সপ্তাহের হালচাল-‘ভূমিদস্যু’ ঠেকাতে দল ঠিক রাখুন by আব্দুল কাইয়ুম
মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে স্বয়ং পূর্ত প্রতিমন্ত্রীকে সেদিন দেশের শীর্ষস্থানীয় আবাসন ব্যবসায়ীরা যেভাবে অপদস্থ করেছেন, তা এককথায় নজিরবিহীন। সেখানে ঢাকা মহানগরের বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা বা ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যান (ড্যাপ) নিয়ে নগর পরিকল্পনাবিদ ও আবাসনব্যবসার সঙ্গে সম্পর্কিত নেতাদের সঙ্গে প্রতিমন্ত্রীর বৈঠক ছিল।
ওই বৈঠকে সরকারদলীয় সাংসদ নসরুল হামিদও উপস্থিত ছিলেন। তিনি এসেছিলেন রিহ্যাবের সভাপতি হিসেবে। প্রতিমন্ত্রীর বিরোধী পক্ষে ছিল তাঁর অবস্থান। ঘটনার পর সন্ধ্যায় প্রথিতযশা সাংবাদিক ও কলাম লেখক এবিএম মূসা মুঠোফোনে উত্তেজিত কণ্ঠে বলেন, ‘খবর শুনেছ?’ আমি বলি, ‘খবর তো অনেক, কোনটার কথা বলছেন?’ তিনি বললেন, ‘আজ তো পূর্তমন্ত্রীর সঙ্গে ভূমি ব্যবসায়ীদের কথাকাটাকাটি থেকে শুরু করে প্রায় হাতাহাতি হয়ে গেছে!’ আমি বললাম, ‘মন্ত্রীর নিরাপত্তারক্ষীরা তাহলে কী করলেন?’ এবার মূসা ভাই আমার অজ্ঞতায় হেসে ফেলে বললেন, ‘ওরা তো সারা বাংলাদেশ কিনে রেখেছে, কে তাদের ধরবে?’ তিনি বললেন, ‘আজ রাতে বাংলাভিশনে আমার টক শো দেখবা, ওদের আমি ধৃষ্টতা সম্পর্কে প্রশ্ন করব।’
পরদিন পত্রিকায় দেখেছি, প্রতিমন্ত্রীকে হুমকির ঘটনায় মন্ত্রিসভার অন্য সদস্যরা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। জানা গেছে, ‘ভূমিদস্যুদের’ আচরণে প্রধানমন্ত্রী অসন্তুষ্ট হয়েছেন। তিনি একান্তভাবেই চাইছেন, রাজধানী ঢাকা যেন বসবাসযোগ্য থাকে। কিছু অর্থলোলুপ ব্যবসায়ীর নির্বিচার ভূমিগ্রাস ঠেকাতে তিনি আগ্রহী। এ ব্যাপারে প্রতিমন্ত্রী আবদুল মান্নান খান সঠিক অবস্থান গ্রহণ করেছেন বলে তিনি মনে করেন।
সোমবার মন্ত্রিসভার বৈঠকে বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) বাস্তবায়নে রাজধানী ঢাকা ও এর পার্শ্ববর্তী এলাকার জলাভূমি ও জলাশয় চিহ্নিত করে গেজেট করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ঢাকার চারপাশের জলাশয় ও কৃষিজমি রক্ষা করতে হবে। এ ব্যাপারে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। রাজধানীর সার্বিক উন্নয়নের জন্য ড্যাপ বাস্তবায়ন করতে হবে।
কিন্তু যেখানে প্রধানমন্ত্রী ভূমিগ্রাস ঠেকাতে চান, সেখানে তাঁরই দলের সাংসদেরা উল্টা মোচড় দিয়ে বসেছেন। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত সংবাদে দেখা যাচ্ছে, ঢাকার সাংসদেরা নাকি ড্যাপ কার্যকর হতে দিতে চান না। তাঁরা দাবি করছেন, ড্যাপ কার্যকর হলে তাঁদের নির্বাচনী এলাকার নাকি বিরাট ক্ষতি হয়ে যাবে। অথচ ড্যাপ হঠাৎ করে তৈরি হয়নি। সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ ও বিভিন্ন মহলের সঙ্গে আলোচনা ও মতবিনিময়ের মধ্য দিয়ে ঢাকা মহানগরের সার্বিক মঙ্গলের কথা চিন্তা করে এই পরিকল্পনা তৈরি করা হয়েছে। এমনকি যে সাংসদদের আপত্তির কথা এখন পত্রিকায় বলা হচ্ছে, তাঁদের সঙ্গেও আলোচনা হয়েছে। এ ব্যাপারে রাজউকের চেয়ারম্যান নূরুল হুদা বলেছেন, ‘২০০৪ সালে ড্যাপ প্রণয়নের প্রক্রিয়া শুরু হওয়ায় তখনকার সাংসদেরা বিষয়টি সম্পর্কে অবহিত ছিলেন। ...বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর পুনরায় সাংসদদের অবহিত করার সিদ্ধান্ত নেয় মন্ত্রণালয়। সে জন্য আহূত প্রথম সভায় সংশ্লিষ্ট সাংসদেরা ড্যাপের পরিবর্তে রাজউকের অতীত কর্মকাণ্ড নিয়ে আলোচনা করেন। তখন মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত নেয় যে সংশ্লিষ্ট সাংসদদের প্রত্যেককে আলাদাভাবে ডেকে তাঁর এলাকার বিষয়ে আলোচনা করা হবে। সেটা করাও হয়েছে এবং ৫৯০ বর্গমাইল এলাকার ঢাকা মহানগরের অন্তর্ভুক্ত প্রতিটি এলাকার সাংসদ এটা শুনেছেন। লিখিতভাবে মতামতও দিয়েছেন। নসরুল হামিদও দিয়েছেন’ (প্রথম আলো, ১৫ জুন ২০১০)।
রাজউকের চেয়ারম্যানের কথা এতই সুনির্দিষ্ট যে অবিশ্বাসের কোনো সুযোগ নেই। তাহলে এখন দেখতে হবে, সাংসদদের বরাতে যে আপত্তির কথা পত্রিকায় ছাপা হয়েছে সেগুলো কি তাঁদের কথা, নাকি অন্য কারও কথা তাঁদের মুখে চালিয়ে দেওয়া হয়েছে। কারণ প্রধানমন্ত্রীর কথার সঙ্গে দলের সাংসদদের দ্বিমত থাকলে তো প্রথমে দলের মধ্যে তাঁদের আলোচনা করা উচিত।
অবশ্য সাংসদদের মধ্যে যে ড্যাপের বিরোধিতা আছে, তা সেদিন পূর্তমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের সময়ই বোঝা গেছে। ওই বৈঠকে রিহ্যাবের সভাপতি, সরকারি দলের সাংসদ নসরুল হামিদ সরাসরি বিরোধিতা করে বলেছিলেন, ড্যাপের পর্যালোচনা প্রতিবেদন মেনে নেওয়া যায় না। তাহলে প্রতিমন্ত্রী কাকে সঙ্গে নিয়ে তাঁর উল্লিখিত ‘ভূমিদস্যুদের’ বিরুদ্ধে দাঁড়াবেন? আর প্রধানমন্ত্রীই বা কী যুক্তি দেবেন? তাঁর নিজের দলের নেতারা যদি তাঁর কথা না শোনেন, তাহলে দেশ চালাবেন কীভাবে?
বিশ্বের কোনো দেশেই অপরিকল্পিতভাবে নগরায়ণ করা হয় না। একটি নির্দিষ্ট পরিকল্পনার অধীনে রাস্তাঘাট, ভবন নির্মাণ, বাণিজ্যিক ও আবাসিক এলাকা নির্ধারণ প্রভৃতি গড়ে তোলা হয়। কিন্তু রাজধানী ঢাকা একশ্রেণীর ভূমি-দুর্বৃত্তের পাল্লায় পড়ে গেছে। তারা রাজউকের নিয়মকানুন মানতে চায় না। সরকারের খাসজমি তো দখল করেই, সাধারণ মানুষকেও কম দামে জমি বিক্রি করতে বাধ্য করে অথবা তাদের জমি স্রেফ জবরদখল করে নেয়। ঢাকার চারপাশের নিম্নাঞ্চলে পানির মধ্যে সাইনবোর্ড লাগিয়ে প্লট বিক্রি করে। টাকার জোরে এসব অপকর্ম ধামাচাপা দিতে তারা সিদ্ধহস্ত।
এই ‘ভূমিদস্যুতা’ অবাধ গতিতে চলছিল। এর প্রতিকারের প্রয়োজন যখন জরুরি হয়ে ওঠে সেই সময়, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ১৯৯৭ সালে কিছু পদক্ষেপ গৃহীত হয়। তারা ‘জলাধার সংরক্ষণ আইন, ২০০০’ পাস করে। ওই আইনে বলা হয়েছে, জলাভূমি ভরাট করা যাবে না। সামান্য বৃষ্টি হলেই যে রাজধানীর বিরাট অংশ ডুবে যায়, তার একটি কারণ হলো বৃষ্টির পানি নেমে যাওয়ার জায়গার অভাব। সুতরাং ভূমি উন্নয়ন ও আবাসিক ভবন নির্মাণের নামে যদি জলাশয় ভরাট চলতে থাকে, তাহলে রাজধানীতে মানুষের বসবাস অসম্ভব হয়ে উঠবে। রাজধানীবাসী এখনই তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। টেকসই উন্নয়নের জন্য যুক্তরাজ্যের একটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের সহায়তায় মহানগর উন্নয়ন পরিকল্পনা (ডিএমডিপি) প্রণীত হয় ১৯৯৩-৯৫ সালে, যা ১৯৯৭ সালে আওয়ামী লীগ সরকার অনুমোদন করে গেজেট প্রকাশ করে। এরই ধারাবাহিকতায় ঢাকা মহানগরের ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যানের (ড্যাপ) খসড়া প্রণয়নের কাজ শুরু হয় ২০০৪ সালে। সম্প্রতি তা পর্যালোচনার মাধ্যমে চূড়ান্ত করা হয়। দেশের বিশিষ্ট নগর পরিকল্পনাবিদ, প্রকৌশলী, স্থপতি, পেশাজীবী প্রমুখ বিশেষজ্ঞের মতামতের ভিত্তিতে এসব করা হয়েছে। তাই কেউ বলতে পারবেন না যে একতরফাভাবে ড্যাপ তৈরি করা হয়েছে। তাহলে আবাসন ব্যবসায়ীদের আপত্তি কেন?
আগেও অনেক চেষ্টা হয়েছে, কিন্তু আবাসন ব্যবসায়ীদের কোনোভাবেই বাগে আনা যায়নি। একপর্যায়ে মনে হচ্ছিল, ওরা বুঝি দুর্দমনীয়। বিভিন্ন সময় ক্ষমতাসীন সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে অনৈতিক লেনদেনের মাধ্যমে ‘ভূমি-দুর্বৃত্তরা’ সমাজে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। সাধারণ মানুষ ছিল অসহায়। চোখের সামনে জমি কেড়ে নেওয়ার ঘটনা ঢাকার চারপাশে এত বেশি ঘটেছে যে তা বলে শেষ করা যাবে না।
কিন্তু যা হোক, শেষ পর্যন্ত সরকার একটা অবস্থান নিয়েছে। রিহ্যাব ফেয়ার ২০০৯-এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিমন্ত্রী পরিষ্কার বলেন, ‘বর্তমান সরকার ভূমিদস্যু-দুর্বৃত্তদের কাছে মাথা নত করবে না। খাল, বিল, নদী-নালা, ডোবা-জলাশয় ভরাট করে কাউকে স্বর্গরাজ্য বানাতে দেওয়া হবে না। এ দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে সরকার কঠোর ব্যবস্থা নেবে। হুমকি দিয়ে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে কোনো কাজ আদায় করা যাবে না’ (প্রথম আলো, ৬ জানুয়ারি ২০১০)।
আপাতদৃষ্টিতে বলা যায়, প্রতিমন্ত্রী অত্যন্ত সাহসী অবস্থান নিয়েছেন। আগে কাউকে এই ভাষায় কথা বলতে শোনা যায়নি। তিনি অবশ্য কোনো বাড়তি কথা বলেননি, আইন অনুযায়ী কথা বলেছেন। জনবহুল রাজধানীতে আরও আবাসনের প্রয়োজন আছে। কিন্তু অপরিকল্পিতভাবে প্রকল্প গ্রহণ করা যাবে না। বিশৃঙ্খলভাবে কোনো রাষ্ট্র চলতে পারে না। সরকারকে প্রমাণ করতে হবে, টাকার জোরে হয়তো অনেক কিছু করা যায়, কিন্তু আইন অবজ্ঞা করা যায় না। যারা আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখায়, তাদের বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানোর সময় এসেছে।
এ জন্য প্রধানমন্ত্রীকে সবচেয়ে আগে দল ঠিক করতে হবে। সাংসদেরা যদি ‘ভূমি-দুর্বৃত্তদের’ কাছে নতি স্বীকার করেন, তাহলে সরকার কিসের ওপর দাঁড়াবে? ঢাকার আবাসন যে কী বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে, তা কারও বুঝতে বাকি আছে? সম্প্রতি বেগুনবাড়িতে একটি ভবন উপড়ে পড়ে ২৫ জনের করুণ মৃত্যু ঘটেছে। এর প্রধান কারণ ছিল জলাশয়ের ওপর অপরিকল্পিতভাবে ভবন নির্মাণ। ‘ভূমিদস্যুরা’ চেনে শুধু মুনাফা। মানুষের জীবন তাদের কাছে কোনো ব্যাপার নয়। এদের বাড়াবাড়ি বন্ধের ব্যবস্থা করা অতি জরুরি হয়ে উঠেছে।
প্রধানমন্ত্রী যখন এই সব ‘ভূমিদস্যুতার’ বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন, শক্ত পায়ে দাঁড়ান। আর লক্ষ রাখুন, দলের সাংসদেরা যেন উল্টা পাশে চলে না যান।
ঢাকা বাঁচান। মানুষ বাঁচান।
আব্দুল কাইয়ুম: সাংবাদিক।
quayum@gmail.com
পরদিন পত্রিকায় দেখেছি, প্রতিমন্ত্রীকে হুমকির ঘটনায় মন্ত্রিসভার অন্য সদস্যরা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। জানা গেছে, ‘ভূমিদস্যুদের’ আচরণে প্রধানমন্ত্রী অসন্তুষ্ট হয়েছেন। তিনি একান্তভাবেই চাইছেন, রাজধানী ঢাকা যেন বসবাসযোগ্য থাকে। কিছু অর্থলোলুপ ব্যবসায়ীর নির্বিচার ভূমিগ্রাস ঠেকাতে তিনি আগ্রহী। এ ব্যাপারে প্রতিমন্ত্রী আবদুল মান্নান খান সঠিক অবস্থান গ্রহণ করেছেন বলে তিনি মনে করেন।
সোমবার মন্ত্রিসভার বৈঠকে বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) বাস্তবায়নে রাজধানী ঢাকা ও এর পার্শ্ববর্তী এলাকার জলাভূমি ও জলাশয় চিহ্নিত করে গেজেট করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ঢাকার চারপাশের জলাশয় ও কৃষিজমি রক্ষা করতে হবে। এ ব্যাপারে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। রাজধানীর সার্বিক উন্নয়নের জন্য ড্যাপ বাস্তবায়ন করতে হবে।
কিন্তু যেখানে প্রধানমন্ত্রী ভূমিগ্রাস ঠেকাতে চান, সেখানে তাঁরই দলের সাংসদেরা উল্টা মোচড় দিয়ে বসেছেন। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত সংবাদে দেখা যাচ্ছে, ঢাকার সাংসদেরা নাকি ড্যাপ কার্যকর হতে দিতে চান না। তাঁরা দাবি করছেন, ড্যাপ কার্যকর হলে তাঁদের নির্বাচনী এলাকার নাকি বিরাট ক্ষতি হয়ে যাবে। অথচ ড্যাপ হঠাৎ করে তৈরি হয়নি। সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ ও বিভিন্ন মহলের সঙ্গে আলোচনা ও মতবিনিময়ের মধ্য দিয়ে ঢাকা মহানগরের সার্বিক মঙ্গলের কথা চিন্তা করে এই পরিকল্পনা তৈরি করা হয়েছে। এমনকি যে সাংসদদের আপত্তির কথা এখন পত্রিকায় বলা হচ্ছে, তাঁদের সঙ্গেও আলোচনা হয়েছে। এ ব্যাপারে রাজউকের চেয়ারম্যান নূরুল হুদা বলেছেন, ‘২০০৪ সালে ড্যাপ প্রণয়নের প্রক্রিয়া শুরু হওয়ায় তখনকার সাংসদেরা বিষয়টি সম্পর্কে অবহিত ছিলেন। ...বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর পুনরায় সাংসদদের অবহিত করার সিদ্ধান্ত নেয় মন্ত্রণালয়। সে জন্য আহূত প্রথম সভায় সংশ্লিষ্ট সাংসদেরা ড্যাপের পরিবর্তে রাজউকের অতীত কর্মকাণ্ড নিয়ে আলোচনা করেন। তখন মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত নেয় যে সংশ্লিষ্ট সাংসদদের প্রত্যেককে আলাদাভাবে ডেকে তাঁর এলাকার বিষয়ে আলোচনা করা হবে। সেটা করাও হয়েছে এবং ৫৯০ বর্গমাইল এলাকার ঢাকা মহানগরের অন্তর্ভুক্ত প্রতিটি এলাকার সাংসদ এটা শুনেছেন। লিখিতভাবে মতামতও দিয়েছেন। নসরুল হামিদও দিয়েছেন’ (প্রথম আলো, ১৫ জুন ২০১০)।
রাজউকের চেয়ারম্যানের কথা এতই সুনির্দিষ্ট যে অবিশ্বাসের কোনো সুযোগ নেই। তাহলে এখন দেখতে হবে, সাংসদদের বরাতে যে আপত্তির কথা পত্রিকায় ছাপা হয়েছে সেগুলো কি তাঁদের কথা, নাকি অন্য কারও কথা তাঁদের মুখে চালিয়ে দেওয়া হয়েছে। কারণ প্রধানমন্ত্রীর কথার সঙ্গে দলের সাংসদদের দ্বিমত থাকলে তো প্রথমে দলের মধ্যে তাঁদের আলোচনা করা উচিত।
অবশ্য সাংসদদের মধ্যে যে ড্যাপের বিরোধিতা আছে, তা সেদিন পূর্তমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের সময়ই বোঝা গেছে। ওই বৈঠকে রিহ্যাবের সভাপতি, সরকারি দলের সাংসদ নসরুল হামিদ সরাসরি বিরোধিতা করে বলেছিলেন, ড্যাপের পর্যালোচনা প্রতিবেদন মেনে নেওয়া যায় না। তাহলে প্রতিমন্ত্রী কাকে সঙ্গে নিয়ে তাঁর উল্লিখিত ‘ভূমিদস্যুদের’ বিরুদ্ধে দাঁড়াবেন? আর প্রধানমন্ত্রীই বা কী যুক্তি দেবেন? তাঁর নিজের দলের নেতারা যদি তাঁর কথা না শোনেন, তাহলে দেশ চালাবেন কীভাবে?
বিশ্বের কোনো দেশেই অপরিকল্পিতভাবে নগরায়ণ করা হয় না। একটি নির্দিষ্ট পরিকল্পনার অধীনে রাস্তাঘাট, ভবন নির্মাণ, বাণিজ্যিক ও আবাসিক এলাকা নির্ধারণ প্রভৃতি গড়ে তোলা হয়। কিন্তু রাজধানী ঢাকা একশ্রেণীর ভূমি-দুর্বৃত্তের পাল্লায় পড়ে গেছে। তারা রাজউকের নিয়মকানুন মানতে চায় না। সরকারের খাসজমি তো দখল করেই, সাধারণ মানুষকেও কম দামে জমি বিক্রি করতে বাধ্য করে অথবা তাদের জমি স্রেফ জবরদখল করে নেয়। ঢাকার চারপাশের নিম্নাঞ্চলে পানির মধ্যে সাইনবোর্ড লাগিয়ে প্লট বিক্রি করে। টাকার জোরে এসব অপকর্ম ধামাচাপা দিতে তারা সিদ্ধহস্ত।
এই ‘ভূমিদস্যুতা’ অবাধ গতিতে চলছিল। এর প্রতিকারের প্রয়োজন যখন জরুরি হয়ে ওঠে সেই সময়, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ১৯৯৭ সালে কিছু পদক্ষেপ গৃহীত হয়। তারা ‘জলাধার সংরক্ষণ আইন, ২০০০’ পাস করে। ওই আইনে বলা হয়েছে, জলাভূমি ভরাট করা যাবে না। সামান্য বৃষ্টি হলেই যে রাজধানীর বিরাট অংশ ডুবে যায়, তার একটি কারণ হলো বৃষ্টির পানি নেমে যাওয়ার জায়গার অভাব। সুতরাং ভূমি উন্নয়ন ও আবাসিক ভবন নির্মাণের নামে যদি জলাশয় ভরাট চলতে থাকে, তাহলে রাজধানীতে মানুষের বসবাস অসম্ভব হয়ে উঠবে। রাজধানীবাসী এখনই তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। টেকসই উন্নয়নের জন্য যুক্তরাজ্যের একটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের সহায়তায় মহানগর উন্নয়ন পরিকল্পনা (ডিএমডিপি) প্রণীত হয় ১৯৯৩-৯৫ সালে, যা ১৯৯৭ সালে আওয়ামী লীগ সরকার অনুমোদন করে গেজেট প্রকাশ করে। এরই ধারাবাহিকতায় ঢাকা মহানগরের ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যানের (ড্যাপ) খসড়া প্রণয়নের কাজ শুরু হয় ২০০৪ সালে। সম্প্রতি তা পর্যালোচনার মাধ্যমে চূড়ান্ত করা হয়। দেশের বিশিষ্ট নগর পরিকল্পনাবিদ, প্রকৌশলী, স্থপতি, পেশাজীবী প্রমুখ বিশেষজ্ঞের মতামতের ভিত্তিতে এসব করা হয়েছে। তাই কেউ বলতে পারবেন না যে একতরফাভাবে ড্যাপ তৈরি করা হয়েছে। তাহলে আবাসন ব্যবসায়ীদের আপত্তি কেন?
আগেও অনেক চেষ্টা হয়েছে, কিন্তু আবাসন ব্যবসায়ীদের কোনোভাবেই বাগে আনা যায়নি। একপর্যায়ে মনে হচ্ছিল, ওরা বুঝি দুর্দমনীয়। বিভিন্ন সময় ক্ষমতাসীন সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে অনৈতিক লেনদেনের মাধ্যমে ‘ভূমি-দুর্বৃত্তরা’ সমাজে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। সাধারণ মানুষ ছিল অসহায়। চোখের সামনে জমি কেড়ে নেওয়ার ঘটনা ঢাকার চারপাশে এত বেশি ঘটেছে যে তা বলে শেষ করা যাবে না।
কিন্তু যা হোক, শেষ পর্যন্ত সরকার একটা অবস্থান নিয়েছে। রিহ্যাব ফেয়ার ২০০৯-এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিমন্ত্রী পরিষ্কার বলেন, ‘বর্তমান সরকার ভূমিদস্যু-দুর্বৃত্তদের কাছে মাথা নত করবে না। খাল, বিল, নদী-নালা, ডোবা-জলাশয় ভরাট করে কাউকে স্বর্গরাজ্য বানাতে দেওয়া হবে না। এ দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে সরকার কঠোর ব্যবস্থা নেবে। হুমকি দিয়ে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে কোনো কাজ আদায় করা যাবে না’ (প্রথম আলো, ৬ জানুয়ারি ২০১০)।
আপাতদৃষ্টিতে বলা যায়, প্রতিমন্ত্রী অত্যন্ত সাহসী অবস্থান নিয়েছেন। আগে কাউকে এই ভাষায় কথা বলতে শোনা যায়নি। তিনি অবশ্য কোনো বাড়তি কথা বলেননি, আইন অনুযায়ী কথা বলেছেন। জনবহুল রাজধানীতে আরও আবাসনের প্রয়োজন আছে। কিন্তু অপরিকল্পিতভাবে প্রকল্প গ্রহণ করা যাবে না। বিশৃঙ্খলভাবে কোনো রাষ্ট্র চলতে পারে না। সরকারকে প্রমাণ করতে হবে, টাকার জোরে হয়তো অনেক কিছু করা যায়, কিন্তু আইন অবজ্ঞা করা যায় না। যারা আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখায়, তাদের বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানোর সময় এসেছে।
এ জন্য প্রধানমন্ত্রীকে সবচেয়ে আগে দল ঠিক করতে হবে। সাংসদেরা যদি ‘ভূমি-দুর্বৃত্তদের’ কাছে নতি স্বীকার করেন, তাহলে সরকার কিসের ওপর দাঁড়াবে? ঢাকার আবাসন যে কী বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে, তা কারও বুঝতে বাকি আছে? সম্প্রতি বেগুনবাড়িতে একটি ভবন উপড়ে পড়ে ২৫ জনের করুণ মৃত্যু ঘটেছে। এর প্রধান কারণ ছিল জলাশয়ের ওপর অপরিকল্পিতভাবে ভবন নির্মাণ। ‘ভূমিদস্যুরা’ চেনে শুধু মুনাফা। মানুষের জীবন তাদের কাছে কোনো ব্যাপার নয়। এদের বাড়াবাড়ি বন্ধের ব্যবস্থা করা অতি জরুরি হয়ে উঠেছে।
প্রধানমন্ত্রী যখন এই সব ‘ভূমিদস্যুতার’ বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন, শক্ত পায়ে দাঁড়ান। আর লক্ষ রাখুন, দলের সাংসদেরা যেন উল্টা পাশে চলে না যান।
ঢাকা বাঁচান। মানুষ বাঁচান।
আব্দুল কাইয়ুম: সাংবাদিক।
quayum@gmail.com
No comments