চিরকুট-ভরসা by শাহাদুজ্জামান

পর্তুগিজ লেখক জোসে সারামাগোর ব্লাইন্ডনেস উপন্যাসে দেখতে পাই, একটি শহরে অন্ধত্বের এক অভিনব মহামারি লেগেছে। একজন অন্ধ হওয়ার পর তার ছোঁয়ায় এক এক করে শহরের সবাই অন্ধ হয়ে যেতে থাকে। সারা শহরে কেবল অন্ধ মানুষ।
কলাম্বিয়ার লেখক মার্কেজের হান্ড্রেড ইয়ারস অব সোলিচুড-এ দেখা যায়, গ্রামে দিনের পর দিন কারও আর ঘুম আসে না। গ্রামে নিদ্রাহীনতার মহামারি দেখা দেয়। আমাদের ঢাকা শহরে কিছু দিন ধরে তেমনি এক ভুতুড়ে মহামারি যেন দেখা যাচ্ছে। একে বলা যায় দালান হেলে পড়ার মহামারি। শহরের এক প্রান্তে একটি দালান হেলে পড়ল, তারপর দেখা গেল, তার দেখাদেখি শহরের নানা প্রান্তে বিভিন্ন দালান হেলে পড়তে শুরু করেছে। মনে হচ্ছে, শহরের দালানগুলো যেন পরস্পরের মধ্যে এক পরাবাস্তব শলাপরামর্শ করে একে একে হেলে পড়তে শুরু করেছে। বেশ একটা জাদুবাস্তব অবস্থা বলা যায়।
হতে পারে কাকতালীয়ভাবে ঠিক এ সময়ে ঢাকার কাছাকাছি কোথাও ভূত্বকে কাঁপুনি ঘটাতে এমন ঘটেছে। হতে পারে একের পর এক ভয়াবহ দুর্ঘটনায় আতঙ্কগ্রস্ত মানুষ অতি সতর্কতায় তাঁর বাড়ির দিকে তাকিয়ে আবিষ্কার করছেন নানা ত্রুটি, যা আগে উপেক্ষা করেছেন। নাকি এটি গণ-মতিভ্রম? গণ-অনিশ্চয়তায় মানুষ কি দেয়ালের দিকে তাকিয়ে কেবল ফাটল দেখছেন? রাস্তায় দাঁড়িয়ে নিজের বাড়িটির দিকে তাকিয়ে কি মনে হচ্ছে, এটি যেন একটু হেলে পড়েছে? মনের ভেতরে ফাটল ধরলে আর বিশ্বাস হেলে পড়লে, এমন মতিভ্রম হতেই পারে।
এ শহরে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া রক্ত হিম করা ঘটনাগুলো নিয়ে ইতিমধ্যে অঢেল শোকগাথা হয়েছে। অবশ্য শোক আমাদের স্বল্পায়ু। বাজেট, বিশ্বকাপ ফুটবল, হরতাল ইত্যাদির ডামাডোল এখন। অনন্তকাল শোকে কাতর হয়ে থাকারও কোনো অর্থ নেই। কিন্তু একটি শহর যখন পুরো দেশের বহু দিনের, বহুজনের, বহুরকম ভুল আর স্বার্থপরতার প্রতিবিম্ব হয়ে ওঠে, তখন সে শহর প্রসঙ্গে ফিরে ফিরে আসতেই হয়। কতিপয় বাড়ির দেয়ালে হাতুড়ির আঘাত আর তিন কন্যার হাতের মেহেদি আমাদের শোক আর ক্ষোভের ওপর প্রলেপ বুলিয়ে দিলেও এ শহরের মৃত্যুঘণ্টা অবিরাম কানে বেজেই চলে। ভুলতে পারি না যে একেবারে খোলনলচে পাল্টানোর ব্যবস্থা না দিলে এ শহর ভেতরে ভেতরে প্রস্তুত হচ্ছে আরও ঘোরতর দুর্ঘটনার জন্য। রাজনীতিবিদ নই, নগরপরিকল্পনাবিদও নই, নেহাত স্মৃতিভারাতুর শব্দবিদ, তাই বসি শব্দে স্বপ্ন রচনা করতে। সমসাময়িক কবি মাসুদ খানের একটি কবিতা মনে পড়ে, “রাত গভীর হলে আমাদের এই প্রচলিত ভূপৃষ্ঠ থেকে/ ঘুমন্ত কুড়িগ্রাম ধীরে ধীরে আলগা হয়ে যায়।/ অগ্রাহ্য করে সকল মাধ্যাকর্ষণ।/ তারপর তার ছোট রাজ্যপাট নিয়ে উড়ে উড়ে/ চলে যায় দূর শূন্যলোকে।/ আমরা তখন দেখি বসে বসে আকাশ কত-না নীল/ ...পৃথিবীর যে জায়গাটিতে কুড়িগ্রাম থাকে/ এখন সেখানে নিঃস্ব কালো গহ্বর।” কবিতাটির মূল ভাবনা ভিন্নতর, কিন্তু আমি কুড়িগ্রামের জায়গায় ঢাকাকে বসিয়ে দিয়ে ভাবতে থাকি এক রাতে এই ভূপৃষ্ঠ থেকে বুঝিবা ঢাকা নামের জায়গাটি আলগা হয়ে গেছে, তারপর মাধ্যাকর্ষণ উপেক্ষা করে শূন্যে উড়ে দূর আকাশের গায়ে একটা নক্ষত্র হয়ে লেপ্টে আছে। আর পৃথিবীর যে জায়গায় ঢাকা ছিল সেখানে একটা শূন্য গহ্বর। তারপর সেই শূন্য গহ্বরে একদিন এক তিলোত্তমা নগর গড়ে তুলেছে আমাদের অনেক অনেক পরের কোনো প্রজন্ম।
কিন্তু কল্পনায় যতই একে মহাকাশে পাঠিয়ে দিই না কেন, এ শহর ঘোরতর বাস্তব হয়ে আমাদের নাকের ওপর দাঁড়িয়ে থাকে। ফলে ভরসা খোঁজার প্রয়োজন পড়ে বাস্তবের মাটিতেই। রবীন্দ্রনাথ একবার লিখেছিলেন ‘টাকার অভাবে দেশ গরিব হয় না, দেশ গরিব হয় ভরসার অভাবে।’ একটু ভরসার জন্য চারদিকে লোকের হাহাকার। বিচিত্র সূত্র থেকে ভরসা খুঁজছে মানুষ। এভারেস্টে পা রেখে পুরো জাতির ভরসার প্রতীকে পরিণত হয়েছেন তরুণ মুসা। এই নিঃসঙ্গ তরুণকে পাহাড় ডিঙ্গাতে দেখে পর্বতপ্রমাণ সংকটের পাশে অসহায় মেষশাবকের মতো দাঁড়িয়ে থাকা জনমানুষের মনে আশার সঞ্চার হয়েছে। বাস্তবে ভরসা রাখতে না পেরে মানুষ ভরসা খুঁজছে প্রতীকে, রাষ্ট্রে ভরসা করতে না পেরে মানুষ ভরসা খুঁজছে ব্যক্তিতে।
এখন ব্যক্তিই সব অভিনব কাণ্ডগুলো করে বসছে। খবরে পড়লাম, গফরগাঁওয়ের এক নিঃস্ব কৃষক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এবং তাঁর পরিবার মারা যাওয়ার পর তাঁর সামান্য সহায় সম্বল দিয়ে শেখ হাসিনার জন্য একখণ্ড জমি কিনে রেখেছিলেন। তাঁর স্ত্রীকে বলেছিলেন, এই এতিম মেয়েটির জন্য এটি তাঁর দান। নিঃস্ব কৃষক চিকিৎসার অভাবে মারা গেছেন, তবু ওই জমিখণ্ডটি বিক্রি করতে দেননি। দেশের প্রধানমন্ত্রী জানতেন না, তাঁর নামে গফরগাঁওয়ে একটুকরো জমি বরাদ্দ আছে। যাঁরা এই খবরটি পড়েছেন, তাঁরা ব্যক্তির এই অভূতপূর্ব আদিম সারল্যে বিস্মিত যেমন হয়েছেন, তেমনি একটা গোপন ভরসাও পেয়েছেন এই ভেবে যে এই রাক্ষুসে স্বার্থপরতা আর ব্যক্তিকেন্দ্রিকতার দেশে এমন প্রায় অলৌকিক, অকপট নিঃস্বার্থতারও জন্ম হতে পারে।
কিন্তু শেষ বিচারে ভরসাটি তো আসতে হবে রাষ্ট্রের কাছ থেকেই। অনেক ভরসা নিয়ে এই রাষ্ট্রের ভার জনতা দিয়েছে এ সরকারের ওপর। বিস্তর দায়িত্ব তাদের। প্রসঙ্গ ছিল নগর রক্ষার। অত্যন্ত সাহসী এবং যুগান্তকারী পদক্ষেপে যথার্থ প্রশাসন বিকেন্দ্রীকরণ এবং যথার্থ নগর সরকার গঠন না করলে সবাই মিলে মৃত্যুকূপে পড়া সময়ের ব্যাপার মাত্র।
শাহাদুজ্জামান: কথাসাহিত্যিক।
zaman567@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.