মত দ্বিমত-মুক্তির অপেক্ষায় জাহাঙ্গীরনগর by নাসিম আখতার হুসাইন
শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য শরীফ এনামুল কবির পদত্যাগ করেছেন। সরকারের এই পদক্ষেপ বিশ্ববিদ্যালয়ের চলমান সংকট নিরসনে কী ভূমিকা রাখবে, সে সম্পর্কে অভিমত দিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন ও অণুপ্রাণবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এবংজাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন উপাচার্য মো. আনোয়ার হোসেন ও আন্দোলনকারী শিক্ষকনেত্রী নাসিম আখতার হোসাইন।
শিক্ষক সমাজের ব্যানারে আমরা যে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছি, তার উদ্দেশ্য জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ব-বিদ্যালয়কে প্রকৃত উচ্চশিক্ষাকেন্দ্র করার বাধাগুলো অপসারণ করা। আমরা নির্বাচনমুখী কোনো মোর্চা না। সুতরাং কে উপাচার্য হচ্ছেন বা কে উপাচার্য প্যানেলের নির্বাচনে দাঁড়াবেন, সে বিষয়ে আমাদের কোনো আগ্রহ নেই। আমাদের আট দফা দাবির মূল কথা, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্বৈরতন্ত্র হটিয়ে গণতান্ত্রিক প্রশাসন ও সন্ত্রাসমুক্ত ক্যাম্পাস প্রতিষ্ঠা করা। সাবেক উপাচার্য যাবতীয় অন্যায়-অনিয়ম, সন্ত্রাস ও স্বৈরতন্ত্রের হোতা হয়ে উঠেছিলেন। তাঁকে গদিনশীন রেখে ক্যাম্পাসে কোনোভাবেই বিদ্যাচর্চার সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখা সম্ভব ছিল না। এ অবস্থাতেই আমরা উপাচার্য অপসারণের এক দফা দাবিতে আসি। প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ যে তিনি আমাদের কথা শুনেছেন, অথচ শিক্ষা উপদেষ্টা আমাদের সঙ্গে দেখা করতেই রাজি হননি।
এটা একটা শুভসূচনা। সরকার যেহেতু অধ্যাপক আনোয়ার হোসেনকে উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে, সেহেতু আমরা দাবিগুলো নিয়ে তাঁর কাছেই যাব। আমরা বলব: সাবেক উপাচার্যের দুষ্কৃতির তদন্ত করে সেগুলোর বিচার হতে হবে। শিক্ষকদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করতে হবে। জুবায়ের হত্যার বিচার, দলীয় নিয়োগ পুনঃ পর্যালোচনা, সব পক্ষের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পরিবেশ নিশ্চিত, বিশ্ববিদ্যালয়ের বাণিজ্যিকীকরণ বন্ধ এবং প্রকৃতির ওপর আগ্রাসন বন্ধ করতে হবে। সর্বোপরি তিয়াত্তরের অধ্যাদেশ অনুযায়ী গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।
উপাচার্য নিয়োগে সরকারের বিবেচনা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বয়স ৪১ বছর। অনেকে আবেগ প্রকাশ করেছেন যে এখানে কি উপাচার্যের দায়িত্ব গ্রহণের মতো কেউ ছিল না? এভাবে জাবির শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের অপমান করা কেন? যিনি নিয়োগ পেয়েছেন তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা। তিনি সাহসী, জীবনে অন্যায়ের কাছে মাথা নত করেননি। যাঁরা জাবি থেকে উপাচার্য নিয়োগ পেলে উপযুক্ত হতো বলছেন, তাঁরাই কিন্তু আবার নতুন উপাচার্যের প্রশংসাও করছেন। তার মানে ব্যক্তিগতভাবে কেউ তাঁর বিরুদ্ধে নয়।
শুধু নির্বাচন হলেই তো গণতন্ত্র হয় না। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, জবাবদিহি এবং স্বচ্ছতাও জরুরি। সাবেক উপাচার্য স্বেচ্ছাচারী ও অসহনশীল হয়ে উঠেছিল। মধ্যরাতে তিনি দুজন শিক্ষককে বিনা ওয়ারেন্টে বাসা থেকে গ্রেপ্তার করালেন। অযোগ্য ব্যক্তিদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিয়ে অনুগত বাহিনী তৈরি করেছিলেন। টাকার বিনিময়ে নিয়োগ দেওয়ার অভিযোগও রয়েছে। তিনি একটি গ্রুপের সন্ত্রাসী আচরণকে অনুমোদন দিচ্ছিলেন। তারা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের টুঁটি টিপে ধরেছিল। জাকসু লাইব্রেরি বাতিল করা হলো, সাংস্কৃতিক সংগঠনের কার্যালয়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হলো। সন্ত্রাসীদের হাতে জুবায়ের নিহত হয়। তাঁরা ক্যাম্পাসজুড়ে সাংস্কৃতিক কর্মীদের নির্যাতন করেছিল। শিক্ষকেরা কয়েকজনকে না বাঁচালে তাদের পরিণতিও জুবায়েরের মতো হতে পারত। পদ ধরে রাখার জন্য সাবেক উপাচার্য ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করলেন। এমন অবস্থায় তাঁর অপসারণ দাবি করা ছাড়া আর কোনো পথ ছিল না। আমরা প্রথমে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনই করেছিলাম। শুরুর দিকে আমরা শিক্ষা কার্যক্রমও ব্যাহত হতে দিইনি। কেবল চরম সন্ত্রাসের মুখেই আমরা ধর্মঘটে গিয়েছিলাম। আমরা এখনো আন্দোলনের মধ্যেই আছি।
বিশ্ববিদ্যালয়ে জ্ঞানচর্চার জন্য নিবিড় পরিবেশ দরকার। বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বত্র গণতন্ত্র না এলে এবং সন্ত্রাসমুক্ত না হলে সেটা সম্ভব না। তাই জাকসু নির্বাচনও দিতে হবে। সিনেটে শিক্ষার্থীদের তরফে পাঁচজন প্রতিনিধি থাকার কথা। জাকসু প্রতিনিধি ছাড়া তাই উপাচার্য প্যানেল নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না। হলগুলোতেও নির্বাচন দিতে হবে। শিক্ষক নিয়োগের রিভিউ হতেই হবে। বিশ্ববিদ্যালয় অযোগ্য শিক্ষকদের ভার বইতে পারবে না। অন্যদিকে দুষ্ট ক্ষমতাচক্র এখনো ক্ষমতাবান। নতুন উপাচার্যকে এসবের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে হবে।
জাবি একটা জাগ্রত বিশ্ববিদ্যালয়। এখানে অন্যায় করে কেউ পার পায়নি। যে উপাচার্য স্বৈরাচারী আচরণ করবেন না, দলবাজি করবেন না তার পক্ষে এই বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করা সহজ হবে বলে মনে করি। এখানকার প্রকৃতি ও মানুষের নিবিড় সম্পর্ক আমাদের যেমন প্রতিবাদ করতে শেখায়, তেমনি গড়বার প্রেরণাও দেয়। এই সৃষ্টিশীলতা ও প্রতিবাদী শক্তিটাই জাবির সৃষ্টিশীলতা। আমরা পরিবর্তন চাই গড়বার জন্যই। নতুন প্রশাসনের উচিত একে লালন করা। জাবি যেন প্রজন্মকে জ্ঞানগত ও চিন্তাগত দিকনির্দেশনা দেওয়ার সামর্থ্য অর্জন করতে পারে, সে লক্ষ্যে একযোগ কাজ করার পরিবেশ নতুন উপাচার্য তৈরি করবেন, এটাই তাঁর কাছে আমাদের প্রত্যাশা।
রাজনৈতিক চাপের কাছে যদি তিনি নতিস্বীকারে বাধ্য হন, তাহলে অনেকের আশাভঙ্গ হবে। নতুন উপাচার্যের উচিত হবে অতিসত্বর উপাচার্য প্যানেলের নির্বাচন দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের সবাইকে নিয়ে এগিয়ে যাওয়া। সরকার নিয়োগ দিলেই শেষ রক্ষা হয় না। তাকে শেষপর্যন্ত জাবির সমাজকে পাশে পেতে হবে। আশা করি ক্ষমতার অপব্যবহার এবং সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার কুফল বিষয়ে আগের উপাচার্যের কাছ থেকে তিনি শিক্ষা নেবেন।
শিক্ষার্থীদের অনেকেই আবেগে ও ভালোবাসায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়কে জানবিবি নামে ডাকে। জানবিবি মুক্তির অপেক্ষায়।
ড. নাসিম আখতার হুসাইন: অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
এটা একটা শুভসূচনা। সরকার যেহেতু অধ্যাপক আনোয়ার হোসেনকে উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে, সেহেতু আমরা দাবিগুলো নিয়ে তাঁর কাছেই যাব। আমরা বলব: সাবেক উপাচার্যের দুষ্কৃতির তদন্ত করে সেগুলোর বিচার হতে হবে। শিক্ষকদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করতে হবে। জুবায়ের হত্যার বিচার, দলীয় নিয়োগ পুনঃ পর্যালোচনা, সব পক্ষের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পরিবেশ নিশ্চিত, বিশ্ববিদ্যালয়ের বাণিজ্যিকীকরণ বন্ধ এবং প্রকৃতির ওপর আগ্রাসন বন্ধ করতে হবে। সর্বোপরি তিয়াত্তরের অধ্যাদেশ অনুযায়ী গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।
উপাচার্য নিয়োগে সরকারের বিবেচনা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বয়স ৪১ বছর। অনেকে আবেগ প্রকাশ করেছেন যে এখানে কি উপাচার্যের দায়িত্ব গ্রহণের মতো কেউ ছিল না? এভাবে জাবির শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের অপমান করা কেন? যিনি নিয়োগ পেয়েছেন তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা। তিনি সাহসী, জীবনে অন্যায়ের কাছে মাথা নত করেননি। যাঁরা জাবি থেকে উপাচার্য নিয়োগ পেলে উপযুক্ত হতো বলছেন, তাঁরাই কিন্তু আবার নতুন উপাচার্যের প্রশংসাও করছেন। তার মানে ব্যক্তিগতভাবে কেউ তাঁর বিরুদ্ধে নয়।
শুধু নির্বাচন হলেই তো গণতন্ত্র হয় না। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, জবাবদিহি এবং স্বচ্ছতাও জরুরি। সাবেক উপাচার্য স্বেচ্ছাচারী ও অসহনশীল হয়ে উঠেছিল। মধ্যরাতে তিনি দুজন শিক্ষককে বিনা ওয়ারেন্টে বাসা থেকে গ্রেপ্তার করালেন। অযোগ্য ব্যক্তিদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিয়ে অনুগত বাহিনী তৈরি করেছিলেন। টাকার বিনিময়ে নিয়োগ দেওয়ার অভিযোগও রয়েছে। তিনি একটি গ্রুপের সন্ত্রাসী আচরণকে অনুমোদন দিচ্ছিলেন। তারা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের টুঁটি টিপে ধরেছিল। জাকসু লাইব্রেরি বাতিল করা হলো, সাংস্কৃতিক সংগঠনের কার্যালয়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হলো। সন্ত্রাসীদের হাতে জুবায়ের নিহত হয়। তাঁরা ক্যাম্পাসজুড়ে সাংস্কৃতিক কর্মীদের নির্যাতন করেছিল। শিক্ষকেরা কয়েকজনকে না বাঁচালে তাদের পরিণতিও জুবায়েরের মতো হতে পারত। পদ ধরে রাখার জন্য সাবেক উপাচার্য ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করলেন। এমন অবস্থায় তাঁর অপসারণ দাবি করা ছাড়া আর কোনো পথ ছিল না। আমরা প্রথমে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনই করেছিলাম। শুরুর দিকে আমরা শিক্ষা কার্যক্রমও ব্যাহত হতে দিইনি। কেবল চরম সন্ত্রাসের মুখেই আমরা ধর্মঘটে গিয়েছিলাম। আমরা এখনো আন্দোলনের মধ্যেই আছি।
বিশ্ববিদ্যালয়ে জ্ঞানচর্চার জন্য নিবিড় পরিবেশ দরকার। বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বত্র গণতন্ত্র না এলে এবং সন্ত্রাসমুক্ত না হলে সেটা সম্ভব না। তাই জাকসু নির্বাচনও দিতে হবে। সিনেটে শিক্ষার্থীদের তরফে পাঁচজন প্রতিনিধি থাকার কথা। জাকসু প্রতিনিধি ছাড়া তাই উপাচার্য প্যানেল নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না। হলগুলোতেও নির্বাচন দিতে হবে। শিক্ষক নিয়োগের রিভিউ হতেই হবে। বিশ্ববিদ্যালয় অযোগ্য শিক্ষকদের ভার বইতে পারবে না। অন্যদিকে দুষ্ট ক্ষমতাচক্র এখনো ক্ষমতাবান। নতুন উপাচার্যকে এসবের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে হবে।
জাবি একটা জাগ্রত বিশ্ববিদ্যালয়। এখানে অন্যায় করে কেউ পার পায়নি। যে উপাচার্য স্বৈরাচারী আচরণ করবেন না, দলবাজি করবেন না তার পক্ষে এই বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করা সহজ হবে বলে মনে করি। এখানকার প্রকৃতি ও মানুষের নিবিড় সম্পর্ক আমাদের যেমন প্রতিবাদ করতে শেখায়, তেমনি গড়বার প্রেরণাও দেয়। এই সৃষ্টিশীলতা ও প্রতিবাদী শক্তিটাই জাবির সৃষ্টিশীলতা। আমরা পরিবর্তন চাই গড়বার জন্যই। নতুন প্রশাসনের উচিত একে লালন করা। জাবি যেন প্রজন্মকে জ্ঞানগত ও চিন্তাগত দিকনির্দেশনা দেওয়ার সামর্থ্য অর্জন করতে পারে, সে লক্ষ্যে একযোগ কাজ করার পরিবেশ নতুন উপাচার্য তৈরি করবেন, এটাই তাঁর কাছে আমাদের প্রত্যাশা।
রাজনৈতিক চাপের কাছে যদি তিনি নতিস্বীকারে বাধ্য হন, তাহলে অনেকের আশাভঙ্গ হবে। নতুন উপাচার্যের উচিত হবে অতিসত্বর উপাচার্য প্যানেলের নির্বাচন দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের সবাইকে নিয়ে এগিয়ে যাওয়া। সরকার নিয়োগ দিলেই শেষ রক্ষা হয় না। তাকে শেষপর্যন্ত জাবির সমাজকে পাশে পেতে হবে। আশা করি ক্ষমতার অপব্যবহার এবং সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার কুফল বিষয়ে আগের উপাচার্যের কাছ থেকে তিনি শিক্ষা নেবেন।
শিক্ষার্থীদের অনেকেই আবেগে ও ভালোবাসায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়কে জানবিবি নামে ডাকে। জানবিবি মুক্তির অপেক্ষায়।
ড. নাসিম আখতার হুসাইন: অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments