ঐতিহ্য-শতবর্ষে বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর by মুহাম্মদ লুৎফুল হক
১৮১৪ সালে হেনরি ক্রেটনের রুইনস অব গৌড় বইটি লন্ডন থেকে প্রকাশ পায়। বরেন্দ্র অঞ্চলের প্রত্ন নিদর্শনের বিষয়ে এটিই প্রথম প্রকাশিত বই। সরকারি উদ্যোগে ১৮৬১ থেকে ১৮৮৫ সালের মধ্যে আলেকজান্ডার কানিংহাম দুই দফায় সারা ভারতের প্রত্ন নিদর্শনের জরিপ করেন। কানিংহামের জরিপে বরেন্দ্র অঞ্চলের বেশ কিছু এলাকা বিশেষত গৌড়ের প্রত্ন নিদর্শনগুলো স্থান পায়।
একই সময়ে রাজশাহীর জেলা প্রশাসকও সরকারের কাছে পেশ করেনজেলার প্রত্ন নিদর্শন সম্পর্কে একটি প্রতিবেদন।
উনিশ শতকের শেষার্ধে রাজশাহীর বিশিষ্ট ব্যক্তিরা এলাকার প্রাচীন ইতিহাসের বিষয়ে বিশেষভাবে আগ্রহী হয়ে ওঠেন; হিন্দু রঞ্জিকা পত্রিকা এ বিষয়ে বিশেষ ভূমিকা রাখে। অক্ষয় কুমার মৈত্রেয় পেশায় আইনজীবী হলেও সে যুগে বিজ্ঞানসম্মতভাবে ইতিহাস চর্চার সূত্রপাত করেন। বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকে অক্ষয় কুমার মৈত্রেয়কে ঘিরে রাজশাহীতে একটি সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল গড়ে ওঠে। এ দলে উল্লেখযোগ্যদের মধ্যে ছিলেন কুমার শরৎ কুমার রায় (দিঘাপতিয়ার জমিদার), রমা প্রসাদ চন্দ প্রমুখ। ১৯০৭ সালে মুর্শিদাবাদের কাশিমবাজারে বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মিলনের প্রথম অধিবেশনে অক্ষয় কুমার মৈত্রেয় বাংলাদেশের কেন্দ্রস্থলে প্রাচীন পুঁথি, উপকথা, কিংবদন্তি, পুরাকীর্তি ইত্যাদি সংগ্রহ, সংকলন ও সংরক্ষণের জন্য একটি ‘স্বারস্বত ভবন’ প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব রাখেন। ১৯০৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বগুড়ায় উত্তরবঙ্গ সাহিত্য সম্মিলনের দ্বিতীয় অধিবেশনে রাজেন্দ্র লাল আচার্য্যের বেশ কিছু ঐতিহাসিক ও প্রত্ন নির্দশন উপস্থাপনের সংবাদে অক্ষয় কুমার বগুড়া আসেন। উত্তরবঙ্গ বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মিলনে এসব সংগৃহীত প্রত্ন নিদর্শন সংরক্ষণের জন্য একটি জাদুঘর প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব গৃহীত হয়।
১৯১০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ভাগলপুরে বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মিলন অধিবেশনে রাজশাহী থেকে অক্ষয় কুমার, শরৎ কুমার এবং রমা প্রসাদ যোগ দেন। ওই এলাকার প্রত্ন নিদর্শন দেখে জাদুঘর প্রতিষ্ঠায় তাদের আগ্রহ আরও বৃদ্ধি পায়। ১৯১০ সালের এপ্রিল মাসে তাঁরা বরেন্দ্র এলাকায় পুরাকীর্তি সংগ্রহ শুরু করেন। ১৯১০ সালের জুন মাসে প্রত্ন নিদর্শন সংগ্রহের জন্য তাঁরা দ্বিতীয় দফায় সফর করেন। ওই সফরে আরও যোগ দেন রাজেন্দ্র লাল আচার্য্য ও শ্রীরাম মৈত্র। এই সফরকালে নিজেদের সংগঠিত করার জন্য একটি সমিতি গঠনের প্রস্তাব উত্থাপিত হয়। একই বছরের সেপ্টেম্বর মাসে রাজশাহীতে আনুষ্ঠানিকভাবে বরেন্দ্র অনুসন্ধান সমিতি (Varindra Research Society) প্রতিষ্ঠা লাভ করে। কুমার শরৎ কুমার রায়, অক্ষয় কুমার মৈত্রেয় এবং রমা প্রসাদ চন্দ যথাক্রমে সভাপতি, পরিচালক এবং সম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত হন।
প্রথম সফরে সংগৃহীত প্রত্ন নিদর্শনগুলো শরৎ কুমারের বড় ভাই প্রমদানাথ রায়ের রাজশাহীর বাড়ির (সাবেক বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়) উঠানে প্রদর্শনের জন্য রাখা হয়। সংগ্রহের সংখ্যা বাড়তে থাকলে উঠানে স্থান সংকুলান না হওয়ায় ১৯১০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে রাজশাহী পাবলিক লাইব্রেরির নিচতলার দুটি ঘরে সেগুলো স্থানান্তর করা হয়। এখানে এটি একটি প্রত্ন সংগ্রহশালা বা জাদুঘরের রূপ নেয়। বরেন্দ্র অনুসন্ধান সমিতি গঠনের পর এই জাদুঘর সমিতির অন্যতম প্রধান অঙ্গ সংগঠনের স্বীকৃতি পায়। ১৯১০ সালের এপ্রিল মাসে প্রমদানাথের উঠানে বরেন্দ্র জাদুঘরের প্রদর্শনী শুরু হলেও সরকারিভাবে ১৯১০ সালের ২৭ সেপ্টেম্বরকে বরেন্দ্র জাদুঘরের প্রতিষ্ঠা দিবস ধরা হয়, কারণ, এ দিন থেকে পাবলিক লাইব্রেরিতে এর আনুষ্ঠানিক যাত্রার শুরু হয়। ১৯১৯ সালের নভেম্বর পর্যন্ত পাবলিক লাইব্রেরিতে বরেন্দ্র অনুসন্ধান সমিতির সংগ্রহশালার প্রদর্শন বহাল থাকে। ১৯১৬ সালে প্রকাশিত সরকারি গেজেটে জাদুঘর সম্পর্কে ও মেলি উল্লেখ করেন, ‘রামপুর বোয়ালিয়ার (রাজশাহী শহরের পুরাতন নাম) সবচেয়ে আকর্ষণীয় প্রতিষ্ঠান হলো বরেন্দ্র অনুসন্ধান সমিতির জাদুঘর, যেটি এখন পাবলিক লাইব্রেরিতে স্থাপিত হয়েছে’।
১৯১৯ সালের নভেম্বরে জাদুঘরের নিজস্ব ভবন নির্মাণ হওয়ার পর অনুসন্ধান সমিতির প্রত্ন সংগ্রহ বর্তমান স্থান অর্থাৎ জাদুঘরের নিজস্ব ভবনে স্থানান্তর করা হয়। ভবন নির্মাণের জন্য জমি দান করেন প্রমদানাথ রায়। জাদুঘর নির্মাণে ব্যয় হয় ৬৩ হাজার টাকা, যার পুরোটাই বহন করেন শরৎ কুমার রায় ও বসন্তকুমার রায়। ১৯১৬ সালের ১৩ নভেম্বর জাদুঘরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন বাংলার গভর্নর লর্ড কারমাইকেল এবং ১৯১৯ সালের ২৭ নভেম্বর জাদুঘর উদ্বোধন করেন বাংলার আর এক গভর্নর লর্ড রোনাল্ডস। জাদুঘর তার আয়ুষ্কালে দুবার বড় ধরনের হোঁচট খায়। ১৯১১ সালে কলকাতা জাদুঘর বরেন্দ্র জাদুঘরের দুষ্প্রাপ্য ও অদ্বিতীয় সংগ্রহগুলো দাবি করে বসলে জাদুঘরের অস্তিত্বের সংকট দেখা দেয়। রাজশাহীর তদানীন্তন বিভাগীয় কমিশনারের প্রচেষ্টা এবং গভর্নর লর্ড কারমাইকেলের সহযোগিতায় এ সংকট কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়। ১৯৪৭-পরবর্তী সময়ে জাদুঘর আরেকবার অস্তিত্ব-সংকটের মুখোমুখি হয়। এ সময় জাদুঘরের প্রধান উদ্যোক্তা এবং পরিচালকেরা দেশত্যাগ করলে জাদুঘরটি অভিভাবকশূন্য হয়ে যায়। ১৯৬২ সালে জাদুঘরের তদানীন্তন কিউরেটর এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর এ আর মল্লিকের প্রচেষ্টায় জাদুঘরটি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণে আনা হলে এটি নতুন জীবন লাভ করে।
বরেন্দ্র জাদুঘর দেশের প্রাচীনতম জাদুঘর এবং এখানে আছে বাংলার প্রস্তর নির্মিত ভাস্কর্যের সবচেয়ে বড় মজুদ। বরেন্দ্র জাদুঘর অবিভক্ত বাংলার দ্বিতীয় প্রাচীনতম জাদুঘর, এর আগে ১৮১৪ সালে কলকাতা জাদুঘর প্রতিষ্ঠা লাভ করে আর ঢাকা জাদুঘর প্রতিষ্ঠা লাভ করে ১৯১৩ সালে।
১৯১০ সালের এপ্রিলে প্রমদানাথ রায়ের বাড়ির উঠানে অল্প কিছু প্রত্ন নিদর্শন নিয়ে যে জাদুঘরের যাত্রা শুরু হয়, তা আজ শতবর্ষ পূর্ণ করল। ১০০ বছরে এখানে প্রত্ন নিদর্শন, মুদ্রা, মূর্তি, পাণ্ডুলিপি, পুস্তকের সংগ্রহ শতগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে, প্রকাশিত হয়েছে সমৃদ্ধ প্রকাশনা, গবেষকেরা এ জাদুঘরের সাহায্য নিয়ে গবেষণাকর্ম সমাধা করেছেন। বরেন্দ্র জাদুঘরের প্রতিষ্ঠা পরবর্তীকালে এর অনেক সংগ্রহ কলকাতা এবং ঢাকা জাদুঘরে স্থানান্তর করে ওই সব জাদুঘরকে সমৃদ্ধ করা হয়েছে। এই জাদুঘরে এমন অনেক সংগ্রহ আছে, যা অদ্বিতীয় এবং পৃথিবীর আর কোথাও তা নেই। জাদুঘরের সংগ্রহে তিন হাজার ভাস্কর্য, পাঁচ হাজার মুদ্রা, এক হাজার ৭৩টি টেরাকোটা, ৩২টি শিলালিপি, ২৫০টি ধাতব সামগ্রী, ২০০ অলংকার এবং ৭০০ বিবিধ সামগ্রীসহ প্রায় ১০ হাজার প্রাচীন কালের নিদর্শন আছে। এ ছাড়া পাঁচ হাজার ৩০০ পাণ্ডুলিপি এবং ১৩ হাজার মূল্যবান বই ও পত্রিকা মজুদ আছে। বরেন্দ্র জাদুঘরের প্রায় ১০০-র অধিক প্রকাশনা রয়েছে, যার মধ্যে অনেকগুলোই আন্তর্জাতিক মানের। এগুলোর বেশির ভাগই এখন দুষ্প্রাপ্য হয়ে গেছে।
বাংলাদেশে শতবর্ষী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা খুবই কম, আর এ ধরনের গবেষণা বা শিক্ষাসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান তো হাতে গোনা। পৃথিবীর অন্য কোনো এলাকায় এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের শতবর্ষকে স্মরণীয় করে রাখা হতো, কিন্তু বাংলাদেশের সংস্কৃতি ভিন্ন। বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘরের শতবর্ষ নিয়ে বিশেষ কারও যে খুব একটা চিন্তা আছে তা মনে হচ্ছে না। জাদুঘর কর্তৃপক্ষ শতবর্ষ উদ্যাপনের এখনো কোনো পরিকল্পনা হাতে নেয়নি, তারা তাকিয়ে আছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে আর বিশ্ববিদ্যালয়ে এ বিষয়ে এখনো কোনো আলোচনা হয়নি। হয়তো শেষ মুহূর্তে তড়িঘড়ি করে একটা দায়সারা অনুষ্ঠান হলেও হতে পারে এবং তা কিছু আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে সীমিত থাকবে, যার মধ্যে একাডেমিক ফ্লেভার বা পাণ্ডিত্যের স্বাদ নাও থাকতে পারে। এপ্রিল মাস তো চলেই গেল, তবে শতবর্ষ উদ্যাপনটা সেপ্টেম্বর মাসেও হতে পারে। সে ক্ষেত্রে উদ্যোগটা এখনই শুরু করতে হবে। এ ব্যাপারে কর্তৃপক্ষ উদ্যোগ নিলে পৃষ্ঠপোষক হিসেবে বড় কোন প্রতিষ্ঠানকে পাওয়া দুরূহ হবে না। আশা করছি যে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় তথা বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর তাদের শতবর্ষ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে জাদুঘরকে নতুন করে বিশ্বের কাছে উপস্থাপন করবে এবং একই সঙ্গে তার ঐতিহ্য ও সুনামকে পুনরুদ্ধার করবে।
মুহাম্মদ লু্ৎফুল হক: গবেষক।
lutful55@gmail.com
উনিশ শতকের শেষার্ধে রাজশাহীর বিশিষ্ট ব্যক্তিরা এলাকার প্রাচীন ইতিহাসের বিষয়ে বিশেষভাবে আগ্রহী হয়ে ওঠেন; হিন্দু রঞ্জিকা পত্রিকা এ বিষয়ে বিশেষ ভূমিকা রাখে। অক্ষয় কুমার মৈত্রেয় পেশায় আইনজীবী হলেও সে যুগে বিজ্ঞানসম্মতভাবে ইতিহাস চর্চার সূত্রপাত করেন। বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকে অক্ষয় কুমার মৈত্রেয়কে ঘিরে রাজশাহীতে একটি সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল গড়ে ওঠে। এ দলে উল্লেখযোগ্যদের মধ্যে ছিলেন কুমার শরৎ কুমার রায় (দিঘাপতিয়ার জমিদার), রমা প্রসাদ চন্দ প্রমুখ। ১৯০৭ সালে মুর্শিদাবাদের কাশিমবাজারে বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মিলনের প্রথম অধিবেশনে অক্ষয় কুমার মৈত্রেয় বাংলাদেশের কেন্দ্রস্থলে প্রাচীন পুঁথি, উপকথা, কিংবদন্তি, পুরাকীর্তি ইত্যাদি সংগ্রহ, সংকলন ও সংরক্ষণের জন্য একটি ‘স্বারস্বত ভবন’ প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব রাখেন। ১৯০৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বগুড়ায় উত্তরবঙ্গ সাহিত্য সম্মিলনের দ্বিতীয় অধিবেশনে রাজেন্দ্র লাল আচার্য্যের বেশ কিছু ঐতিহাসিক ও প্রত্ন নির্দশন উপস্থাপনের সংবাদে অক্ষয় কুমার বগুড়া আসেন। উত্তরবঙ্গ বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মিলনে এসব সংগৃহীত প্রত্ন নিদর্শন সংরক্ষণের জন্য একটি জাদুঘর প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব গৃহীত হয়।
১৯১০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ভাগলপুরে বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মিলন অধিবেশনে রাজশাহী থেকে অক্ষয় কুমার, শরৎ কুমার এবং রমা প্রসাদ যোগ দেন। ওই এলাকার প্রত্ন নিদর্শন দেখে জাদুঘর প্রতিষ্ঠায় তাদের আগ্রহ আরও বৃদ্ধি পায়। ১৯১০ সালের এপ্রিল মাসে তাঁরা বরেন্দ্র এলাকায় পুরাকীর্তি সংগ্রহ শুরু করেন। ১৯১০ সালের জুন মাসে প্রত্ন নিদর্শন সংগ্রহের জন্য তাঁরা দ্বিতীয় দফায় সফর করেন। ওই সফরে আরও যোগ দেন রাজেন্দ্র লাল আচার্য্য ও শ্রীরাম মৈত্র। এই সফরকালে নিজেদের সংগঠিত করার জন্য একটি সমিতি গঠনের প্রস্তাব উত্থাপিত হয়। একই বছরের সেপ্টেম্বর মাসে রাজশাহীতে আনুষ্ঠানিকভাবে বরেন্দ্র অনুসন্ধান সমিতি (Varindra Research Society) প্রতিষ্ঠা লাভ করে। কুমার শরৎ কুমার রায়, অক্ষয় কুমার মৈত্রেয় এবং রমা প্রসাদ চন্দ যথাক্রমে সভাপতি, পরিচালক এবং সম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত হন।
প্রথম সফরে সংগৃহীত প্রত্ন নিদর্শনগুলো শরৎ কুমারের বড় ভাই প্রমদানাথ রায়ের রাজশাহীর বাড়ির (সাবেক বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়) উঠানে প্রদর্শনের জন্য রাখা হয়। সংগ্রহের সংখ্যা বাড়তে থাকলে উঠানে স্থান সংকুলান না হওয়ায় ১৯১০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে রাজশাহী পাবলিক লাইব্রেরির নিচতলার দুটি ঘরে সেগুলো স্থানান্তর করা হয়। এখানে এটি একটি প্রত্ন সংগ্রহশালা বা জাদুঘরের রূপ নেয়। বরেন্দ্র অনুসন্ধান সমিতি গঠনের পর এই জাদুঘর সমিতির অন্যতম প্রধান অঙ্গ সংগঠনের স্বীকৃতি পায়। ১৯১০ সালের এপ্রিল মাসে প্রমদানাথের উঠানে বরেন্দ্র জাদুঘরের প্রদর্শনী শুরু হলেও সরকারিভাবে ১৯১০ সালের ২৭ সেপ্টেম্বরকে বরেন্দ্র জাদুঘরের প্রতিষ্ঠা দিবস ধরা হয়, কারণ, এ দিন থেকে পাবলিক লাইব্রেরিতে এর আনুষ্ঠানিক যাত্রার শুরু হয়। ১৯১৯ সালের নভেম্বর পর্যন্ত পাবলিক লাইব্রেরিতে বরেন্দ্র অনুসন্ধান সমিতির সংগ্রহশালার প্রদর্শন বহাল থাকে। ১৯১৬ সালে প্রকাশিত সরকারি গেজেটে জাদুঘর সম্পর্কে ও মেলি উল্লেখ করেন, ‘রামপুর বোয়ালিয়ার (রাজশাহী শহরের পুরাতন নাম) সবচেয়ে আকর্ষণীয় প্রতিষ্ঠান হলো বরেন্দ্র অনুসন্ধান সমিতির জাদুঘর, যেটি এখন পাবলিক লাইব্রেরিতে স্থাপিত হয়েছে’।
১৯১৯ সালের নভেম্বরে জাদুঘরের নিজস্ব ভবন নির্মাণ হওয়ার পর অনুসন্ধান সমিতির প্রত্ন সংগ্রহ বর্তমান স্থান অর্থাৎ জাদুঘরের নিজস্ব ভবনে স্থানান্তর করা হয়। ভবন নির্মাণের জন্য জমি দান করেন প্রমদানাথ রায়। জাদুঘর নির্মাণে ব্যয় হয় ৬৩ হাজার টাকা, যার পুরোটাই বহন করেন শরৎ কুমার রায় ও বসন্তকুমার রায়। ১৯১৬ সালের ১৩ নভেম্বর জাদুঘরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন বাংলার গভর্নর লর্ড কারমাইকেল এবং ১৯১৯ সালের ২৭ নভেম্বর জাদুঘর উদ্বোধন করেন বাংলার আর এক গভর্নর লর্ড রোনাল্ডস। জাদুঘর তার আয়ুষ্কালে দুবার বড় ধরনের হোঁচট খায়। ১৯১১ সালে কলকাতা জাদুঘর বরেন্দ্র জাদুঘরের দুষ্প্রাপ্য ও অদ্বিতীয় সংগ্রহগুলো দাবি করে বসলে জাদুঘরের অস্তিত্বের সংকট দেখা দেয়। রাজশাহীর তদানীন্তন বিভাগীয় কমিশনারের প্রচেষ্টা এবং গভর্নর লর্ড কারমাইকেলের সহযোগিতায় এ সংকট কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়। ১৯৪৭-পরবর্তী সময়ে জাদুঘর আরেকবার অস্তিত্ব-সংকটের মুখোমুখি হয়। এ সময় জাদুঘরের প্রধান উদ্যোক্তা এবং পরিচালকেরা দেশত্যাগ করলে জাদুঘরটি অভিভাবকশূন্য হয়ে যায়। ১৯৬২ সালে জাদুঘরের তদানীন্তন কিউরেটর এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর এ আর মল্লিকের প্রচেষ্টায় জাদুঘরটি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণে আনা হলে এটি নতুন জীবন লাভ করে।
বরেন্দ্র জাদুঘর দেশের প্রাচীনতম জাদুঘর এবং এখানে আছে বাংলার প্রস্তর নির্মিত ভাস্কর্যের সবচেয়ে বড় মজুদ। বরেন্দ্র জাদুঘর অবিভক্ত বাংলার দ্বিতীয় প্রাচীনতম জাদুঘর, এর আগে ১৮১৪ সালে কলকাতা জাদুঘর প্রতিষ্ঠা লাভ করে আর ঢাকা জাদুঘর প্রতিষ্ঠা লাভ করে ১৯১৩ সালে।
১৯১০ সালের এপ্রিলে প্রমদানাথ রায়ের বাড়ির উঠানে অল্প কিছু প্রত্ন নিদর্শন নিয়ে যে জাদুঘরের যাত্রা শুরু হয়, তা আজ শতবর্ষ পূর্ণ করল। ১০০ বছরে এখানে প্রত্ন নিদর্শন, মুদ্রা, মূর্তি, পাণ্ডুলিপি, পুস্তকের সংগ্রহ শতগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে, প্রকাশিত হয়েছে সমৃদ্ধ প্রকাশনা, গবেষকেরা এ জাদুঘরের সাহায্য নিয়ে গবেষণাকর্ম সমাধা করেছেন। বরেন্দ্র জাদুঘরের প্রতিষ্ঠা পরবর্তীকালে এর অনেক সংগ্রহ কলকাতা এবং ঢাকা জাদুঘরে স্থানান্তর করে ওই সব জাদুঘরকে সমৃদ্ধ করা হয়েছে। এই জাদুঘরে এমন অনেক সংগ্রহ আছে, যা অদ্বিতীয় এবং পৃথিবীর আর কোথাও তা নেই। জাদুঘরের সংগ্রহে তিন হাজার ভাস্কর্য, পাঁচ হাজার মুদ্রা, এক হাজার ৭৩টি টেরাকোটা, ৩২টি শিলালিপি, ২৫০টি ধাতব সামগ্রী, ২০০ অলংকার এবং ৭০০ বিবিধ সামগ্রীসহ প্রায় ১০ হাজার প্রাচীন কালের নিদর্শন আছে। এ ছাড়া পাঁচ হাজার ৩০০ পাণ্ডুলিপি এবং ১৩ হাজার মূল্যবান বই ও পত্রিকা মজুদ আছে। বরেন্দ্র জাদুঘরের প্রায় ১০০-র অধিক প্রকাশনা রয়েছে, যার মধ্যে অনেকগুলোই আন্তর্জাতিক মানের। এগুলোর বেশির ভাগই এখন দুষ্প্রাপ্য হয়ে গেছে।
বাংলাদেশে শতবর্ষী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা খুবই কম, আর এ ধরনের গবেষণা বা শিক্ষাসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান তো হাতে গোনা। পৃথিবীর অন্য কোনো এলাকায় এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের শতবর্ষকে স্মরণীয় করে রাখা হতো, কিন্তু বাংলাদেশের সংস্কৃতি ভিন্ন। বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘরের শতবর্ষ নিয়ে বিশেষ কারও যে খুব একটা চিন্তা আছে তা মনে হচ্ছে না। জাদুঘর কর্তৃপক্ষ শতবর্ষ উদ্যাপনের এখনো কোনো পরিকল্পনা হাতে নেয়নি, তারা তাকিয়ে আছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে আর বিশ্ববিদ্যালয়ে এ বিষয়ে এখনো কোনো আলোচনা হয়নি। হয়তো শেষ মুহূর্তে তড়িঘড়ি করে একটা দায়সারা অনুষ্ঠান হলেও হতে পারে এবং তা কিছু আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে সীমিত থাকবে, যার মধ্যে একাডেমিক ফ্লেভার বা পাণ্ডিত্যের স্বাদ নাও থাকতে পারে। এপ্রিল মাস তো চলেই গেল, তবে শতবর্ষ উদ্যাপনটা সেপ্টেম্বর মাসেও হতে পারে। সে ক্ষেত্রে উদ্যোগটা এখনই শুরু করতে হবে। এ ব্যাপারে কর্তৃপক্ষ উদ্যোগ নিলে পৃষ্ঠপোষক হিসেবে বড় কোন প্রতিষ্ঠানকে পাওয়া দুরূহ হবে না। আশা করছি যে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় তথা বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর তাদের শতবর্ষ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে জাদুঘরকে নতুন করে বিশ্বের কাছে উপস্থাপন করবে এবং একই সঙ্গে তার ঐতিহ্য ও সুনামকে পুনরুদ্ধার করবে।
মুহাম্মদ লু্ৎফুল হক: গবেষক।
lutful55@gmail.com
No comments