শ্রদ্ধাঞ্জলি-সফিউদ্দীন আহমেদ: শুদ্ধতম শিল্পী by সৈয়দ আজিজুল হক

দীর্ঘ ও সুঠামদেহী, ঋজু ও বলিষ্ঠ স্বাস্থ্যের অধিকারী ছিলেন তিনি। তার ওপর গৌরবর্ণের এই মানুষটিকে দেখলে এমনিতেই শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসত। তারপর শিল্প নিয়ে তাঁর সাধনার পরিচয় পেলে এই শ্রদ্ধা বাড়তে বাড়তে চূড়ায় পৌঁছে যেত। বাংলাদেশের চিত্রকলার জগৎকে তিনি অশেষ আলোয় আলোকিত করে গেছেন।


বিনয় ছিল তাঁর সহজাত। দেখা হলে প্রশ্ন করতেন, ‘আমি কি তেমন কিছু আঁকতে পেরেছি? যা এঁকেছি, তা কি শিল্প হয়েছে?’—এসব প্রশ্ন আমাদের লজ্জায় ফেলে দিত।
আমরা বলছি শিল্পগুরু সফিউদ্দীন আহমেদের কথা। নব্বই বছর পূর্ণ হতে যাঁর বাকি ছিল এক মাস তিন দিন। তিনি চলে গেলেন ১৯ মে মধ্যরাত পার করে। এভাবেই ১৯২২ সালের ২২ জুন মধ্যরাত পার করেই তিনি পৃথিবীতে এসেছিলেন। ফলে তাঁর জন্মদিন পালিত হয় ২৩ জুন। একইভাবে তাঁর মৃত্যুদিনও হয়তো পালিত হবে ২০ মে।
শিল্পগুরু বিশেষণটির মতো আরেকটি অভিধাও তাঁর ক্ষেত্রে যথার্থ বলে মনে হয়। সেটি হলো: শুদ্ধতম শিল্পী। আধুনিক শিল্পের ক্ষেত্রে শুদ্ধতার বা নিখুঁততার বিষয়টিকে যদিও গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচনা করা হয় না। কিন্তু সফিউদ্দীন আহমেদ তাঁর সৃষ্টিশীলতার শেষ দিন পর্যন্ত শুদ্ধতার চর্চা করে গেছেন। নিখুঁততার দিকেই ছিল তাঁর ঝোঁক। একটি শিল্পকর্মকে কতটা নিখুঁত করে তোলা যায়, সে ব্যাপারে তিনি ছিলেন একাগ্রভাবে মনোযোগী, শ্রমশীল ও আপসহীন। ফলে ছবি আঁকার কাজটি তাঁর কাছে কখনোই তাড়াহুড়া কিংবা দ্রুততার বিষয় ছিল না। ছিল সময়সাপেক্ষ, দীর্ঘ অভিনিবেশের এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষার।
তাঁর এই বিশুদ্ধতার চর্চার সঙ্গে ব্যক্তিজীবনের পরিচ্ছন্নতার বৈশিষ্ট্যটিও হয়তো জড়িত। বলতেন, ‘পোশাক-পরিচ্ছদ থেকে শুরু করে পরিচ্ছন্ন জীবন যাপনের আগ্রহ আমার গড়ে উঠেছে বাবা-মাকে দেখে।’ তাঁর বাবা-মা দুজনেই জীবন যাপনে অতিশয় পরিচ্ছন্ন ছিলেন। এগুলো হয়তো নাগরিক মানসিকতারও ফল। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত নগরেই তাঁর বসবাস। প্রথমে কলকাতা, তারপর ঢাকা। গ্রামীণ প্রকৃতির যে চিত্র তাঁর ছবিতে আছে, তা নগর থেকে গ্রামে গিয়েই তিনি দেখেছেন। যদিও তাতে নেই কোনো বিচ্ছিন্নতার বোধ বা আরোপিত ভাব। কেননা, তিনি একাত্ম হয়ে পড়েছিলেন সমগ্র দেশের আত্মার সঙ্গে।
কীভাবে গড়ে উঠল তাঁর এমন দৃঢ়তা? তিনি বলেন, ‘বাল্যকাল থেকেই একধরনের যুদ্ধ করতে হয়েছে জীবনের সঙ্গে।’ প্রথম যুদ্ধ শুরু হলো মাত্র ছয় বছর বয়সে বাবাকে হারিয়ে। কৈশোরেই বাড়ির অংশ নিয়ে চাচাদের সঙ্গে দ্বন্দ্ব, আর্ট স্কুলে পড়া নিয়ে আত্মীয়স্বজনের মধ্যকার অবজ্ঞাপূর্ণ মনোভাবের বিরুদ্ধে সংগ্রাম, সর্বোপরি নিজেকে শিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে বিরামহীন যুদ্ধ—এ সবই হয়তো তাঁর মানসিক দৃঢ়তার কারণ।
‘শিল্পের চর্চা একপ্রকার জীবনযুদ্ধেরই নামান্তর’—এ কথা বলতেন তিনি। ফলে এই শিল্পযোদ্ধার নীতিবোধও ছিল অসাধারণভাবে প্রখর। সেখানে শৈথিল্য বা নমনীয়তার কোনো স্পর্শ ছিল না। তাঁর এই শাণিত নীতিচেতনা শিল্প ও জীবন—উভয় ক্ষেত্রেই ছিল সমানভাবে সক্রিয়। ফলে শিল্পচর্চা তাঁর কাছে হয়ে উঠেছিল সাধনার নামান্তর। তা সাধারণ জীবন-জীবিকার উপায় বলে গণ্য হয়নি কখনো। প্রকৃতই এ ছিল সুন্দরের সাধনা, যা সাধারণ বৈষয়িক প্রয়োজনের অতিরিক্ত কিছু। এভাবেই তিনি হয়ে উঠেছিলেন যথার্থই শিল্পের সাধক। তাই বলে ‘শিল্পের জন্য শিল্প’—এই তত্ত্বেও বিশ্বাসী ছিলেন না তিনি। নিজ শিল্পে তিনি স্থান দেননি বিষয়বিমুখতাকে। তাঁর শিল্পের বিষয় আহরণে বরাবরই ছিল দেশের মানুষ আর প্রকৃতির প্রাধান্য। ফলে তাঁর শিল্পের জমিনে দেশের আত্মার সংগীতই সব সময় মর্মরিত হয়। বাংলাদেশের শিল্পকলার জগতে এ কারণেই তিনি এতটা শ্রদ্ধার আসনে অধিষ্ঠিত হতে পেরেছেন।
একটি অপূর্ণতা তিনি নিয়ে গেলেন। তাঁর একান্ত ইচ্ছার কথা এভাবে ব্যক্ত করতেন: ‘জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ছবি আঁকতে চাই।’ কিন্তু এই ইচ্ছা তাঁর পূরণ হলো না ব্যাধির কারণে। সর্বশেষ ছবিটি এঁকেছেন ২০০৮ সালে। কিন্তু ছয় দশকেরও বেশি সময় ধরে তিনি যে ছবি এঁকেছেন, এটাই বিরাট ঘটনা। তবে আরেকটি আকাঙ্ক্ষার ব্যত্যয় ঘটেনি তাঁর জীবনে। তা হলো, তিনি বলতেন, ‘যেদিন ছবিতে নতুন কিছু দিতে না পারব, সেদিন আঁকা বন্ধ করব, সেদিন আমার শিল্পীজীবনের মৃত্যু ঘটবে।’ আমাদের সৌভাগ্য, সফিউদ্দীন আহমেদ সব সময়ই তাঁর শিল্পকর্মে নতুন কিছু যোগ করেছেন। নিজের ব্যর্থতার, অর্থাৎ পুনরাবৃত্তিদোষের উপলব্ধির জন্য তাঁকে শিল্পচর্চা থেকে বিরত থাকতে হয়নি। আরেকটি পূর্ণতা বা সার্থকতার উপলব্ধি নিয়েও তিনি গেলেন। শিল্পকলার বই প্রকাশে আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাত প্রতিষ্ঠান ইতালির স্কিরা থেকে তাঁর সমগ্র কাজের ওপর একটি বই বের হয়েছে গত ফেব্রুয়ারিতে। এটি তিনি দেখে যেতে পেরেছেন।
তাঁর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে একটি কালের অবসান ঘটল। বাংলাদেশে শিল্পকলা চর্চার যাঁরা পথিকৃৎ, তাঁদের সর্বশেষ প্রতিনিধি ছিলেন তিনি। তাঁর স্বতন্ত্র জীবনদৃষ্টির কারণেই তাঁর মৃত্যুতে যে বিরাট শূন্যতা সৃষ্টি হলো, তা দীর্ঘ দীর্ঘকাল অনুভূত হবে। তাঁর জীবন থেকে, তাঁর শিল্পচর্চা থেকে আমাদের আনেক কিছু শেখার আছে। তাঁর আঁকা শিল্পকর্ম বিপুল গবেষণার দাবি রাখে।

No comments

Powered by Blogger.