বিশেষ সাক্ষাৎকার : অধ্যাপক মো. ময়েনউদ্দিন খান-বিদ্যা সম্প্রসারণের বদলে সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে
অধ্যাপক মো. ময়েনউদ্দিন খান আশা ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ-এর উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। অধ্যাপক খান তাঁর ৪০ বছরের শিক্ষকতা জীবনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজনেস স্টাডিজ অনুষদের ডিন, অ্যাকাউন্টিং এবং ইনফরমেশন সিস্টেম বিভাগ,
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ারম্যান এবং সাউথ ইস্ট ইউনিভার্সিটির উপ-উপাচার্য ও অত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব বিজনেস স্টাডিজের ডিন ও অধ্যাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি ২০০৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে শিল্প, বিজ্ঞান ও তথ্য প্রযুক্তি এবং পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার মান, পরিবেশ এবং প্রাসঙ্গিক অন্যান্য বিষয় নিয়ে সম্প্রতি কালের কণ্ঠের সঙ্গে কথা বলেছেন। তাঁর সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন মহসীন হাবিব
কালের কণ্ঠ : বাংলাদেশে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস খুব বেশি দিনের নয়। এর মধ্যে অনেক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। এগুলোর বর্তমান অবস্থা কেমন বলে মনে করেন?
ময়েনউদ্দিন খান : বিভিন্ন বয়সের বিশ্ববিদ্যালয় আছে। যেমন ধরুন, কিছু বিশ্ববিদ্যালয় একদম প্রথম থেকেই আছে। সেগুলোর বয়স ১৬-১৭ বছর হয়ে গেছে। যেমন নর্থ সাউথ, দারুল এহসান, ইনডিপেনডেন্ট, ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি - এমন বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় আছে যেগুলো ১৫ বছরের উপরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এর মধ্যে কিছু বিশ্ববিদ্যালয় নিজেদের ক্যাম্পাসেও চলে গেছে। তারা অনেক আগে থেকেই আছে বিধায় তাদের আয়ও হয়েছে। আর আমরা হলাম পরের জেনারেশনের। আমি মনে করি, আমরা থার্ড জেনারেশনের। আর এখন ফোর্থ জেনারেশনের গোটা আটেক ইউনিভার্সিটির অনুমোদন দিয়েছে সরকার। এর মধ্যে দুটো ঢাকা সিটিতে এবং বাকি ছয়টি ঢাকার বাইরে।
কালের কণ্ঠ : একজন ভিসি হিসেবে আপনি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের লেখাপড়ার মান কেমন বলে মনে করছেন?
ময়েনউদ্দিন খান : আমি তো সব বিশ্ববিদ্যালয়ের মানের কথা বলতে পারব না। খুবই মুশকিল। যদি কাউকে দিয়ে গবেষণা করানো হতো, তাহলে বলা যেত। শিক্ষার মান কী কী ক্রাইটেরিয়ায় ঠিক করা হয়, এটা ঠিক করে যদি একটি সার্ভে করা যেত, তাহলে আমি আপনাকে সাচ্ছন্দ্যে উত্তরটা দিতে পারতাম। তবে শোনা কথা, দেখা কথা এবং বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের সঙ্গে মাঝেমধ্যে দেখা হয়, কথা হয়। সে দৃষ্টি থেকে বলতে পারি, কিছু বিশ্ববিদ্যালয় যে খুব ভালো চলছে, তা মনে হয় না। সেটা বিভিন্ন কারণে হতে পারে। এমন হতে পারে যে প্রশাসনে কিছু দুর্বলতা আছে, ব্যবস্থাপনা ভালো যাচ্ছে না। অন্তর্কলহ আছে, দ্বন্দ্ব আছে। আমরা দেখেছি, কিছুদিন আগেও শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে সাবধান করে দেওয়া হয়েছে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে। এ রকম তিন-চারটি রয়েছে। আরেক শ্রেণীর বিশ্ববিদ্যালয় আছে, যাদের সম্পর্কে আমরা শুনি যে সার্টিফিকেট বিক্রি করে থাকে।
কালের কণ্ঠ : আপনারা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন থেকে কী ধরনের সহযোগিতা পাচ্ছেন?
ময়েনউদ্দিন খান : সহযোগিতা বলতে তারা শুধু তদারকই করে। আর কোনো সহযোগিতা আমাদের করে না। যেমন ধরুন, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ওখান থেকে কোনো ধরনের অনুদান পায় না। একটি পয়সাও না। তবে তা দেওয়ার কথাও নয়। এখানে বলাই হয়েছে যে ব্যক্তিগত উদ্যোগে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় হবে। সত্যি কথা বলতে, একেবারে পুরোপুরি প্রাইভেটভাবে বিশ্ববিদ্যালয় হয়েছে, কোনো পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ নয়। বরং তদারকিটাই বেশি। আমাদের সব কিছু তাদের জানাতে হয়। যেমন আমরা কী কোর্স পড়াব সেটার অনুমোদন নিতে হয়। তারা অনুমোদন না দিলে আমরা কোর্স চালাতে পারব না। সেটা অসম্ভব। তাদের রিপোর্ট করতে হয়। সম্প্রতি আরো একটি প্রতিবন্ধকতা আমাদের ওপর এসে পড়েছে। সেটা দেখে আমরা খুব হতভম্ব হয়েছি। সম্প্রতি আমরা দুটো বিষয়ের ওপর অনুমোদন চেয়েছিলাম। তার মধ্যে একটি ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং। এ আবেদন আমরা আগেও করেছিলাম। তখন তারা বলেছিল, আপনারা যেহেতু নিজস্ব জায়গা কেনেননি, সেহেতু এখন দেওয়া যাবে না। এখন যখন জায়গা কিনেছি, তখন বলা হচ্ছে আপনারা যেহেতু নিজস্ব ক্যাম্পাসে যাননি তাই আপাতত দেওয়া যাবে না। তো এটা কি আলাদিনের চেরাগ যে এক দিনে হয়ে যাবে? এটার জন্য তো সময় লাগবে। আমরা মাত্র ২৬ জানুয়ারি রেজিস্ট্রেশন করেছি। আপনি শুনে খুশি হবেন যে আমরা ২৭ কোটি টাকা ব্যয় করে জায়গা কিনেছি। আমাদের বয়স মাত্র পাঁচ বছর। এর মধ্যে আমরা ঋণও নিয়েছি। আমরা কোনো সিকিউরিটি মানিও ভাঙাইনি। আমরা যে পাঁচ কোটি টাকা সিকিউরি রেখেছি, সেটা একেবারে অক্ষত আছে। আমাদের প্রতিষ্ঠানে এ যাবত সাড়ে সাত হাজার ছাত্র ভর্তি হয়েছে। এর মধ্যে প্রায় দুই হাজার ছাত্র পাস করে গেছে।
কালের কণ্ঠ : আপনাদের ফ্যাকাল্টির অবস্থা কী?
ময়েনউদ্দিন খান : আমাদের ফ্যাকাল্টি আছে চারটি আর ডিপার্টমেন্ট আছে ছয়টি। তার মধ্যে সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং ফ্যাকাল্টিও আছে। ফার্মাসি এবং এমপিএস আছে, ওটা মাস্টার্স লেভেলের জন্য। বিজনেস ইংলিশ এবং ল নিয়ে আমরা শুরু করেছিলাম। আমরা ৭৭১ জন শিক্ষার্থী নিয়ে এ বিশ্ববিদ্যালয় শুরু করেছি। এটি একটি রেকর্ড। আজ পর্যন্ত কেউ এটা ভাঙতে পারেনি। আমাদের সম্পর্কে মানুষের একটি আস্থা আছে। এর পেছনে দুটি কারণ আছে। আমি এ বিশ্ববিদ্যালয়ের নেতৃত্ব দিয়েছি। আমি ৪০ বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছি। আমাকে বহু মানুষ চেনে। আমার বই ৩০ বছর যাবত একচ্ছত্রভাবে বাংলাদেশে অ্যাকাউন্টিংয়ের বই হিসেবে ছিল। বিকম, এমকম এবং চার্টার্ড অ্যাকাউনট্যান্সির শিক্ষার্থীরা আমার বই পড়ত। একমাত্র বই ছিল, যা ইংরেজিতে লেখা। দুই ভলিউমে। ফলে আমার বহু ছাত্র এবং সহকর্মীর আমার প্রতি আস্থা ছিল। তারা তাদের সন্তানদের এখানে পাঠিয়েছে। আমরা শুরু করেছি ৭৭১ জন নিয়ে। এখনো কেউ এত দ্রুত বিকাশ লাভ করতে পারেনি। একমাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যাত্রাকালে হাজারখানেক ছাত্র নিয়ে শুরু করেছিল। তাও সেটার অনেক ঐতিহাসিক কারণ ছিল। আর ওটা শুধু একটি বিশ্ববিদ্যালয়ই নয়, একটি জাতীয় প্রতিষ্ঠান।
কালের কণ্ঠ : আপনারা কি আপনাদের বর্তমান কারিকুলাম নিয়ে সন্তুষ্ট?
ময়েনউদ্দিন খান : না। আমরা দুটো সিলেবাস চেয়েছি, সে দুটো রিফিউজ করে দিয়েছে। বলছে, এখন দেওয়া যাবে না। মন্ত্রণালয়ে নাকি একটি মিটিং হয়েছে। মিটিংয়ে বলা হয়েছে, যারা তাদের স্থায়ী ক্যাম্পাসে যায়নি, তাদের এখন সাবজেক্ট খুলতে দেওয়া হবে না।
কালের কণ্ঠ : অর্থাৎ এটি নীতিগত সিদ্ধান্ত?
ময়েনউদ্দিন খান : এটি তারা একটি মিটিং করেছে। কিন্তু আমরা আবেদনটি মিটিংয়ের আগেই দিয়েছি। তার পরও আমাদেরটি বিবেচনা করা হয়নি। এর ফলে আমরা প্রতিষ্ঠান সম্প্রসারণ করতে পারছি না। বিদ্যা সম্প্রসারণের বদলে যেন সঙ্কুচিত হয়ে যাচ্ছে। আর কারিকুলাম যেটা আছে, সে ব্যাপারে বলা হয়েছে, এ ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সিলেবাসে যেটা আছে, তার বাইরে তো প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের যাওয়ার সুযোগ নেই। তাদের যাঁরা এক্সপার্ট আছেন, সেই এক্সপার্টদের মতামতের ভিত্তিতে চূড়ান্তভাবে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালগুলোকে জানিয়ে দেওয়া হয়। প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি সেটা অনুসরণ করে। আর কারিকুলাম এমন একটি জিনিস, যা কখনো স্ট্যাটিক হয় না। এক থাকতে পারে না, এটা সর্বদা পরিবর্তনশীল। সার্বিক পরিবর্তনের সঙ্গে সংগতি রেখেই কারিকুলামে পরিবর্তন আনতে হয়। যদি সব পরিবর্তনের সঙ্গে কারিকুলাম সামঞ্জস্যপূর্ণ না হয় তাহলে আপনাকে আপ টু ডেট বলা যাবে না।
কালের কণ্ঠ : এ ক্ষেত্রে আপনি কি মনে করেন, আন্তর্জাতিক, বিশেষ করে উন্নত বিশ্বের যে কারিকুলাম রয়েছে তার সঙ্গে আমাদের কারিকুলাম সংগতিপূর্ণ?
ময়েনউদ্দিন খান : অবশ্যই আমরা সেটা দেখি। আমরা ওদের দেখেই আমাদেরটা রচনা করি। তবে বড় ধরনের কোনো পরিবর্তন আনতে গেলে আমাদের অনুমতি নিতে হয়। তাতে আমাদের কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু কিছু স্বাধীনতা তো আমাদেরকেও দিতে হবে। শিক্ষার্থীরা যখন দেখবে, আমাদের কারিকুলাম ভালো, তখনই তারা আমাদের কাছে আসবে।
কালের কণ্ঠ : প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন চলে আসে শিক্ষাদানের মান নিয়ে। আপনার বিশ্ববিদ্যালয়ে যে শিক্ষকরা আছেন, তাঁরা আন্তর্জাতিক মানের টিচিং দিতে সক্ষম বলে আপনি মনে করেন?
ময়েনউদ্দিন খান : একটি ভালো প্রশ্ন করেছেন। আমরা একটা বিষয় বুঝি যে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান মূলত দুটি বিষয়ের ওপর নির্ভর করে। একটি হলো ইনপুট ফ্যাক্টর, অর্থাৎ ছাত্রদের মান, এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটিকে আপনি এড়িয়ে যেতে পারবেন না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এত ভালো কেন? সারা দেশের সেরা শিক্ষার্থীরা সেখানে ভর্তি হয়ে থাকে, সুযোগ পায়। আর দ্বিতীয় বিষয়টি হলো, বেতন কাঠামো। আকর্ষণীয় বেতন না দিলে ভালো শিক্ষকও পাবেন না, ভালো টিচিংও দেওয়া যাবে না। আমরা অত্যন্ত আকর্ষণীয় বেতন দিয়ে থাকি। তাই আমরা ভালো শিক্ষক পাচ্ছি। যদিও সরকারি চাকরির কিছু বিশেষ সুবিধা আছে। তা ছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরিও সম্মানজনক। তবে আমরা অনেক সুযোগ-সুবিধা দিয়ে থাকি।
কালের কণ্ঠ : আপনি দীর্ঘ ৪০ বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন। এখন একটি মানসম্পন্ন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থতিতে শিক্ষা, আপনার প্রতিষ্ঠানের কথাই ধরুন, কতটা ব্যাহত হচ্ছে বলে মনে করেন?
ময়েনউদ্দিন খান : আমাদের প্রতিষ্ঠানে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নেই। তবে হরতালের মতো কর্মসূচি তো অবশ্যই ক্ষতি করছে। হরতালের কারণে আমাদের যে পরীক্ষা হয় তা পুষিয়ে দিই বন্ধের দিন পরীক্ষা নিয়ে। আর হ্যাঁ, হরতাল বা রাজনৈতিক অস্থিরতা কিছু প্রভাব তো নানাভাবে ফেলছেই।
কালের কণ্ঠ : বাংলাদেশ একটি দরিদ্র দেশ। এখানে দরিদ্র ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা অনেক বেশি। আপনারা এই শিক্ষার্থীদের জন্য কী ধরনের কনট্রিবিশন রাখছেন?
ময়েনউদ্দিন খান : খুবই ভালো প্রশ্ন। নিয়মিত দরিদ্র শিক্ষার্থী যাতে আসতে পারে, সে কথা মাথায় রেখে আমরা ভর্তির ব্যবস্থা করে থাকি। তবে বিশেষ করে ভর্তির ক্ষেত্রে আমরা জিপিএ ২.৫-এর নিচে নিতে পারি না।
কালের কণ্ঠ : ধন্যবাদ আপনাকে কালের কণ্ঠের পক্ষ থেকে।
ময়েনউদ্দিন খান : আপনাকেও ধন্যবাদ।
কালের কণ্ঠ : বাংলাদেশে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস খুব বেশি দিনের নয়। এর মধ্যে অনেক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। এগুলোর বর্তমান অবস্থা কেমন বলে মনে করেন?
ময়েনউদ্দিন খান : বিভিন্ন বয়সের বিশ্ববিদ্যালয় আছে। যেমন ধরুন, কিছু বিশ্ববিদ্যালয় একদম প্রথম থেকেই আছে। সেগুলোর বয়স ১৬-১৭ বছর হয়ে গেছে। যেমন নর্থ সাউথ, দারুল এহসান, ইনডিপেনডেন্ট, ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি - এমন বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় আছে যেগুলো ১৫ বছরের উপরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এর মধ্যে কিছু বিশ্ববিদ্যালয় নিজেদের ক্যাম্পাসেও চলে গেছে। তারা অনেক আগে থেকেই আছে বিধায় তাদের আয়ও হয়েছে। আর আমরা হলাম পরের জেনারেশনের। আমি মনে করি, আমরা থার্ড জেনারেশনের। আর এখন ফোর্থ জেনারেশনের গোটা আটেক ইউনিভার্সিটির অনুমোদন দিয়েছে সরকার। এর মধ্যে দুটো ঢাকা সিটিতে এবং বাকি ছয়টি ঢাকার বাইরে।
কালের কণ্ঠ : একজন ভিসি হিসেবে আপনি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের লেখাপড়ার মান কেমন বলে মনে করছেন?
ময়েনউদ্দিন খান : আমি তো সব বিশ্ববিদ্যালয়ের মানের কথা বলতে পারব না। খুবই মুশকিল। যদি কাউকে দিয়ে গবেষণা করানো হতো, তাহলে বলা যেত। শিক্ষার মান কী কী ক্রাইটেরিয়ায় ঠিক করা হয়, এটা ঠিক করে যদি একটি সার্ভে করা যেত, তাহলে আমি আপনাকে সাচ্ছন্দ্যে উত্তরটা দিতে পারতাম। তবে শোনা কথা, দেখা কথা এবং বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের সঙ্গে মাঝেমধ্যে দেখা হয়, কথা হয়। সে দৃষ্টি থেকে বলতে পারি, কিছু বিশ্ববিদ্যালয় যে খুব ভালো চলছে, তা মনে হয় না। সেটা বিভিন্ন কারণে হতে পারে। এমন হতে পারে যে প্রশাসনে কিছু দুর্বলতা আছে, ব্যবস্থাপনা ভালো যাচ্ছে না। অন্তর্কলহ আছে, দ্বন্দ্ব আছে। আমরা দেখেছি, কিছুদিন আগেও শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে সাবধান করে দেওয়া হয়েছে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে। এ রকম তিন-চারটি রয়েছে। আরেক শ্রেণীর বিশ্ববিদ্যালয় আছে, যাদের সম্পর্কে আমরা শুনি যে সার্টিফিকেট বিক্রি করে থাকে।
কালের কণ্ঠ : আপনারা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন থেকে কী ধরনের সহযোগিতা পাচ্ছেন?
ময়েনউদ্দিন খান : সহযোগিতা বলতে তারা শুধু তদারকই করে। আর কোনো সহযোগিতা আমাদের করে না। যেমন ধরুন, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ওখান থেকে কোনো ধরনের অনুদান পায় না। একটি পয়সাও না। তবে তা দেওয়ার কথাও নয়। এখানে বলাই হয়েছে যে ব্যক্তিগত উদ্যোগে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় হবে। সত্যি কথা বলতে, একেবারে পুরোপুরি প্রাইভেটভাবে বিশ্ববিদ্যালয় হয়েছে, কোনো পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ নয়। বরং তদারকিটাই বেশি। আমাদের সব কিছু তাদের জানাতে হয়। যেমন আমরা কী কোর্স পড়াব সেটার অনুমোদন নিতে হয়। তারা অনুমোদন না দিলে আমরা কোর্স চালাতে পারব না। সেটা অসম্ভব। তাদের রিপোর্ট করতে হয়। সম্প্রতি আরো একটি প্রতিবন্ধকতা আমাদের ওপর এসে পড়েছে। সেটা দেখে আমরা খুব হতভম্ব হয়েছি। সম্প্রতি আমরা দুটো বিষয়ের ওপর অনুমোদন চেয়েছিলাম। তার মধ্যে একটি ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং। এ আবেদন আমরা আগেও করেছিলাম। তখন তারা বলেছিল, আপনারা যেহেতু নিজস্ব জায়গা কেনেননি, সেহেতু এখন দেওয়া যাবে না। এখন যখন জায়গা কিনেছি, তখন বলা হচ্ছে আপনারা যেহেতু নিজস্ব ক্যাম্পাসে যাননি তাই আপাতত দেওয়া যাবে না। তো এটা কি আলাদিনের চেরাগ যে এক দিনে হয়ে যাবে? এটার জন্য তো সময় লাগবে। আমরা মাত্র ২৬ জানুয়ারি রেজিস্ট্রেশন করেছি। আপনি শুনে খুশি হবেন যে আমরা ২৭ কোটি টাকা ব্যয় করে জায়গা কিনেছি। আমাদের বয়স মাত্র পাঁচ বছর। এর মধ্যে আমরা ঋণও নিয়েছি। আমরা কোনো সিকিউরিটি মানিও ভাঙাইনি। আমরা যে পাঁচ কোটি টাকা সিকিউরি রেখেছি, সেটা একেবারে অক্ষত আছে। আমাদের প্রতিষ্ঠানে এ যাবত সাড়ে সাত হাজার ছাত্র ভর্তি হয়েছে। এর মধ্যে প্রায় দুই হাজার ছাত্র পাস করে গেছে।
কালের কণ্ঠ : আপনাদের ফ্যাকাল্টির অবস্থা কী?
ময়েনউদ্দিন খান : আমাদের ফ্যাকাল্টি আছে চারটি আর ডিপার্টমেন্ট আছে ছয়টি। তার মধ্যে সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং ফ্যাকাল্টিও আছে। ফার্মাসি এবং এমপিএস আছে, ওটা মাস্টার্স লেভেলের জন্য। বিজনেস ইংলিশ এবং ল নিয়ে আমরা শুরু করেছিলাম। আমরা ৭৭১ জন শিক্ষার্থী নিয়ে এ বিশ্ববিদ্যালয় শুরু করেছি। এটি একটি রেকর্ড। আজ পর্যন্ত কেউ এটা ভাঙতে পারেনি। আমাদের সম্পর্কে মানুষের একটি আস্থা আছে। এর পেছনে দুটি কারণ আছে। আমি এ বিশ্ববিদ্যালয়ের নেতৃত্ব দিয়েছি। আমি ৪০ বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছি। আমাকে বহু মানুষ চেনে। আমার বই ৩০ বছর যাবত একচ্ছত্রভাবে বাংলাদেশে অ্যাকাউন্টিংয়ের বই হিসেবে ছিল। বিকম, এমকম এবং চার্টার্ড অ্যাকাউনট্যান্সির শিক্ষার্থীরা আমার বই পড়ত। একমাত্র বই ছিল, যা ইংরেজিতে লেখা। দুই ভলিউমে। ফলে আমার বহু ছাত্র এবং সহকর্মীর আমার প্রতি আস্থা ছিল। তারা তাদের সন্তানদের এখানে পাঠিয়েছে। আমরা শুরু করেছি ৭৭১ জন নিয়ে। এখনো কেউ এত দ্রুত বিকাশ লাভ করতে পারেনি। একমাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যাত্রাকালে হাজারখানেক ছাত্র নিয়ে শুরু করেছিল। তাও সেটার অনেক ঐতিহাসিক কারণ ছিল। আর ওটা শুধু একটি বিশ্ববিদ্যালয়ই নয়, একটি জাতীয় প্রতিষ্ঠান।
কালের কণ্ঠ : আপনারা কি আপনাদের বর্তমান কারিকুলাম নিয়ে সন্তুষ্ট?
ময়েনউদ্দিন খান : না। আমরা দুটো সিলেবাস চেয়েছি, সে দুটো রিফিউজ করে দিয়েছে। বলছে, এখন দেওয়া যাবে না। মন্ত্রণালয়ে নাকি একটি মিটিং হয়েছে। মিটিংয়ে বলা হয়েছে, যারা তাদের স্থায়ী ক্যাম্পাসে যায়নি, তাদের এখন সাবজেক্ট খুলতে দেওয়া হবে না।
কালের কণ্ঠ : অর্থাৎ এটি নীতিগত সিদ্ধান্ত?
ময়েনউদ্দিন খান : এটি তারা একটি মিটিং করেছে। কিন্তু আমরা আবেদনটি মিটিংয়ের আগেই দিয়েছি। তার পরও আমাদেরটি বিবেচনা করা হয়নি। এর ফলে আমরা প্রতিষ্ঠান সম্প্রসারণ করতে পারছি না। বিদ্যা সম্প্রসারণের বদলে যেন সঙ্কুচিত হয়ে যাচ্ছে। আর কারিকুলাম যেটা আছে, সে ব্যাপারে বলা হয়েছে, এ ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সিলেবাসে যেটা আছে, তার বাইরে তো প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের যাওয়ার সুযোগ নেই। তাদের যাঁরা এক্সপার্ট আছেন, সেই এক্সপার্টদের মতামতের ভিত্তিতে চূড়ান্তভাবে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালগুলোকে জানিয়ে দেওয়া হয়। প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি সেটা অনুসরণ করে। আর কারিকুলাম এমন একটি জিনিস, যা কখনো স্ট্যাটিক হয় না। এক থাকতে পারে না, এটা সর্বদা পরিবর্তনশীল। সার্বিক পরিবর্তনের সঙ্গে সংগতি রেখেই কারিকুলামে পরিবর্তন আনতে হয়। যদি সব পরিবর্তনের সঙ্গে কারিকুলাম সামঞ্জস্যপূর্ণ না হয় তাহলে আপনাকে আপ টু ডেট বলা যাবে না।
কালের কণ্ঠ : এ ক্ষেত্রে আপনি কি মনে করেন, আন্তর্জাতিক, বিশেষ করে উন্নত বিশ্বের যে কারিকুলাম রয়েছে তার সঙ্গে আমাদের কারিকুলাম সংগতিপূর্ণ?
ময়েনউদ্দিন খান : অবশ্যই আমরা সেটা দেখি। আমরা ওদের দেখেই আমাদেরটা রচনা করি। তবে বড় ধরনের কোনো পরিবর্তন আনতে গেলে আমাদের অনুমতি নিতে হয়। তাতে আমাদের কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু কিছু স্বাধীনতা তো আমাদেরকেও দিতে হবে। শিক্ষার্থীরা যখন দেখবে, আমাদের কারিকুলাম ভালো, তখনই তারা আমাদের কাছে আসবে।
কালের কণ্ঠ : প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন চলে আসে শিক্ষাদানের মান নিয়ে। আপনার বিশ্ববিদ্যালয়ে যে শিক্ষকরা আছেন, তাঁরা আন্তর্জাতিক মানের টিচিং দিতে সক্ষম বলে আপনি মনে করেন?
ময়েনউদ্দিন খান : একটি ভালো প্রশ্ন করেছেন। আমরা একটা বিষয় বুঝি যে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান মূলত দুটি বিষয়ের ওপর নির্ভর করে। একটি হলো ইনপুট ফ্যাক্টর, অর্থাৎ ছাত্রদের মান, এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটিকে আপনি এড়িয়ে যেতে পারবেন না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এত ভালো কেন? সারা দেশের সেরা শিক্ষার্থীরা সেখানে ভর্তি হয়ে থাকে, সুযোগ পায়। আর দ্বিতীয় বিষয়টি হলো, বেতন কাঠামো। আকর্ষণীয় বেতন না দিলে ভালো শিক্ষকও পাবেন না, ভালো টিচিংও দেওয়া যাবে না। আমরা অত্যন্ত আকর্ষণীয় বেতন দিয়ে থাকি। তাই আমরা ভালো শিক্ষক পাচ্ছি। যদিও সরকারি চাকরির কিছু বিশেষ সুবিধা আছে। তা ছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরিও সম্মানজনক। তবে আমরা অনেক সুযোগ-সুবিধা দিয়ে থাকি।
কালের কণ্ঠ : আপনি দীর্ঘ ৪০ বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন। এখন একটি মানসম্পন্ন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থতিতে শিক্ষা, আপনার প্রতিষ্ঠানের কথাই ধরুন, কতটা ব্যাহত হচ্ছে বলে মনে করেন?
ময়েনউদ্দিন খান : আমাদের প্রতিষ্ঠানে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নেই। তবে হরতালের মতো কর্মসূচি তো অবশ্যই ক্ষতি করছে। হরতালের কারণে আমাদের যে পরীক্ষা হয় তা পুষিয়ে দিই বন্ধের দিন পরীক্ষা নিয়ে। আর হ্যাঁ, হরতাল বা রাজনৈতিক অস্থিরতা কিছু প্রভাব তো নানাভাবে ফেলছেই।
কালের কণ্ঠ : বাংলাদেশ একটি দরিদ্র দেশ। এখানে দরিদ্র ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা অনেক বেশি। আপনারা এই শিক্ষার্থীদের জন্য কী ধরনের কনট্রিবিশন রাখছেন?
ময়েনউদ্দিন খান : খুবই ভালো প্রশ্ন। নিয়মিত দরিদ্র শিক্ষার্থী যাতে আসতে পারে, সে কথা মাথায় রেখে আমরা ভর্তির ব্যবস্থা করে থাকি। তবে বিশেষ করে ভর্তির ক্ষেত্রে আমরা জিপিএ ২.৫-এর নিচে নিতে পারি না।
কালের কণ্ঠ : ধন্যবাদ আপনাকে কালের কণ্ঠের পক্ষ থেকে।
ময়েনউদ্দিন খান : আপনাকেও ধন্যবাদ।
No comments