'মোরা বুঝিব সত্য, পূজিব সত্য খুঁজিব সত্য ধন' by ডা. ওয়াহিদ নবী

দৈনিক পত্রিকার সঙ্গে প্রাত্যহিকতার একটা সম্পর্ক থাকে, এটাই আমাদের ধারণা। 'সংহত হোক মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তি' শিরোনামে যে প্রবন্ধ তিনটি পড়লাম ২৫ ফেব্রুয়ারির কালের কণ্ঠে সেগুলোয় দেখলাম, জাতিকে দিকনির্দেশনা দিয়েছেন দেশের তিনজন সম্মানিত ব্যক্তিত্ব।


আমাদের অনেক গভীর সমস্যার অন্তর্নিহিত কারণ সম্পর্কে তাঁরা অঙ্গুলি নির্দেশ করেছেন এবং সমাধানের ইঙ্গিত দিয়েছেন। পাঠক হিসেবে আমাদের কর্তব্য কী, তাই আলোচনা করার চেষ্টা করছি। গভীর মনোযোগের সঙ্গে প্রবন্ধ তিনটি পড়েছি। বোঝার চেষ্টা করেছি। মূল বক্তব্য অনুধাবন করার চেষ্টা করেছি। এবং এ বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ বুঝে ভবিষ্যতে আরো জানার চেষ্টা করব ভেবেছি। কবিগুরুর ভাষায়, 'বুঝিব সত্য, পূজিব সত্য, খুঁজিব সত্য ধন।' এ প্রসঙ্গে আরো দুটি কথা মনে পড়েছে। প্রথম কথাটি বৈজ্ঞানিক কার্ল পপারের। 'নির্জলা সত্য বলে কিছু নেই। আমরা মিথ্যা থেকে দূরে সরে যাওয়ার চেষ্টা করব।' দ্বিতীয় কথাটি ইংরেজ দার্শনিক জন স্টুুয়ার্ট মিলের। 'যে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীর মতামত বোঝে না, তার নিজের মতামত ভালো করে বোঝে না।'
প্রবন্ধ তিনটি পড়তে পড়তে মনে হয়েছে জাতি হিসেবে আমাদের নিজেদের চেনার চেষ্টা করতে হবে। এটা আমরা করতে পারি শুধু জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে। বই পড়ে ও জ্ঞানী ব্যক্তিদের বক্তব্য শুনে জানা সম্ভব। আমরা সবাই জীবিকা ও অন্যান্য কিছু নিয়ে ব্যস্ত। কাজেই যতটা আমরা জানতে চাই, তা পারি না। তবু জানতে হবে। একমাত্র জানাই আমাদের অন্ধবিশ্বাসের হাত থেকে মুক্তি দিতে পারে। দুর্ভাগ্যবশত অন্ধবিশ্বাস আমাদের জীবনে একটা অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ ও বিপক্ষের দলে ঠেলে দিয়েছে। আমাদের মনীষীরা কত কষ্ট করে মূল্যবান সব বই লিখে গেছেন। পত্রিকায় মূল্যবান সব প্রবন্ধ লেখেন তাঁরা। ব্যস্ততার অজুহাতে আমরা নিজেদের মূল্যবান এসব ধন থেকে বঞ্চিত করি। আমার মনে হয় কতকগুলো বই আছে যাদের 'ক্লাসিক' বলে বর্ণনা করা হয়, এগুলো পড়লে একটা সুন্দর ধারণা হয়। পরে অবশ্য আরো জানতে হবে।
মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ ও বিপক্ষের কথা জানতে হলে মনে হয় নেতৃত্ব সম্বন্ধে আমাদের কিছু জানতে হবে। হান্টার বা বেভারলির লেখা ভালো করে না পড়ে শুধু তাঁদের কথা ভাসাভাসা শুনে রাগে ফেটে পড়া বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। সত্য আমার মনের মতো করে রূপ নেবে না। আমার মনে হয়েছিল মুস্তাফা নূরউল ইসলাম সম্পাদিত 'বাংলাদেশ ও বাঙালি : আত্মপরিচয়ের সন্ধানে' বইটি আমাদের নিজেদের জানতে খুব সাহায্য করবে। সুকুমার সেন বাংলা সাহিত্যের যে মহামূল্যবান ইতিহাস লিখে গেছেন তা প্রতিটি বাঙালির পড়া উচিত। গোপাল হালদারের বইটি আমাকে বাংলা, বাংলা সাহিত্য ও বাঙালিদের সম্পর্কে জানতে সাহায্য করেছে। গোলাম মুরশিদের বইটি সহজপাঠ্য কিন্তু তথ্যবহুল। রাখাল বন্দ্যোপাধ্যারের দুই খণ্ডে লেখা বইটি পড়া বেশ শক্ত_এ কথা স্যার যদুনাথ সরকার বলেছিলেন। বইটি অপূর্ব এ জন্য যে প্রমাণসহকার তিনি ইতিহাস আলোচনা করেছেন। এই প্রসঙ্গে একটি ঘটনা মনে পড়ে। একবার রাজশাহীর বরেন্দ্র মিউজিয়াম দেখতে গিয়েছিলাম। লক্ষ করলাম শরৎ কুমার রায়ের অবদান দৃশ্যমান। হঠাৎ করে মিউজিয়ামের কিউরেটরের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। তিনি দয়া করে আমার সঙ্গে কথা বলতে রাজি হলেন। শরৎ কুমার রায় কে_এই প্রশ্ন করাতে তিনি যে দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন তাতে লজ্জা পেলাম। তাঁর দৃষ্টি বলেছিল, 'আশ্চর্য আপনি শরৎ কুমার রায় কে জানেন না।' তিনি অত্যন্ত যত্নসহকারে এই মূর্খকে শরৎ কুমার রায়ের অবদানের কথা জানালেন। এই ঘটনা আমি অনেককে বলেছি। এই ঘটনা আমাকে শিক্ষা দিয়েছে, আমাদের পরিচিত সবাইকে আমরা যেন স্থানীয় মিউজিয়াম দেখতে অনুরোধ করি। বিশেষ করে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে। ইতিহাস সম্বন্ধে আমার অত্যন্ত সীমিত জ্ঞানে মনে হয়েছে যে একটা জিনিস আমাদের বোঝা উচিত আর তা হচ্ছে কোনো বিশেষ ব্যক্তির একটি বিশেষ দেশে পদার্পণের দিনটি থেকে সে দেশের ইতিহাস শুরু হয় না, তা তিনি যেই হোন না কেন। তিনি দিগ্বিজয়ী হন আর নৈতিকতার দিশারীই হন।
মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ-বিপক্ষের কথা আলোচনা করার সময় মুক্তিযুদ্ধ শুরুর প্রেক্ষাপট মনে রাখা উচিত। প্রেক্ষাপটের বাস্তবতা বোঝার চেষ্টা করা উচিত। একটি সেনা-শাসিত দেশে স্বাধীনতার কথা স্পষ্ট করে বলার অবস্থা ছিল না। আমাদের সমস্যাগুলো আলোচনা করার সুযোগ ছিল না। সেনা-শাসিত দেশে স্বায়ত্তশাসনের কথা বলাও সমস্যা ছিল স্বাধীনতার কথা বলা দূরে থাক। এসব বাস্তব কারণে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি ছিল অসম্ভব। এমনি অবস্থায় কিছু অবাঞ্ছিত ব্যক্তি মুক্তিবাহিনীতে ঢুকে পড়ে। এদের কার্যকলাপ স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে জনগণ পছন্দ করেনি। পরিস্থিতি প্রতিকূল ছিল বলে স্বাধীন দেশের রূপরেখা কেমন হবে তা জনগণকে জানানো সম্ভব ছিল না। তাই খোন্দকার মোশতাকের মতো প্রতিক্রিয়াশীল ব্যক্তির পক্ষে সম্ভব হয়েছিল স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় এবং পরেও শীর্ষস্থানীয় নেতা হতে। একটা দেশের স্বাধীনতার ঘোষণা একমাত্র সেই দেশের সর্বময় নেতা দিতে পারেন এটুকু বোঝার মতো বুদ্ধি আমাদের বিধাতা দিয়েছেন বলে আমি বিশ্বাস করি।
আজ অবশ্য আশ্চর্য লাগে এসব কথা ভাবতে। এসব কারণে নির্লজ্জ ইতিহাস বিকৃতির প্রচেষ্টা চালায় মিথ্যাচারীরা। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জ্ঞাতার্থে আমাদের এসবের কিছু কিছু আলোচনা হওয়া প্রয়োজন। আমরা বাঙালিরা বিভ্রান্ত হয়ে পাকিস্তানের মতো একটা কিম্ভূতকিমাকার রাষ্ট্রের প্রজা হতে রাজি হয়েছিলাম_এ কথা সত্য। আমরা তখন 'ধর্ম' ও 'জাতির' মধ্যে পার্থক্য বুঝতে পারিনি। কিন্তু আমাদের তখনকার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল সরল বিশ্বাসে।
পশ্চিম পাকিস্তানিরা বাঙালিদের সরল বিশ্বাসের মর্যাদা দেয়নি। তারা বাঙালিদের বঞ্চিত করেছিল সবদিক দিয়ে। এর অসংখ্য উদাহরণ সবার জানা। আমি শুধু একটির কথা উল্লেখ করব। পাকিস্তানের জন্মের পর পশ্চিম পাকিস্তানের সব প্রাক্তন প্রদেশের নাম তেমনি থেকে গেল। যেমন পাঞ্জাবের নাম পাঞ্জাব, সিন্ধুর নাম সিন্ধু, বেলুচিস্তানের নাম বেলুচিস্তান আর উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের নাম উ.প.সী. প্রদেশ থেকে গেল। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তান নাম করা হলো বাংলার নাম মুছে ফেলার জন্য।
কবীর চৌধুরী স্বাধীনতার পক্ষ ও বিপক্ষ শক্তির সংজ্ঞা দিয়েছেন। কিন্তু পৃথিবীতে কোনো দল নির্ভেজালভাবে সমমনা নয়। ইংরেজ কর্নেল স্লিম্যান ঠগীদের নির্মূল করে ভারতবাসীদের উপকার করেছিলেন। আর ভারতবাসী মীরজাফরের কথা তো আমরা জানি। আদর্শিক দিক দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে হয়েও দুর্নীতিগ্রস্ত কিছু ব্যবসায়ী রাজনীতিবিদ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির অপূরণীয় ক্ষতি করছেন। বিএনপি নিজেদের ইতিবাচক কারণের জন্য নয়, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির দুর্বলতার জন্য অনেক সাফল্য অর্জন করেছে। জিয়াউর রহমানের কুকীর্তির কথা কবীর চৌধুরী উল্লেখ করেছেন। তাঁর ব্যক্তিগত সাধুতা সম্পর্কে ঢালাও প্রচারের অন্তরালে যে প্রভূত রাজনৈতিক অসাধুতা লুকিয়ে রাখা হয়েছে, তার অনেকটা এখনো জনগণ জানে না। ধর্মের প্রধান বিষয় যে আচার-আনুষ্ঠানিকতা নয়, নৈতিকতা_এটা তিনি সুন্দরভাবে বর্ণনা করেছেন। আমার মনে হয় 'সেক্যুলার' কথাটির বাংলা প্রতিশব্দ হিসেবে 'পার্থিব' বা 'জাগতিক' ব্যবহার করা উচিত ছিল। 'ধর্মনিরপেক্ষতা' শব্দটি ব্যবহার করে এই শব্দটির অপব্যবহার করার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে স্বাধীনতার বিপক্ষের শক্তিকে। ইতিহাস-সচেতন মুনতাসীর মামুন ইতিহাসের আলোকে রাজনীতিতে আদর্শ ভূমিকার কথা আলোচনা করেছেন।
রাজনীতিতে আদর্শের ভূমিকাকে খর্ব করা হলে জাতি বিপর্যয়ের সম্মুখীন হবে বলে তিনি যে সাবধানবাণী উচ্চারণ করেছেন, সে সম্পর্কে আমাদের সচেতন হতে হবে।
আবেদ খান মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের প্রশাসন সম্পর্কে প্রজ্ঞাবান মন্তব্য করেছেন। আসলেই প্রশাসনের দায়িত্ব যারা কেড়ে নিয়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশে, তাদের অধিকাংশের চেতনা মুক্তির চেতনার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ ছিল না। ফলে দেশ শাসিত হয়েছে পাকিস্তানপন্থী বাঙালিদের দ্বারা। আমাদের ইতিহাস চেতনার অভাবও ছিল। ইতিহাস যতই নির্মম হোক না কেন, ঐতিহাসিক সত্য মেনে নিতেই হবে।
১৯৭১ সালেই আমরা প্রথম স্বাধীন ও গণতান্ত্রিক দেশে বাস করার সুযোগ পেয়েছি। এর আগে শাসকদের অনেকের নাম শুনতে আমাদের মতো হলেও তাঁরা বিদেশি ছিলেন এবং তাঁরা গণতান্ত্রিক ছিলেন না। এসব কারণে আমাদের রাজনৈতিক নেতারা দেশ পরিচালনা করার অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারেননি। এই সুযোগ আমাদের শত্রুরা ব্যবহার করেছে। অনেকেই মনে করেন যে তাজউদ্দীন আহমদের প্রকৃত মূল্যায়ন হয়নি।
সত্য জানার জন্য আমাদের দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হতে হবে। পরিশ্রম করতে হবে সত্যকে জানার জন্য। আবেগ আমাদের থাকতেই হবে মুক্তির জন্য। তবে আবেগ যেন যুক্তির দ্বারা পরিচালিত হয়। শত্রুকে চেনার জন্য আমাদের ধীশক্তি থাকতে হবে। মনে রাখতে হবে স্বাধীন দেশে শত্রুকে চেনা কঠিন।
লেখক : লন্ডন প্রবাসী বিশেষজ্ঞ
চিকিৎসক ও গবেষক

No comments

Powered by Blogger.