গণমাধ্যম-মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে খোলা চিঠি

বাংলাদেশে একটি বিশ্বমানের টেলিভিশন গড়ার স্বপ্ন নিয়ে বছরখানেক আগে আমরা পাঁচ শতাধিক সংবাদকর্মী বিভিন্ন টেলিভিশন ও পত্রিকা থেকে যমুনা টেলিভিশনে যোগদান করি। আমাদের সঙ্গে যোগ দেয় এ প্রজন্মের মেধাবী ও উদ্যমী একঝাঁক তরুণ।


আপনি জেনে খুশি হবেন যে প্রায় এক বছরেরও বেশি সময় ধরে নানা ধরনের প্রশিক্ষণ, পরীক্ষা-নিরীক্ষার ভেতর দিয়ে আমরা নিজেদের সম্প্রচারের জন্য তৈরি করেছি। উপযুক্ত বিনিয়োগ, সর্বাধুনিক প্রযুক্তি, প্রশিক্ষিত জনবলের সমন্বয়ে যমুনা টেলিভিশন বাংলাদেশের টেলিভিশন ইতিহাসে এক নতুন ধারা তৈরি করার অপেক্ষায়, মনেপ্রাণে আমরা তা বিশ্বাস করি, যা সত্যিকার অর্থেই আপনার কাঙ্ক্ষিত ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্নের সঙ্গে একাকার।
আপনি জানেন, বাংলাদেশে এ পর্যন্ত যে কয়টি টেলিভিশন চালু আছে এবং নতুন যে দুটি সম্প্রতি চালু হয়েছে, তাদের মতো যমুনা টেলিভিশনও সব রকম নিয়মকানুন অনুসরণ করে যাত্রা শুরুর পথে এগোচ্ছিল। তথ্য মন্ত্রণালয়ের দেওয়া অনাপত্তিপত্রের শর্ত মেনে এবং বিটিআরসির বেঁধে দেওয়া নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পরীক্ষামূলক সম্প্রচারও শুরু করেছিল। কিন্তু এর কিছুদিন পরেই পুনঃঅনাপত্তি না থাকার অজুহাত দেখিয়ে তথ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে বিটিআরসি গত বছর ১৯ নভেম্বর বন্ধ করে দেয় যমুনা টিভির পরীক্ষামূলক সম্প্রচার। ওই ঘটনার আজ প্রায় আট মাস পার হতে চলল। সেই থেকে এক অনিশ্চিত অবস্থার মধ্যেও প্রতিনিয়ত কাজ করে যাচ্ছি আমরা। একসময় না একসময় প্রশাসনিক ও আইনি জটিলতার অবসান হবে, দূর হবে সকল অনিশ্চয়তা—এই বিশ্বাসে মুখ বুজে পার করে দিয়েছি দুঃসহ আট মাস। কাজ ছাড়া এভাবে আর কত অসহনীয় দিন পার করতে হবে, আমাদের? আমাদের আশঙ্কা, এই অবস্থা আরও দীর্ঘায়িত হলে কর্তৃপক্ষ যেকোনো মুহূর্তে আমাদের চাকরিচ্যুত করতে পারে। সেই ইঙ্গিত ইতিমধ্যে আমরা পেয়েছি।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আমরা মনে করি, যমুনা টিভি সম্পর্কে কিছু প্রয়োজনীয় তথ্য আপনার সামনে তুলে ধরা প্রয়োজন। আমাদের বিশ্বাস, তথ্যগুলো যাচাই করে দেখলে যমুনা টিভির অতীত এবং বর্তমান অবস্থান সম্পর্কে আপনার ধারণা পরিষ্কার হবে।
১. বলা হচ্ছে, যমুনা টেলিভিশনের তথ্য মন্ত্রণালয়ের অনাপত্তিপত্র নেই। ২০০২ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি তথ্য মন্ত্রণালয় যমুনা টিভিকে যে অনাপত্তিপত্র দিয়েছে, তার কোথাও মেয়াদকালের কথা বলা নেই। তা ছাড়া এই অনাপত্তিপত্রের বিষয়ে একাধিকবার হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টের রায় যমুনা টিভির পক্ষে আছে। হাইকোর্টের বিচারপতি মো. আবদুর রশীদ (যিনি এখন ল কমিশনের চেয়ারম্যান) ও বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহম্মদের বেঞ্চ যে রায় দেন, তাতে পরিষ্কার বলা আছে, তথ্য মন্ত্রণালয় লাইসেন্স ইস্যু করে না। তথ্য মন্ত্রণালয় অনাপত্তিপত্র দেয়, যার মেয়াদ অনির্দিষ্টকালের জন্য, যা সুপ্রিম কোর্টও বহাল রাখেন। সুতরাং যমুনা টিভির অনাপত্তিপত্র নিয়ে বিতর্কের সুযোগ নেই।
২. বিটিআরসি যমুনা টিভির অনুকূলে যে তরঙ্গ বরাদ্দ করে এবং যন্ত্রপাতি আমদানির যে অনুমতি দেয়, তাতে বলা আছে—এক বছরের মধ্যে সম্প্রচারে যেতে হবে। যমুনা টিভি বিটিআরসির শর্তানুযায়ী ফ্রিকোয়েন্সি ব্যবহার ও পরীক্ষামূলক সম্প্রচারের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদনসহ নির্ধারিত এক বছরের আগেই নিয়মিত লাইসেন্সের জন্য বিটিআরসিতে আবেদন দাখিল করে। সুতরাং যমুনা টিভি অবৈধভাবে সম্প্রচারে গেছে, এ বক্তব্য ঠিক নয়। বরং বিটিআরসিই অনুমোদনের শর্তে সময়সীমা বেঁধে দিয়েছিল। শুধু তাই নয়, যমুনা টিভির যে অনাপত্তিপত্র আছে, সেটি বিটিআরসি তরঙ্গ বরাদ্দ পত্রের মধ্যেই পরিষ্কার উল্লেখ করা আছে।
৩. বলা হচ্ছে, অনাপত্তিপত্রের মেয়াদ পাঁচ বছর, যা ২০০৭ সালে শেষ হয়ে গেছে। ব্যাখ্যাটি যে ভুল, তার বড় প্রমাণ—যমুনা টিভির পক্ষে ইতিপূর্বে দেওয়া হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টের রায়। যেখানে বলা আছে, অনাপত্তিপত্রের মেয়াদ অনির্দিষ্টকালের জন্য। পাঁচ বছর সময়সীমা অনাপত্তিপত্রের ক্ষেত্রে নয়। এটি মূলত বেসরকারি মালিকানায় টেলিভিশন স্থাপন ও পরিচালনা নীতি ’৯৮-এর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। ওই নীতিমালায় বলা আছে, প্রাথমিক অবস্থায় টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় পাঁচ বছরের জন্য লাইসেন্স দেবে। ২০০১ সালে স্বাধীন সংস্থা হিসেবে বিটিআরসি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর লাইসেন্স দেওয়ার সকল ক্ষমতা কমিশনই সংরক্ষণ করছে। তথ্য মন্ত্রণালয় শুধু অনাপত্তিপত্র দেবে আর লাইসেন্স দেবে বিটিআরসি। প্রশ্ন হলো, ২০০৭ সালে যদি যমুনা টিভির মেয়াদ শেষ হয়েই থাকে, তাহলে বিটিআরসি কিসের ভিত্তিতে ২০০৮ সালের ২০ নভেম্বর যমুনা টিভিকে তরঙ্গ বরাদ্দ ও যন্ত্রপাতি আমদানির অনুমতি দিয়েছিল?
৪. বলা হচ্ছে, যমুনা টিভি অবৈধভাবে পরীক্ষামূলক সম্প্রচারে গেছে। এ কথাটিও সত্য নয়। বিটিআরসি ২০০৮ সালের ২০ নভেম্বর তরঙ্গ বরাদ্দ ও যন্ত্রপাতি আমদানির যে অনাপত্তিপত্র দেয়, তার প্রথম শর্তেই পরিষ্কার বলা আছে, এক বছরের মধ্যেই তরঙ্গ ব্যবহার এবং যন্ত্রপাতি ব্যবহার করতে হবে। তা না হলে ফ্রিকোয়েন্সি বাতিল বলে গণ্য হবে। সুতরাং বক্তব্যটি যে মিথ্যা, তা বলা বাহুল্য।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, এ সবই স্বীকৃত তথ্য, যা কেবলই আপনার সুচিন্তিত বিবেচনার জন্য তুলে ধরা। আমরা জানি, সবকিছুর ওপরে থাকে আপনার বুদ্ধিদীপ্ত বিবেচনা। যে বিবেচনা সব সময় ইতিবাচক পথেই যায়। পাঁচ শতাধিক সংবাদকর্মীর অস্তিত্বের প্রশ্ন যেখানে, কর্মসংস্থানের প্রশ্ন যেখানে, বিনিয়োগের প্রশ্ন যেখানে, সর্বোপরি ডিজিটাল বাংলাদেশের অঙ্গীকার যেখানে, সেখানে আমরা আপনার সহূদয় বিবেচনার অপেক্ষায়।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আমরা দেখেছি, নিমতলীর আগুনে পুড়ে নিঃস্ব হওয়া রুনা-রত্নার পাশে আপনি কীভাবে দাঁড়িয়েছেন। গণভবনে দুই বোনের বিয়ের মতো বিরল অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছেন। এত ব্যস্ততার মধ্যে থেকেও আপনি যেভাবে তিন বোনের কথা ভেবেছেন, সেটি আপনার মানবিক মনের পরিচয়কেই বড় করে তুলে ধরে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আমরা এ কথাও জানি, আপনি বরাবরই সাংবাদিকদের প্রতি সংবেদনশীল। অতীতেও আপনি সাংবাদিকদের অধিকার আদায়ের পক্ষে কথা বলেছেন। তাঁদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। আমাদের বিশ্বাস, ৫০০ সংবাদকর্মীর চরম অনিশ্চিত ও কঠিন দুঃসময়ে রুনা-রত্না-আসমার মতো আমরাও আপনাকে আমাদের পাশে পাব। যমুনা টেলিভিশনকে সম্প্রচারে আনার ব্যাপারে আমরা আপনার উদ্যোগী ভূমিকা প্রত্যাশা করছি। আশা করি, নিরাশ করবেন না।
যমুনা টেলিভিশনে কর্মরত সকল সাংবাদিক ও কর্মী।-যমুনা টেলিভিশন

No comments

Powered by Blogger.