চরাচর-কিংবদন্তির নারী সুহাসিনী দাস by তামান্না ইসলাম অলি

মাত্র ১৬ বছর বয়সে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়েছিল তাঁকে। আর বিধবা হয়েছিলেন ২০ বছর বয়সে। তখন তাঁর কন্যার বয়স মাত্র দেড় বছর। তিনি পেরিয়েছেন জীবনের অনেক চড়াই-উতরাই। একসময় সাধারণ গৃহবধূ থেকে হয়ে উঠেছেন সক্রিয় কংগ্রেসকর্মী। সারা জীবন অভয়বাণী শুনিয়েছেন বঞ্চিতদের।


জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন সাধারণ মানুষের পাশে থেকে। সাধারণ মানুষের কল্যাণে বিলিয়ে দিয়েছেন তাঁর বিশাল সম্পত্তির পুরোটাই। তিনি আর কেউ নন। সিলেটের কিংবদন্তি নারী সুহাসিনী দাস। ২০০৯ সালের এই দিনে দেহ রাখেন তিনি।
সুহাসিনী দাসের জন্ম ১৩২২ সনের ১ ভাদ্র। সুনামগঞ্জ জেলার জগন্নাথপুরে তাঁর জন্ম। বাবা প্যারি মোহন রায় ও মা শোভা রায়। বাবা ছিলেন ব্যবসায়ী ও শিল্পানুরাগী। তাঁদের গ্রামটি ছিল অন্য রকম। ওই সময় সেই গ্রামে মেয়েদের স্কুল ছিল। যেখানে পড়ানো হতো চতুর্থ শ্রেণী পর্যন্ত। সুহাসিনী দাসের পড়াশোনার হাতেখড়ি সে স্কুলেই। মেয়েদের ১৬ বছর বয়স, তখনকার সামাজিক দৃষ্টিকোণ বিয়ের জন্য অনেক বেশি বয়স। সে বয়সেই তাঁর বিয়ে হয় সিলেটের নামকরা ব্যবসায়ী কুমুদচন্দ্র দাসের সঙ্গে।
স্বামীর আকস্মিক মৃত্যুর পর অনেকটা দিশেহারা হন তিনি। অকাল বৈধব্যেও শোক কাটিয়ে উঠতে তিনি আবার পড়াশোনায় মনোযোগী হন। এ সময় তিনি যোগ দেন শ্রীহট্ট মহিলা সংঘে। এখানকার মেয়েদের সুতা কাটার কাজ তাঁকে আগ্রহী করে। একপর্যায়ে তিনি এ কাজের দায়িত্ব নেন। চরকায় সুতা কাটতে কাটতে তিনি জড়িয়ে পড়েন রাজনীতিতে। কারণ ওই সময় স্বদেশি আন্দোলনের সঙ্গে হাতে বানানো কাপড় ও সুতার সম্পর্ক ছিল অনেক গভীর। এরই মধ্যে সুহাসিনীর সঙ্গে পরিচয় হয় কংগ্রেস নেতা ধীরেন্দ্রনাথ দাসের সঙ্গে। যোগ দেন কংগ্রেসে। কিছু দিনের মধ্যেই পুরোপুরি রাজনৈতিক কর্মী বনে যান তিনি।
১৯৪২ সাল। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে তখন উত্তাল গোটা ভারতবর্ষ। 'ডু অর ডাই' এই স্লোগানে মুখর শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত। তখন দলে দলে কংগ্রেস কর্মীরা গ্রেপ্তার হচ্ছিলেন। সুহাসিনী দাসও গ্রেপ্তার হন ব্রিটিশ পুলিশের হাতে। ১৯৪৩ সালে ব্রিটিশ ষড়যন্ত্রে শুরু হয় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। দাঙ্গা মোকাবিলায় রিলিফ ক্যাম্প খোলে কংগ্রেস। সুহাসিনী দাস ঝাঁপিয়ে পড়েন আর্তমানবতার সেবায়।
১৯৪৭-এ দেশভাগের পর অনেকেই ভারতে চলে যান। কংগ্রেসের রাজনীতিও ছেড়ে দেন কেউ কেউ। কিন্তু সুহাসিনী দাস পূর্ব পাকিস্তানে কংগ্রেস সংগঠিত করার চেষ্টা করেন। একসময় রাজনীতির গণ্ডি পেরিয়ে মনোযোগী হন সমাজ সংস্কারে। ১৯৫০-এর দাঙ্গার পর আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব যখন দলে দলে পূর্ব পাকিস্তান ছেড়ে যাচ্ছে তখনো অটল ছিলেন সুহাসিনী দাস। জন্মভূমি ছাড়েননি তিনি। বরং নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন মানবসেবায়। একাত্তরে বাংলাদেশের মুক্তি আন্দোলনে তাঁর দুই সংগঠনই মুক্তিযোদ্ধাদের পাশে দাঁড়ায়। ১৯৭৩-এ দিল্লিতে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের যে মহাসম্মেলন হয়, সেখানে যোগ দেন তিনি।
এ সব কিছুর বাইরে আর একটি প্রাণের প্রতিষ্ঠান ছিল সুহাসিনী দাসের। সেটি হচ্ছে সিলেটের চালিবন্দরে উমেশচন্দ্র-নির্মলাবালা ছাত্রাবাস। ১৯৬২ সালে কংগ্রেস নেতা নিকুঞ্জ বিহারী গোস্বামী এটি প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতিষ্ঠার সময় থেকে আমৃত্যু এর ভালোমন্দের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন সুহাসিনী দাস।
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামী হিসেবে ১৯৭৩ সালে তাঁকে সংবর্ধনা দেয় ভারত সরকার। এ সময় তাঁকে ভারতে থেকে যাওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। সে প্রস্তাব তিনি মেনে নেননি। বরং তাঁর স্থাবর-অস্থাবর সব সম্পত্তি বিলিয়ে দেন জনকল্যাণে। ২০০৯ সালের ৩০ মে সিলেটে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। তাঁর তৃতীয় প্রয়াণ দিবসে আমরা তাঁর প্রতি জানাই গভীর শ্রদ্ধা।
তামান্না ইসলাম অলি

No comments

Powered by Blogger.