স্মরণ-লালনগীতির মকছেদ আলী সাঁই by ম. মনিরউজ্জামান
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কণ্ঠশিল্পী, গীতিকার ও সুরকার মকছেদ আলী সাঁইয়ের অবদান যেমন শব্দসৈনিক হিসেবে স্মরণযোগ্য, তেমনি বাংলাদেশ স্বাধীনতা-উত্তরকালে নানা বাদ্যযন্ত্র সহযোগে লালনগীতি পরিবেশনার যে ধারা আন্তর্জাতিকভাবে প্রসারিত হয়েছে; তাতেও রয়েছে তাঁর পথিকৃৎ ভূমিকা।
তিনি জন্মগ্রহণ করেন ১৯৩৫ (মতান্তরে ১৯৩৩) খ্রিষ্টাব্দে কুষ্টিয়া শহরের হরিশঙ্করপুর গ্রামে। বাবার নাম আবদুর রশিদ খান। মা-নিগার নেছা। পিতৃ-পদবি ‘খান’; ‘সাঁই’ তাঁর নিজের আরোপিত।
মকছেদ আলী সাঁই লালনগীতির পরিশীলিত কণ্ঠশিল্পী ছিলেন, সাধক ছিলেন না। নামের শেষে পূর্বপুরুষের পদবি ‘খান’ বাদ দিয়ে নিজে ‘সাঁই’ যোগ করেছিলেন; এবং সে নামেই তিনি বেশি পরিচিত। প্রথম জীবনে শাস্ত্রীয় সংগীত ছাড়াও অনুশীলন করতেন গণসংগীত, নজরুলগীতি ও অন্যান্য সংগীত। যাত্রা দলেও ছিলেন কিছুকাল। পেশা হিসেবে কুষ্টিয়া তহশিল অফিসে এসএ জরিপকালে (১৯৬২) অস্থায়ীভাবে নিয়োজিত থাকার পরে আনসার কমান্ডার হিসেবে চাকরি করেছেন ১৯৭১-এর আগে। শাস্ত্রীয় সংগীত চর্চায় তাঁর প্রথম শিক্ষাগুরু ওস্তাদ ওসমান গণি। গত শতাব্দীর ষাটের দশকে কয়েকজন শুভাকাঙ্ক্ষীর দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে লালনগীতি শেখার প্রতি বিশেষ মনোযোগী হন।
১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে দেশভাগের আগে অমূল্য শাহ নামের এক বিশিষ্ট লালনগীতির কণ্ঠশিল্পী বর্ধমান-বীরভূম অঞ্চলের বাউলদের অনুসরণে ডান হাতে একতারা এবং বাঁ হাতে বায়া বাজিয়ে বিভিন্ন আসরে দাঁড়িয়ে লালনের গান গাইতে শুরু করলে লালনগীতি পরিবেশনের একটি নতুন ধারা প্রবর্তিত হয়। পরবর্তী সময়ে এ ধারাটি বজায় ছিল সুকণ্ঠের অধিকারী বেহাল শাহ, নিমাই শাহ, খোদা বক্স শাহ (জাঁহাপুর) প্রমুখের মাধ্যমে। মকছেদ আলী সাঁইয়ের সুযোগ হয়েছিল তিনজনের অন্তরঙ্গ সান্নিধ্য লাভ করা। যার ফলে অমূল্য শাহের গায়কি-ঢংটি অপ্রত্যক্ষভাবে তাঁর ওপর প্রভাব ফেলে। অন্যদিকে লালনশিষ্য ভোলাই শাহের মাধ্যমে প্রচলনকৃত ইসমাইল ফকির, ফকির গোলাম ইয়াছিন, মোতাহার খন্দকার প্রমুখ যাঁরা পরিচিত ছিলেন ‘ছেঁউড়িয়া ঘরনা’ বলে, তাঁদের গায়কি ধরন-ধারণ সম্পর্কে বিশেষভাবে অবগত ছিলেন তিনি। এঁদের সহায়তায় মকছেদ আলী সাঁই লালনগীতি শিখেছিলেন। লালনের গানে রাগ-রাগিণী, রামপ্রাসাদী, কীর্তন, ধুয়া গানের সুর প্রভৃতির সন্ধান তিনিই প্রথম করেন।
পারিপার্শ্বিক প্রভাবের সমন্বয়ে সংগীত জগতের পরিশীলিত কণ্ঠশিল্পী মকছেদ আলী সাঁই যখন নিজস্ব ভঙ্গিতে নানা ধরনের বাদ্যযন্ত্র ব্যবহারের মধ্য দিয়ে লালনগীতি গাওয়া শুরু করলেন এবং পাশাপাশি আরও অনেক শিল্পীর কণ্ঠে তাঁর পরিবেশিত ভঙ্গির গান তুলে দিলেন—তখন সহজে এ ধারা জনপ্রিয়তা পায়। বর্তমানে অনেকে লালনগীতি পরিবেশনে অনুসরণ করছেন মকছেদ আলী সাঁইয়ের ধরন-ভঙ্গি। ফরিদা পারভীন, ইন্দ্রমোহন রাজবংশী, চন্দনা মজুমদার, কিরণচন্দ্র রায়, রেবা সরকার, বিউটি প্রমুখ এ ধারারই সার্থক উত্তরসুরি।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহ নাগাদ ভারতে গিয়ে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। গীতিকার ও সুরকার হিসেবে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত তাঁর ‘সোনায় মোড়ানো বাংলা মোদের, শ্মশান করেছে কে?/এহিয়া তোমায় আসামির মতো জবাব দিতে হবে’—গানটি খুবই জনপ্রিয় হয়েছিল। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে তাঁর অন্যান্য উল্লেখযোগ্য গান হচ্ছে ১. ‘বাংলাদেশের খাঁটি মানুষ, শেখ মুজিবুর জেনো ভাই’ ২. ‘ওগো আগুন, ওগো সূর্যের আলো’ ৩. ‘চোখের জলে বুকের রক্তে সারাটা দেশ ভেসেছে’ ৪. ‘মাগো আমার কেঁদো নাকো তুমি’ ৫. ‘আমায় তুমি খুঁজছ কি মা আকাশের তারায়’ ৬. ‘শান্তির দূত রে শ্বেতকপোত উড়ে যা বাংলাদেশে’।
১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতার ‘হিন্দুস্তান মিউজিক্যাল প্রোডাক্ট লিমিটেড’ রেকর্ড কোম্পানি মকছেদ আলী সাঁইয়ের দুটি লালনগীতি (১. ‘গৌর প্রেম করবি যদি’ ২. ‘আপন ঘরের নে না’ প্রকাশ করে গ্রামোফোনের রেকর্ডে।
স্বাধীনতার পর ঢাকা বেতার কেন্দ্রে চালু হয়েছিল ‘ট্রান্সক্রিপশন সার্ভিস’ নামের একটি বিভাগ। এই বিভাগে সংগীত পরিচালক হিসেবে তিনি কয়েক বছর নিয়োজিত ছিলেন। তখন দেশের বহু অবহেলিত ও অখ্যাত শিল্পী সংগ্রহ করে তাঁদের কণ্ঠের গান টেপ রেকর্ডারে ধারণ করার উদ্যোগ গ্রহণ করার ক্ষেত্রে তাঁর অগ্রণী ভূমিকা বিশেষভাবে স্মরণীয়।
মকছেদ আলী সাঁইয়ের লেখা গান নানা সময়ে পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। এ ছাড়া তাঁর রচিত অধিকাংশ গান ও প্রবন্ধ রয়েছে এখন পর্যন্ত অপ্রকাশিত। লালন শাহের সাধক জীবনের ওপর ভিত্তি করে তিনি কীর্তি লালন [কীর্তিমান লালন?] শিরোনামে একটি নাটক লেখার পরিকল্পনা করেছিলেন, এর চার অঙ্কের কিছু দৃশ্যের খসড়া অংশ পাওয়া গেছে। সে দিনের এই দিন (মার্চ ১৯৮১) নামের লালনবিষয়ক একটি পুস্তিকা মকছেদ আলী সাঁই মৃত্যুর কয়েক মাস আগে প্রকাশ করেছিলেন গোলাম ইয়াছিন শাহের সঙ্গে যৌথ সম্পাদনায়। ১৭ জুন ১৯৮১ সালে হঠাৎ তাঁর মৃত্যু হয় হরিশঙ্করপুর গ্রামের পৈতৃক বাড়িতে। মকছেদ আলী সাঁইয়ের মৃত্যুদিনে তাঁর স্মৃতির প্রতি নিবেদন করি গভীর শ্রদ্ধা।
মকছেদ আলী সাঁই লালনগীতির পরিশীলিত কণ্ঠশিল্পী ছিলেন, সাধক ছিলেন না। নামের শেষে পূর্বপুরুষের পদবি ‘খান’ বাদ দিয়ে নিজে ‘সাঁই’ যোগ করেছিলেন; এবং সে নামেই তিনি বেশি পরিচিত। প্রথম জীবনে শাস্ত্রীয় সংগীত ছাড়াও অনুশীলন করতেন গণসংগীত, নজরুলগীতি ও অন্যান্য সংগীত। যাত্রা দলেও ছিলেন কিছুকাল। পেশা হিসেবে কুষ্টিয়া তহশিল অফিসে এসএ জরিপকালে (১৯৬২) অস্থায়ীভাবে নিয়োজিত থাকার পরে আনসার কমান্ডার হিসেবে চাকরি করেছেন ১৯৭১-এর আগে। শাস্ত্রীয় সংগীত চর্চায় তাঁর প্রথম শিক্ষাগুরু ওস্তাদ ওসমান গণি। গত শতাব্দীর ষাটের দশকে কয়েকজন শুভাকাঙ্ক্ষীর দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে লালনগীতি শেখার প্রতি বিশেষ মনোযোগী হন।
১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে দেশভাগের আগে অমূল্য শাহ নামের এক বিশিষ্ট লালনগীতির কণ্ঠশিল্পী বর্ধমান-বীরভূম অঞ্চলের বাউলদের অনুসরণে ডান হাতে একতারা এবং বাঁ হাতে বায়া বাজিয়ে বিভিন্ন আসরে দাঁড়িয়ে লালনের গান গাইতে শুরু করলে লালনগীতি পরিবেশনের একটি নতুন ধারা প্রবর্তিত হয়। পরবর্তী সময়ে এ ধারাটি বজায় ছিল সুকণ্ঠের অধিকারী বেহাল শাহ, নিমাই শাহ, খোদা বক্স শাহ (জাঁহাপুর) প্রমুখের মাধ্যমে। মকছেদ আলী সাঁইয়ের সুযোগ হয়েছিল তিনজনের অন্তরঙ্গ সান্নিধ্য লাভ করা। যার ফলে অমূল্য শাহের গায়কি-ঢংটি অপ্রত্যক্ষভাবে তাঁর ওপর প্রভাব ফেলে। অন্যদিকে লালনশিষ্য ভোলাই শাহের মাধ্যমে প্রচলনকৃত ইসমাইল ফকির, ফকির গোলাম ইয়াছিন, মোতাহার খন্দকার প্রমুখ যাঁরা পরিচিত ছিলেন ‘ছেঁউড়িয়া ঘরনা’ বলে, তাঁদের গায়কি ধরন-ধারণ সম্পর্কে বিশেষভাবে অবগত ছিলেন তিনি। এঁদের সহায়তায় মকছেদ আলী সাঁই লালনগীতি শিখেছিলেন। লালনের গানে রাগ-রাগিণী, রামপ্রাসাদী, কীর্তন, ধুয়া গানের সুর প্রভৃতির সন্ধান তিনিই প্রথম করেন।
পারিপার্শ্বিক প্রভাবের সমন্বয়ে সংগীত জগতের পরিশীলিত কণ্ঠশিল্পী মকছেদ আলী সাঁই যখন নিজস্ব ভঙ্গিতে নানা ধরনের বাদ্যযন্ত্র ব্যবহারের মধ্য দিয়ে লালনগীতি গাওয়া শুরু করলেন এবং পাশাপাশি আরও অনেক শিল্পীর কণ্ঠে তাঁর পরিবেশিত ভঙ্গির গান তুলে দিলেন—তখন সহজে এ ধারা জনপ্রিয়তা পায়। বর্তমানে অনেকে লালনগীতি পরিবেশনে অনুসরণ করছেন মকছেদ আলী সাঁইয়ের ধরন-ভঙ্গি। ফরিদা পারভীন, ইন্দ্রমোহন রাজবংশী, চন্দনা মজুমদার, কিরণচন্দ্র রায়, রেবা সরকার, বিউটি প্রমুখ এ ধারারই সার্থক উত্তরসুরি।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহ নাগাদ ভারতে গিয়ে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। গীতিকার ও সুরকার হিসেবে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত তাঁর ‘সোনায় মোড়ানো বাংলা মোদের, শ্মশান করেছে কে?/এহিয়া তোমায় আসামির মতো জবাব দিতে হবে’—গানটি খুবই জনপ্রিয় হয়েছিল। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে তাঁর অন্যান্য উল্লেখযোগ্য গান হচ্ছে ১. ‘বাংলাদেশের খাঁটি মানুষ, শেখ মুজিবুর জেনো ভাই’ ২. ‘ওগো আগুন, ওগো সূর্যের আলো’ ৩. ‘চোখের জলে বুকের রক্তে সারাটা দেশ ভেসেছে’ ৪. ‘মাগো আমার কেঁদো নাকো তুমি’ ৫. ‘আমায় তুমি খুঁজছ কি মা আকাশের তারায়’ ৬. ‘শান্তির দূত রে শ্বেতকপোত উড়ে যা বাংলাদেশে’।
১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতার ‘হিন্দুস্তান মিউজিক্যাল প্রোডাক্ট লিমিটেড’ রেকর্ড কোম্পানি মকছেদ আলী সাঁইয়ের দুটি লালনগীতি (১. ‘গৌর প্রেম করবি যদি’ ২. ‘আপন ঘরের নে না’ প্রকাশ করে গ্রামোফোনের রেকর্ডে।
স্বাধীনতার পর ঢাকা বেতার কেন্দ্রে চালু হয়েছিল ‘ট্রান্সক্রিপশন সার্ভিস’ নামের একটি বিভাগ। এই বিভাগে সংগীত পরিচালক হিসেবে তিনি কয়েক বছর নিয়োজিত ছিলেন। তখন দেশের বহু অবহেলিত ও অখ্যাত শিল্পী সংগ্রহ করে তাঁদের কণ্ঠের গান টেপ রেকর্ডারে ধারণ করার উদ্যোগ গ্রহণ করার ক্ষেত্রে তাঁর অগ্রণী ভূমিকা বিশেষভাবে স্মরণীয়।
মকছেদ আলী সাঁইয়ের লেখা গান নানা সময়ে পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। এ ছাড়া তাঁর রচিত অধিকাংশ গান ও প্রবন্ধ রয়েছে এখন পর্যন্ত অপ্রকাশিত। লালন শাহের সাধক জীবনের ওপর ভিত্তি করে তিনি কীর্তি লালন [কীর্তিমান লালন?] শিরোনামে একটি নাটক লেখার পরিকল্পনা করেছিলেন, এর চার অঙ্কের কিছু দৃশ্যের খসড়া অংশ পাওয়া গেছে। সে দিনের এই দিন (মার্চ ১৯৮১) নামের লালনবিষয়ক একটি পুস্তিকা মকছেদ আলী সাঁই মৃত্যুর কয়েক মাস আগে প্রকাশ করেছিলেন গোলাম ইয়াছিন শাহের সঙ্গে যৌথ সম্পাদনায়। ১৭ জুন ১৯৮১ সালে হঠাৎ তাঁর মৃত্যু হয় হরিশঙ্করপুর গ্রামের পৈতৃক বাড়িতে। মকছেদ আলী সাঁইয়ের মৃত্যুদিনে তাঁর স্মৃতির প্রতি নিবেদন করি গভীর শ্রদ্ধা।
No comments