নগর দর্পণ: চট্টগ্রাম-লালদীঘিতে সুইমিংপুল! by বিশ্বজিৎ চৌধুরী

‘লালদীঘি’ শব্দটি উচ্চারণমাত্র এ অঞ্চলের মানুষের মনে যে দৃশ্য ও চিত্রকল্প ভেসে ওঠে, তা শুধু একটি জলাশয়মাত্র নয়, তার চেয়ে অনেক বেশি কিছু। লালদীঘি আমাদের ইতিহাসের অংশ, ঐতিহ্যের স্মারক। লালদীঘির পাড়সংলগ্ন ময়দানটি এ দেশের আন্দোলন-সংগ্রামের সূতিকাগার।
দেশের রাজনৈতিক বাঁকবদলের প্রতিটি পর্বে আন্দোলিত হয়েছে লালদীঘি। সোহরাওয়ার্দী-হক-ভাসানী-মুজিবসহ দেশের সব বরেণ্য নেতার তেজোদীপ্ত ভাষণ ও আন্দোলন-সংগ্রামের দিকনির্দেশনা শুনতে এখানে দলে দলে সমবেত হয়েছে চট্টগ্রামবাসী, হাজারো মানুষের স্লোগানে-মিছিলে প্রকম্পিত হয়েছে লালদীঘির ময়দান।
স্বাধীন বাংলাদেশের এমন কোনো রাষ্ট্রপ্রধান বা বিরোধীদলীয় নেতা নেই, যিনি দেশ ও দলের ক্রান্তিলগ্নে লালদীঘির ময়দানে এসে দাঁড়াননি।
এই লালদীঘির ঐতিহাসিক মর্যাদা উপলব্ধি করার জন্য, জীবিত রাজনীতিকদের মধ্যে বর্তমান সিটি মেয়র এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর মতো যোগ্য ব্যক্তি এই মুহূর্তে খুব কমই আছেন। কেননা, যে দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে চড়াই-উতরাই পেরিয়ে তিনি আজ নগরপিতার আসনে অধিষ্ঠিত, সেখানে লালদীঘি ও দীঘির পাড়ের ময়দানটির ভূমিকা বিশাল। এখানেই মঞ্চে দাঁড়িয়ে তিনি তাঁর কর্মসূচির কথা জানিয়েছেন নগরবাসীকে। চট্টগ্রামের বঞ্চনার কথা বলেছেন, প্রতিবাদ-বিক্ষোভ-আন্দোলনের পথে উদ্দীপ্ত করেছেন মানুষকে।
কিন্তু সম্প্রতি লালদীঘির একাংশ ভরাট করে সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে সুইমিংপুল তৈরির পরিকল্পনার কথা জেনে যারপরনাই বিস্মিত হয়েছি আমরা। এই উদ্যোগ কোনো ভুঁইফোড় রাজনীতিক বা ইতিহাস-ভূগোল জ্ঞানবর্জিত কোনো প্রশাসনিক কর্মকর্তার হলে বিস্ময়ের কিছু থাকত না। কিন্তু তৃণমূল পর্যায় থেকে উঠে আসা রাজনীতিক মহিউদ্দিন চৌধুরী যখন এ ধরনের পরিকল্পনা হাতে নিয়ে এগিয়ে যান, তখন মনে হয় জাতি হিসেবে আমরা বড় দুর্ভাগা। মনে হয়, রাজপথ থেকে নগরভবনের দূরত্ব ক্রমশ বেড়েই চলেছে।
নগর উন্নয়ন বা এর সৌন্দর্যবর্ধন নিয়ে মহিউদ্দিন চৌধুরী বা তাঁর পরামর্শকমণ্ডলীর ধারণার সঙ্গে এখানকার নগর পরিকল্পনাবিদ, পরিবেশবাদী ও সচেতন নাগরিকদের দৃষ্টিভঙ্গির একটা ব্যবধান ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে। এর আগেও আমরা দেখেছি উন্নয়নের নামে এমন সব পদক্ষেপ তিনি নিয়েছেন (যেমন, চাক্তাই রিংরোডের পাশে সারি সারি দোকান নির্মাণ, অপর্ণাচরণ স্কুলের আঙিনায় বিপণিবিতান তৈরি, চরচাক্তাই এলাকায় একটি খেলার মাঠকে আবাসিক প্লট বানিয়ে বিক্রির উদ্যোগ ইত্যাদি), যার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন সচেতন নগরবাসী।
এই নাগরিকদের প্রতিরোধের মুখে এসব প্রকল্প বাদ দিতে বাধ্য হয়েছেন তিনি। সর্বশেষ দুটি প্রকল্পের ব্যাপারে তিনি সুধী সমাজের প্রতিনিধি প্রফেসর জামাল নজরুল ইসলামের মধ্যস্থতায় ফোরাম ফর প্ল্যানড চিটাগাংয়ের সদস্যসহ সচেতন নাগরিকদের সঙ্গে বৈঠক করেন। এ বৈঠকে যুক্তি-পাল্টা যুক্তির পর মেয়র এ দুটি প্রকল্প বাতিলের ঘোষণা দেন এবং চাক্তাই রিংরোড থেকে নির্মীয়মাণ দোকানপাট ভেঙে ফেলে তাঁর প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেন। আমরা মনে করি, এই পশ্চাদপসরণের মধ্যে কোনো অমর্যাদা নেই বরং জনমতের প্রতি শ্রদ্ধা দেখানোর এই মনোভাবকে সাধারণ মানুষ ইতিবাচকই মনে করেছে।
কিন্তু একটি সমস্যার অবসান হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই নতুন একটি সমস্যার সৃষ্টি করা যেন মেয়র বা সিটি করপোরেশনের প্রবণতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ‘বেশি কিছু’ করার প্রবণতাই আসল কাজ থেকে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে তাঁকে, তৈরি করছে নতুন নতুন সমস্যার। সিটি করপোরেশন যেসব মাতৃসদন ও স্বাস্থ্যসেবাকেন্দ্র চালু রেখেছে, তার মান নিয়ে খুব একটা প্রশ্ন নেই। একইভাবে সিটি করপোরেশন পরিচালিত স্কুল-কলেজের মানও বেড়েছে ধারাবাহিকভাবে। এখন দরকার এই অর্জনগুলো ধরে রাখা।
নগরের সব ধরনের কাজই সিটি করপোরেশনের মাধ্যমে হতে হবে এ মানসিকতারও পরিবর্তন হওয়া দরকার। সম্প্রতি স্বাধীনতা পার্কের (বর্তমান সরকারের আমলে জিয়া স্মৃতি কমপ্লেক্সের পরিবর্তিত নাম) ইজারা নিয়েছে সিটি করপোরেশন। আগে এটি পরিচালনা করত এর নির্মাতা প্রতিষ্ঠান কনকর্ড। শোনা যাচ্ছে, কনকর্ডের আরেকটি প্রকল্প ফয়’স লেক অ্যামিউজমেন্ট পার্কটিও নিজেদের আয়ত্তে নিতে চায় সিটি করপোরেশন। কিন্তু কনকর্ডের সঙ্গে সরকারের দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি থাকায় তা সম্ভব হচ্ছে না। নিয়মের আওতায় সম্ভব হচ্ছে না বলে কিছু উচ্ছৃঙ্খল কর্মী-সমর্থককে দিয়ে পার্কটির কার্যক্রম ব্যাহত করা হচ্ছে, এমন অভিযোগ উঠেছে। যদি অভিযোগ সত্য হয়, তাহলে এর চেয়ে নিন্দনীয় আর কিছু হতেই পারে না। বেসরকারি উদ্যোক্তাদের ক্ষতিগ্রস্ত করে তার সুযোগ নেবে সিটি করপোরেশন, এটা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। সিটি করপোরেশন যে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান নয়, এ কথা কিছুতেই মনে রাখতে পারছেন না মেয়র।
লালদীঘি প্রসঙ্গে আসি। এর একাংশ ভরাট করে ইতিমধ্যেই সুইমিংপুল তৈরির কাজ শুরু করেছে সিটি করপোরেশন। ১৫-২০ দিন ধরে চলছে পাইলিংয়ের কাজ। প্রকৃতি সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী দেশের যেকোনো মহানগর, বিভাগীয় শহর, জেলা শহর বা পৌর এলাকার যেকোনো ধরনের খেলার মাঠ, উন্মুক্ত স্থান, পুকুর-দিঘি ভরাট করা আইনত অপরাধ। এর জন্য অপরাধীর ১০ লাখ টাকা জরিমানা বা পাঁচ বছর জেল বা উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। এই আইন প্রয়োগ করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে সিটি করপোরেশনকে। কিন্তু দ্বাররক্ষী যদি দুয়ার ভাঙে, ঘর রক্ষা করবে কে?
সুইমিংপুল নির্মাণ বন্ধের দাবি জানিয়ে ইতিমধ্যে সিটি করপোরেশনকে নোটিশ দিয়েছে পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা)। নোটিশে অবিলম্বে সুইমিংপুল নির্মাণকাজ বন্ধ করে দিঘির ভরাট করা অংশ আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নেওয়ার দাবি জানানো হয়।
এ বিষয়ে মেয়রের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তাঁর হয়ে ওয়ার্ড কাউন্সিলর জহরলাল হাজারী বলেছেন, ‘সিটি করপোরেশন নালা-নর্দমা তৈরি করতে পারলে, চট্টগ্রামের উন্নয়নে সুইমিংপুল করতে পারবে না কেন?’
কেউ কিন্তু বলছেন না করপোরেশন সুইমিংপুল নির্মাণ করতে পারবে না, বলা হচ্ছে লালদীঘির একাংশ ভরাট করে ব্যাপারটি করা সংগত নয়। একদিকে শাহ আমানত মাজার, অন্যদিকে ঐতিহাসিক লালদীঘির ময়দান, দিঘির পাড়ে মসজিদ; মুসল্লি ও প্রাতর্ভ্রমণ-সান্ধ্য ভ্রমণকারীদের ভিড়ে মুখর লালদীঘির পাড়। সব মিলিয়ে পরিবেশটি একটি সুইমিংপুলের উপযোগী কি না ভেবে দেখতে হবে। নগরে সুইমিংপুল করার মতো জায়গার অভাব রয়েছে? নগর পরিকল্পনাবিদেরা বলছেন, পাঁচলাইশ এলাকায় জাতিসংঘ পার্কের মাঝখানে শানবাঁধানো ঘাটের পুলটিই তো চমৎকার একটি সুইমিং ুল হতে পারে।
কোথায় কী করতে হবে এই ঔচিত্যবোধের অভাব থাকলে কোনো উন্নয়নই জনকল্যাণে আসে না। মনে রাখতে হবে, যমুনার তীরে বলেই তাজমহল, আর সমুদ্রের ধারে বলেই স্ট্যাচু অব লিবার্টি এত সৌন্দর্যমণ্ডিত।
বিশ্বজিৎ চৌধুরী: কবি, লেখক ও সাংবাদিক।
bishwa_chy@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.