ত্রিশক্তির লিবিয়া মিশন by এম আবদুল হাফিজ
মার্কিন ধৃষ্টবৎ মিডিয়া এবং কংগ্রেস ও সিনেটের একই প্রকার সদস্যদের ওবামা প্রশাসনকে প্রদত্ত উপদেশের মর্মার্থ হলো, লিবীয় নেতা গাদ্দাফি ও তার বৃহৎ পরিবারের সদস্যদের হত্যা। সিনেটের আর্মড ফোর্সেস কমিটির সদস্য লিন্ডসে গ্রাহাম সিএনএনকে খোলামেলাই বলেছেন যে, ন্যাটো ও মার্কিন প্রশাসনের কাছে তার পরামর্শ গাদ্দাফিসদৃশ সর্পের মাথা একেবারেই কর্তন।
আরও বলেছেন যে, ত্রিপোলিতে গিয়ে গাদ্দাফির বিশ্বস্ত অনুসারীদের ওপর, তাদের বাসস্থান এবং হেডকোয়ার্টার্সে উপর্যুপরি বোমাবর্ষণই এখন তাদের একমাত্র পদক্ষেপ।
ন্যাটোকে মার্কিন নীতিনির্ধারকদের এমন ভয়ঙ্কর উপদেশ যদি বিবেকের কোনো দংশন ছাড়াই দেওয়া হয়ে থাকে, তাহলে এমন সব শব্দ চয়ন পরিহার করে শুধু 'হত্যা' শব্দটির ব্যবহার গাদ্দাফির সম্ভাব্য হত্যা এত 'ঘৃণ্য' শোনাত না। সিনেটর গ্রাহাম যদি জজ অরওয়েলের ওই লেখাটি পাঠ করে থাকেন যাতে যুদ্ধের ভয়াবহ বিষযগুলোও বর্ণনাশৈলীর বদৌলতে শব্দ চয়নের মধ্য দিয়ে তা বিদ্বেষমুক্ত করা সম্ভব। ন্যাটো ও প্রশাসনের উপদেশদাতার সোজা-সাপ্টাভাবে গাদ্দাফিকে চুপ করিয়ে দেওয়ার কথা বলতে পারতেন। কিন্তু তারা তো এমনভাবে তাদের উপদেশবাণীকে সাজিয়েছেন যাতে তাতে যথেষ্ট প্ররোচনা থাকে।
যখন সিএনএন অ্যাংকর ধরিয়ে দিলেন যে, ১৯৭৩ সালে জাতিসংঘ প্রস্তাব ত্রিপোলির বেসামরিক এলাকার বেলায় প্রযোজ্য নয়, সিনেটরের প্রতিক্ষেপণ ছিল এই যে লক্ষ্য হলো লিবিয়াকে গাদ্দাফিমুক্ত করা। একমাত্র ঔদ্ধত্য ছাড়া সাম্রাজ্যবাদীদের গাদ্দাফির প্রতি এই আক্রোশ কেন। মুসলিম দেশগুলোকে সেটাই বিস্মিত করে_ অবশ্য সে দেশগুলোর শাসককুল এই বিস্ময়ের বলয়ে নেই। যেসব আরব নেতা লিবিয়ার ধ্বংসে মদদ দিয়ে চলেছে, তাদের জন্য কল্যাণকর হবে যদি তারা গাদ্দাফির ভাগ্য বিপর্যয়কে লক্ষ্য করেন।
মরুঝড় প্রবাদ অনুযায়ী 'মায়াময়' বিশ্বাসঘাতী হতে পারে। যখন বালুকা ঝড়ে বালিরাশি স্থানান্তরিত হয় তখন মরুচারীর কাছে তা পিচ্ছিল মনে হয় এবং সে ঐকান্তিকভাবে ভ্রাতৃপ্রতিম একজন মুসলমানকেই সাহায্যের জন্য খোঁজে। দুর্ভাগ্য যে, আলখাল্লা পরিহিত মুসলিম ক্ষমতাসীনরা তখন নিশ্চুপ থাকে। তারা আরও ক'টা বছর তাদের ঐশ্বর্যে ডুবে থাকতে চায়।
লিবিয়ায় যে পরিমাণ নৃশংসতা চলছে তা কোনো খ্রিস্টান ভূখণ্ডে ঘটলে বিশ্ব খ্রিস্টান সম্প্রদায় কুক্কুট ধব নিতে সপ্ত আকাশ উথাল-পাতাল করত। মুসলিম বিশ্বই শুধু গভীর নিষ্ক্রিয়। নিঃসন্দেহে গত দশ বছরের যুদ্ধই ছিল লুণ্ঠনমূলক এবং তা উস্কে দিতে একটি বিশেষ ভূমিকা ছিল মিডিয়ার। দৃষ্টান্তস্বরূপ নিউইয়র্ক টাইমস ও ওয়াশিংটন পোস্টের কলাম লেখক ও প্রতিবেদকরা মার্কিন প্রশাসনকে পরিচালিত করছে যে কীভাবে লিবিয়ার যুদ্ধকে এগিয়ে নিতে হবে। দ্য টাইমসের উপদেশ অনুযায়ী ১০৫ এমএম কামান সজ্জিত এ-১৩০ হারকিউলাস টার্বোগ্রুপ যুদ্ধ বিমানের কথা উঠে এসেছে, যার বিধ্বংসী ক্ষমতা অপরিসীম।
এই বিমানে বাহিত শুধু ১০৫ মিলিমিটার কামানটিই মিনিটে ১০টি গোলা নিক্ষেপ করা ছাড়া একই বিমানে বাহিত ২৫ মিলিমিটার হালকা কামান মিনিটে সাড়ে সাত হাজার রাউন্ড দিয়ে টার্গেটকে আঘাত হানতে পারে। এই বিধ্বংসী বিমানটির নামকরণ করা হয়েছে 'মৃত্যুদূত'। এই বিমান থেকে নিক্ষিপ্ত বিস্ফোরকের টুকরো ১৫০০ মিটার ব্যাসের মধ্যে ছড়িয়ে পড়তে পারে। উল্লেখ্য, এই ধরনের বিমান ইরাক ও আফগানিস্তানে অত্যন্ত কার্যকরী হয়েছে। যে কেউ এর বিস্ফোরকের কার্যকারিতার বলয়ে পড়লে সে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়।
লিবীয় যুদ্ধের মিডিয়া ফ্রন্টে রয়েছে ফক্স নিউজ, দ্য সান, দ্য টাইমস অব লন্ডন, সান ডে টাইমস এবং ওয়ালস্ট্রিট জার্নাল। সর্বোপরি নিউইয়র্ক টাইমস এবং ওয়াশিংটন পোস্ট তো রয়েছেই। আশ্চর্য নয় যে, এই তালিকাভুক্ত প্রথম পাঁচটি মালিক যুক্তরাষ্ট্রের সর্ববৃহৎ মিডিয়া কনগ্গ্নোমারেটস নিউজ করপোরেশনের যার মালিক রুপার্ট মুরডক, যিনি একজন অস্ট্রেলিয়ান ইহুদি এবং বর্তমানে মার্কিন নাগরিক। আরব মুসলিম বিশ্বে লিবিয়া নিয়ে অনেক বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে এই মার্কিন প্রকাশনাগুলো।
যা হোক, পশ্চিমের শক্তিশালী মিডিয়া লিবিয়াকে ঘিরে যে রেটোরিকগুলো ছড়াচ্ছে তাতে মনে হবে, একটি বিশাল মানবিক উদ্যোগে এখন লিবিয়াবাসীদের সুরক্ষা প্রচেষ্টা চলছে। বিশ্ব সম্প্রদায়কে বলা হচ্ছে, গাদ্দাফির বাহিনী তার নিজ দেশবাসীকে নির্দয়ভাবে হত্যা করছে। আরও প্রচার করা হচ্ছে, ব্রিটেন, ফ্রান্স এবং আমেরিকা_ এই তিনটি সাম্রাজ্যবাদী শক্তিই এখন লিবিয়ায় তাদের সেনাদল পাঠিয়ে লিবীয়দের সুরক্ষার ব্যবস্থা করতে যাচ্ছে। যদিও বলা হচ্ছে, তাদের উদ্দেশ্য মানবিক, কিন্তু শক্তিত্রয়ের আসল উদ্দেশ্য সরকার উৎখাত এবং তাদের পছন্দের একটি সরকারের অধিষ্ঠান। লিবিয়ায় সাম্রাজ্যবাদী শক্তিদের দুটি মিশনের মিশ্রণ সত্যিই চমৎকার।
ব্রিগেডিয়ার (অব.) এম আবদুল হাফিজ : সাবেক মহাপরিচালক বিআইআইএসএস ও কলাম লেখক
ন্যাটোকে মার্কিন নীতিনির্ধারকদের এমন ভয়ঙ্কর উপদেশ যদি বিবেকের কোনো দংশন ছাড়াই দেওয়া হয়ে থাকে, তাহলে এমন সব শব্দ চয়ন পরিহার করে শুধু 'হত্যা' শব্দটির ব্যবহার গাদ্দাফির সম্ভাব্য হত্যা এত 'ঘৃণ্য' শোনাত না। সিনেটর গ্রাহাম যদি জজ অরওয়েলের ওই লেখাটি পাঠ করে থাকেন যাতে যুদ্ধের ভয়াবহ বিষযগুলোও বর্ণনাশৈলীর বদৌলতে শব্দ চয়নের মধ্য দিয়ে তা বিদ্বেষমুক্ত করা সম্ভব। ন্যাটো ও প্রশাসনের উপদেশদাতার সোজা-সাপ্টাভাবে গাদ্দাফিকে চুপ করিয়ে দেওয়ার কথা বলতে পারতেন। কিন্তু তারা তো এমনভাবে তাদের উপদেশবাণীকে সাজিয়েছেন যাতে তাতে যথেষ্ট প্ররোচনা থাকে।
যখন সিএনএন অ্যাংকর ধরিয়ে দিলেন যে, ১৯৭৩ সালে জাতিসংঘ প্রস্তাব ত্রিপোলির বেসামরিক এলাকার বেলায় প্রযোজ্য নয়, সিনেটরের প্রতিক্ষেপণ ছিল এই যে লক্ষ্য হলো লিবিয়াকে গাদ্দাফিমুক্ত করা। একমাত্র ঔদ্ধত্য ছাড়া সাম্রাজ্যবাদীদের গাদ্দাফির প্রতি এই আক্রোশ কেন। মুসলিম দেশগুলোকে সেটাই বিস্মিত করে_ অবশ্য সে দেশগুলোর শাসককুল এই বিস্ময়ের বলয়ে নেই। যেসব আরব নেতা লিবিয়ার ধ্বংসে মদদ দিয়ে চলেছে, তাদের জন্য কল্যাণকর হবে যদি তারা গাদ্দাফির ভাগ্য বিপর্যয়কে লক্ষ্য করেন।
মরুঝড় প্রবাদ অনুযায়ী 'মায়াময়' বিশ্বাসঘাতী হতে পারে। যখন বালুকা ঝড়ে বালিরাশি স্থানান্তরিত হয় তখন মরুচারীর কাছে তা পিচ্ছিল মনে হয় এবং সে ঐকান্তিকভাবে ভ্রাতৃপ্রতিম একজন মুসলমানকেই সাহায্যের জন্য খোঁজে। দুর্ভাগ্য যে, আলখাল্লা পরিহিত মুসলিম ক্ষমতাসীনরা তখন নিশ্চুপ থাকে। তারা আরও ক'টা বছর তাদের ঐশ্বর্যে ডুবে থাকতে চায়।
লিবিয়ায় যে পরিমাণ নৃশংসতা চলছে তা কোনো খ্রিস্টান ভূখণ্ডে ঘটলে বিশ্ব খ্রিস্টান সম্প্রদায় কুক্কুট ধব নিতে সপ্ত আকাশ উথাল-পাতাল করত। মুসলিম বিশ্বই শুধু গভীর নিষ্ক্রিয়। নিঃসন্দেহে গত দশ বছরের যুদ্ধই ছিল লুণ্ঠনমূলক এবং তা উস্কে দিতে একটি বিশেষ ভূমিকা ছিল মিডিয়ার। দৃষ্টান্তস্বরূপ নিউইয়র্ক টাইমস ও ওয়াশিংটন পোস্টের কলাম লেখক ও প্রতিবেদকরা মার্কিন প্রশাসনকে পরিচালিত করছে যে কীভাবে লিবিয়ার যুদ্ধকে এগিয়ে নিতে হবে। দ্য টাইমসের উপদেশ অনুযায়ী ১০৫ এমএম কামান সজ্জিত এ-১৩০ হারকিউলাস টার্বোগ্রুপ যুদ্ধ বিমানের কথা উঠে এসেছে, যার বিধ্বংসী ক্ষমতা অপরিসীম।
এই বিমানে বাহিত শুধু ১০৫ মিলিমিটার কামানটিই মিনিটে ১০টি গোলা নিক্ষেপ করা ছাড়া একই বিমানে বাহিত ২৫ মিলিমিটার হালকা কামান মিনিটে সাড়ে সাত হাজার রাউন্ড দিয়ে টার্গেটকে আঘাত হানতে পারে। এই বিধ্বংসী বিমানটির নামকরণ করা হয়েছে 'মৃত্যুদূত'। এই বিমান থেকে নিক্ষিপ্ত বিস্ফোরকের টুকরো ১৫০০ মিটার ব্যাসের মধ্যে ছড়িয়ে পড়তে পারে। উল্লেখ্য, এই ধরনের বিমান ইরাক ও আফগানিস্তানে অত্যন্ত কার্যকরী হয়েছে। যে কেউ এর বিস্ফোরকের কার্যকারিতার বলয়ে পড়লে সে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়।
লিবীয় যুদ্ধের মিডিয়া ফ্রন্টে রয়েছে ফক্স নিউজ, দ্য সান, দ্য টাইমস অব লন্ডন, সান ডে টাইমস এবং ওয়ালস্ট্রিট জার্নাল। সর্বোপরি নিউইয়র্ক টাইমস এবং ওয়াশিংটন পোস্ট তো রয়েছেই। আশ্চর্য নয় যে, এই তালিকাভুক্ত প্রথম পাঁচটি মালিক যুক্তরাষ্ট্রের সর্ববৃহৎ মিডিয়া কনগ্গ্নোমারেটস নিউজ করপোরেশনের যার মালিক রুপার্ট মুরডক, যিনি একজন অস্ট্রেলিয়ান ইহুদি এবং বর্তমানে মার্কিন নাগরিক। আরব মুসলিম বিশ্বে লিবিয়া নিয়ে অনেক বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে এই মার্কিন প্রকাশনাগুলো।
যা হোক, পশ্চিমের শক্তিশালী মিডিয়া লিবিয়াকে ঘিরে যে রেটোরিকগুলো ছড়াচ্ছে তাতে মনে হবে, একটি বিশাল মানবিক উদ্যোগে এখন লিবিয়াবাসীদের সুরক্ষা প্রচেষ্টা চলছে। বিশ্ব সম্প্রদায়কে বলা হচ্ছে, গাদ্দাফির বাহিনী তার নিজ দেশবাসীকে নির্দয়ভাবে হত্যা করছে। আরও প্রচার করা হচ্ছে, ব্রিটেন, ফ্রান্স এবং আমেরিকা_ এই তিনটি সাম্রাজ্যবাদী শক্তিই এখন লিবিয়ায় তাদের সেনাদল পাঠিয়ে লিবীয়দের সুরক্ষার ব্যবস্থা করতে যাচ্ছে। যদিও বলা হচ্ছে, তাদের উদ্দেশ্য মানবিক, কিন্তু শক্তিত্রয়ের আসল উদ্দেশ্য সরকার উৎখাত এবং তাদের পছন্দের একটি সরকারের অধিষ্ঠান। লিবিয়ায় সাম্রাজ্যবাদী শক্তিদের দুটি মিশনের মিশ্রণ সত্যিই চমৎকার।
ব্রিগেডিয়ার (অব.) এম আবদুল হাফিজ : সাবেক মহাপরিচালক বিআইআইএসএস ও কলাম লেখক
No comments