সিটি করপোরেশন নির্বাচন ২০১০: চট্টগ্রাম-জয়ী হয়েছে গণতন্ত্র ও নির্বাচন কমিশন by আবুল মোমেন
পূর্বাভাস ও সবার আশঙ্কাকে ভুল প্রমাণ করে সারা দিন আবহাওয়া ছিল চমৎকার— রোদও নেই, বৃষ্টিও নেই। শুকনো মেঘলা দিনে ছুটির আমেজটা ভালোই উপভোগ করেছে নগরবাসী। সাধারণত সকাল আটটা থেকেই ভোটকেন্দ্রে লাইন ধরে ভোট দিতে অভ্যস্ত নগরবাসী এবারে ভোটকেন্দ্রের পরিবেশ নিয়ে দুশ্চিন্তা করেননি।
দুই সপ্তাহের প্রচারণায় এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি, যা ভোটার ও নগরবাসীর মনে ভোট নিয়ে বিপৎসংকেত হিসেবে কাজ করবে। তাই নগরবাসী ফুরফুরে মেজাজে ধীরেসুস্থে ভোটকেন্দ্রে এসেছেন। বিভিন্ন ভোটকেন্দ্রে কর্তব্যরত নির্বাচনী কর্মকর্তারাও ভয় ও চাপমুক্ত মনে কাজ করেছেন। কলেজিয়েট স্কুল, সেন্ট স্কলাস্টিকা, দক্ষিণ হালিশহর বালিকা বিদ্যালয়, বাগমনিরাম স্কুল, পুলিশ ইনস্টিটিউট—সবখানেই দেখি কি পুরুষ কি মহিলা কোনো কর্মকর্তার মুখেই উদ্বেগের চিহ্ন নেই। সবাই একবাক্যে বলেছেন, কোনো সমস্যা নেই, শান্তিতে নির্বাচন হচ্ছে। কলেজিয়েট কেন্দ্রের প্রিসাইডিং কর্মকর্তা রেলের একজন প্রকৌশলী বললেন, ‘আগে আমরা নির্বাচনী দায়িত্ব নিতে চাইতাম না, ভয় পেতাম। এখন আর ভয় পাই না, বরং আগ্রহ করে নিই।’
সব কেন্দ্রেই পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের দেখেছি হালকা মনে বসেই কর্তব্য পালন করতে পারছেন। হাঁকডাক, দৌড়াদৌড়ি, লাঠি উঁচিয়ে তাড়া করা, ধাক্কাধাক্কি চোখে পড়েনি।
নির্বাচনের দিনের এই পরিবেশ হঠাৎ করে হয়নি। প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেছিলেন, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচন হবে একটি ‘মডেল’। মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার দিন থেকেই নির্বাচন কমিশন তাদের দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন ছিল। ভাবা যায়! দেয়ালে পোস্টার লাগেনি। মেয়র ও কাউন্সিলর পদপ্রার্থীরা দড়িতে ঝুলিয়েছেন তাঁদের সাদা-কালো পোস্টার। চার দিনের বৃষ্টিতে অনেক পোস্টার ঝরেও গেছে। সেই অজুহাতেও কেউ আইন ভেঙে নিজের নিয়মে চলতে চাননি। মিছিল হয়নি বললেই চলে, মাইকিং আর পথসভা নাগরিকদের জন্য উৎপাত সৃষ্টি করেনি।
নির্বাচনে প্রার্থীদের মধ্যেই হার-জিত সীমাবদ্ধ থাকবে। কিন্তু অতীতে সবচেয়ে বড় হার হতো প্রশাসন ও নির্বাচন কমিশনের। অনেকবারই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সরকার আর নির্বাচন কমিশনের বিশ্বাসযোগ্যতা প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছে। এবারও নির্বাচনের আগের দিন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য এম কে আনোয়ার জানিয়ে রেখেছেন, কোনো অনিয়ম হলে সরকার পতনের আন্দোলন হবে, সারা দেশে আগুন জ্বলবে। সাধারণত বিরোধী দল নির্বাচন থেকেই সরকারবিরোধী আন্দোলনের জ্বালানি পেতে চায়। এটাই আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রচলিত রীতি। কিন্তু এবার সে রকম সুযোগ পাওয়া যাবে না।
আমি এবং আমার অন্তত ১৮ জন সহকর্মী শ খানেক কেন্দ্রে গিয়ে বিভিন্ন বুথে আনারস (বিএনপি-সমর্থিত মেয়র প্রার্থী মন্জুর আলমের প্রতীক) প্রতীকের এজেন্টদের নির্বাচনী পরিবেশ নিয়ে প্রশ্ন করে একই উত্তর পেয়েছি। তাঁরা একবাক্যে বলেছেন, নির্বাচন শান্তিপূর্ণ ও সুষ্ঠু হচ্ছে। কোনো ঝামেলা নেই।
ফলে মেয়র যিনিই নির্বাচিত হন, কাউন্সিলর যাঁরাই হন, সবচেয়ে বড় বিজয় অর্জন করেছে নির্বাচন কমিশন।
দেখা যাচ্ছে, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান যদি আইন প্রয়োগে সক্রিয় এবং নিরপেক্ষ থাকে, তাহলে লক্ষ্য অর্জন সম্ভব, গৃহীত উদ্যোগ ফলপ্রসূ হয়। সে দিক থেকে এই নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা জেসমিন টুলীকে বিশেষভাবে কৃতিত্ব দেব। নির্বাচনভিত্তিক সব কাজ দক্ষতা, আন্তরিকতা ও নিরপেক্ষতার সঙ্গে সম্পাদনে তিনিই নেতৃত্ব দিয়েছেন। মূল জায়গায় ঠিকভাবে কাজ হলে সংশ্লিষ্ট অন্য সব দপ্তর, ব্যক্তি, বাহিনী সেই ধারা অনুসরণ করতে বাধ্য হয়। নির্বাচনের আগেই সুষ্ঠু নির্বাচনের বাতাবরণ তৈরি হয়ে গিয়েছিল। কেউ তা ভাঙার সাহস পাননি, ভাঙতে যাওয়ার খেসারত কী হতে পারে, তা ছিল অনিশ্চিত।
আমাদের গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে নানা সময় আমরা আশঙ্কা প্রকাশ করি। গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি দেওয়ার কথা বারবার বলা হয়, কারণ আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্নীতি, পক্ষপাত, অদক্ষতার এবং ক্ষমতার অন্যান্য হস্তক্ষেপ ও যাপ-প্রভাবে অত্যন্ত দুর্বল ও প্রায় অকার্যকর হয়ে পড়েছে। সেখানে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচন দিনবদলের এবং পরিবর্তনের ইশারা দিচ্ছে। কমিশন, প্রশাসনের অন্যান্য অংশ, প্রার্থী ও রাজনৈতিক দল এবং সমর্থক ও ভোটাররা মিলে সত্যিই একটি মডেল নির্বাচন উপহার দিতে সক্ষম হয়েছেন।
নির্বাচনে ফলাফল যা-ই হোক, পরাজিত পক্ষ এ নিয়ে যা-ই বলুক, চট্টগ্রামের মানুষ কিন্তু একটি ইতিহাসের অংশীদার হয়ে গেল। সেটা আমাদের গণতন্ত্রের অভিযাত্রায় মাইলফলকরূপে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। ফলে এই নির্বাচনে মূল বিজয়ী গণতন্ত্র। আর এর সুফল হলো—নির্বাচন কমিশনের প্রতি মানুষের আস্থা বাড়বে, আইন ও বিধানের প্রতি মানুষ আস্থা ফিরে পাবে। ১৭ জুনের নির্বাচন থেকে এটাই সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি।
আবুল মোমেন: কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।
সব কেন্দ্রেই পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের দেখেছি হালকা মনে বসেই কর্তব্য পালন করতে পারছেন। হাঁকডাক, দৌড়াদৌড়ি, লাঠি উঁচিয়ে তাড়া করা, ধাক্কাধাক্কি চোখে পড়েনি।
নির্বাচনের দিনের এই পরিবেশ হঠাৎ করে হয়নি। প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেছিলেন, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচন হবে একটি ‘মডেল’। মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার দিন থেকেই নির্বাচন কমিশন তাদের দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন ছিল। ভাবা যায়! দেয়ালে পোস্টার লাগেনি। মেয়র ও কাউন্সিলর পদপ্রার্থীরা দড়িতে ঝুলিয়েছেন তাঁদের সাদা-কালো পোস্টার। চার দিনের বৃষ্টিতে অনেক পোস্টার ঝরেও গেছে। সেই অজুহাতেও কেউ আইন ভেঙে নিজের নিয়মে চলতে চাননি। মিছিল হয়নি বললেই চলে, মাইকিং আর পথসভা নাগরিকদের জন্য উৎপাত সৃষ্টি করেনি।
নির্বাচনে প্রার্থীদের মধ্যেই হার-জিত সীমাবদ্ধ থাকবে। কিন্তু অতীতে সবচেয়ে বড় হার হতো প্রশাসন ও নির্বাচন কমিশনের। অনেকবারই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সরকার আর নির্বাচন কমিশনের বিশ্বাসযোগ্যতা প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছে। এবারও নির্বাচনের আগের দিন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য এম কে আনোয়ার জানিয়ে রেখেছেন, কোনো অনিয়ম হলে সরকার পতনের আন্দোলন হবে, সারা দেশে আগুন জ্বলবে। সাধারণত বিরোধী দল নির্বাচন থেকেই সরকারবিরোধী আন্দোলনের জ্বালানি পেতে চায়। এটাই আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রচলিত রীতি। কিন্তু এবার সে রকম সুযোগ পাওয়া যাবে না।
আমি এবং আমার অন্তত ১৮ জন সহকর্মী শ খানেক কেন্দ্রে গিয়ে বিভিন্ন বুথে আনারস (বিএনপি-সমর্থিত মেয়র প্রার্থী মন্জুর আলমের প্রতীক) প্রতীকের এজেন্টদের নির্বাচনী পরিবেশ নিয়ে প্রশ্ন করে একই উত্তর পেয়েছি। তাঁরা একবাক্যে বলেছেন, নির্বাচন শান্তিপূর্ণ ও সুষ্ঠু হচ্ছে। কোনো ঝামেলা নেই।
ফলে মেয়র যিনিই নির্বাচিত হন, কাউন্সিলর যাঁরাই হন, সবচেয়ে বড় বিজয় অর্জন করেছে নির্বাচন কমিশন।
দেখা যাচ্ছে, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান যদি আইন প্রয়োগে সক্রিয় এবং নিরপেক্ষ থাকে, তাহলে লক্ষ্য অর্জন সম্ভব, গৃহীত উদ্যোগ ফলপ্রসূ হয়। সে দিক থেকে এই নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা জেসমিন টুলীকে বিশেষভাবে কৃতিত্ব দেব। নির্বাচনভিত্তিক সব কাজ দক্ষতা, আন্তরিকতা ও নিরপেক্ষতার সঙ্গে সম্পাদনে তিনিই নেতৃত্ব দিয়েছেন। মূল জায়গায় ঠিকভাবে কাজ হলে সংশ্লিষ্ট অন্য সব দপ্তর, ব্যক্তি, বাহিনী সেই ধারা অনুসরণ করতে বাধ্য হয়। নির্বাচনের আগেই সুষ্ঠু নির্বাচনের বাতাবরণ তৈরি হয়ে গিয়েছিল। কেউ তা ভাঙার সাহস পাননি, ভাঙতে যাওয়ার খেসারত কী হতে পারে, তা ছিল অনিশ্চিত।
আমাদের গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে নানা সময় আমরা আশঙ্কা প্রকাশ করি। গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি দেওয়ার কথা বারবার বলা হয়, কারণ আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্নীতি, পক্ষপাত, অদক্ষতার এবং ক্ষমতার অন্যান্য হস্তক্ষেপ ও যাপ-প্রভাবে অত্যন্ত দুর্বল ও প্রায় অকার্যকর হয়ে পড়েছে। সেখানে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচন দিনবদলের এবং পরিবর্তনের ইশারা দিচ্ছে। কমিশন, প্রশাসনের অন্যান্য অংশ, প্রার্থী ও রাজনৈতিক দল এবং সমর্থক ও ভোটাররা মিলে সত্যিই একটি মডেল নির্বাচন উপহার দিতে সক্ষম হয়েছেন।
নির্বাচনে ফলাফল যা-ই হোক, পরাজিত পক্ষ এ নিয়ে যা-ই বলুক, চট্টগ্রামের মানুষ কিন্তু একটি ইতিহাসের অংশীদার হয়ে গেল। সেটা আমাদের গণতন্ত্রের অভিযাত্রায় মাইলফলকরূপে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। ফলে এই নির্বাচনে মূল বিজয়ী গণতন্ত্র। আর এর সুফল হলো—নির্বাচন কমিশনের প্রতি মানুষের আস্থা বাড়বে, আইন ও বিধানের প্রতি মানুষ আস্থা ফিরে পাবে। ১৭ জুনের নির্বাচন থেকে এটাই সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি।
আবুল মোমেন: কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।
No comments