গণমাধ্যম-যেভাবে ইটিভি সেভাবে চ্যানেল ওয়ান! by সোহরাব হাসান
আওয়ামী লীগ কি মনে মনে ঠিক করে ফেলেছে যে তারা দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসতে চায় না? না হলে এ ধরনের আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নিতে পারত না। তরঙ্গ ব্যবহারের শর্ত ভঙ্গ করার অভিযোগে মঙ্গলবার বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল ওয়ানের সম্প্রচার বন্ধ করে দিয়েছে সরকার।
এই চ্যানেলটি কীভাবে ও কারা প্রতিষ্ঠা করেছেন, তা আমাদের অজানা নয়। এর উদ্যোক্তা ছিলেন তারেক রহমানের বন্ধু ও ব্যবসায়ী শরিক গিয়াস উদ্দিন আল মামুন। যখন বিএনপি সরকারের বিদায়ঘণ্টা বেজে উঠেছিল, তখনই দলীয় লোকদের নামে একটার পর একটা টিভি চ্যানেল খুলতে থাকে। তারা ভেবেছিল, এসব চ্যানেল দিয়ে বিএনপি জোট ফের ক্ষমতায় আসতে পারবে। তাদের সে আশা পূরণ হয়নি। আওয়ামী লীগ কি আশা করছে, বিরোধী পক্ষের চ্যানেল বন্ধ করে ক্ষমতা পাকাপোক্ত করা যাবে?
ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী রাজিউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, ‘টেলিযোগাযোগ আইনে সম্প্রচারে ব্যবহূত যন্ত্রপাতি বিক্রয় বা হস্তান্তরের সুযোগ নেই। অথচ চ্যানেলটি তা-ই করেছে। আইন ভঙ্গ করার কারণেই চ্যানেলটি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।’ এটি খোঁড়া যুক্তি। চ্যানেল ওয়ানের মালিকেরা যে ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে প্রাইম ব্যাংক থেকে মোটা অঙ্কের ঋণ নিয়েছিলেন, তাতেও সন্দেহ নেই। ঋণ শোধ করতে না পারায় ব্যাংক এখন চ্যানেল ওয়ানের যন্ত্রপাতি নিলামে বিক্রি করেও অন্যায় কিছু করেনি। বিবাদটা হলো ঋণদাতা ব্যাংক ও চ্যানেল ওয়ানের মধ্যে। ঋণ আদায়ে সরকার সংশ্লিষ্ট ব্যাংককে সব ধরনের সহায়তাও দিতে পারে। কিন্তু শর্তের বেড়াজালে ফেলে একটি চ্যানেলকে বন্ধ করে দিতে পারে না। যেখানে কয়েক শ সংবাদসেবীর জীবন-জীবিকার প্রশ্ন আছে, আছে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার প্রশ্নও। চ্যানেলটি যদি বিরোধী দলের সমর্থক হয়, তা হলে তো নিজের স্বার্থেই সরকারকে সেটি চালু রাখতে হবে। চ্যানেল বন্ধের মতো যে গর্হিত কাজ মৌলবাদ-জঙ্গিবাদের মদদদাতা বিএনপি-জামায়াত করতে পারে, ডিজিটাল বাংলাদেশের প্রবক্তা আওয়ামী লীগ করবে কেন?
বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়া সরকারের এই সিদ্ধান্তের কঠোর সমালোচনা করে বলেছেন, ‘তারা একবারও চিন্তা করল না, এর সঙ্গে কত লোকের কর্মসংস্থান জড়িত।’ খুবই ন্যায্য কথা। কিন্তু বিএনপি আমলে তাঁর এ কথা মনে ছিল না। ফেনীতে খালেদা জিয়ার প্রধান নির্বাচনী এজেন্ট ছিলেন, এমন একজনের দায়ের করা মামলায় ২০০২ সালের ২৯ আগস্ট ইটিভি বন্ধ হয়ে গেলে সারা দেশের মানুষ প্রতিবাদ জানিয়েছিল। তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী তাদের আবেদন-নিবেদনে সাড়া দেননি। বরং ইটিভি চালুর দাবিতে সাংবাদিক ও সংস্কৃতিসেবীরা রাস্তায় নামলে বিভিন্ন স্থানে সরকারি দল তাদের ঠেঙানি দিয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের সাহসী কলমযোদ্ধা সাইমন ড্রিংয়ের কাজের ছাড়পত্র বাতিল করে তাঁকে দেশ ছাড়তেও বাধ্য করেছিল বিএনপি সরকার। অসফল মানুষের দেশে ইটিভি ছিল নব্বই-পরবর্তী একটি বড় সাফল্য। সেই সাফল্যকে নস্যাত্ করে দিতে খালেদা জিয়া বা বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার একটুও দ্বিধা করেনি।
আমরা জানি, ইটিভি ও চ্যানেল ওয়ান এক নয়। চ্যানেল ওয়ানের উদ্যোক্তা মামুন দুর্নীতিসহ নানা অপকর্মের দায়ে এখন জেলে। হয়তো চ্যানেলে খাটানো পুঁজিও দুই নম্বরি। কিন্তু তাই বলে কারিগরি ত্রুটি বা আর্থিক অনিয়মের অভিযোগে একটি টিভি চ্যানেল বন্ধ করা ঠিক নয়। চ্যানেল ওয়ানে যাঁরা কাজ করছেন তাঁরা পেশাজীবী সাংবাদিক। এঁদের অনেকে আগে অন্য চ্যানেলে বা পত্রিকায় কাজ করতেন। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় যখন সম্প্রচার বন্ধের খবরটি প্রচার করা হচ্ছিল, তখন অনেককে দেখেছি কান্নায় ভেঙে পড়ছেন। অতীতে সংবাদকর্মীদের পথে বসানোর ফল ভালো হয়নি। ভবিষ্যতেও হবে না। ক্ষমতাসীনদের শুধু এ কথাটি স্মরণ রাখতে বলব।
দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় বহু সংগ্রাম হয়েছে, বহু মানুষ জীবন দিয়েছেন। স্বৈরাচারকে হটিয়ে আমরা নির্বাচিত সরকার (তারা প্রকৃতই গণতান্ত্রিক কি না, অনেকের মনেই সে প্রশ্ন রয়েছে)। কিন্তু পূর্বাপর সরকারের আচরণে খুব একটা পার্থক্য নেই। বিরোধী মতকে কেউ সহ্য করে না। বিএনপি সরকার বেছে বেছে দলীয় লোকদের দিয়ে টিভি চ্যানেল খুলিয়েছে। ক্ষমতার পালাবদলের সঙ্গে সঙ্গে কয়েকটির মালিকানাও বদল হয়েছে। আওয়ামী লীগও ক্ষমতায় এসে পছন্দমতো ১০টি প্রতিষ্ঠানকে চ্যানেল চালুর অনুমতি দিয়েছে। আবার যাদের পছন্দ হয়নি তাদের অনুমতি দেয়নি। এমন প্রতিষ্ঠানকেও অনুমতি দেওয়া হয়েছে, যারা সেই অনুমতিপত্র নিয়ে বিনিয়োগকারীর সন্ধানে বের হয়েছেন। কী চমত্কার!
বিএনপি সরকার ইটিভি বন্ধ করে দিয়েছিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকার সিএসবি টিভি বন্ধ করে দিয়েছিল। বর্তমান সরকার বন্ধ করল চ্যানেল ওয়ান। এর আগে যমুনা টিভির পরীক্ষামূলক সম্প্রচারও বন্ধ করে দেওয়া হয়। ভবিষ্যতে অন্য সরকার এসে হয়তো আরও এক বা একাধিক চ্যানেল বন্ধ করে দেবে। এভাবে কত দিন চলবে?
আমাদের শেষ কথা, আইনগত ত্রুটি থাকলে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করা যেতে পারে। আইন মানতে বাধ্য করা যেতে পারে। ব্যাংক ঋণ পরিশোধ না করলে তা আদায়ে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। কিন্তু কোনোভাবেই চ্যানেল বন্ধ করা যাবে না।
নব্বইয়ের আগে নানা অজুহাতে পত্রিকার প্রকাশনাও বন্ধ করা হতো। বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদকে সালাম জানাই, তিনি গণবিরোধী সেই আইন বাতিল করে দিয়েছিলেন। টিভি চ্যানেলের ক্ষেত্রেও অনুরূপ কোনো রক্ষাকবচ চাই, যাতে কেউ ইচ্ছে হলেই সুইচ অফ করতে না পারে।
সরকারের কাছে অনুরোধ জানাব, চ্যানেল ওয়ান বন্ধের অদেশটি প্রত্যাহার করে নিন। আশা করি পেশাদার সাংবাদিকদের অভিশাপ নেবেন না। সবার মঙ্গল হোক।
সোহরাব হাসান: কবি ও সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net
ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী রাজিউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, ‘টেলিযোগাযোগ আইনে সম্প্রচারে ব্যবহূত যন্ত্রপাতি বিক্রয় বা হস্তান্তরের সুযোগ নেই। অথচ চ্যানেলটি তা-ই করেছে। আইন ভঙ্গ করার কারণেই চ্যানেলটি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।’ এটি খোঁড়া যুক্তি। চ্যানেল ওয়ানের মালিকেরা যে ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে প্রাইম ব্যাংক থেকে মোটা অঙ্কের ঋণ নিয়েছিলেন, তাতেও সন্দেহ নেই। ঋণ শোধ করতে না পারায় ব্যাংক এখন চ্যানেল ওয়ানের যন্ত্রপাতি নিলামে বিক্রি করেও অন্যায় কিছু করেনি। বিবাদটা হলো ঋণদাতা ব্যাংক ও চ্যানেল ওয়ানের মধ্যে। ঋণ আদায়ে সরকার সংশ্লিষ্ট ব্যাংককে সব ধরনের সহায়তাও দিতে পারে। কিন্তু শর্তের বেড়াজালে ফেলে একটি চ্যানেলকে বন্ধ করে দিতে পারে না। যেখানে কয়েক শ সংবাদসেবীর জীবন-জীবিকার প্রশ্ন আছে, আছে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার প্রশ্নও। চ্যানেলটি যদি বিরোধী দলের সমর্থক হয়, তা হলে তো নিজের স্বার্থেই সরকারকে সেটি চালু রাখতে হবে। চ্যানেল বন্ধের মতো যে গর্হিত কাজ মৌলবাদ-জঙ্গিবাদের মদদদাতা বিএনপি-জামায়াত করতে পারে, ডিজিটাল বাংলাদেশের প্রবক্তা আওয়ামী লীগ করবে কেন?
বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়া সরকারের এই সিদ্ধান্তের কঠোর সমালোচনা করে বলেছেন, ‘তারা একবারও চিন্তা করল না, এর সঙ্গে কত লোকের কর্মসংস্থান জড়িত।’ খুবই ন্যায্য কথা। কিন্তু বিএনপি আমলে তাঁর এ কথা মনে ছিল না। ফেনীতে খালেদা জিয়ার প্রধান নির্বাচনী এজেন্ট ছিলেন, এমন একজনের দায়ের করা মামলায় ২০০২ সালের ২৯ আগস্ট ইটিভি বন্ধ হয়ে গেলে সারা দেশের মানুষ প্রতিবাদ জানিয়েছিল। তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী তাদের আবেদন-নিবেদনে সাড়া দেননি। বরং ইটিভি চালুর দাবিতে সাংবাদিক ও সংস্কৃতিসেবীরা রাস্তায় নামলে বিভিন্ন স্থানে সরকারি দল তাদের ঠেঙানি দিয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের সাহসী কলমযোদ্ধা সাইমন ড্রিংয়ের কাজের ছাড়পত্র বাতিল করে তাঁকে দেশ ছাড়তেও বাধ্য করেছিল বিএনপি সরকার। অসফল মানুষের দেশে ইটিভি ছিল নব্বই-পরবর্তী একটি বড় সাফল্য। সেই সাফল্যকে নস্যাত্ করে দিতে খালেদা জিয়া বা বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার একটুও দ্বিধা করেনি।
আমরা জানি, ইটিভি ও চ্যানেল ওয়ান এক নয়। চ্যানেল ওয়ানের উদ্যোক্তা মামুন দুর্নীতিসহ নানা অপকর্মের দায়ে এখন জেলে। হয়তো চ্যানেলে খাটানো পুঁজিও দুই নম্বরি। কিন্তু তাই বলে কারিগরি ত্রুটি বা আর্থিক অনিয়মের অভিযোগে একটি টিভি চ্যানেল বন্ধ করা ঠিক নয়। চ্যানেল ওয়ানে যাঁরা কাজ করছেন তাঁরা পেশাজীবী সাংবাদিক। এঁদের অনেকে আগে অন্য চ্যানেলে বা পত্রিকায় কাজ করতেন। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় যখন সম্প্রচার বন্ধের খবরটি প্রচার করা হচ্ছিল, তখন অনেককে দেখেছি কান্নায় ভেঙে পড়ছেন। অতীতে সংবাদকর্মীদের পথে বসানোর ফল ভালো হয়নি। ভবিষ্যতেও হবে না। ক্ষমতাসীনদের শুধু এ কথাটি স্মরণ রাখতে বলব।
দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় বহু সংগ্রাম হয়েছে, বহু মানুষ জীবন দিয়েছেন। স্বৈরাচারকে হটিয়ে আমরা নির্বাচিত সরকার (তারা প্রকৃতই গণতান্ত্রিক কি না, অনেকের মনেই সে প্রশ্ন রয়েছে)। কিন্তু পূর্বাপর সরকারের আচরণে খুব একটা পার্থক্য নেই। বিরোধী মতকে কেউ সহ্য করে না। বিএনপি সরকার বেছে বেছে দলীয় লোকদের দিয়ে টিভি চ্যানেল খুলিয়েছে। ক্ষমতার পালাবদলের সঙ্গে সঙ্গে কয়েকটির মালিকানাও বদল হয়েছে। আওয়ামী লীগও ক্ষমতায় এসে পছন্দমতো ১০টি প্রতিষ্ঠানকে চ্যানেল চালুর অনুমতি দিয়েছে। আবার যাদের পছন্দ হয়নি তাদের অনুমতি দেয়নি। এমন প্রতিষ্ঠানকেও অনুমতি দেওয়া হয়েছে, যারা সেই অনুমতিপত্র নিয়ে বিনিয়োগকারীর সন্ধানে বের হয়েছেন। কী চমত্কার!
বিএনপি সরকার ইটিভি বন্ধ করে দিয়েছিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকার সিএসবি টিভি বন্ধ করে দিয়েছিল। বর্তমান সরকার বন্ধ করল চ্যানেল ওয়ান। এর আগে যমুনা টিভির পরীক্ষামূলক সম্প্রচারও বন্ধ করে দেওয়া হয়। ভবিষ্যতে অন্য সরকার এসে হয়তো আরও এক বা একাধিক চ্যানেল বন্ধ করে দেবে। এভাবে কত দিন চলবে?
আমাদের শেষ কথা, আইনগত ত্রুটি থাকলে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করা যেতে পারে। আইন মানতে বাধ্য করা যেতে পারে। ব্যাংক ঋণ পরিশোধ না করলে তা আদায়ে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। কিন্তু কোনোভাবেই চ্যানেল বন্ধ করা যাবে না।
নব্বইয়ের আগে নানা অজুহাতে পত্রিকার প্রকাশনাও বন্ধ করা হতো। বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদকে সালাম জানাই, তিনি গণবিরোধী সেই আইন বাতিল করে দিয়েছিলেন। টিভি চ্যানেলের ক্ষেত্রেও অনুরূপ কোনো রক্ষাকবচ চাই, যাতে কেউ ইচ্ছে হলেই সুইচ অফ করতে না পারে।
সরকারের কাছে অনুরোধ জানাব, চ্যানেল ওয়ান বন্ধের অদেশটি প্রত্যাহার করে নিন। আশা করি পেশাদার সাংবাদিকদের অভিশাপ নেবেন না। সবার মঙ্গল হোক।
সোহরাব হাসান: কবি ও সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net
No comments