বীর মুক্তিযোদ্ধা-তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না

৪১০ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন মনিরুল ইসলাম, বীর প্রতীক সাহসী এক যোদ্ধার কথা সীমান্ত এলাকা থেকে কিছুটা দূরে কালাছড়া চা-বাগান। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার অন্তর্গত। ভারতে মুক্তিযোদ্ধা শিবিরে খবর এল, ওই চা-বাগানে একদল পাকিস্তানি সেনা অবস্থান নিয়েছে।


মুক্তিযোদ্ধাদের অধিনায়ক সিদ্ধান্ত নিলেন পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণের।
শুরু হলো প্রস্তুতি। গঠিত হলো কয়েকটি দল। একটি দলে অন্তর্ভুক্ত হলেন মনিরুল ইসলাম। মুক্তিযোদ্ধা সব মিলে দুই কোম্পানি। তাঁদের মধ্যে প্রায় অর্ধেক স্বল্প প্রশিক্ষণ নেওয়া মুক্তিযোদ্ধা। বাকিরা পেশাদার। কেউ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, কেউ ইপিআরের। মনিরুল ইসলাম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের।
মুক্তিযোদ্ধাদের অধিনায়ক খবর নিয়ে জানতে পারলেন, কালাছড়া চা-বাগানে অবস্থান নেওয়া পাকিস্তানি সেনা সংখ্যায় অনেক। প্রায় এক কোম্পানি। আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত। এত বড় দলকে প্রথাগত আক্রমণ করতে হলে চার গুণ শক্তি প্রয়োজন। কিন্তু তাঁদের শক্তি মাত্র দ্বিগুণ। তার পরও আক্রমণের সিদ্ধান্ত বহাল থাকল। এ ঘটনা অক্টোবর মাসে।
একদিন রাতে মুক্তিযোদ্ধারা সীমান্ত অতিক্রম করে মধ্যরাতে অবস্থান নিলেন কালাছড়া চা-বাগানের কাছে। সেখানে দুটি দলে বিভক্ত হয়ে ভোরে একযোগে আক্রমণ চালালেন পাকিস্তানি সেনাদের। শুরু হলো ভয়াবহ যুদ্ধ। তুমুল গোলাগুলিতে সুমসাম এলাকা নিমেষে রণক্ষেত্রে পরিণত হলো।
মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল পাকিস্তানি সেনাদের পাল্টা আক্রমণ উপেক্ষা করে সাহসিকতার সঙ্গে এগিয়ে যায় চা-বাগানে। এই দলে ছিলেন মনিরুল ইসলাম। তিনি ছিলেন একটি ক্ষুদ্র উপদলের নেতৃত্বে। অপর দল শুরুতেই দুর্ঘটনায় পড়ে। পাকিস্তানি সেনাদের পাল্টা আক্রমণে ওই দলের একজন শহীদ হন এবং বেশ কয়েকজন আহত হন। ফলে থেমে যায় তাঁদের অগ্রযাত্রা!
মনিরুল ইসলাম ও তাঁর সহযোদ্ধাদের বীরত্বে তছনছ হয়ে গেল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একাংশের প্রতিরক্ষা। প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে পাকিস্তানি সেনারা আশ্রয় নিল সুরক্ষিত বাংকারে। মনিরুল ইসলাম কয়েকজন সহযোদ্ধাকে নিয়ে দুঃসাহসিকতার সঙ্গে গ্রেনেড হামলা চালালেন বাংকারে। হতাহত হলো কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা। এতে পর্যদুস্ত হয়ে পড়ল পাকিস্তানি সেনারা। এই সুযোগে মুক্তিযোদ্ধাদের অন্যান্য উপদল একযোগে সাঁড়াশি আক্রমণ শুরু করল।
তুমুল যুদ্ধের একপর্যায়ে পাকিস্তানি সেনারা নিহত ও আহত সহযোদ্ধাদের ফেলে পালিয়ে গেল। সেদিন যুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অনেক নিহত হয়। যুদ্ধশেষে মুক্তিযোদ্ধারা গণনা করে দেখেন ২৭ জন পাকিস্তানি সেনার মৃতদেহ বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছে। পরে গ্রামবাসীর সহায়তায় মক্তিযোদ্ধারা সেই মৃতদেহগুলো দাফন করে। আহতদের ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছে হস্তান্তর করে। এই যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে দুজন শহীদ ও সাতজন আহত হন।
মনিরুল ইসলাম চাকরি করতেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে। ১৯৭১ সালে এই রেজিমেন্টের অবস্থান ছিল কুমিল্লার ময়নামতি সেনানিবাসে। তখন তাঁর পদবি ছিল হাবিলদার। মার্চ মাসে চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট সেনানিবাসের বাইরে মোতায়েন ছিল। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তাঁরা ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। প্রতিরোধযুদ্ধ শেষে প্রথমে যুদ্ধ করেন ২ নম্বর সেক্টরের গঙ্গাসাগর সাব সেক্টরে। পরে ‘কে’ ফোর্সের নবম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধীনে। আখাউড়া, কর্নেল বাজার ও মুকন্দপুরসহ আরো কয়েক স্থানে সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধ করেন।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য মনিরুল ইসলাম বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত হন। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ৯৭।
মনিরুল ইসলাম স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ সেনাবাহিনী থেকে ১৯৮১ সালে অবসর নেন। তখন তাঁর পদবী ছিল নায়েব সুবেদার। তাঁর পৈতৃক বাড়ি টাঙ্গাইল জেলার বাসাইল উপজেলার কাশিল ইউনিয়নের কামুটিয়া গ্রামে। বাবার নাম সাহেব আলী, মা হালিমা বেগম। স্ত্রী মমতাজ বেগম। তাঁদের তিন ছেলে। মনিরুল ইসলাম বর্তমানে অসুস্থ। শরীরের বাঁ অংশের একাংশ অবশ হয়ে গেছে।
সূত্র: প্রথম আলোর সখীপুর (টাঙ্গাইল) প্রতিনিধি ইকবাল গফুর এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ দলিলপত্র, দশম খণ্ড।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.