বাজেট-দীর্ঘ বাজেট বত্তৃদ্ধতায় বলা হলো না অনেক কিছুই by শওকত হোসেন
‘অনেক কথা যাও যে ব’লে কোনো কথা না বলি।/ তোমার ভাষা বোঝার আশা দিয়েছি জলাঞ্জলি\’ অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের বাজেট বক্তৃতা পড়ে রবীন্দ্রনাথের গানের এই দুটি লাইন মনে পড়ল। তবে অর্থনীতির ছাত্র ও অর্থনৈতিক সাংবাদিক হিসেবে বাজেটের ভাষা বোঝার আশা জলাঞ্জলি দেওয়া গেল না।
এবারের বাজেটে অর্থমন্ত্রী অনেক কথা বলেছেন ঠিকই, কিন্তু আবার অনেক কথাই বলেননি। বাজেটে প্রকাশিত তথ্যের চেয়ে লুকানো তথ্যই মনে হলো বেশি।
অর্থমন্ত্রী ১০ জুন যে বাজেটটি দিলেন সেটি দেশের ৩৯তম বাজেট। আবার এটিকে ৪০তম বাজেটও বলা যায়। কারণ, দেশের প্রথম অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ১৯৭২ সালের ৩০ জুন একসঙ্গে ১৯৭১-৭২ এবং ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরের বাজেট দিয়েছিলেন। এরপর থেকে মোটামুটি একই ধাঁচের বাজেট বক্তৃতা দিয়ে আসছেন অর্থমন্ত্রী বা অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা। অগ্রগতি যা হয়েছে তা বক্তৃতায় নয়, উপস্থাপনায়। ১৯৯২ সালে ব্রিটিশ সাহায্য সংস্থা ডিএফআইডির সহায়তায় অর্থ মন্ত্রণালয় একটি প্রকল্প শুরু করেছিল। বাজেটীয় বরাদ্দ এবং ব্যয় নিয়ন্ত্রণ বিষয়ে সংস্কার নামের এই প্রকল্পটি রিবেক (রিফর্মস ইন বাজেটিং অ্যান্ড এক্সপেনডিচার কন্ট্রোল) নামেই পরিচিত। এর ফলে বাজেট বরাদ্দের ক্ষেত্রে অনেক স্বচ্ছতা এসেছে। আগে বাজেটের সময় দেওয়া অসংখ্য পরিসংখ্যান-সমৃদ্ধ বই থেকে কিছু উদ্ধার করা কঠিন ছিল, এখন মোটামুটি সহজেই বাজেট পরিসংখ্যান বোঝা যায়।
এর পর থেকে গণমাধ্যমে বাজেট নিয়ে রিপোর্টিংয়ের ধারা অনেকখানি পাল্টে গেছে। বাজেটের আকার যদি এক লাখ ৩২ হাজার ১৭০ কোটি টাকা হয়, তাহলে এই পরিসংখ্যান তুলে দেওয়ার মতো সহজ সাংবাদিকতা এখন আর নেই। বরং সাধারণ মানুষের ওপর বাজেটে প্রভাব কী পড়ছে, সেটাই এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সেটিই এখন গণমাধ্যমে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে, বাজেটের একগাদা পরিসংখ্যান নয়।
এবারের বাজেট বক্তৃতাটি বেশ দীর্ঘ। পরিশিষ্ট বাদ দিলে ৯২ পৃষ্ঠার বাজেট বক্তৃতার ৭৬ পৃষ্ঠা পর্যন্ত তিন অধ্যায়ে অর্থমন্ত্রী শুকরিয়া আদায় থেকে শুরু করে অর্থনীতি এবং এর সংশ্লিষ্ট অনেক কথা বলেছেন। কিন্তু রাজস্ব কার্যক্রমের বর্ণনা দিয়েছেন শেষ অধ্যায়ে মাত্র ১৩ পৃষ্ঠার মধ্যে। এর সঙ্গে ১৯ পৃষ্ঠাজুড়ে রয়েছে রাজস্ব-সংক্রান্ত বিভিন্ন কার্যক্রমের বিবরণ। নতুন অর্থবছরে মানুষের যাপিত জীবন কেমন যাবে, তা এই রাজস্ব কার্যক্রম থেকেই জানতে পারার কথা। কিন্তু সেই নিরিখে এবারের বাজেটকে অস্বচ্ছই বলা যায়। বাজেট থেকে সাধারণ মানুষ কী জানতে চায়? কত টাকার বাজেট, আয় কত, ব্যয় কত, ঘাটতি কত, সর্বোচ্চ বরাদ্দ কোন খাতে, সুদ পরিশোধে কত বরাদ্দ, এসব? নাকি কোথায় কোথায় নতুন করে বা বেশি হারে কর দিতে হবে সেটি? অর্থমন্ত্রী সাধারণ মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় এ কথাগুলোই বলেননি।
২০০৯-১০ অর্থবছরের সংশোধিত রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ৭৯ হাজার ৪৮৪ কোটি টাকা। আর আগামী অর্থবছরের জন্য আয়ের পরিকল্পনা ৯২ হাজার ৮৪৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ আগামী অর্থবছরে জনগণকে বাড়তি কর দিতে হবে ১৩ হাজার ৩৬৩ কোটি টাকা। অর্থমন্ত্রী যে কেবল করের আওতা বাড়িয়েছেন তা নয়, কিছু কিছু ক্ষেত্রে করের হারও বাড়িয়েছেন। এর ফলে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় রাজস্ব আদায় বেশি হবে বলেই মনে করছে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই। সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসছে, কোন কোন খাতে কর বসল, কত হারে বসল।
অস্বচ্ছতার কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া যায়। অর্থমন্ত্রী ৮১ নম্বর পৃষ্ঠায় উৎস মূলে আয়কর সংগ্রহের হার যৌক্তিকীকরণ করা প্রয়োজন বলে এর বিস্তারিত পরিশিষ্টের পঞ্চম অংশে উল্লেখ করেছেন। পরিশিষ্ট পড়ে জানার কোনো উপায় নেই যে আমদানি পর্যায়ে উৎসে আয়করের হার ৩ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৫ শতাংশ করা হয়েছে। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে মোট আমদানির পরিমাণ ছিল দুই হাজার ২৫০ কোটি টাকা। ২০১০-১১ অর্থবছরে এর পরিমাণ আরও বাড়বে। এর বড় অংশ থেকেই উৎসে আয়কর কেটে নেওয়া হবে। এতে বাড়তি রাজস্ব আদায় হবে এক হাজার কোটি টাকার অনেক বেশি। এর অর্থ হচ্ছে প্রায় সব ধরনের আমদানি পণ্যের দাম বাড়ছে, যা অবশ্যই বাজারে প্রভাব ফেলবে। এত বড় একটি সিদ্ধান্তের কথা অর্থমন্ত্রী বাজেটে উল্লেখই করলেন না।
সঞ্চয়পত্র নিরাপদ বিনিয়োগ নামেই পরিচিত। গৃহিণী থেকে শুরু করে অবসরপ্রাপ্ত ব্যক্তিসহ অসংখ্য ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরাই সঞ্চয়পত্র কিনে থাকেন। শেয়ারবাজারের রমরমা অবস্থাতেও ঝুঁকির কারণে তাঁরা সেখানে যাবেন না। অনেকেরই জীবন চলে সঞ্চয়পত্রের আয় থেকে। সঞ্চয়পত্রের প্রতি আগ্রহ আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। ২০০৯-১০ অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে ১১ হাজার ৯৭ কোটি টাকার, আর চলতি অর্থবছরের প্রথম নয় মাসেই বিক্রি হয়েছে ১৮ হাজার ৯০৭ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র। এত দিন এই সঞ্চয়পত্রের আয় দেড় লাখ টাকা পর্যন্ত ছিল আয়করমুক্ত। আর পেনশনভোগী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য যে বিশেষ সঞ্চয়পত্র, তা ছিল সম্পূর্ণই করমুক্ত।
অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তৃতার ১৬ পৃষ্ঠায় বলেছেন, ‘অনেক মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পরিবারের সামাজিক নিরাপত্তা হিসেবে এ স্কিমগুলো তাঁদের উপকারে আসে।’ এ কথা উল্লেখ করে অর্থমন্ত্রী কেবল বলেছেন, ‘আগামী অর্থবছরে আমরা ঋণসীমা, ঋণের পরিমাণ ও সুদের হারসমূহের যৌক্তিকীকরণের জন্য একটি গ্রহণযোগ্য নীতিমালা প্রণয়নের আশা করছি।’ এ কথা বলা হলেও আসলে বাজেটে সঞ্চয়পত্রকে সম্পূর্ণভাবে আয়করের আওতায় আনা হয়েছে। এমনকি পেনশনভোগীরাও আর ছাড় পাচ্ছেন না। অথচ বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী এত গুরুত্বপূর্ণ একটি সিদ্ধান্তের কথা জানানোরই প্রয়োজন বোধ করলেন না।
দেশজুড়ে আছেন অসংখ্য খুচরা ও ক্ষুদ্র দোকানদার। তাঁদের বছরে নির্দিষ্ট হারে মূল্য সংযোজন কর (মূসক বা ভ্যাট) দিতে হয়। নতুন বাজেটে সবার কর বাড়ানো হয়েছে। যেমন, ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন এলাকার জন্য এত দিন দিতে হয়েছে চার হাজার ২০০ টাকা, নতুন অর্থবছর থেকে দিতে হবে ছয় হাজার টাকা, অন্যান্য সিটি করপোরেশন এলাকায় দিতে হতো তিন হাজার ৬০০ টাকা, বাড়িয়ে করা হয়েছে চার হাজার ৮০০ টাকা, অন্যান্য জেলা শহর ও পৌর এলাকায় এর পরিমাণ ছিল দুই হাজার ৪০০ টাকা, করা হয়েছে তিন হাজার ৬০০ টাকা এবং দেশের বাকি এলাকায় এই মূসকের পরিমাণ এক হাজার ২০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে এক হাজার ৮০০ টাকা করা হয়েছে।
আবার আমদানির ক্ষেত্রে অগ্রিম ব্যবসায় মূসকের হারও (এটিভি) ২ দশমিক ২৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৩ শতাংশ করা হয়েছে। একই সঙ্গে ব্যবসায়ী পর্যায়ে মূসকের হার ছিল দেড় শতাংশ, করা হয়েছে ৩ শতাংশ।
সারা দেশের দোকানদার ও ব্যবসায়ীরা কর বাড়ানোর এই তথ্য কোথা থেকে জানবেন? জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) থেকে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করলেই কি যথেষ্ট? বাজেট বক্তৃতার মাধ্যমে দেশের সবাইকে একসঙ্গে জানানোর সুযোগটা নিলেন না কেন অর্থমন্ত্রী?
এবার আসা যাক কালো টাকা প্রসঙ্গে। চলতি বাজেটে কালো টাকা সাদা করার ব্যাপক সুযোগ দিয়েছিলেন অর্থমন্ত্রী। পরে সমালোচনার মুখে এই সুযোগ ২০১০ সালের জুন পর্যন্ত রাখা হয়। ফলে এমনিতেই ৩০ জুন কালো টাকা সাদা করার সুযোগের মেয়াদ শেষ হয়ে যাচ্ছে। অর্থমন্ত্রী কিন্তু বাজেটে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ আবার দিয়েছেন। অথচ বাজেট বক্তৃতায় তিনি সে কথা উচ্চারণই করেননি। ৭৯ পৃষ্ঠায় তিনি একটি ভৌত অবকাঠামো অর্থায়ন তহবিল গঠনের কথা জানিয়ে বলেছেন, ‘এই তহবিলের ইস্যুকৃত বন্ডে জুন ২০১২ সাল পর্যন্ত ১০ শতাংশ হারে কর প্রদান সাপেক্ষে বিনিয়োগের বিধান প্রবর্তন করা হবে।’ অর্থবিল ঘেঁটে দেখা গেল, এটি আসলে কালো টাকা সাদা করারই সুযোগ। কেননা, আয়কর অধ্যাদেশে ১৯সি নামে একটি ধারা সংযোজন করে বলা হয়েছে, এই তহবিলে বিনিয়োগ করলে অর্থের উৎস সম্বন্ধে কোনো প্রশ্নই করা হবে না।
এ রকম অনেক কথাই নেই বাজেট বক্তৃতায়। আদতে এবারের বাজেটে লুকানো আছে অনেক কিছুই। এই অস্বচ্ছতার কারণও বোঝা গেল না। বাজেট তৈরির জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ের আলাদা বিভাগ আছে। তবে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়সংক্রান্ত যেসব কথা বাজেট বক্তৃতায় লেখা থাকে, সেসব পাঠায় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলো। আর রাজস্ব কার্যক্রম অংশটি তৈরি করে দেয় এনবিআর। এসব পেয়ে নিজস্ব বক্তব্য ও দর্শন ঢুকিয়ে অর্থমন্ত্রী তৈরি করেন বাজেট বক্তৃতা। সুতরাং এনবিআর কেন সবকিছু পরিষ্কার করল না, সে প্রশ্ন থেকেই যায়।
মানুষ কম জানলেই কি বাজেট সমালোচনা কম হয়?
শওকত হোসেন: সাংবাদিক।
massum99@yahoo.com
অর্থমন্ত্রী ১০ জুন যে বাজেটটি দিলেন সেটি দেশের ৩৯তম বাজেট। আবার এটিকে ৪০তম বাজেটও বলা যায়। কারণ, দেশের প্রথম অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ১৯৭২ সালের ৩০ জুন একসঙ্গে ১৯৭১-৭২ এবং ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরের বাজেট দিয়েছিলেন। এরপর থেকে মোটামুটি একই ধাঁচের বাজেট বক্তৃতা দিয়ে আসছেন অর্থমন্ত্রী বা অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা। অগ্রগতি যা হয়েছে তা বক্তৃতায় নয়, উপস্থাপনায়। ১৯৯২ সালে ব্রিটিশ সাহায্য সংস্থা ডিএফআইডির সহায়তায় অর্থ মন্ত্রণালয় একটি প্রকল্প শুরু করেছিল। বাজেটীয় বরাদ্দ এবং ব্যয় নিয়ন্ত্রণ বিষয়ে সংস্কার নামের এই প্রকল্পটি রিবেক (রিফর্মস ইন বাজেটিং অ্যান্ড এক্সপেনডিচার কন্ট্রোল) নামেই পরিচিত। এর ফলে বাজেট বরাদ্দের ক্ষেত্রে অনেক স্বচ্ছতা এসেছে। আগে বাজেটের সময় দেওয়া অসংখ্য পরিসংখ্যান-সমৃদ্ধ বই থেকে কিছু উদ্ধার করা কঠিন ছিল, এখন মোটামুটি সহজেই বাজেট পরিসংখ্যান বোঝা যায়।
এর পর থেকে গণমাধ্যমে বাজেট নিয়ে রিপোর্টিংয়ের ধারা অনেকখানি পাল্টে গেছে। বাজেটের আকার যদি এক লাখ ৩২ হাজার ১৭০ কোটি টাকা হয়, তাহলে এই পরিসংখ্যান তুলে দেওয়ার মতো সহজ সাংবাদিকতা এখন আর নেই। বরং সাধারণ মানুষের ওপর বাজেটে প্রভাব কী পড়ছে, সেটাই এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সেটিই এখন গণমাধ্যমে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে, বাজেটের একগাদা পরিসংখ্যান নয়।
এবারের বাজেট বক্তৃতাটি বেশ দীর্ঘ। পরিশিষ্ট বাদ দিলে ৯২ পৃষ্ঠার বাজেট বক্তৃতার ৭৬ পৃষ্ঠা পর্যন্ত তিন অধ্যায়ে অর্থমন্ত্রী শুকরিয়া আদায় থেকে শুরু করে অর্থনীতি এবং এর সংশ্লিষ্ট অনেক কথা বলেছেন। কিন্তু রাজস্ব কার্যক্রমের বর্ণনা দিয়েছেন শেষ অধ্যায়ে মাত্র ১৩ পৃষ্ঠার মধ্যে। এর সঙ্গে ১৯ পৃষ্ঠাজুড়ে রয়েছে রাজস্ব-সংক্রান্ত বিভিন্ন কার্যক্রমের বিবরণ। নতুন অর্থবছরে মানুষের যাপিত জীবন কেমন যাবে, তা এই রাজস্ব কার্যক্রম থেকেই জানতে পারার কথা। কিন্তু সেই নিরিখে এবারের বাজেটকে অস্বচ্ছই বলা যায়। বাজেট থেকে সাধারণ মানুষ কী জানতে চায়? কত টাকার বাজেট, আয় কত, ব্যয় কত, ঘাটতি কত, সর্বোচ্চ বরাদ্দ কোন খাতে, সুদ পরিশোধে কত বরাদ্দ, এসব? নাকি কোথায় কোথায় নতুন করে বা বেশি হারে কর দিতে হবে সেটি? অর্থমন্ত্রী সাধারণ মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় এ কথাগুলোই বলেননি।
২০০৯-১০ অর্থবছরের সংশোধিত রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ৭৯ হাজার ৪৮৪ কোটি টাকা। আর আগামী অর্থবছরের জন্য আয়ের পরিকল্পনা ৯২ হাজার ৮৪৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ আগামী অর্থবছরে জনগণকে বাড়তি কর দিতে হবে ১৩ হাজার ৩৬৩ কোটি টাকা। অর্থমন্ত্রী যে কেবল করের আওতা বাড়িয়েছেন তা নয়, কিছু কিছু ক্ষেত্রে করের হারও বাড়িয়েছেন। এর ফলে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় রাজস্ব আদায় বেশি হবে বলেই মনে করছে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই। সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসছে, কোন কোন খাতে কর বসল, কত হারে বসল।
অস্বচ্ছতার কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া যায়। অর্থমন্ত্রী ৮১ নম্বর পৃষ্ঠায় উৎস মূলে আয়কর সংগ্রহের হার যৌক্তিকীকরণ করা প্রয়োজন বলে এর বিস্তারিত পরিশিষ্টের পঞ্চম অংশে উল্লেখ করেছেন। পরিশিষ্ট পড়ে জানার কোনো উপায় নেই যে আমদানি পর্যায়ে উৎসে আয়করের হার ৩ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৫ শতাংশ করা হয়েছে। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে মোট আমদানির পরিমাণ ছিল দুই হাজার ২৫০ কোটি টাকা। ২০১০-১১ অর্থবছরে এর পরিমাণ আরও বাড়বে। এর বড় অংশ থেকেই উৎসে আয়কর কেটে নেওয়া হবে। এতে বাড়তি রাজস্ব আদায় হবে এক হাজার কোটি টাকার অনেক বেশি। এর অর্থ হচ্ছে প্রায় সব ধরনের আমদানি পণ্যের দাম বাড়ছে, যা অবশ্যই বাজারে প্রভাব ফেলবে। এত বড় একটি সিদ্ধান্তের কথা অর্থমন্ত্রী বাজেটে উল্লেখই করলেন না।
সঞ্চয়পত্র নিরাপদ বিনিয়োগ নামেই পরিচিত। গৃহিণী থেকে শুরু করে অবসরপ্রাপ্ত ব্যক্তিসহ অসংখ্য ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরাই সঞ্চয়পত্র কিনে থাকেন। শেয়ারবাজারের রমরমা অবস্থাতেও ঝুঁকির কারণে তাঁরা সেখানে যাবেন না। অনেকেরই জীবন চলে সঞ্চয়পত্রের আয় থেকে। সঞ্চয়পত্রের প্রতি আগ্রহ আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। ২০০৯-১০ অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে ১১ হাজার ৯৭ কোটি টাকার, আর চলতি অর্থবছরের প্রথম নয় মাসেই বিক্রি হয়েছে ১৮ হাজার ৯০৭ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র। এত দিন এই সঞ্চয়পত্রের আয় দেড় লাখ টাকা পর্যন্ত ছিল আয়করমুক্ত। আর পেনশনভোগী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য যে বিশেষ সঞ্চয়পত্র, তা ছিল সম্পূর্ণই করমুক্ত।
অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তৃতার ১৬ পৃষ্ঠায় বলেছেন, ‘অনেক মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পরিবারের সামাজিক নিরাপত্তা হিসেবে এ স্কিমগুলো তাঁদের উপকারে আসে।’ এ কথা উল্লেখ করে অর্থমন্ত্রী কেবল বলেছেন, ‘আগামী অর্থবছরে আমরা ঋণসীমা, ঋণের পরিমাণ ও সুদের হারসমূহের যৌক্তিকীকরণের জন্য একটি গ্রহণযোগ্য নীতিমালা প্রণয়নের আশা করছি।’ এ কথা বলা হলেও আসলে বাজেটে সঞ্চয়পত্রকে সম্পূর্ণভাবে আয়করের আওতায় আনা হয়েছে। এমনকি পেনশনভোগীরাও আর ছাড় পাচ্ছেন না। অথচ বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী এত গুরুত্বপূর্ণ একটি সিদ্ধান্তের কথা জানানোরই প্রয়োজন বোধ করলেন না।
দেশজুড়ে আছেন অসংখ্য খুচরা ও ক্ষুদ্র দোকানদার। তাঁদের বছরে নির্দিষ্ট হারে মূল্য সংযোজন কর (মূসক বা ভ্যাট) দিতে হয়। নতুন বাজেটে সবার কর বাড়ানো হয়েছে। যেমন, ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন এলাকার জন্য এত দিন দিতে হয়েছে চার হাজার ২০০ টাকা, নতুন অর্থবছর থেকে দিতে হবে ছয় হাজার টাকা, অন্যান্য সিটি করপোরেশন এলাকায় দিতে হতো তিন হাজার ৬০০ টাকা, বাড়িয়ে করা হয়েছে চার হাজার ৮০০ টাকা, অন্যান্য জেলা শহর ও পৌর এলাকায় এর পরিমাণ ছিল দুই হাজার ৪০০ টাকা, করা হয়েছে তিন হাজার ৬০০ টাকা এবং দেশের বাকি এলাকায় এই মূসকের পরিমাণ এক হাজার ২০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে এক হাজার ৮০০ টাকা করা হয়েছে।
আবার আমদানির ক্ষেত্রে অগ্রিম ব্যবসায় মূসকের হারও (এটিভি) ২ দশমিক ২৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৩ শতাংশ করা হয়েছে। একই সঙ্গে ব্যবসায়ী পর্যায়ে মূসকের হার ছিল দেড় শতাংশ, করা হয়েছে ৩ শতাংশ।
সারা দেশের দোকানদার ও ব্যবসায়ীরা কর বাড়ানোর এই তথ্য কোথা থেকে জানবেন? জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) থেকে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করলেই কি যথেষ্ট? বাজেট বক্তৃতার মাধ্যমে দেশের সবাইকে একসঙ্গে জানানোর সুযোগটা নিলেন না কেন অর্থমন্ত্রী?
এবার আসা যাক কালো টাকা প্রসঙ্গে। চলতি বাজেটে কালো টাকা সাদা করার ব্যাপক সুযোগ দিয়েছিলেন অর্থমন্ত্রী। পরে সমালোচনার মুখে এই সুযোগ ২০১০ সালের জুন পর্যন্ত রাখা হয়। ফলে এমনিতেই ৩০ জুন কালো টাকা সাদা করার সুযোগের মেয়াদ শেষ হয়ে যাচ্ছে। অর্থমন্ত্রী কিন্তু বাজেটে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ আবার দিয়েছেন। অথচ বাজেট বক্তৃতায় তিনি সে কথা উচ্চারণই করেননি। ৭৯ পৃষ্ঠায় তিনি একটি ভৌত অবকাঠামো অর্থায়ন তহবিল গঠনের কথা জানিয়ে বলেছেন, ‘এই তহবিলের ইস্যুকৃত বন্ডে জুন ২০১২ সাল পর্যন্ত ১০ শতাংশ হারে কর প্রদান সাপেক্ষে বিনিয়োগের বিধান প্রবর্তন করা হবে।’ অর্থবিল ঘেঁটে দেখা গেল, এটি আসলে কালো টাকা সাদা করারই সুযোগ। কেননা, আয়কর অধ্যাদেশে ১৯সি নামে একটি ধারা সংযোজন করে বলা হয়েছে, এই তহবিলে বিনিয়োগ করলে অর্থের উৎস সম্বন্ধে কোনো প্রশ্নই করা হবে না।
এ রকম অনেক কথাই নেই বাজেট বক্তৃতায়। আদতে এবারের বাজেটে লুকানো আছে অনেক কিছুই। এই অস্বচ্ছতার কারণও বোঝা গেল না। বাজেট তৈরির জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ের আলাদা বিভাগ আছে। তবে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়সংক্রান্ত যেসব কথা বাজেট বক্তৃতায় লেখা থাকে, সেসব পাঠায় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলো। আর রাজস্ব কার্যক্রম অংশটি তৈরি করে দেয় এনবিআর। এসব পেয়ে নিজস্ব বক্তব্য ও দর্শন ঢুকিয়ে অর্থমন্ত্রী তৈরি করেন বাজেট বক্তৃতা। সুতরাং এনবিআর কেন সবকিছু পরিষ্কার করল না, সে প্রশ্ন থেকেই যায়।
মানুষ কম জানলেই কি বাজেট সমালোচনা কম হয়?
শওকত হোসেন: সাংবাদিক।
massum99@yahoo.com
No comments