জাতীয় বাজেট-পুলিশের বরাদ্দ কি বাড়ানো উচিত? by শেখ হাফিজুর রহমান ও ফারহানা হেলাল মেহতাব

কয়েক দিন আগে জাতীয় প্রেসক্লাবের ভিআইপি লাউঞ্জে ‘পুলিশের জন্য নির্ধারিত বাজেট: বাস্তবতা ও জনগণের প্রত্যাশা’ শীর্ষক একটি গোলটেবিল আলোচনা হয়ে গেল। এ আলোচনা সভায় সংসদ সদস্য, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, পুলিশের সাবেক আইজি, সাংবাদিক ও কর্মরত পুলিশ কর্মকর্তারা অংশ নেন।


নানা শ্রেণী-পেশার আলোচকের নানা মাত্রা ও দৃষ্টিভঙ্গির আলোচনায় গোলটেবিল বৈঠকটি প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছিল।
গোলটেবিল আলোচনায় যে বিষয়ের ওপর আলোকপাত করা হয়, সেটি হচ্ছে, পুলিশের বাজেট বরাদ্দ সীমিত। দেশে শান্তি বজায় রাখা এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি রক্ষা করার মূল দায়িত্ব পুলিশের। ফলে পুলিশকে সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে, পুলিশের জন্য আধুনিক অবকাঠামো গড়ে তুলতে হবে এবং অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত করতে হবে পুলিশকে। এসব কারণেই পুলিশের জন্য বাজেট বরাদ্দ বাড়াতে হবে। তবে আলোচনায় উপেক্ষিত ছিল পুলিশ-জনগণ আস্থার সংকট এবং পুলিশের দুর্নীতির বিষয়টি। সরকারের নানা সংস্থা ও বাহিনীর অনেক সমস্যা রয়েছে। তার মধ্যে পুলিশের ইমেজ-সংকট প্রকট। তিনটি ঘটনার উল্লেখ প্রাসঙ্গিক হবে। ঢাকার অদূরে আমিনবাজারে পুলিশের চোখের সামনে ছয়জন কলেজছাত্রকে গ্রামবাসী কর্তৃক পিটিয়ে হত্যা। দুই. খিলগাঁও থানার ওসি কর্তৃক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র কাদেরকে থানার ভেতরে চাপাতি দিয়ে কোপানো। তিন. নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জে পুলিশ ভ্যান থেকে নামিয়ে পুলিশের নির্দেশে শামসুদ্দিন মিলনকে গণপ্রহারে হত্যা করে আবার পুলিশ ভ্যানে তুলে দেওয়া। আর পুলিশের দুর্নীতি তো শত বছরের পুরোনো এক সমস্যা। ২০ মে অর্থমন্ত্রী সুশাসনবিষয়ক এক গোলটেবিল বৈঠকে দুর্নীতির শীর্ষে পুলিশ বলে উল্লেখ করেন।
পুলিশের ইমেজ-সংকট রয়েছে, পুলিশ দুর্নীতিগ্রস্ত, পুলিশের কাছ থেকে মানুষ বলতে গেলে কোনো সেবাই পায় না। এসব বিষয় আমরা জানি। সরকার আসে, সরকার যায়। কিন্তু বাংলাদেশ পুলিশ তার শতবর্ষ পুরোনো বৈশিষ্ট্যগুলো নিয়ে আগের মতোই থেকে যায়। প্রশ্ন হচ্ছে, এসবের জন্য পুলিশ কতটা দায়ী, আর নীতিনির্ধারকেরা কতটা দায়ী? বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর এ পর্যন্ত যাঁরা রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিলেন, তাঁরা কি কখনো পুলিশের সংস্কার চেয়েছেন বা পুলিশের সংস্কারে কোনো উদ্যোগ নিয়েছেন? বর্তমান সরকারের একটি উদ্যোগের কথা বলি। বছর খানেক বা তারও কিছু সময় আগে বর্তমান সরকার থানা পর্যায়ে ওসিদের স্থলে বিসিএস উত্তীর্ণ এএসপিদের স্থাপন করতে চেয়েছিল। থানা পর্যায়ে সেবার মান বাড়ানোর জন্যই সরকার এমন একটি উদ্যোগ নিতে চেয়েছিল। কিন্তু কোন অজানা কারণে বা কোন গোষ্ঠীর চাপের জন্য সরকার এটা করতে পারেনি, তা আমরা জানি না।
উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া অনেকগুলো জটিল সমস্যা নিয়ে বাংলাদেশ পুলিশ কাজ শুরু করেছে। সময় পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সমস্যাগুলো জটিলতর হয়েছে, এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নতুন নতুন সমস্যা কিন্তু পুলিশের সংস্কারের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। ১৮৬১ সালের পুলিশ আইন বাতিল করে নতুন আইন করার কথা বলা হচ্ছে অনেক দিন ধরে। পুলিশের পক্ষ থেকে নতুন আইনের খসড়াও করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু নীতিনির্ধারক ও আইনপ্রণেতারা এ বিষয়ে কোনো উদ্যোগ নিচ্ছেন না। তাহলে এ দায় তো আর পুলিশের ওপর চাপানো যায় না। তখনই প্রশ্ন ওঠে নীতিনির্ধারকেরা কি পুলিশের সংস্কার চান? পুলিশের সংস্কার না হলে তার মূল সুবিধা তো তাঁরাই ভোগ করেন! ফলে কেন তাঁরা পুলিশের সংস্কার চাইবেন?
‘পুলিশের জন্য নির্ধারিত বাজেট: বাস্তবতা ও জনগণের প্রত্যাশা’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনার মূল প্রবন্ধে উল্লেখ করা হয়েছে যে বর্তমানে বাজেটের ০.৫৮ শতাংশ পুলিশের জন্য বরাদ্দ করা হয়ে থাকে। পাশের দেশ ভারত ২০১০ সালে তার বাজেটের ৪.৩ শতাংশ পুলিশের জন্য বরাদ্দ করেছিল। ২০১০-১১ ও ২০১১-১২ অর্থবছরে পাকিস্তান তার বাজেটের যথাক্রমে ২ ও ২.১৫ শতাংশ পুলিশের জন্য বরাদ্দ করেছিল। পাশের দেশের সঙ্গে তুলনামূলক আলোচনায় এবং আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে বাংলাদেশের জাতীয় বাজেটে পুলিশের জন্য যে বরাদ্দ তা খুবই অপ্রতুল। প্রশ্ন হচ্ছে, পুলিশের বরাদ্দ কেন বৃদ্ধি করতে হবে? কেননা, পুলিশের বরাদ্দ বাড়লে পুলিশের জন্য শক্তিশালী অবকাঠামো গড়ে তোলা যাবে, পুলিশের বেতন-ভাতা ও সুযোগ-সুবিধা বাড়বে, পুলিশকে পেশাদারি ও মানবাধিকারসহ নানা বিষয়ে উন্নত প্রশিক্ষণ দেওয়া যাবে। তবে সবকিছুর মূল লক্ষ্য হতে হবে জনগণকে সেবা প্রদান এবং জনগণের মধ্যে পুলিশ সম্পর্কে ‘আস্থা’ গড়ে তোলা। বরাদ্দ বাড়ানোর পরও যদি জনগণ পুলিশের কাছ থেকে সেবা না পায়, পুলিশ যদি ‘ক্ষমতাধর’ ব্যক্তিদের সেবা দিতেই ব্যস্ত থাকে, তাহলে আমরা সে বরাদ্দ বৃদ্ধিকে সমর্থন করি না।
পুলিশ স্টেশনের ওপর ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল যে ওয়ার্কিং পেপার তৈরি করেছে, তার রিপোর্ট অনুযায়ী, মেট্রোপলিটন থানা পুলিশ মাসের শতকরা ৪০.৭ ভাগ সময় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি রক্ষার জন্য ব্যয় করে। এর মধ্যে হরতালসহ রাজনৈতিক দলগুলোর পাল্টাপাল্টি কর্মসূচিজাত নানা পরিস্থিতি মোকাবিলা রয়েছে। ভিআইপিদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য পুলিশকে ব্যয় করতে হয় মাসের শতকরা ৩২.৭ ভাগ সময়। শুধু ১৮.৪ ভাগ সময় পুলিশ পায় অপরাধের তদন্তসহ অন্যান্য কাজে যা অপরাধীর শাস্তি, অপরাধ নির্মূলসহ শান্তি-শৃঙ্খলা ও জননিরাপত্তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট।
পরিশেষে বলতে চাই, বাংলাদেশ পুলিশের সমস্যাগুলো আমরা কমবেশি জানি। কার্যকর উদ্যোগ নিয়ে ‘জনবান্ধব’ পুলিশ বাহিনী গড়ে তুলতে হবে। মনে রাখতে হবে যে মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রথম আক্রান্ত হয়েছিল রাজারবাগ পুলিশ লাইন। পুলিশ বাহিনীর অনেক সদস্য মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছিলেন। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীর অনেক সদস্য সুনামের সঙ্গে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে কাজ করছেন। এখন যেটা দরকার তা হচ্ছে, যথাযথ সংস্কার করে একটি জনবান্ধব পুলিশ বাহিনী গড়ে তোলা। আর এ ধরনের একটি পুলিশ বাহিনী গড়ার জন্যই জাতীয় বাজেটে পুলিশের বরাদ্দ বৃদ্ধি করা দরকার। তবে সে সঙ্গে পুলিশের আচরণও বদলাতে হবে। সাংবাদিকসহ সাধারণ মানুষের ওপর পুলিশ যে নিপীড়ন ও হয়রানি চালাচ্ছে, তা থেকেও বিরত থাকতে হবে। আমরা জনবান্ধব পুলিশ বাহিনী চাই, নিপীড়ক পুলিশ বাহিনী নয়।
শেখ হাফিজুর রহমান: সহযোগী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
ফারহানা হেলাল মেহতাব: সহযোগী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি।

No comments

Powered by Blogger.