মত দ্বিমত-পরিবেশ তৈরিই হবে প্রথম কাজ by মো. আনোয়ার হোসেন

শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য শরীফ এনামুল কবির পদত্যাগ করেছেন। সরকারের এই পদক্ষেপ বিশ্ববিদ্যালয়ের চলমান সংকট নিরসনে কী ভূমিকা রাখবে, সে সম্পর্কে অভিমত দিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন ও অণুপ্রাণবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এবংজাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের


নতুন উপাচার্য মো. আনোয়ার হোসেন ও আন্দোলনকারী শিক্ষকনেত্রী নাসিম আখতার হোসাইন।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় দেশের অন্যতম বড় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। দীর্ঘ দিন ধরে এখানে আংশিক অচলাবস্থা বিরাজ করছিল। এর ফলে একপর্যায়ে উপাচার্য পদত্যাগ করলেন এবং আমি দায়িত্ব পেলাম। এই দায়িত্ব আমাকে নিতে হয়েছে এক কঠিন পরিস্থিতিতে। সেদিক থেকে আমার দায়িত্বটাও কঠিনই বৈকি। আমার প্রথম কাজ শিক্ষক-ছাত্রছাত্রীসহ বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের সবার সঙ্গে ব্যাপকভাবে মতবিনিময় করা এবং তাদের অভিমত চাওয়া। সমস্যা সমাধানে সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টাকেই আমি জরুরি মনে করি। এখানে এককভাবে কেউ কিছু করতে পারবে না। আমি বিশ্বাস করি, সবার সঙ্গে আলোচনা করে একটা ঐকমত্যের জায়গায় আমরা পৌঁছাতে পারব। তবে, আমাদের লক্ষ্য রাখতে হবে, যাতে ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষাকার্যক্রম কোনোভাবেই ব্যাহত না হয়। ইতিমধ্যে সেটার অনেক ক্ষতি হয়েছে। আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত এই ক্ষতি দ্রুত কাটিয়ে ওঠা। জুন মাসের প্রথমে ক্লাস শুরু হওয়ার সময় শিক্ষা, গবেষণা ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রম নির্বিঘ্ন করাই আমার প্রধান বিবেচনা হবে।
আমি কোনো কিছুর অংশ না হয়ে সেখানে আমার দায়িত্ব পালন করে যাওয়ার আশা রাখি। উপাচার্য সম্মানজনক পদ, বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় তিনি কারও পক্ষ নেবেন না, সেটা ছাত্রসংগঠন হোক বা শিক্ষকসংগঠন হোক। তিনি থাকবেন সম্পূর্ণ নিরপক্ষে। ইতিমধ্যে বিভিন্ন গণমাধ্যমের কল্যাণে এবং ব্যক্তিগতভাবেও বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেকের সঙ্গে আমার মতবিনিময় হয়েছে। আমি অবগত আছি যে বাইরে থেকে উপাচার্য নিয়োগ দেওয়া নিয়ে জাবির শিক্ষকদের একটি অংশের মধ্যে বেদনার মনোভাব ছিল। এই মনোভাব খুবই সংগত। পাশাপাশি তাদের দিক থেকে আমি অনুপ্রাণিতও হয়েছি। আশা করি, অচিরেই একটা আস্থাপূর্ণ কর্মপরিবেশ সেখানে নিশ্চিত করা যাবে।
আমি সবার দাবিদাওয়া জানি। দাবিগুলোর ব্যাপারে আমার অবস্থান খুবই পরিষ্কার। সমস্যাগুলো বিভিন্নমুখী এবং অনেক পুরোনোও বটে। এসবের সমাধান বের করা এবং তা বাস্তবায়নের পদক্ষেপগুলো আলোচনা করেই ঠিক করে নিতে হবে। সত্যি যে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগে অনিয়ম ও দলতন্ত্র আছে। এসব ব্যাপারে কখন থেকে পদক্ষেপ শুরু করব তা আলোচনা করেই ঠিক করা হবে। তার থেকে গুরুত্বপূর্ণ হলো এখন যেন আর কোনো অনিয়ম না হয়। উপাচার্য প্যানেলের ব্যাপারে ইতিমধ্যে আমি আমার বক্তব্য দিয়েছি। এ ব্যাপারে আমি অনুসরণ করব তিয়াত্তরের অধ্যাদেশ। সেই অধ্যাদেশে সিনেটে নির্বাচিত তিনজনের প্যানেল থেকে মহামান্য রাষ্ট্রপতি একজনকে নিয়োগ দেবেন, এমন বিধান রয়েছে। আমি এ কথা স্পষ্ট করে বলে দিচ্ছি, যত শিগগিরই সম্ভব সিনেট থেকে উপাচার্য প্যানেল নির্বাচিত করা হবে। এ ব্যাপারে আমার দিক থেকে গড়িমসি করার কোনো অভিপ্রায় নেই। আমি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেছি। কোনো রাজনৈতিক চাপের কাছে নতিস্বীকার করার মানুষ আমি নই। একজন উপাচার্য যদি কর্মপরিধি ও বিধান মেনে চলেন, তাহলে বিভিন্ন পক্ষের চাপ আর আর গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে সামনে আসার কথা নয়।
জাকসু নির্বাচন তথা ছাত্র সংসদ নির্বাচনের বিষয়টিও তিয়াত্তরের অধ্যাদেশে রয়েছে। অধ্যাদেশে শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকে পাঁচজন প্রতিনিধি রাখার সুযোগ আছে। কিন্তু গত ২০ বছরে সেটা করা হয়নি, তাই বর্তমানে সিনেটে কোনো ছাত্র প্রতিনিধি নেই। তাই জাকসু নির্বাচন যাতে হয় সে ব্যাপারে সক্রিয় উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে। এই নির্বাচনের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে যে সহনশীল পরিবেশ থাকা দরকার, শিক্ষার্থীদের সব অংশের মধ্যে ভিন্নমতের সহাবস্থান নিশ্চিত করতে হবে। তারা যাতে নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষে লিপ্ত না হয়, জয়-পরাজয়কে যাতে হাসিমুখে গ্রহণ করতে পারে, সেই ব্যবস্থা করতে হবে। এই গণণতান্ত্রিক সংস্কৃতি ছাত্রসংগঠনগুলোকে অর্জন করতে হবে। সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের প্রতি আমার আহ্বান থাকবে, সেই পরিবেশ গড়ে তোলার ব্যাপারে যেন তারাও সজাগ থাকে। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশের চেতনা-বিরোধী শক্তির অনুসারীদের কোনো ধরনের কার্যক্রমের সুযোগ আমি দেব না। তারা যদি পরিশুদ্ধ হয়ে আসে, তাহলে সমস্যা নেই। এ ছাড়া সকল ছাত্রসংগঠনের সহাবস্থানের পরিবেশ আমি বজায় রাখার চেষ্টা করব।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়কে অনেকে সাংস্কৃতিক রাজধানী হিসেবে আখ্যায়িত করে থাকেন। এই অবস্থা ফিরিয়ে আনায় আমি সচেষ্ট থাকব। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ব-বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের গণতান্ত্রিক চেতনা, তাদের সন্ত্রাস ও যৌননিপীড়ন বিরোধিতার ঐতিহ্যের প্রতি আমি সম্মান পোষণ করি। আমি তাদের ও তাদের অভিভাবকদের কষ্ট-বেদনার সঙ্গেও মোটামুটি পরিচিত। বিশ্ববিদ্যালয় মুক্তবুদ্ধির জায়গা, গণতন্ত্রের অনুশীলনের জায়গা, প্রগতিশীল সংস্কৃতি চর্চার জায়গা। বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন সুস্থ-গতিময়-প্রাণবান সাংস্কৃতিক কার্যক্রম থাকে, তখন শিক্ষার পরিবেশটাও সাবলীল হয়ে ওঠে। এখানে প্রতিভাবান নাট্যকার সেলিম আল দীন কাজ করে গেছেন। জাহাঙ্গীরনগরের অবস্থান ও পরিবেশটাও আদর্শ বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে ওঠার উপযোগী। সেই পরিবেশটা যাতে গড়ে ওঠে, সে ব্যাপারে আমার দায়বদ্ধতা থাকবে।
আমি খুবই আশাবাদী মানুষ। আমি সবাইকে খুব আস্থায় নিয়ে থাকি। এতে করে আমি কখনো ঠকিনি। সে জন্যই বারবার বলছি, সবার সহযোগিতা আমি পাব এবং আমি সেটার প্রত্যাশী।
ড. মো. আনোয়ার হোসেন: জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নবনিযুক্ত উপাচার্য।

No comments

Powered by Blogger.