কমনওয়েলথ স্কাউট সম্মেলন-লন্ডনে রানি-দর্শন by সিদ্ধার্থ মজুমদার
মাত্র ২৬ বছর বয়সে যুক্তরাজ্যের রানি হয়ে বসেছিলেন দ্বিতীয় এলিজাবেথ। আর এ বছরই তাঁর সিংহাসনে আরোহণের পূর্ণ হলো ৬০ বছর। বছরের শুরু থেকেই তাই যুক্তরাজ্য জুড়ে উৎসবের আমেজ। উৎসবের রং তারা ছড়িয়ে দিল প্রায় সারা পৃথিবীতে। তারা কেমন করে ছড়াল এই হীরকজয়ন্তীর আলো?
তারা দেশে দেশে আমন্ত্রণপত্র পাঠাল দুজন করে প্রতিনিধি পাঠানোর জন্য। আর শর্ত জুড়ে দিল, বয়স হতে হবে পঁচিশের মধ্যে। নিজ দেশের স্কাউটসের সর্বোচ্চ অ্যাওয়ার্ডধারীও হতে হবে অংশগ্রহণকারীকে। এমন সব শর্ত আর পরীক্ষা পর্ব শেষে তৈরি হলো বাংলাদেশ প্রতিনিধিদল। দুজনের এই প্রতিনিধিদলের মধ্যে ছিলাম আমিও। আরেকজন, সরকার তৌফিক প্রীতম। সবকিছু ঠিকঠাক হওয়ার পর নির্দিষ্ট দিনে আমরা পাড়ি দিলাম সুদূর যুক্তরাজ্যের উদ্দেশে।
লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দরে মোটামুটি জড়ভরত হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। একেক জন লটবহর নিয়ে হাসি হাসি মুখে ইমিগ্রেন্ট কর্মকর্তাদের কাছে এগিয়ে যান আর কিছুক্ষণের মধ্যেই তাঁর মুখ কেন যেন অন্ধকার হয়ে আসে। যার মুখ যত অন্ধকার হয়, কর্মকর্তাদের মুখের হাসি হয় তত চওড়া। যেসব কাগজ দেখাতে হবে, সেগুলো হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি অনেকক্ষণ, আমাদের পালা আসতেই হুড়মুড় করে কাগজগুলো ধরিয়ে দিলাম। এমনিতেই শীতের দেশ, হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যাওয়ার কথা, উল্টো ঘাম দেখা দিয়েছে কপালে। ইমিগ্রেশনের লাইনে দাঁড়িয়ে কানাঘুষা শুনছিলাম, সন্তোষজনক কাগজপত্র না থাকলে এরা বড় ঝামেলা করে। কখনো নাকি আলাদা ঘরে নিয়ে জামা প্যান্ট...। এসব চিন্তা শেষ হওয়ার আগেই কর্মকর্তাটি মুখ উদাস করে বললেন, ‘ইংল্যান্ড যাত্রা আপনার শুভ হোক। আপনি যেতে পারেন।’ কথাটা হজম করতে যখন সময় লাগছিল, তখন তিনি বুঝিয়ে বললেন, ‘আমাদের রানির অনুষ্ঠানে যেহেতু যোগ দিতে যাচ্ছেন, তখন তো আপনাকে দেরি করিয়ে দেওয়াটা খুব অন্যায় হবে! তাই না।’ রানির অনুষ্ঠানের এক টুকরো আমন্ত্রণপত্র সব ঝামেলা থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছে আমাদের।
২৯ এপ্রিল, লন্ডন। প্রচণ্ড ঝোড়ো বাতাস আর বৃষ্টি শুরু হলো। খোদ ইংরেজরা বলল, এবারের বৃষ্টিটা একটু বেশিই জ্বালাচ্ছে। বৃষ্টি মাথায় করে আমরা হাজির উইন্ডসর প্রাসাদের চত্বরে রানি দর্শনে। আমরা বলতে কমনওয়েলভুক্ত অসংখ্য দেশ। ইংল্যান্ড তো রয়েছেই। এ ছাড়া অ্যান্টিগো বারমুডা, অস্ট্রেলিয়া, বাহামাস, কানাডা, ঘানা, জামাইকা, কিরবাতি, নিউজিল্যান্ড, সেন্ট লুসিয়া, সিঙ্গাপুর, সাউথ আফ্রিকা, সোয়াজি ল্যান্ড—এমন সব দেশ মিলে অন্তত ৫০টি দেশের প্রতিনিধি এখানে। রানির সঙ্গে সাক্ষাতে আমরা যখন অধীর আগ্রহে বসে আছি, তখন হাজির একদল রাজকীয় সেনাবাহিনী। তারা আমাদের বলল, ‘এমন করে তো রানির সামনে যাওয়া যাবে না। তোমাদের খানিকটা প্রশিক্ষণ দিতে হবে।’ আমরা সমস্বরে বললাম, ‘দেও প্রশিক্ষণ।’ রাজকীয় বাহিনী আমাদের জানাল, তেমন কোনো কঠিন ব্যাপার না, রানির সামনে যখন হেঁটে যাবেন, তখন বুকটা উঁচু আর মুখটা হাসি হাসি করে রাখতে হবে। মনে মনে বললাম, এ কেমন ঢং! এত কাছ থেকে রানিকে দেখব, আনন্দে মুখটা তো হাসি হাসিই থাকবে। শুরু হলো প্রশিক্ষণ। দাবার চাল পুরোপুরি উল্টে গেল। হাসি কোথায় পালিয়ে গেল! শীতের পোশাক ছাড়া শুরু হলো প্রশিক্ষণ। ঠান্ডা বাতাসে বরফ হয়ে যাওয়ার জোগাড় তখন। আমার সামনে অ্যান্টিগো বারমুডার থেকে আসা মাইকেল দাঁড়ানো। ওর সঙ্গে আমার বেশ একটা বন্ধুত্ব হয়েছে। ও একটু পরপর বলছে, ‘আমি মনে হয় মারা যাচ্ছি।’ আমি আমার মুখটা হাসি হাসি করতে চাইলাম, কিন্তু গোল হয়ে গেল। ওকে সান্ত্বনা দিয়ে বললাম, আমি যেহেতু এখনো মারা যাইনি, তুমিও হয়তো মারা যাবে না। আমাদের পাশ কাটিয়ে গেল একদল স্কটিশ ছেলে। তাদের সবার মুখে হাসি এগাল-ওগাল জোড়া। সব স্কটিশ ছেলে তাদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরে আছে। পোশাক বলতে ওপরে জামার মতো একটা জিনিস আর নিচে মেয়েদের স্কাটের আদলে তৈরি একরকম কাপড়। উদোম পা। মোটামুটি জেদ চেপে গেল, আমরা তো অন্তত ফুলপ্যান্ট পরে আছি। তারপর কী হলো? মাংসপেশি শক্ত হয়ে হাসি পাকাপাকি মুখে আটকে গেল। চাইলেও মুখ আর স্বাভাবিক করতে পারি না। অবস্থা এমন যে পড়েছি ব্রিটিশদের হাতে, খানা না হোক, তবুও হাসতে হবে সাথে!
একসময় রাজকীয় বাদক দল তাদের যন্ত্রে সুর তুলল। সুর ধ্বনিত হলো উইন্ডসর প্রাসাদের পাথরের দেয়ালে। আস্তে-ধীরে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি রানির দিকে। রাজকীয় সৈন্য-সামন্ত পেছনে ফেলে আমরা দৃপ্তপায়ে এগিয়ে যাচ্ছি। রানি শুধুই আমাদের অপেক্ষায়! বড় সুখ হলো সেদিন। কই, কোথাও তো আর শীত নেই। ঘোষণা হতে থাকল একেকটা দেশের নাম। এবার ‘বাংলাদেশ’। আমি আমার দেশের নামটাও শুনলাম। রানি হাত নাড়লেন, ছোট্ট করে ধন্যবাদ দিলেন। মুখের হাসি তখন আমার এগাল থেকে ওগাল ছড়িয়েছে।
রাজকীয় অনুষ্ঠান শেষে প্রাসাদ চত্বরেই দেখা হয়ে গেল বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মো. সায়েদুর রহমান খানের সঙ্গে। আমাদের দেখে খুশিটা যেন তাঁর আরও বাড়ল। কাকে যেন ডেকে দেখালেনও, ‘দেখো, আমার দেশের ছেলে। ওরাও আমন্ত্রিত হয়ে এসেছে এ দেশে।’ তাঁর তৃপ্ত চোখ দেখে এই রাজকীয় অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার গুরুত্ব আবার নতুন করে বুঝলাম।
No comments