সোনা রঙের প্যাগোডা by আহমেদ হেলাল
মিয়ানমারের রাজধানী ইয়াঙ্গুনে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আঞ্চলিক একটি সম্মেলনের ব্যস্ততার মধ্যে এক বেলা নির্ধারিত ছিল শহর ঘুরে দেখবার। সেডোনা হোটেল থেকে ছেড়ে আসা টুরিস্ট বাসটি মিনিট তিরিশের মধ্যে এসে থামল শেওয়ে ডাগোন প্যাগোডার সামনে। ইংরেজিতে যার অর্থ গ্রেট গোল্ডেন প্যাগোডা। ইয়াঙ্গুনে এলে এটি দেখতেই হবে।
রেঙ্গুনের কান্ডাওকি লেকের পশ্চিমে সিঙ্গুটারা পাহাড়ের উপর এটি অবস্থিত। বাসের মধ্যেই স্থানীয় গাইড সুন্দর করে ইংরেজিতে এটির ইতিহাস বলে দিয়েছেন এবং প্যাগোডার ভেতরে কোথায় কী দেখব তাও বলে দিয়েছেন। ঢোকার মুখে তেমন কিছু বোঝা গেল না কিন্তু লিফটে উঠে প্যাগোডার চাতালের ভেতরে ঢুকতেই চোখ ঝলসে গেল। বিকেল গড়িয়ে আসছে পশ্চিমের সূর্য ঠিকরে পড়ছে সোনা রঙের প্যাগোডার চুড়োয়। প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে তৈরি হয়েছিল এই বুদ্ধ মন্দির যাকে বলা হয় ‘জাদি’। বলা হয় তাপস্য আর ভল্লিক দুই ভাই গৌতম বুদ্ধের জীবদ্দশায় তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং বুদ্ধের আটটি চুল নিয়ে বার্মায় ফিরে আসেন। এর পর সিঙ্গুটারা পাহাড়ে এই বুদ্ধমন্দির স্থাপন করেন তখনকার মং রাজবংশের রাজা এবং বুদ্ধস্মৃতি সংরক্ষিত হয়। চাতালের ভেতর কয়েকটি ছোট ছোট মন্দির আর প্যাগোডার মূল চূড়া। গাইডের ভাষ্যমতে এই চূড়াসহ প্যাগোডায় মোট আট টন সোনা ব্যবহার করা হয়েছে আর হীরা ও রুবীসহ দামি পাথরও আছে কয়েক হাজার। চূড়ার উচ্চতা প্রায় ৩২৫ ফুট। অসংখ্য অল্পবয়সী বালক আর কিশোর নবীন সন্ন্যাসী লাল আর গেরুয়া কাপড় পরে সারিবদ্ধভাবে হেঁটে যাচ্ছে, পর্যটকের সংখাও নেহাত কম নয়। কিন্তু ভেতরে এক আশ্চর্য নীরবতা, শান্ত সমাহিত পরিবেশ। মাঝে মধ্যে ঘণ্টা ধ্বনি ভেসে আসছে। নিজের ইচ্ছা পূরণের জন্য কেউ কেউ ঘণ্টায় আঘাত করছে, কেউ বা প্যাগোডার ছোট চুড়োয় বা বুদ্ধ মূর্তিতে পানি আর ফুল দিচ্ছে। নবীন সন্ন্যাসীদের সঙ্গে ভাব জমানোর চেষ্টা করতেই তারা সোৎসাহে আমার সাথে ছবি তুলতে চাইল। অবাক করা বিষয় হচ্ছে ওদের মধ্যে একজন আবার বাংলাদেশি, বাড়ি চট্টগ্রামের রাউজান। সাত বছর ধরে এখানে আছে, ভালো বাংলা বলতে পারে না। একটা বড় ঘন্টা আছে চাতালের মধ্যে ঘন্টাটির নাম ‘মহাগন্ধা’ বা মিষ্টি গন্ধের ঘন্টা। এর আরেক নাম সিংগু মিন ঘন্টা। এর ভেতর বসে প্রার্থনা করছে অনেকে। ১৭৭৯ সালে তৈরি ব্রোঞ্জের এই ঘন্টাটির ওজন প্রায় ২৩ টন। ১৮২৪ সালে ইঙ্গ-বর্মা যুদ্ধের পর ইংরেজরা এই প্যাগোডা দখল করে এই ঘন্টাটি সরিয়ে ফেলে ধারণা করা হয়। এখন যে ঘন্টাটি আছে এটি নাকি ১৮২৭ সালে পুনঃস্থাপিত হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ এবং কয়েকটি ভূমিকম্পের পর শেওয়ে ডাগোন প্যাগোডা অনেকবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়, আবার মেরামতও করা হয়।
সন্ধ্যা নেমে আসছে, চূড়ার আলো লালচে আভা ছড়াচ্ছে, গাইডের সংকেত মেনে আস্তে আস্তে নেমে আসতে থাকি শেওয়ে ডাগোন প্যাগোডা ছেড়ে, বের হবার আগে ইচ্ছাপূরণের ঘন্টাটি বাজিয়ে আসতে ভুল করল না প্রায় কেউই।
No comments