চারদিক-‘পুকরির পানির ওপর মানুষ ভাসছে’ by আকমল হোসেন
পুকুরপাড়ে দাঁড়িয়ে কথা বলতে বলতে বারবার কেঁপে উঠছিলেন, কেঁদে উঠছিলেন একজন সুবোধ মালাকার। বয়স এখন আশি। গলা দিয়ে কথা বের হতে চায় না। গলা ধরে আসে। দু-একটি কথা বলেই যেন স্মৃতি হাতড়ান। যেন এখনো হিমশীতল মৃত্যুর ছায়া তাঁকে তাড়া করছে।
সুবোধ মালাকার বলেন, ‘দুইজন তিনজন করে বান্দি জুটা লাগায় (বেঁধে যুক্ত করে)। এরপর উষ্টাইয়া পুকরিত ফালায় (লাথি দিয়ে পুকুরে ফেলে)। পানিত ফালানোর পর গুলি করে। গুলি খাইয়া মরতে অয়নি (হয়নি)। পানি খাইয়াই অনেকে মারা যায়।’
সুবোধ মালাকারের সঙ্গেও একজনকে জুটা বাঁধা হয়। সুবোধ মালাকার ও যামিনী মালাকারকে একসঙ্গে বেঁধে পুকুরে ফেলা হয়েছিল। সুবোধ মালাকার বলেন, ‘পুকরিত ফালানোর পর আর কিচ্ছু কইতাম পারি না। ঘটনা সকালের দিকে। হুঁশ অইছে একটা-দেড়টার দিকে। আতকা চাইয়া দেখি পানিত ভাসছি (আচমকা তাকিয়ে দেখি পানিতে ভাসছি)। বান্দ (বাঁধ) একটু ঢিলা আছিল (ছিল)। কোনো রকম হাত দিয়া বান্দ খুলি। এরপর চাইয়া দেখি পুকরির (পুকুরের) পানির ওপর মানুষ ভাসছে। পুকরির পাড়ও (পুকুরের পাড়ে) উঠি দেখি বাবার লাশ (সুবল মালাকার) পড়ি রইছে।’ সুবোধ মালাকার জানান, তখন তাঁর গলা, গাল ও কান থেকে রক্ত ঝরছে। ডান কান কেটে বেরিয়ে গেছে গুলি। তীব্র ব্যথা করছে। চিকিৎসার ব্যবস্থা নেই। কোথায় যাবেন। বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। বউ-বাচ্চারা কোথায় গেছে জানেন না। মুহূর্তেই সাজানো সংসার, শান্ত এক জীবন ছিন্নভিন্ন। পুকুরের পাশে একটি বাড়িতে ওঠেন সুবোধ মালাকার। এরপর তাঁর শ্বশুরবাড়ির লোকজন খবর পেয়ে এসে তাঁকে নিয়ে যান। সেখানে হাতুড়ে চিকিৎসা নিয়ে কিছুদিন পর ভারতে চলে যান। তাঁর সঙ্গের যামিনী মালাকার আর চোখ মেলতে পারেননি।
এভাবেই পুকুরপাড়ের ঘাটে দাঁড়িয়ে মৃত্যুর সঙ্গে সময় কাটানোর বিবরণ দিলেন সুবোধ মালাকার। তিনি জানান, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ছিল। কিন্তু তখনো তাঁরা বাড়ি ছাড়েননি। মাটির মায়া ছেড়ে যাবেন কোথায়! ঘরবাড়ি, খেত, গবাদিপশু—সংসারটা তো কত কিছু দিয়ে জড়ানো। সেদিনও এমন এক বৈশাখ মাস ছিল। তবে অনেক বৈশাখ এলেও স্মৃতি থেকে মুছে যাওয়ার নয় ২৩ বৈশাখ। বারটা ছিল শুক্রবার। এটুকু ভালো করেই মনে আছে। সকালে বৃষ্টি হয়েছে। পথঘাটে কাদা। এ রকম পরিবেশে মৌলভীবাজার জেলার রাজনগর উপজেলার পাঁচগাঁওয়ে পাকিস্তানি সেনারা ঢোকে। তারা বাড়ি বাড়ি ঢুকে লোকজনকে আটক করে।
সুবোধ মালাকার বলেন, ‘পাকিস্তানি সৈন্যরা কইলো, শান্তির মিটিং আছে (শান্তি কমিটির সভা)। সরকার বাজারমে চলো (বাড়িসংলগ্ন বাজার)।’ পাঁচগাঁওয়ে তখন মৃত্যু-আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়লেও পরিস্থিতি কতটা নির্মম, নৃশংস, অমানবিক হতে পারে, তা কারোরই অনুমানে ছিল না। শান্তি কমিটির সভার কথা বলে গ্রামের বিভিন্ন বাড়ি থেকে লোকজনকে ধরে ধরে সরকার বাজারের সঙ্গেই হিরণ্ময় দাসের বাড়ির পুকুরপাড়ে নিয়ে আসে। সবাইকে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করায়। তারপর ধরে আনা লোকদের একজনের সঙ্গে আরেকজনকে বাঁধতে থাকে। দুজন, তিনজন করে একসঙ্গে বাঁধে। কারও মাথার সঙ্গে কারও পা, কারও পায়ের সঙ্গে কারও মাথা, হাঁস-মোরগের মতো বেঁধে পাড় থেকে লাথি দিয়ে পুকুরে ফেলে দেয়। সবাইকে পুকুরে ছুড়ে ফেলা শেষ হলে চলে গুলিবর্ষণ। সুবোধ মালাকার জানান, অনেকেই গুলি খাওয়ার আগে পানি খেয়ে মারা গেছেন। কারোই হাত-পা ছোড়ার সুযোগ ছিল না। তিনি জানান, পাকিস্তানি সেনাদের পথ দেখিয়েছিল স্থানীয় কিছু লোক, যাদের অনেকেই এরই মাঝে মারা গেছে। কেউ কেউ এখনো বেঁচে আছে।
সুবোধ মালাকার বলেন, ‘আমার তো বাঁচবার কথা আছিল না। কেমনে যে বাঁচছি, উপরআলাই জানইন।’ তিনি জানিয়েছেন, সেদিন শুধু তাঁদের বাড়ি থেকেই দশজনকে ধরে নিয়েছিল পাকিস্তানি সেনারা। তার মধ্যে তিনিই শুধু বাড়ি ফিরেছেন। তাঁর বাবা সুবল মালাকার, বিমল মালাকার, টোনা বৈষ্ণব, সুকেশ মালাকার, বাদল মালাকার, পুতুল মালাকার, রসো মালাকার, রবি মালাকার ও সুরেন্দ্র মালাকার আর ফিরে আসতে পারেননি। সেদিন পাঁচগাঁওয়ের গণহত্যায় শুধু এ বাড়িরই নয়জন রক্ত দিয়ে ঋণী করেননি লাল-সবুজ পতাকাকে, পাঁচগাঁও গ্রামের ৫৯ জন নিরীহ মানুষ সেদিন জঘন্যতম নির্মমতার বলি হয়েছিলেন। তাঁরা জানতেও পারেননি, কী ছিল তাঁদের অপরাধ! পাকিস্তানি সেনাদের বর্বরতা তাঁদের ছিনিয়ে নিয়েছে জীবন থেকে মৃত্যুর কাছে। নিরীহ মানুষকে হত্যার বীরত্ব (!) নিয়ে পাকিস্তানি সেনারা চলে যাওয়ার পর পুকুরের পানিতে কচুরিপানার মতো ভাসমান জোড়ে-বেজোড়ে মানুষের লাশ গ্রামের ও আশপাশের অনেকে ছুটে এসে পুকুর থেকে তুলেছেন। পুকুরের পাশেই স্তূপ করে মাটিচাপা দিয়েছেন। সেই গণকবরটি চারটি দেয়ালে ঘেরা আছে। কিন্তু এতটা মানুষের জীবনদানের কোনো স্মারক এখনো সেই গণকবরে চোখে পড়ে না।
সুবোধ মালাকার ঘটনার পর চল্লিশ বছর ধরে একজন নীরব দর্শকের মতো দেখে চলছেন এই দেশটিকে। শুধু পুনর্জন্মের বিস্ময়-কাতরতা চোখেমুখে। কেন যুদ্ধ, কেন মৃত্যু—এ নিয়ে কিছু বলতে গেলেই তাঁর শুধু কান্না পায়। কোনো ক্ষোভ, আকাঙ্ক্ষা কিছুই নেই তাঁর।
সুবোধ মালাকারের সঙ্গেও একজনকে জুটা বাঁধা হয়। সুবোধ মালাকার ও যামিনী মালাকারকে একসঙ্গে বেঁধে পুকুরে ফেলা হয়েছিল। সুবোধ মালাকার বলেন, ‘পুকরিত ফালানোর পর আর কিচ্ছু কইতাম পারি না। ঘটনা সকালের দিকে। হুঁশ অইছে একটা-দেড়টার দিকে। আতকা চাইয়া দেখি পানিত ভাসছি (আচমকা তাকিয়ে দেখি পানিতে ভাসছি)। বান্দ (বাঁধ) একটু ঢিলা আছিল (ছিল)। কোনো রকম হাত দিয়া বান্দ খুলি। এরপর চাইয়া দেখি পুকরির (পুকুরের) পানির ওপর মানুষ ভাসছে। পুকরির পাড়ও (পুকুরের পাড়ে) উঠি দেখি বাবার লাশ (সুবল মালাকার) পড়ি রইছে।’ সুবোধ মালাকার জানান, তখন তাঁর গলা, গাল ও কান থেকে রক্ত ঝরছে। ডান কান কেটে বেরিয়ে গেছে গুলি। তীব্র ব্যথা করছে। চিকিৎসার ব্যবস্থা নেই। কোথায় যাবেন। বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। বউ-বাচ্চারা কোথায় গেছে জানেন না। মুহূর্তেই সাজানো সংসার, শান্ত এক জীবন ছিন্নভিন্ন। পুকুরের পাশে একটি বাড়িতে ওঠেন সুবোধ মালাকার। এরপর তাঁর শ্বশুরবাড়ির লোকজন খবর পেয়ে এসে তাঁকে নিয়ে যান। সেখানে হাতুড়ে চিকিৎসা নিয়ে কিছুদিন পর ভারতে চলে যান। তাঁর সঙ্গের যামিনী মালাকার আর চোখ মেলতে পারেননি।
এভাবেই পুকুরপাড়ের ঘাটে দাঁড়িয়ে মৃত্যুর সঙ্গে সময় কাটানোর বিবরণ দিলেন সুবোধ মালাকার। তিনি জানান, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ছিল। কিন্তু তখনো তাঁরা বাড়ি ছাড়েননি। মাটির মায়া ছেড়ে যাবেন কোথায়! ঘরবাড়ি, খেত, গবাদিপশু—সংসারটা তো কত কিছু দিয়ে জড়ানো। সেদিনও এমন এক বৈশাখ মাস ছিল। তবে অনেক বৈশাখ এলেও স্মৃতি থেকে মুছে যাওয়ার নয় ২৩ বৈশাখ। বারটা ছিল শুক্রবার। এটুকু ভালো করেই মনে আছে। সকালে বৃষ্টি হয়েছে। পথঘাটে কাদা। এ রকম পরিবেশে মৌলভীবাজার জেলার রাজনগর উপজেলার পাঁচগাঁওয়ে পাকিস্তানি সেনারা ঢোকে। তারা বাড়ি বাড়ি ঢুকে লোকজনকে আটক করে।
সুবোধ মালাকার বলেন, ‘পাকিস্তানি সৈন্যরা কইলো, শান্তির মিটিং আছে (শান্তি কমিটির সভা)। সরকার বাজারমে চলো (বাড়িসংলগ্ন বাজার)।’ পাঁচগাঁওয়ে তখন মৃত্যু-আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়লেও পরিস্থিতি কতটা নির্মম, নৃশংস, অমানবিক হতে পারে, তা কারোরই অনুমানে ছিল না। শান্তি কমিটির সভার কথা বলে গ্রামের বিভিন্ন বাড়ি থেকে লোকজনকে ধরে ধরে সরকার বাজারের সঙ্গেই হিরণ্ময় দাসের বাড়ির পুকুরপাড়ে নিয়ে আসে। সবাইকে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করায়। তারপর ধরে আনা লোকদের একজনের সঙ্গে আরেকজনকে বাঁধতে থাকে। দুজন, তিনজন করে একসঙ্গে বাঁধে। কারও মাথার সঙ্গে কারও পা, কারও পায়ের সঙ্গে কারও মাথা, হাঁস-মোরগের মতো বেঁধে পাড় থেকে লাথি দিয়ে পুকুরে ফেলে দেয়। সবাইকে পুকুরে ছুড়ে ফেলা শেষ হলে চলে গুলিবর্ষণ। সুবোধ মালাকার জানান, অনেকেই গুলি খাওয়ার আগে পানি খেয়ে মারা গেছেন। কারোই হাত-পা ছোড়ার সুযোগ ছিল না। তিনি জানান, পাকিস্তানি সেনাদের পথ দেখিয়েছিল স্থানীয় কিছু লোক, যাদের অনেকেই এরই মাঝে মারা গেছে। কেউ কেউ এখনো বেঁচে আছে।
সুবোধ মালাকার বলেন, ‘আমার তো বাঁচবার কথা আছিল না। কেমনে যে বাঁচছি, উপরআলাই জানইন।’ তিনি জানিয়েছেন, সেদিন শুধু তাঁদের বাড়ি থেকেই দশজনকে ধরে নিয়েছিল পাকিস্তানি সেনারা। তার মধ্যে তিনিই শুধু বাড়ি ফিরেছেন। তাঁর বাবা সুবল মালাকার, বিমল মালাকার, টোনা বৈষ্ণব, সুকেশ মালাকার, বাদল মালাকার, পুতুল মালাকার, রসো মালাকার, রবি মালাকার ও সুরেন্দ্র মালাকার আর ফিরে আসতে পারেননি। সেদিন পাঁচগাঁওয়ের গণহত্যায় শুধু এ বাড়িরই নয়জন রক্ত দিয়ে ঋণী করেননি লাল-সবুজ পতাকাকে, পাঁচগাঁও গ্রামের ৫৯ জন নিরীহ মানুষ সেদিন জঘন্যতম নির্মমতার বলি হয়েছিলেন। তাঁরা জানতেও পারেননি, কী ছিল তাঁদের অপরাধ! পাকিস্তানি সেনাদের বর্বরতা তাঁদের ছিনিয়ে নিয়েছে জীবন থেকে মৃত্যুর কাছে। নিরীহ মানুষকে হত্যার বীরত্ব (!) নিয়ে পাকিস্তানি সেনারা চলে যাওয়ার পর পুকুরের পানিতে কচুরিপানার মতো ভাসমান জোড়ে-বেজোড়ে মানুষের লাশ গ্রামের ও আশপাশের অনেকে ছুটে এসে পুকুর থেকে তুলেছেন। পুকুরের পাশেই স্তূপ করে মাটিচাপা দিয়েছেন। সেই গণকবরটি চারটি দেয়ালে ঘেরা আছে। কিন্তু এতটা মানুষের জীবনদানের কোনো স্মারক এখনো সেই গণকবরে চোখে পড়ে না।
সুবোধ মালাকার ঘটনার পর চল্লিশ বছর ধরে একজন নীরব দর্শকের মতো দেখে চলছেন এই দেশটিকে। শুধু পুনর্জন্মের বিস্ময়-কাতরতা চোখেমুখে। কেন যুদ্ধ, কেন মৃত্যু—এ নিয়ে কিছু বলতে গেলেই তাঁর শুধু কান্না পায়। কোনো ক্ষোভ, আকাঙ্ক্ষা কিছুই নেই তাঁর।
No comments