অরণ্যে রোদন-ভাবিয়া করিও কাজ by আনিসুল হক

কৌতূহলে বিড়াল মরে। সবাই বলেছিল, টঙ্গী ডাইভারসন সড়ক থেকে র‌্যাবংগসের ভাঙা ভবনের ওপর দিয়ে অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সড়কে যাওয়ার জন্য যে নতুন পথটি সবে উদ্বোধিত হয়েছে, সেটাতে যাওয়ার চেষ্টা করো না। কারণ সারাক্ষণই, ওর পুব থেকে পশ্চিমে যাওয়ার পথে বামের লেনটা, যানজটে স্থবির হয়ে থাকে।


তা কে শোনে কার কথা। তেজগাঁও থেকে ওই লেনে ওঠার জন্যই বেশ খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে হলো। দেখাই যাচ্ছে, পুরোটাই গাড়ি ভরা। তবু অপেক্ষা করে ওটাতেই উঠলাম। আর ঝাড়া এক ঘণ্টা আটকে রইলাম ইঁদুর ধরার কলে। শুধু ওই রাস্তাতে যানজট বাধলে কথা ছিল, ওই এক নতুন রাস্তার কারণে যানজট বেড়ে গেছে ভিআইপি সড়কেও, যানজট এখন উত্তরে জাহাঙ্গীর গেট, দক্ষিণে ফার্মগেট, ওদিকে চন্দ্রিমা উদ্যানের মোড় পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে। সুখের লাগিয়া এ ঘর বাঁধিনু, অনলে পুড়িয়া গেল! ভিআইপি সড়কে এসে মেশা এই নতুন সড়ক যে নতুন গিট্টু বাঁধাবে, সেটা বলার জন্য নগর পরিকল্পনাবিদ হতে হয় না! আগে ওই মোড়ে সিগন্যাল ছিল তিন দিকে যাওয়ার জন্য বা তিন দিক থেকে আসার জন্য, এবার দিক আরেকটা বেড়েছে। পুব থেকে পশ্চিমে আসা যানবাহনগুলোর জন্য ৪০-৫০ সেকেন্ড তো দিতেই হবে। আর ওই ব্যস্ত ভিআইপি সড়কে প্রতি ১০ মিনিটে যদি দুই মিনিট চলাচল বন্ধ রাখতে হয়, কী হতে পারে, তা ওই সড়কে নিয়মিত চলাচলকারী ভুক্তভোগীরা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন।
আমি ট্রাফিক পুলিশ বিভাগের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বললাম। উনি বললেন, এ জন্য আপনার মতো প্রকৌশলীরা দায়ী! আমি তারপর আমার দুজন জ্যেষ্ঠ প্রকৌশলী-শিক্ষকের সঙ্গে কথা বললাম। একজন বললেন, রাস্তাটা র‌্যাবংগস ভবনের সঙ্গের ভিআইপি রাস্তায় মিলিয়ে না দিয়ে ওভারপাস দিয়ে ভিআইপি সড়কটা পার করে দিলেই তো হতো! হতো, এ কথাটা আমিও বলছি, প্রকৌশলী শিক্ষকও বলছেন, ড্রাইভাররাও বলছেন। তাহলে দেওয়া হয়নি কেন?
আচ্ছা, এ রকম একটা নতুন রাস্তা করার আগে তো একটা মডেল টেস্ট করে নেওয়ার কথা! এই রাস্তা চালু হলে কী হবে তার ফল, সেটা ওই টেস্ট থেকেই বেরিয়ে আসার কথা। এই রাস্তার পরিকল্পনা করার সময় সেটা কি করা হয়েছিল? উত্তর হচ্ছে, হয়নি। কেন হয়নি?
এবার আমি একটা গল্প শোনাব। ফখরুদ্দীন আহমদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় এই গল্পটা এই কলামেই একবার বলেছিলাম, অনেকের মনে আছে আশা করি। গল্পটা আকবর আলি খান তাঁর লেখা পরার্থপরতার অর্থনীতি বইয়ে বলেছেন। আইয়ুব খান দেশে সামরিক শাসন জারি করেছেন। একটা এলাকায় দুধে ভেজাল বন্ধ করার জন্য অভিযান শুরু হলো। ভ্রাম্যমাণ আদালত ঘুরে বেড়াচ্ছেন হাটে হাটে, ল্যাকটোমিটার নিয়ে, গয়লার দুধ পরীক্ষা করে দেখছেন, ভেজাল পাওয়ামাত্র গয়লাকে অর্থদণ্ডে দণ্ডিত করছেন। আকবর আলি খান ওই এলাকায় তখন প্রশাসক হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন। তিনি বলছেন, এরপর দেখা গেল, দুধে ভেজাল আরও বেড়ে গেছে। কারণ গরিব গয়লারা তাঁদের জরিমানার টাকা তুলে নেওয়ার জন্য দুধে পানির পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়েছেন। আকবর আলি খান বলেছিলেন, দুধে পানি দেওয়ার পরিমাণ রোধ করার উপায় হলো দুধের উৎপাদন বৃদ্ধি, উন্নত গাভি পালন ইত্যাদি। তাঁর বক্তব্য হলো, অর্থনৈতিক সমস্যার কোনো রাজনৈতিক সমাধান নেই। এ কথার সূত্র ধরে ওই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে আমি বলেছিলাম, অর্থনৈতিক সমস্যার কোনো সামরিক সমাধান নেই। কারণ ওই সময় চেষ্টা হয়েছিল, বিডিআরের মাধ্যমে খেত থেকে শাকসবজি সরাসরি ঢাকার মার্কেটে এনে বিক্রি করার, আর অবৈধ দোকানপাট উচ্ছেদ করার। তার ফল ভালো হচ্ছিল না।
এখন ওই কথাটার রেশ ধরে বলি, প্রকৌশল সমস্যার, নগর সমস্যারও কোনো রাজনৈতিক সমাধান নেই। সামরিক সমাধানও নেই।
আমরা জানি, ঢাকার রাস্তাগুলো উত্তর-দক্ষিণমুখী, আমাদের পুব-পশ্চিম রাস্তার অভাব আছে। পুব-পশ্চিমমুখী রাস্তা আরও হতে হবে, এটাও আমরা শুনে আসছি। কিন্তু সামরিক ফরমান দিয়ে বা রাজনৈতিক ঘোষণা দিয়ে রাস্তাঘাট, সেতু বানানো হলে তা সমস্যার সমাধান না করে সমস্যাকে বাড়াতে পারে। প্রথম আলোর সেতুসংখ্যায় তার ছবি আমরা অনেক দেখেছি। সেতু হয়েছে, সংযোগ সড়ক নেই; অর্ধসমাপ্ত সেতু, ডাঙার মধ্যে সেত—এই রকম কত যে অকেজো সেতুর ছবি ছাপা হয়েছিল ওই সংখ্যায়।
হ্যাঁ। রাজনৈতিক অঙ্গীকার ও সদিচ্ছার দরকার আছে। দরকার রাজনৈতিক নির্দেশনাও। কিন্তু যার কাজ তাকে করতে দিতে হবে। এসব উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেওয়ার কতগুলো আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত পদ্ধতি আছে। আপনাকে সম্ভাব্যতা যাচাই করতে হবে। আপনাকে অর্থনৈতিকভাবে এই প্রকল্প কতটা লাভজনক হবে, আদৌ লাভজনক হবে কি না, কী করলে সবচেয়ে বেশি লাভ হবে—সেসব পরীক্ষা করে দেখতে হবে। আর একটা প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে মানুষ, প্রতিবেশ-পরিবেশের ওপর তার কী প্রভাব পড়বে, সেটা বিবেচনায় আনতেই হবে। এই জন্য সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলতে হবে, মানুষের মতটাকে বিবেচনায় নিতে হবে। টঙ্গী ডাইভারসন সড়ক থেকে ভিআইপি সড়ক পর্যন্ত নতুন সড়কটির নকশা করার সময় এই বিবেচনাগুলো আদৌ করা হয়েছিল কি না, সন্দেহ আছে। সত্য বটে, রাজউকের এই পরিকল্পনাটা অনেক পুরোনো, কিন্তু ফখরুদ্দীন আহমদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে এটা করা হয়েছে। ওই সরকার ছিল বলেই ওটা করা সম্ভব হয়েছে, না হলে র‌্যাবংগস ভবন কে-ই বা ভাঙতে পারত! তার কৃতিত্ব যদি ওই সরকারকে দিই, এটার যদি কোনো ত্রুটি থাকে, তাহলে তার দায়িত্বও ওই সরকারকেই নিতে হবে। এখানে আসে ওই পুলিশ ভাইয়ের কথা, আমরা প্রকৌশলীরাই এই সড়কের জন্য দায়ী। কিন্তু প্রকৌশল-সমস্যার সমাধানটা যদি হয় রাজনৈতিক কিংবা সামরিক, তাহলে তো সমস্যা মিটবে না।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কুড়িল ফ্লাইওভারের নির্মাণকাজ উদ্বোধন করতে গিয়ে ২ মে ২০১০ যা বলেছেন, তার সব কটিই খুবই জরুরি ও প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন, ঢাকার যানজটের জন্য অপরিকল্পিত নগরায়ণ দায়ী। বলেছেন, ঢাকার ওপর থেকে মানুষের চাপ কমাতে হবে, বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। তিনি কলকারখানা ঢাকার বাইরে নিয়ে যাওয়াকে উৎসাহিত করার জন্য প্রণোদনার কথা বলেছেন। বলেছেন স্যাটেলাইট শহর, সংযোগ সড়ক, দ্বিতল সড়ক, ভূতল সড়ক, কমিউটার রেলওয়ে, রিংরোড আর ওয়াটারওয়ের কথা।
ঢাকার যানজট নিরসনের জন্য এসবের প্রতিটির দরকার হবে। জরুরি পদক্ষেপ হওয়া উচিত ফুটওভারব্রিজ, অনেকগুলো, সারা ঢাকায়। বিমানবন্দর সড়কে মানুষ হাতের মুঠোয় জীবন নিয়ে ছোটাছুটি করে রাস্তা পার হয়। সোনারগাঁও মোড়ে রোজ লাখো মানুষ রাস্তা পেরোয়। ঢাকার যানপ্রবাহকে ধীর করে দেয় এই মানবস্রোত। ফুটপাত আর ফুটওভারব্রিজ তাই জরুরি।
কিন্তু সবচেয়ে বেশি জরুরি একটা মহাপরিকল্পনা, সমন্বিত পরিকল্পনা। আমরা জানি, এক কেজি মাল পরিবহনে সবচেয়ে কম খরচ পড়ে জলপথে, তারপর আড়াই গুণ পড়ে রেলপথে, সবচেয়ে বেশি খরচ হয় আর সবচেয়ে বেশি পরিবেশদূষণ ঘটে সড়কপথে। কিন্তু সেদিন ডেইলি স্টার-এ খবর ও ছবি দেখলাম, ঢাকার চারদিকের জলপথটা চালু করতে হলে নির্মাণাধীন ও সদ্যনির্মিত অনেকগুলো সেতু ভেঙে ফেলতে হবে। কারণ ওই সব সেতুর নিচ দিয়ে নৌবাহন চলাচল সম্ভব নয়! আবার সেই সেতুকাহিনি!
বলতে চাইছি, রাজনীতিকেরা দিকনির্দেশনা দেবেন, কিন্তু নকশা প্রস্তুত করবেন ওই বিষয়ের বিশেষজ্ঞরা, আর সেটা তাঁরা করবেন মানুষের সঙ্গে কথা বলে, পরিবেশের ওপর, প্রতিবেশের ওপর প্রকল্পের প্রভাবগুলো যাচাই-বাছাই করে, মডেল টেস্ট সম্পন্ন করে, আর পুরো ব্যাপারটা হতে হবে সুসমন্বিতভাবে। নইলে পরে দেখা যাবে, সেতুর কারণে নৌপরিবহন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, ফুটওভারব্রিজের কারণে ফ্লাইওভার করা যাচ্ছে না, ভূতল পরিবহনের জন্য বাধাগ্রস্ত হচ্ছে পয়োনিষ্কাশনব্যবস্থা! ১৬ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০ বছর মেয়াদি একটা কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা (স্ট্রাটেজিক ট্রান্সপোর্ট প্লান) প্রণয়ন করে রেখেছে ঢাকা যানবাহন সমন্বয় বোর্ড বলে একটা প্রতিষ্ঠান, ২০০৮ সালে যেটা অনুমোদিতও হয়েছে। শুনতে পেলাম, এই যে কুড়িল ফ্লাইওভার হচ্ছে, সেটা এই কৌশলগত পরিকল্পনায় নেই। না থাকলেই নতুন কিছু করা যাবে না, তা বলছি না, কিন্তু একটা সমন্বয় তো থাকতে হবে। তা না হলে ওই ১৬ কোটি টাকা খরচ করবারই বা কী দরকার ছিল!
আবার বলি, প্রকৌশল-সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান নেই। ওপর থেকে সিদ্ধান্ত দিয়ে দেবেন, এটা করো, ওটা করো না, তা হয় না। মডেল টেস্ট করুন। সম্ভাব্যতা যাচাই করুন। অর্থনৈতিক লাভ-ক্ষতির হিসাব করুন। পরিবেশ-প্রতিবেশের প্রতিক্রিয়া যাচাই করুন। মানুষের সঙ্গে কথা বলুন। তার পরই প্রকল্প হাতে নিন। আর যা করবেন, তা হতে হবে একটা সামগ্রিক পরিকল্পনার অংশ। মন্ত্রী বা সাংসদেরা প্রকল্প ঘোষণা করে বসবেন ভোটের আগে, জনসভায় দাঁড়িয়ে আবেগের বশে, আবেগে উদ্বেল জনগণের সামনে, পরে বিশেষজ্ঞরা সেই প্রকল্প ‘করতেই হবে জেনে নিয়ে’ সেই মোতাবেক সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে নামবেন, তাহলে তো হবে না। রাজনীতিকেরা বলবেন, আমরা এই সমস্যার সমাধান চাই, কী কী বিকল্প আছে, আমাদের সামনে আনুন, সেখান থেকে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে পরামর্শ করে দেশের জন্য যেটা সবচেয়ে ভালো হয়, সেটা করার জন্য তাঁরা নির্দেশ দেবেন। এ প্রসঙ্গে আবার বলি, ঢাকার বাইরে গার্মেন্টসপল্লি গড়ে তোলার কথাটা গুরুত্বের সঙ্গে ভাবুন। আর বাংলাদেশের যোগাযোগব্যবস্থায় সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিন নৌপরিবহনে, তারপর রেলপথে। ঢাকা-চট্টগ্রাম চার লেনের আরেকটা মহাসড়ক হতে পারলে সংক্ষেপিত ও উন্নত রেলপথ কেন হতে পারবে না?
পুরোনো কৌতুকটা মনে পড়ছে। নেতা জনসভায় বললেন, আপনাদের আমি একটা সেতু দেব। জনগণ বলল, আমাদের তো নদী নেই। সেতু কোথায় দেবেন? নেতা বললেন, আচ্ছা, আগে নদী কেটে দেব, তারপর তার ওপরে সেতু দেব। সেতু দেবেন নাকি সড়ক দেবেন, সেটার সিদ্ধান্তটা যেন কেবল ওপর থেকে চাপিয়ে না দিয়ে বৈজ্ঞানিকভাবে সুসমন্বিতভাবে দেওয়া হয়। মনে রাখতে হবে, আমাদের সম্পদ সীমাবদ্ধ, মানুষ বেশি, জমিও খুব কম। আমাদের একই জিনিস একবার গড়া, একবার ভাঙা শোভা পায় না। তুরাগ নদের ওপরের সেতু ভেঙে ফেলতে হলেও তা হবে জাতীয় সম্পদ ও অমূল্য সময়ের অপচয়। কাজেই নেতারা দিকনির্দেশনা দিন, কিন্তু বিশেষজ্ঞদের কাজ বিশেষজ্ঞরাই করুন। হয়তো কোনো মুচিই আবিষ্কার করে ফেলবে জুতা। কারণ ওটাই তার কাজ।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক, সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.