমুখ নেতাদেরও দেখা গেছে। গতকাল দুপুর পৌনে ১২টার দিকে খালেদা জিয়া যখন মহানগর নাট্যমঞ্চের সামনে গণ-অনশনের স্থানে প্রবেশ করেন, তখন বকুল তাঁর লোকজন নিয়ে গাড়ির পাশে গিয়ে শুভেচ্ছা জানান। খালেদা জিয়াও হাত নেড়ে দলীয় নেতা-কর্মীদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন।
ব্যারিস্টার রফিকের অভিনন্দন : হরতালের মতো কঠোর কর্মসূচির বিকল্প খোঁজার জন্য খালেদা জিয়াকে অভিনন্দন জানিয়ে সুপ্রিম কোর্টের প্রবীণ আইনজীবী রফিক-উল হক অনশন অনুষ্ঠানে বলেন, 'আমি হরতালে বিশ্বাস করি না। এতে দেশ ও জনগণের ক্ষতি হয়। ম্যাডাম গণ-অনশন করে দেখালেন, কিভাবে সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা হয়। রাজনৈতিক দলগুলো বাধ্য হয়ে হরতালের মতো কর্মসূচি দেয়। আমাদের ম্যাডাম আজ গণ-অনশন করে বিকল্প একটি নজির স্থাপন করলেন।'
বিভাগীয় শহরে গণ-অনশন : চট্টগ্রাম, রাজশাহী, সিলেট, বরিশাল, খুলনা ও রংপুরে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটের গণ-অনশন কর্মসূচি পালিত হয়েছে। কর্মসূচিতে জোটের নেতারা বলেছেন, দেশ চালাতে ব্যর্থ হয়ে সরকার বিরোধীদলীয় নেতা-কর্মীদের দমনে নেমেছে।
ঢাকার বাইরে কালের কণ্ঠের বিভিন্ন অফিস থেকে পাঠানো প্রতিবেদনে জানা যায়, চট্টগ্রাম মহানগরে উত্তর ও দক্ষিণ জেলা বিএনপির নেতা-কর্মীরা সকাল ১০টায় দলের কার্যালয় শহরের কাজিরদেউড়ি এলাকায় নাসিমন ভবনের সামনে কর্মসূচি শুরু করেন। বিকেল ৪টায় সিটি করপোরেশনের মেয়র এম মনজুর আলম ফলের রস খাইয়ে অনশন ভঙ্গ করান। কর্মসূচিতে নগর বিএনপির সভাপতি আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীসহ অন্য নেতারা উপস্থিত ছিলেন। রাজশাহী নগরীর ভুবনমোহন পার্কে মহানগর বিএনপির সিনিয়র সহসভাপতি নজরুল হুদার নেতৃত্বে নেতা-কর্মীরা কর্মসূচি পালন করেন। প্রায় ১০০ গজ দূরে সাহেববাজার জিরো পয়েন্টে জেলা বিএনপির সভাপতি সাবেক সংসদ সদস্য নাদিম মোস্তফার নেতৃত্বে নেতা-কর্মীরা একই কর্মসূচি পালন করেন। খুলনার কর্মসূচিতে নেতৃত্ব দেন নগর বিএনপির সভাপতি সংসদ সদস্য নজরুল ইসলাম মঞ্জু ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা এম নুরুল ইসলাম। বরিশাল শহরে পৃথক তিনটি স্থানে কর্মসূচি পালন করে বিএনপি। এসব কর্মসূচিতে মহানগর বিএনপির সভাপতি সংসদ সদস্য মজিবর রহমান সরোয়ার, সংসদ সদস্য মেজবাহ উদ্দিন ফরহাদ, জামায়াতের নগর শাখার আমির মোয়াজ্জেম হোসেন হেলাল, খেলাফত মজলিসের নেতা মো. মোস্তাফিজুর রহমান। সিলেটে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সকাল ১০টা থেকে ৫টা পর্যন্ত কর্মসূচি পালন করেন বিএনপির নেতা-কর্মীরা। এতে নেতৃত্ব দেন নগর বিএনপির সভাপতি এম এ হক, সাবেক সংসদ সদস্য দিলদার হোসেন সেলিম প্রমুখ। রংপুর শহরের পায়রা চত্বরে কর্মসূচি পালন করেন ১৮ দলীয় জোটের নেতারা। এতে নেতৃত্ব দেন জেলা বিএনপির আহ্বায়ক মোজাফফর হোসেন, যুগ্ম আহ্বায়ক সামসুজ্জামান সামু প্রমুখ।

No comments

Powered by Blogger.