বাজেট পর্যালোচনা-উন্নয়নদর্শন ও বরাদ্দের ফাঁকি by আনু মুহাম্মদ
বর্তমান অর্থমন্ত্রীর কাজের অভিজ্ঞতা দীর্ঘদিনের, বাজেট প্রস্তাবনারও। তিনি প্রথম বাজেট পেশ করেন ১৯৮২-৮৩ অর্থবছরের এবং পরে ১৯৮৩-৮৪ সালের। তিনি তখন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের নেতৃত্বাধীন সামরিক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ছিলেন।
১৯৮৫ সালে তৃতীয় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা নিয়ে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির বিশেষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে সভাপতির ভাষণে বাজেট ও পরিকল্পনা নিয়ে হতাশা ব্যক্ত করে রেহমান সোবহান বলেছিলেন, ‘আগামী ২০ বছর বাংলাদেশ কীভাবে কোন দিকে চলবে তা আগেই ঠিক হয়ে আছে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সাথে চুক্তির কারণে।’ এই অবস্থা আরও জোরদার হয়েছে গত ২৫ বছরে। এর আরেক প্রান্তে সেই মুহিত সাহেব আবারও বাজেট উপস্থাপন করছেন। এর মধ্যে অনেক সরকার পরিবর্তন হয়েছে, কিন্তু উন্নয়ন দর্শনের ধারাবাহিকতা রয়ে গেছে। সেটি কোথায়?
বস্তুত, আশির দশকটি অন্য অনেক দেশের মতো বাংলাদেশের অর্থনীতির বর্তমান গতিমুখ ও চেহারা নির্ধারণেও গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সে সময় রিগ্যান ও থ্যাচারের নেতৃত্বাধীন বিশ্ব পুঁজিবাদী ব্যবস্থাপনায় নয়া উদারতাবাদী (নিও লিবারেল), সঠিকভাবে বললে গোঁড়া ডানপন্থী বৃহৎ পুঁজিমুখী কর্মসূচির জোর প্রতাপ শুরু হয়। ওয়াশিংটন কনসেনশাস কাঠামোর অধীনে সমন্বিত ও শক্তিশালীভাবে কাঠামোগত সমন্বয় কর্মসূচির প্রয়োগ শুরু হয়। সেই কাজে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ প্রভৃতি সংস্থা বাংলাদেশসহ প্রান্তস্থ দেশগুলোর বিভিন্ন খাতে তাদের উপযোগী নীতি ও প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করে। এসব সংস্থার নেতৃত্বে তথাকথিত বিদেশি সাহায্যের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশে দারিদ্র্য দূর ও উন্নয়নের নামে কীভাবে দখল ও লুণ্ঠনের বিভিন্ন নীতি ও প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে তার কিছু প্রামাণ্য বিবরণ পাওয়া যাবে জন পারকিনসের কনফেশনস অব ইকোনমিক হিটম্যান (২০০৪) ও দ্য সিক্রেট হিস্ট্রি অব দ্য আমেরিকান এম্পায়ার (২০০৭), নাওমি ক্লেইনের শক ডকট্রিন: দ্য রাইজ অব ডিসাস্টার ক্যাপিটালিজম (২০০৮) প্রভৃতি বইয়ে।
উন্নয়ন নামে এই সর্বনাশা জাল টিকে থাকে দেশের ভেতর তার সমর্থক গোষ্ঠীর কারণে, যারা এসব তৎপরতার প্রধান সুবিধাভোগী। আন্দ্রে গুন্ডার ফ্রাংক ও চেরিল পেয়ার এদের নাম দিয়েছিলেন পঞ্চম বাহিনী, যারা দেশের নাগরিক অথচ বহুজাতিক পুঁজির স্বার্থরক্ষাকারী হিসেবে নিজেদের বিত্ত ও ক্ষমতা নিশ্চিত করে। এদের মধ্যে রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, আমলা ছাড়াও থাকে ‘বিশেষজ্ঞ’। নিজের পেশার মানুষদের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করে রেহমান সোবহান সে সময় আরও বলেছিলেন, “অর্থনীতিবিদরা বিদেশি সাহায্য নির্ভর গবেষণায় এরকম ব্যস্ত আগে কখনোই ছিল না। বাংলাদেশের দারিদ্র ও অনুন্নয়ন ‘অনুধাবন’ করবার জন্য জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক অর্থসংস্থানকারী প্রতিষ্ঠানসমূহ যে কোটি কোটি ডলার যোগান দিচ্ছে তার প্রধান সুবিধাভোগী এখন তারা।”
এসব ঋণ ও অনুদান নিয়ে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে যেসব নীতি প্রণীত বা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় তা কোনো নির্বাচিত সংস্থায় আলোচনা করে হয় না। গোপনীয়তা, অস্বচ্ছতা, অপচয় ও দুর্নীতি এসব নীতি ও প্রকল্প প্রণয়ন-প্রক্রিয়ার অন্যতম দিক। আশি, নব্বই ও বর্তমান দশকজুড়ে অন্য প্রান্তস্থ দেশগুলোর মতো বাংলাদেশও ‘ওয়াশিংটন কনসেনশাস’-এর জোয়ালে ঘাড়টা দিয়ে উন্নয়ন ও সংস্কারের নামে অনেক কর্মসূচি নিয়েছে। এসব কর্মসূচিরই ফল হলো আদমজী পাটকল বন্ধসহ পাট খাতে বড় বিপর্যয়, জ্বালানি খাতে জাতীয় সক্ষমতার অবক্ষয় ও বিদেশি মালিকানার সম্প্রসারণ, শিক্ষা ও চিকিৎসা খাতে অব্যাহত বাণিজ্যিকীকরণ, নদীনালা খালবিল জলাশয় দখল ও ভরাট করে বিনিয়োগ, আমদানিনির্ভরতা বৃদ্ধি, মিল থেকে মলমুখী (শপিং) অর্থনৈতিক তৎপরতার বিস্তার, চট্টগ্রাম স্টিল মিল, মেশিন টুলস ফ্যাক্টরিসহ বহু শিল্পকারখানা বন্ধ, বহু রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান পানির দামে বিতরণ, রেলওয়ে সংকোচন, দখল ও লুণ্ঠন-প্রক্রিয়ায় জনগণের সাধারণ সম্পত্তি ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে রূপান্তর, কৃষি খাতে হাইব্রিড বীজসহ কোম্পানিনির্ভরতা বৃদ্ধি, চোরাই টাকার তৎপরতা বৃদ্ধি, কাজ ও মজুরির নিরাপত্তা সংকোচন, বাণিজ্য ঘাটতির ক্রমান্বয় বৃদ্ধি এবং নতুন ধনিক শ্রেণীর জন্ম ও বিকাশ।
সন্দেহ নেই, এসবের মধ্য দিয়ে আমাদের সমাজ-অর্থনীতির বিশেষত ঢাকা শহরের জৌলুশ অনেক বেড়েছে। টিভি চ্যানেলে বিজ্ঞাপন ও বিলবোর্ড, বহুতল ভবন, শপিংমল, বেসরকারি ব্যয়বহুল জাঁকজমকপূর্ণ হাসপাতাল, ডায়াগনস্টিক সেন্টার আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অগণিত ব্যক্তিগত গাড়ি, ব্যয়বহুল রেস্টুরেন্ট ইত্যাদি মিলে উন্নয়নের একটা চেহারা দাঁড়িয়েছে। জিডিপি প্রবৃদ্ধিও অন্য অনেক দেশের তুলনায় খারাপ হয়নি। কিন্তু এই জৌলুশের নিচে চাপা পড়ে থাকে জাতীয় সক্ষমতার বদলে হীনম্মন্যতার প্রাতিষ্ঠানিকতা, সবার জন্য সুলভে শিক্ষা, চিকিৎসা ও গণপরিবহন নিশ্চিতকরণে রাষ্ট্রীয় দায়িত্বের প্রশ্ন, দখল ও লুণ্ঠনের তৎপরতা, আর টেকসই উন্নয়নের বদলে টেকসই দারিদ্র্যের দগদগে চিত্র।
উন্নয়ন দর্শনের এই ধারাবাহিকতার অন্যতম শিকার বাংলাদেশের জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাত। ১৯৮১ সাল থেকে এই খাতের দিকে নজর যায় বিশ্বব্যাংকসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর। তাদের ঋণের টাকায় নানা গবেষণা করে যে দৃষ্টিভঙ্গি ক্রমে প্রতিষ্ঠিত হয় তার মূল কথা হলো, গ্যাস রপ্তানি করতে হবে; এই খাত ছাড়তে হবে বহুজাতিক কোম্পানির হাতে, রাষ্ট্রীয় বিদ্যুৎ প্লান্টে আর অর্থ ব্যয় করা হবে না। এই রাস্তা ধরেই ১৯৯৩-৯৪ সালে প্রথম উৎপাদন বণ্টন চুক্তি হয় এবং ১৯৯৬ সালে বেসরকারি খাতে বিদ্যুৎ উৎপাদননীতি চূড়ান্ত হয়। এই খাতে বিপর্যয়ের শুরু তখন থেকেই। ফলে এখন এই খাতে যে বরাদ্দ আমরা চোখে দেখি তার দুই-তৃতীয়াংশই গ্যাস ও বিদ্যুৎ কিনতে ভর্তুকি হিসেবে খরচ হয়। দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রান্তিক অবস্থানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে ‘পুঁজির অভাব’ যুক্তি দিয়ে, অথচ বিদেশি কোম্পানির স্বার্থে ভর্তুকি দিতে তার কয়েক গুণ অর্থ ঠিকই খরচ করা হচ্ছে। বছর বছর তাই দাম বাড়ে গ্যাস ও বিদ্যুতের। কিন্তু সংকট ও অনিশ্চয়তা কমে না। বর্তমান সরকারও তার জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতের পথ-নকশায় (জুন ২০১০) এই ধারাকে আরও শক্তিশালী করার সংকল্প ব্যক্ত করেছে।
জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে বলে অর্থমন্ত্রী দাবি করেছেন, অনেক বিশেষজ্ঞ ও সংস্থা সেটা সত্য ধরে নিয়ে উচ্ছ্বাসও প্রকাশ করছেন। এসব দাবি ও কথার ভিত্তি হলো এ খাতে বর্ধিত বরাদ্দ। গত বছরের মূল বরাদ্দের তুলনায় এটি ১৮০৪ কোটি টাকা বেশি। কিন্তু জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে এই বর্ধিত বরাদ্দ বাপেক্স-পেট্রোবাংলাকে শক্তিশালী করাসহ জাতীয় সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য নয়, বিদ্যুৎ প্লান্ট স্থাপনের জন্য নয়, এই খাতে শিক্ষা ও গবেষণা বিকাশের জন্যও নয়। তাহলে এর আসল খরচের জায়গা কোথায়?
আগের বছর অর্থাৎ ২০০৯-১০ অর্থবছরে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে অর্থ বরাদ্দ ছিল ৪৩১০ কোটি টাকা। বছর শেষে অর্থাৎ ২০১০ সালের জুন পর্যন্ত হিসাবে দেখা যায়, ৫২৪ কোটি টাকা ব্যয় হয়নি। সম্পদের অভাবের যুক্তিতে যেখানে বাপেক্স-পেট্রোবাংলায় বহু পদ খালি, প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি কেনা হয় না, প্রশিক্ষণ-গবেষণা হয় না, সেখানে ৫৪২ কোটি টাকা উদ্বৃত্ত থাকে কী করে? অথচ এই সময়কালে সারা দেশ যে অভূতপূর্ব গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকটে পড়েছিল তাকে মোকাবিলার জন্য যদি দেশীয় সংস্থার অধীন গ্যাসক্ষেত্র ও বিদ্যুৎ প্লান্টে মেরামত, নবায়নসহ প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা হতো, তাহলে এই পরিমাণ অর্থই স্বল্প মেয়াদে যথেষ্ট ছিল। তাতে গ্যাসের ঘাটতি দূর হতো এবং রাষ্ট্রীয় বিদ্যুৎ প্লান্টগুলো অনেক কম দামে ভর্তুকি ছাড়া আমাদের বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে সক্ষম হতো। এই কাজগুলো না হওয়া নিছক অদক্ষতার সমস্যা নয়, এগুলো উন্নয়ননীতির অংশ। দুর্নীতি তার সহযোগী।
একদিকে এসব কাজের জন্য টাকা খরচ হলো না, অন্যদিকে বিদ্যুৎ সংকট সমাধানের নামে অনেক বেশি দামে, অনির্ভরযোগ্য রেন্টাল পাওয়ার প্লান্ট স্থাপনের জন্য, কোনো দরপত্র ছাড়াই চুক্তি করা হলো প্রধানত কয়েকটি বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে। ড্রিলিংয়ের কাজ বাপেক্সকে না দিয়ে দেওয়া হচ্ছে বিদেশি কোম্পানিকে। এসবের ফলে সামনের বছর থেকে বাংলাদেশের কয়েক হাজার কোটি টাকা বাড়তি খরচ হতে থাকবে। বাজেটের বাড়তি বরাদ্দ এসব খরচ জোগানের জন্যই। এই বরাদ্দ দিয়ে কুলাবে না বলে বাজেট অধিবেশনের পরে বাড়ানো হবে গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম। এই দামবৃদ্ধি জনগণের জীবনে কয়েক দফা শুল্কবৃদ্ধির শামিল। সকল পর্যায়ে উৎপাদনব্যয় বাড়বে এবং তার চক্রাকার প্রভাবে জীবনযাত্রার ব্যয়ও বৃদ্ধি পাবে। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের প্রকৃত আয় কমবে। ক্ষতিগ্রস্ত হবে প্রকৃত শিল্পোদ্যোক্তারাও।
উল্লেখ্য, ১৯৯৭ ও ২০০৫ সালে মাগুরছড়া ও টেংরাটিলায় যথাক্রমে মার্কিন ও কানাডীয় কোম্পানির কর্তৃত্বাধীন গ্যাসক্ষেত্রে যে বিস্ফোরণ হয় তাতে বাংলাদেশের কমপক্ষে ৫০০ বিলিয়ন বা আধা ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস নষ্ট হয়। এই গ্যাস বর্তমানে বার্ষিক মোট উত্তোলিত গ্যাসের সমপরিমাণ। বাংলাদেশে এখন যে পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে, এই হারানো গ্যাস দিয়ে সেই পরিমাণ আরও বিদ্যুৎ তিন বছর ধরে উৎপাদন করা যেত। এর জন্য শেভ্রন ও নাইকোর কাছ থেকে আমাদের ক্ষতিপূরণ পাওয়ার কথা পাঁচ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বা প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকা। এটা শুধু গ্যাসসম্পদের দাম। এই দাম আমরা হিসাব করেছি বাংলাদেশ যে দামে এখন কাতার থেকে গ্যাস আমদানির দরকষাকষি করছে তার নিম্নহার বিবেচনা করে।
এই অর্থ চলতি বছরের মোট বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির চেয়ে বেশি। এটি প্রস্তাবিত বাজেটে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে ‘বর্ধিত বরাদ্দের’ প্রায় ছয় গুণ, বিদেশি সাহায্য বলে যে পরিমাণ অর্থ দেখানো হয়েছে তার প্রায় চার গুণ। অথচ এই বিশাল পরিমাণ অর্থ দাবি করার বা তা নিয়ে প্রয়োজনীয় কোনো উদ্যোগ এ যাবৎ কোনো সরকারই গ্রহণ করেনি। যুক্তরাষ্ট্রে সম্পদ ধ্বংসের জন্য তেল কোম্পানি বিপি (ব্রিটিশ পেট্রোলিয়াম) হাতজোড় করে ২০ বিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণ প্রদান করছে, আর বাংলাদেশে তাদের হাতে আরও সম্পদ তুলে দেওয়ার আয়োজন চলছে। দুই মাস আগে মেক্সিকো উপসাগরে তেল উত্তোলনে সংঘটিত দুর্ঘটনার জন্য বিপিকে এর মধ্যে কমপক্ষে সাতবার প্রকাশ্য (সরাসরি টিভি সম্প্রচারে) শুনানির সম্মুখীন হতে হয়েছে। বাংলাদেশে সেই দেশেরই তেল কোম্পানির গাফিলতি ও অদক্ষতায় সৃষ্ট ধ্বংসকাণ্ডের জন্য গত ১৩ বছরে একবারও তাদের নিয়ে কোনো শুনানি হয়নি। বাংলাদেশের উন্নয়নে নীতিনির্ধারক বিশ্বব্যাংক গোষ্ঠী জাতীয় প্রতিষ্ঠানে কথিত অদক্ষতা ও লোকসান নিয়ে সারাক্ষণ সোচ্চার থাকলেও, বহুজাতিক সংস্থার অদক্ষতা আর তাদের কাছে এই বিপুল পাওনা নিয়ে গভীর মৌনব্রত পালন করছে।
আনু মুহাম্মদ: অর্থনীতিবিদ। অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
বস্তুত, আশির দশকটি অন্য অনেক দেশের মতো বাংলাদেশের অর্থনীতির বর্তমান গতিমুখ ও চেহারা নির্ধারণেও গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সে সময় রিগ্যান ও থ্যাচারের নেতৃত্বাধীন বিশ্ব পুঁজিবাদী ব্যবস্থাপনায় নয়া উদারতাবাদী (নিও লিবারেল), সঠিকভাবে বললে গোঁড়া ডানপন্থী বৃহৎ পুঁজিমুখী কর্মসূচির জোর প্রতাপ শুরু হয়। ওয়াশিংটন কনসেনশাস কাঠামোর অধীনে সমন্বিত ও শক্তিশালীভাবে কাঠামোগত সমন্বয় কর্মসূচির প্রয়োগ শুরু হয়। সেই কাজে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ প্রভৃতি সংস্থা বাংলাদেশসহ প্রান্তস্থ দেশগুলোর বিভিন্ন খাতে তাদের উপযোগী নীতি ও প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করে। এসব সংস্থার নেতৃত্বে তথাকথিত বিদেশি সাহায্যের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশে দারিদ্র্য দূর ও উন্নয়নের নামে কীভাবে দখল ও লুণ্ঠনের বিভিন্ন নীতি ও প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে তার কিছু প্রামাণ্য বিবরণ পাওয়া যাবে জন পারকিনসের কনফেশনস অব ইকোনমিক হিটম্যান (২০০৪) ও দ্য সিক্রেট হিস্ট্রি অব দ্য আমেরিকান এম্পায়ার (২০০৭), নাওমি ক্লেইনের শক ডকট্রিন: দ্য রাইজ অব ডিসাস্টার ক্যাপিটালিজম (২০০৮) প্রভৃতি বইয়ে।
উন্নয়ন নামে এই সর্বনাশা জাল টিকে থাকে দেশের ভেতর তার সমর্থক গোষ্ঠীর কারণে, যারা এসব তৎপরতার প্রধান সুবিধাভোগী। আন্দ্রে গুন্ডার ফ্রাংক ও চেরিল পেয়ার এদের নাম দিয়েছিলেন পঞ্চম বাহিনী, যারা দেশের নাগরিক অথচ বহুজাতিক পুঁজির স্বার্থরক্ষাকারী হিসেবে নিজেদের বিত্ত ও ক্ষমতা নিশ্চিত করে। এদের মধ্যে রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, আমলা ছাড়াও থাকে ‘বিশেষজ্ঞ’। নিজের পেশার মানুষদের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করে রেহমান সোবহান সে সময় আরও বলেছিলেন, “অর্থনীতিবিদরা বিদেশি সাহায্য নির্ভর গবেষণায় এরকম ব্যস্ত আগে কখনোই ছিল না। বাংলাদেশের দারিদ্র ও অনুন্নয়ন ‘অনুধাবন’ করবার জন্য জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক অর্থসংস্থানকারী প্রতিষ্ঠানসমূহ যে কোটি কোটি ডলার যোগান দিচ্ছে তার প্রধান সুবিধাভোগী এখন তারা।”
এসব ঋণ ও অনুদান নিয়ে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে যেসব নীতি প্রণীত বা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় তা কোনো নির্বাচিত সংস্থায় আলোচনা করে হয় না। গোপনীয়তা, অস্বচ্ছতা, অপচয় ও দুর্নীতি এসব নীতি ও প্রকল্প প্রণয়ন-প্রক্রিয়ার অন্যতম দিক। আশি, নব্বই ও বর্তমান দশকজুড়ে অন্য প্রান্তস্থ দেশগুলোর মতো বাংলাদেশও ‘ওয়াশিংটন কনসেনশাস’-এর জোয়ালে ঘাড়টা দিয়ে উন্নয়ন ও সংস্কারের নামে অনেক কর্মসূচি নিয়েছে। এসব কর্মসূচিরই ফল হলো আদমজী পাটকল বন্ধসহ পাট খাতে বড় বিপর্যয়, জ্বালানি খাতে জাতীয় সক্ষমতার অবক্ষয় ও বিদেশি মালিকানার সম্প্রসারণ, শিক্ষা ও চিকিৎসা খাতে অব্যাহত বাণিজ্যিকীকরণ, নদীনালা খালবিল জলাশয় দখল ও ভরাট করে বিনিয়োগ, আমদানিনির্ভরতা বৃদ্ধি, মিল থেকে মলমুখী (শপিং) অর্থনৈতিক তৎপরতার বিস্তার, চট্টগ্রাম স্টিল মিল, মেশিন টুলস ফ্যাক্টরিসহ বহু শিল্পকারখানা বন্ধ, বহু রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান পানির দামে বিতরণ, রেলওয়ে সংকোচন, দখল ও লুণ্ঠন-প্রক্রিয়ায় জনগণের সাধারণ সম্পত্তি ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে রূপান্তর, কৃষি খাতে হাইব্রিড বীজসহ কোম্পানিনির্ভরতা বৃদ্ধি, চোরাই টাকার তৎপরতা বৃদ্ধি, কাজ ও মজুরির নিরাপত্তা সংকোচন, বাণিজ্য ঘাটতির ক্রমান্বয় বৃদ্ধি এবং নতুন ধনিক শ্রেণীর জন্ম ও বিকাশ।
সন্দেহ নেই, এসবের মধ্য দিয়ে আমাদের সমাজ-অর্থনীতির বিশেষত ঢাকা শহরের জৌলুশ অনেক বেড়েছে। টিভি চ্যানেলে বিজ্ঞাপন ও বিলবোর্ড, বহুতল ভবন, শপিংমল, বেসরকারি ব্যয়বহুল জাঁকজমকপূর্ণ হাসপাতাল, ডায়াগনস্টিক সেন্টার আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অগণিত ব্যক্তিগত গাড়ি, ব্যয়বহুল রেস্টুরেন্ট ইত্যাদি মিলে উন্নয়নের একটা চেহারা দাঁড়িয়েছে। জিডিপি প্রবৃদ্ধিও অন্য অনেক দেশের তুলনায় খারাপ হয়নি। কিন্তু এই জৌলুশের নিচে চাপা পড়ে থাকে জাতীয় সক্ষমতার বদলে হীনম্মন্যতার প্রাতিষ্ঠানিকতা, সবার জন্য সুলভে শিক্ষা, চিকিৎসা ও গণপরিবহন নিশ্চিতকরণে রাষ্ট্রীয় দায়িত্বের প্রশ্ন, দখল ও লুণ্ঠনের তৎপরতা, আর টেকসই উন্নয়নের বদলে টেকসই দারিদ্র্যের দগদগে চিত্র।
উন্নয়ন দর্শনের এই ধারাবাহিকতার অন্যতম শিকার বাংলাদেশের জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাত। ১৯৮১ সাল থেকে এই খাতের দিকে নজর যায় বিশ্বব্যাংকসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর। তাদের ঋণের টাকায় নানা গবেষণা করে যে দৃষ্টিভঙ্গি ক্রমে প্রতিষ্ঠিত হয় তার মূল কথা হলো, গ্যাস রপ্তানি করতে হবে; এই খাত ছাড়তে হবে বহুজাতিক কোম্পানির হাতে, রাষ্ট্রীয় বিদ্যুৎ প্লান্টে আর অর্থ ব্যয় করা হবে না। এই রাস্তা ধরেই ১৯৯৩-৯৪ সালে প্রথম উৎপাদন বণ্টন চুক্তি হয় এবং ১৯৯৬ সালে বেসরকারি খাতে বিদ্যুৎ উৎপাদননীতি চূড়ান্ত হয়। এই খাতে বিপর্যয়ের শুরু তখন থেকেই। ফলে এখন এই খাতে যে বরাদ্দ আমরা চোখে দেখি তার দুই-তৃতীয়াংশই গ্যাস ও বিদ্যুৎ কিনতে ভর্তুকি হিসেবে খরচ হয়। দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রান্তিক অবস্থানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে ‘পুঁজির অভাব’ যুক্তি দিয়ে, অথচ বিদেশি কোম্পানির স্বার্থে ভর্তুকি দিতে তার কয়েক গুণ অর্থ ঠিকই খরচ করা হচ্ছে। বছর বছর তাই দাম বাড়ে গ্যাস ও বিদ্যুতের। কিন্তু সংকট ও অনিশ্চয়তা কমে না। বর্তমান সরকারও তার জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতের পথ-নকশায় (জুন ২০১০) এই ধারাকে আরও শক্তিশালী করার সংকল্প ব্যক্ত করেছে।
জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে বলে অর্থমন্ত্রী দাবি করেছেন, অনেক বিশেষজ্ঞ ও সংস্থা সেটা সত্য ধরে নিয়ে উচ্ছ্বাসও প্রকাশ করছেন। এসব দাবি ও কথার ভিত্তি হলো এ খাতে বর্ধিত বরাদ্দ। গত বছরের মূল বরাদ্দের তুলনায় এটি ১৮০৪ কোটি টাকা বেশি। কিন্তু জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে এই বর্ধিত বরাদ্দ বাপেক্স-পেট্রোবাংলাকে শক্তিশালী করাসহ জাতীয় সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য নয়, বিদ্যুৎ প্লান্ট স্থাপনের জন্য নয়, এই খাতে শিক্ষা ও গবেষণা বিকাশের জন্যও নয়। তাহলে এর আসল খরচের জায়গা কোথায়?
আগের বছর অর্থাৎ ২০০৯-১০ অর্থবছরে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে অর্থ বরাদ্দ ছিল ৪৩১০ কোটি টাকা। বছর শেষে অর্থাৎ ২০১০ সালের জুন পর্যন্ত হিসাবে দেখা যায়, ৫২৪ কোটি টাকা ব্যয় হয়নি। সম্পদের অভাবের যুক্তিতে যেখানে বাপেক্স-পেট্রোবাংলায় বহু পদ খালি, প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি কেনা হয় না, প্রশিক্ষণ-গবেষণা হয় না, সেখানে ৫৪২ কোটি টাকা উদ্বৃত্ত থাকে কী করে? অথচ এই সময়কালে সারা দেশ যে অভূতপূর্ব গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকটে পড়েছিল তাকে মোকাবিলার জন্য যদি দেশীয় সংস্থার অধীন গ্যাসক্ষেত্র ও বিদ্যুৎ প্লান্টে মেরামত, নবায়নসহ প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা হতো, তাহলে এই পরিমাণ অর্থই স্বল্প মেয়াদে যথেষ্ট ছিল। তাতে গ্যাসের ঘাটতি দূর হতো এবং রাষ্ট্রীয় বিদ্যুৎ প্লান্টগুলো অনেক কম দামে ভর্তুকি ছাড়া আমাদের বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে সক্ষম হতো। এই কাজগুলো না হওয়া নিছক অদক্ষতার সমস্যা নয়, এগুলো উন্নয়ননীতির অংশ। দুর্নীতি তার সহযোগী।
একদিকে এসব কাজের জন্য টাকা খরচ হলো না, অন্যদিকে বিদ্যুৎ সংকট সমাধানের নামে অনেক বেশি দামে, অনির্ভরযোগ্য রেন্টাল পাওয়ার প্লান্ট স্থাপনের জন্য, কোনো দরপত্র ছাড়াই চুক্তি করা হলো প্রধানত কয়েকটি বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে। ড্রিলিংয়ের কাজ বাপেক্সকে না দিয়ে দেওয়া হচ্ছে বিদেশি কোম্পানিকে। এসবের ফলে সামনের বছর থেকে বাংলাদেশের কয়েক হাজার কোটি টাকা বাড়তি খরচ হতে থাকবে। বাজেটের বাড়তি বরাদ্দ এসব খরচ জোগানের জন্যই। এই বরাদ্দ দিয়ে কুলাবে না বলে বাজেট অধিবেশনের পরে বাড়ানো হবে গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম। এই দামবৃদ্ধি জনগণের জীবনে কয়েক দফা শুল্কবৃদ্ধির শামিল। সকল পর্যায়ে উৎপাদনব্যয় বাড়বে এবং তার চক্রাকার প্রভাবে জীবনযাত্রার ব্যয়ও বৃদ্ধি পাবে। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের প্রকৃত আয় কমবে। ক্ষতিগ্রস্ত হবে প্রকৃত শিল্পোদ্যোক্তারাও।
উল্লেখ্য, ১৯৯৭ ও ২০০৫ সালে মাগুরছড়া ও টেংরাটিলায় যথাক্রমে মার্কিন ও কানাডীয় কোম্পানির কর্তৃত্বাধীন গ্যাসক্ষেত্রে যে বিস্ফোরণ হয় তাতে বাংলাদেশের কমপক্ষে ৫০০ বিলিয়ন বা আধা ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস নষ্ট হয়। এই গ্যাস বর্তমানে বার্ষিক মোট উত্তোলিত গ্যাসের সমপরিমাণ। বাংলাদেশে এখন যে পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে, এই হারানো গ্যাস দিয়ে সেই পরিমাণ আরও বিদ্যুৎ তিন বছর ধরে উৎপাদন করা যেত। এর জন্য শেভ্রন ও নাইকোর কাছ থেকে আমাদের ক্ষতিপূরণ পাওয়ার কথা পাঁচ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বা প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকা। এটা শুধু গ্যাসসম্পদের দাম। এই দাম আমরা হিসাব করেছি বাংলাদেশ যে দামে এখন কাতার থেকে গ্যাস আমদানির দরকষাকষি করছে তার নিম্নহার বিবেচনা করে।
এই অর্থ চলতি বছরের মোট বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির চেয়ে বেশি। এটি প্রস্তাবিত বাজেটে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে ‘বর্ধিত বরাদ্দের’ প্রায় ছয় গুণ, বিদেশি সাহায্য বলে যে পরিমাণ অর্থ দেখানো হয়েছে তার প্রায় চার গুণ। অথচ এই বিশাল পরিমাণ অর্থ দাবি করার বা তা নিয়ে প্রয়োজনীয় কোনো উদ্যোগ এ যাবৎ কোনো সরকারই গ্রহণ করেনি। যুক্তরাষ্ট্রে সম্পদ ধ্বংসের জন্য তেল কোম্পানি বিপি (ব্রিটিশ পেট্রোলিয়াম) হাতজোড় করে ২০ বিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণ প্রদান করছে, আর বাংলাদেশে তাদের হাতে আরও সম্পদ তুলে দেওয়ার আয়োজন চলছে। দুই মাস আগে মেক্সিকো উপসাগরে তেল উত্তোলনে সংঘটিত দুর্ঘটনার জন্য বিপিকে এর মধ্যে কমপক্ষে সাতবার প্রকাশ্য (সরাসরি টিভি সম্প্রচারে) শুনানির সম্মুখীন হতে হয়েছে। বাংলাদেশে সেই দেশেরই তেল কোম্পানির গাফিলতি ও অদক্ষতায় সৃষ্ট ধ্বংসকাণ্ডের জন্য গত ১৩ বছরে একবারও তাদের নিয়ে কোনো শুনানি হয়নি। বাংলাদেশের উন্নয়নে নীতিনির্ধারক বিশ্বব্যাংক গোষ্ঠী জাতীয় প্রতিষ্ঠানে কথিত অদক্ষতা ও লোকসান নিয়ে সারাক্ষণ সোচ্চার থাকলেও, বহুজাতিক সংস্থার অদক্ষতা আর তাদের কাছে এই বিপুল পাওনা নিয়ে গভীর মৌনব্রত পালন করছে।
আনু মুহাম্মদ: অর্থনীতিবিদ। অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments