সিটি করপোরেশন নির্বাচন ২০১০: চট্টগ্রাম-জনগণই রাজা by আবুল মোমেন
আদর্শ নির্বাচনের খেতাব পাওয়ার পর ফলাফল ঘোষণায় দেরি করে একটু হোঁচট খেল নির্বাচন কমিশন। কেউ কি তাদের ওপর প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করেছিল? কিন্তু তার আগেই তো কেন্দ্র থেকে এজেন্টদের হাত ঘুরে ফলাফল জমা হয়েছে দুই প্রতিদ্বন্দ্বীর ক্যাম্পে।
আর এই দেরি থেকে সন্দেহ, তা থেকে উত্তেজনা এবং পরিণামে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, অনিশ্চয়তা ও অস্থিরতা। ফলে একটু কালিমা মেখেই ফলাফল ঘোষণা হলো এই নির্বাচনের।
দীর্ঘ পোড় খাওয়া বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনে মহিউদ্দিন চৌধুরী বোধহয় সবচেয়ে বড় ঘা খেলেন এবারে। তিনি কীভাবে ঘুরে দাঁড়াবেন সেটা ভবিষ্যৎই বলবে। তবে সেটা নির্ভর করবে যে ভুলগুলোর কারণে এবার তিনি পরাজিত হলেন তা বুঝে নিজেকে সংশোধনের ওপর।
জেদ এবং দম্ভ মানুষকে অনেক সময় ভুলের ফাঁদে আটকে ফেলে। ঘুরে দাঁড়াতে হলে পরাজয় মেনেই শুরু করতে হবে তাঁকে। অর্থাৎ ভুলগুলো বুঝে নিজেকে শুধরে নিয়েই তাঁকে শুরু করতে হবে। মন্জুর পক্ষে নেতিবাচক ভোট অর্থাৎ মহিউদ্দিনকে যাঁরা চাননি, তাঁদের ভোট গেছে বেশি। তাঁর রাজনৈতিক জীবন ও মেয়র জীবনের প্রথম দুই মেয়াদ মিলে মহিউদ্দিনের অর্জন অনেক। সুনাম প্রতিষ্ঠা হয়েছে বেশ। কিন্তু এ তো ব্যাংকের টাকা নয় যে জমা রাখলে সুদে-আসলে আপনিই বাড়বে। নিত্য ভালো কাজ করে যোগ না করলে বরং আপনিই খরচ হতে থাকে। সেটা যেন মহিউদ্দিন চৌধুরী হিসাবেই ধরেননি।
মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং মেয়র—এ দুই গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে আর স্বাভাবিক নেতৃত্বগুণ মিলে তিনি হয়ে উঠেছিলেন চট্টগ্রামে অপ্রতিদ্বন্দ্বী ক্ষমতাধর ব্যক্তি। এই জি-হুজুরের দেশ ক্ষমতাধরকে অন্ধ ও অসহিষ্ণু করে সহজে। তৃতীয় মেয়াদে তিনি যেন হয়ে উঠলেন বেপরোয়া। তোয়াক্কা করলেন না দলীয় নেতা, সমাজনেতাদের অভিমতের।
মন্জুরের ওপর মানুষের গভীর আস্থা আছে এমন নয়, কিন্তু প্রায় পাঁচ লাখ ভোটার মহিউদ্দিনের ওপর আস্থা হারানোয় তাঁর জয় হয়ে ওঠে অনিবার্য। ভোটাররা তাঁর কাছে কী বার্তা পাঠিয়েছে এই ফলাফলের মাধ্যমে?
কেবল পাঁচ লাখ নতুন ভোটারই নয়, আদতে নগরবাসীই পরিবর্তন চায়। তারা গতানুগতিক রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন চায়, সেই সঙ্গে নগরজীবনের গুণগত উত্তরণ চায়। এটি কিন্তু বেশ শক্ত চ্যালেঞ্জ। মন্জুর মূলত ব্যবসায়ী, রাজনীতির ভেতরমহলের মানুষ নন। তাই বিরোধীদলীয় মেয়র হয়ে ভোটারদের চাহিদা পূরণ হবে তাঁর জন্য বেশ কঠিন কাজ। তার ওপর জোটের শরিক ও তাঁর অন্যতম সমর্থক দল জামায়াতের এজেন্ডা তাঁকে না তরুণ ও সংখ্যালঘু সমর্থকদের কাছে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দেয়।
এদিকে বিএনপির নেতাদের মধ্যে অনেকেই তাঁর মুরব্বি হয়ে উঠবেন। যোগ্য পরামর্শক পাওয়া ভাগ্যের কথা, কিন্তু অনেক মুরব্বির মন জুগিয়ে মানুষের কল্যাণে কাজ করা সহজ নয়। তাঁকে ত্রিধারার চাপ মোকাবিলা করে এগোতে হবে—ভিন্নদলীয় সরকার, নিজদলীয় বহুমুখী টানাপোড়েন এবং শরিক জামায়াতের ভূমিকা। বিনয় ও সারল্য যাঁর ভূষণ, যিনি নির্বিবাদী ভদ্রলোক হিসেবে পরিচিত, তিনি এই বহুমুখী চাপ সামলে জনগণকে কাজ দিতে পারলে সেটা তাঁর নির্বাচনী বিজয়ের চেয়ে কম চমৎকার সাফল্য হবে না। মন্জুর তাঁর অতিসক্রিয় প্রতিদ্বন্দ্বীর প্রায় বিপরীত চরিত্রের মানুষ। সক্রিয় রাজনীতিতে এসে কাদের তিনি সঙ্গী হিসেবে পাবেন, নিজেই বা কাদের সঙ্গ পছন্দ করবেন সে ব্যাপারে হুঁশিয়ার থাকাই ভালো হবে।
মনে রাখা দরকার, চট্টগ্রামবাসী কিন্তু নিজেদের ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত। জাতীয় অর্থনীতিতে বন্দরের গুরুত্বের দোহাই দিলেও দিনে দিনে চট্টগ্রামের অবক্ষয় থামছে না, সরকার যথাযথ বরাদ্দ দিচ্ছে না। এ নিয়ে উদ্যোগ নিলে দলমত নির্বিশেষে চট্টগ্রামবাসীর সাড়া কিন্তু পাওয়া যাবে।
এ পরাজয় মহিউদ্দিন চৌধুরীকে নিশ্চয় দমাতে পারবে না। তিনি বরাবরের লড়াকু রাজনীতিক। তবে তিনি তো সেই বিলীয়মান জাতের রাজনীতিক, যে ধারা থেকে বঙ্গবন্ধু, মওলানা ভাসানীর মতো মহৎ জাতীয় নেতারা এসেছেন। সেটি গৌরবময় ধারা হলেও ক্ষয়িষ্ণু, সে ধারাকে সেকেলে হিসেবে জবাব দিতে শুরু করেছেন একালের জাতীয় নেতারা। আমাদের রাজনীতিকেরা সাধারণত নিজেদের নবায়নের কথা ভাবেন না, নতুন বক্তব্য ও স্লোগান দিলেও রাজনৈতিক সংস্কৃতি পরিবর্তনে আগ্রহী নন। তাতে রাজনীতি এবং রাজনীতিক উভয়েই তামাদি হয়ে পড়ে। মহিউদ্দিনের ডাইনামিক বা গতিময় প্রাণবন্ত চরিত্রের পরিচয় নগরবাসী পেয়েছে। ফলে এ পরাজয় তাঁকে রাজনৈতিক বিস্মৃতিতে তলিয়ে দেবে বলে মনে হয় না। তামাদিও করবে না নিশ্চয়।
তবে এটা সবাইকে বুঝতে হবে, আজকের নাগরিকেরা পরিবর্তন চায়, দিনবদল চায়, তারা কথা নয়, কাজ চায়। অন্ধ আনুগত্যের দিন শেষ, চোখ খুলে গেছে ভোটারদের, তারা বিচার করে নির্ভয়ে নিজেদের মতামত দেয়। ভোটার প্রার্থী সম্পর্কে জনশ্রুতির তোয়াক্কা করবে না আর, প্রার্থীকেই ভোটারের চাহিদার তোয়াক্কা করতে হবে।
গণতন্ত্রে মন্ত্রী-মেয়র রাজা নন, ভোটারই রাজা, তাঁর মতামতই মুখ্য। এটাই গণতন্ত্র। আমরা কি তাহলে সেই দিকেই যাচ্ছি?
তাহলে পরিবর্তনের শুভ সূচনা হলো এ দেশে। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচনকে এ রকম ইতিবাচকভাবে দেখাই সঠিক।
আবুল মোমেন: কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।
দীর্ঘ পোড় খাওয়া বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনে মহিউদ্দিন চৌধুরী বোধহয় সবচেয়ে বড় ঘা খেলেন এবারে। তিনি কীভাবে ঘুরে দাঁড়াবেন সেটা ভবিষ্যৎই বলবে। তবে সেটা নির্ভর করবে যে ভুলগুলোর কারণে এবার তিনি পরাজিত হলেন তা বুঝে নিজেকে সংশোধনের ওপর।
জেদ এবং দম্ভ মানুষকে অনেক সময় ভুলের ফাঁদে আটকে ফেলে। ঘুরে দাঁড়াতে হলে পরাজয় মেনেই শুরু করতে হবে তাঁকে। অর্থাৎ ভুলগুলো বুঝে নিজেকে শুধরে নিয়েই তাঁকে শুরু করতে হবে। মন্জুর পক্ষে নেতিবাচক ভোট অর্থাৎ মহিউদ্দিনকে যাঁরা চাননি, তাঁদের ভোট গেছে বেশি। তাঁর রাজনৈতিক জীবন ও মেয়র জীবনের প্রথম দুই মেয়াদ মিলে মহিউদ্দিনের অর্জন অনেক। সুনাম প্রতিষ্ঠা হয়েছে বেশ। কিন্তু এ তো ব্যাংকের টাকা নয় যে জমা রাখলে সুদে-আসলে আপনিই বাড়বে। নিত্য ভালো কাজ করে যোগ না করলে বরং আপনিই খরচ হতে থাকে। সেটা যেন মহিউদ্দিন চৌধুরী হিসাবেই ধরেননি।
মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং মেয়র—এ দুই গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে আর স্বাভাবিক নেতৃত্বগুণ মিলে তিনি হয়ে উঠেছিলেন চট্টগ্রামে অপ্রতিদ্বন্দ্বী ক্ষমতাধর ব্যক্তি। এই জি-হুজুরের দেশ ক্ষমতাধরকে অন্ধ ও অসহিষ্ণু করে সহজে। তৃতীয় মেয়াদে তিনি যেন হয়ে উঠলেন বেপরোয়া। তোয়াক্কা করলেন না দলীয় নেতা, সমাজনেতাদের অভিমতের।
মন্জুরের ওপর মানুষের গভীর আস্থা আছে এমন নয়, কিন্তু প্রায় পাঁচ লাখ ভোটার মহিউদ্দিনের ওপর আস্থা হারানোয় তাঁর জয় হয়ে ওঠে অনিবার্য। ভোটাররা তাঁর কাছে কী বার্তা পাঠিয়েছে এই ফলাফলের মাধ্যমে?
কেবল পাঁচ লাখ নতুন ভোটারই নয়, আদতে নগরবাসীই পরিবর্তন চায়। তারা গতানুগতিক রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন চায়, সেই সঙ্গে নগরজীবনের গুণগত উত্তরণ চায়। এটি কিন্তু বেশ শক্ত চ্যালেঞ্জ। মন্জুর মূলত ব্যবসায়ী, রাজনীতির ভেতরমহলের মানুষ নন। তাই বিরোধীদলীয় মেয়র হয়ে ভোটারদের চাহিদা পূরণ হবে তাঁর জন্য বেশ কঠিন কাজ। তার ওপর জোটের শরিক ও তাঁর অন্যতম সমর্থক দল জামায়াতের এজেন্ডা তাঁকে না তরুণ ও সংখ্যালঘু সমর্থকদের কাছে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দেয়।
এদিকে বিএনপির নেতাদের মধ্যে অনেকেই তাঁর মুরব্বি হয়ে উঠবেন। যোগ্য পরামর্শক পাওয়া ভাগ্যের কথা, কিন্তু অনেক মুরব্বির মন জুগিয়ে মানুষের কল্যাণে কাজ করা সহজ নয়। তাঁকে ত্রিধারার চাপ মোকাবিলা করে এগোতে হবে—ভিন্নদলীয় সরকার, নিজদলীয় বহুমুখী টানাপোড়েন এবং শরিক জামায়াতের ভূমিকা। বিনয় ও সারল্য যাঁর ভূষণ, যিনি নির্বিবাদী ভদ্রলোক হিসেবে পরিচিত, তিনি এই বহুমুখী চাপ সামলে জনগণকে কাজ দিতে পারলে সেটা তাঁর নির্বাচনী বিজয়ের চেয়ে কম চমৎকার সাফল্য হবে না। মন্জুর তাঁর অতিসক্রিয় প্রতিদ্বন্দ্বীর প্রায় বিপরীত চরিত্রের মানুষ। সক্রিয় রাজনীতিতে এসে কাদের তিনি সঙ্গী হিসেবে পাবেন, নিজেই বা কাদের সঙ্গ পছন্দ করবেন সে ব্যাপারে হুঁশিয়ার থাকাই ভালো হবে।
মনে রাখা দরকার, চট্টগ্রামবাসী কিন্তু নিজেদের ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত। জাতীয় অর্থনীতিতে বন্দরের গুরুত্বের দোহাই দিলেও দিনে দিনে চট্টগ্রামের অবক্ষয় থামছে না, সরকার যথাযথ বরাদ্দ দিচ্ছে না। এ নিয়ে উদ্যোগ নিলে দলমত নির্বিশেষে চট্টগ্রামবাসীর সাড়া কিন্তু পাওয়া যাবে।
এ পরাজয় মহিউদ্দিন চৌধুরীকে নিশ্চয় দমাতে পারবে না। তিনি বরাবরের লড়াকু রাজনীতিক। তবে তিনি তো সেই বিলীয়মান জাতের রাজনীতিক, যে ধারা থেকে বঙ্গবন্ধু, মওলানা ভাসানীর মতো মহৎ জাতীয় নেতারা এসেছেন। সেটি গৌরবময় ধারা হলেও ক্ষয়িষ্ণু, সে ধারাকে সেকেলে হিসেবে জবাব দিতে শুরু করেছেন একালের জাতীয় নেতারা। আমাদের রাজনীতিকেরা সাধারণত নিজেদের নবায়নের কথা ভাবেন না, নতুন বক্তব্য ও স্লোগান দিলেও রাজনৈতিক সংস্কৃতি পরিবর্তনে আগ্রহী নন। তাতে রাজনীতি এবং রাজনীতিক উভয়েই তামাদি হয়ে পড়ে। মহিউদ্দিনের ডাইনামিক বা গতিময় প্রাণবন্ত চরিত্রের পরিচয় নগরবাসী পেয়েছে। ফলে এ পরাজয় তাঁকে রাজনৈতিক বিস্মৃতিতে তলিয়ে দেবে বলে মনে হয় না। তামাদিও করবে না নিশ্চয়।
তবে এটা সবাইকে বুঝতে হবে, আজকের নাগরিকেরা পরিবর্তন চায়, দিনবদল চায়, তারা কথা নয়, কাজ চায়। অন্ধ আনুগত্যের দিন শেষ, চোখ খুলে গেছে ভোটারদের, তারা বিচার করে নির্ভয়ে নিজেদের মতামত দেয়। ভোটার প্রার্থী সম্পর্কে জনশ্রুতির তোয়াক্কা করবে না আর, প্রার্থীকেই ভোটারের চাহিদার তোয়াক্কা করতে হবে।
গণতন্ত্রে মন্ত্রী-মেয়র রাজা নন, ভোটারই রাজা, তাঁর মতামতই মুখ্য। এটাই গণতন্ত্র। আমরা কি তাহলে সেই দিকেই যাচ্ছি?
তাহলে পরিবর্তনের শুভ সূচনা হলো এ দেশে। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচনকে এ রকম ইতিবাচকভাবে দেখাই সঠিক।
আবুল মোমেন: কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।
No comments