ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়-বাস-৪ বছর, ১৮ কারণ ও ৩৬ সুপারিশ
২০০৭ সালের ১১ জুনের ভয়াবহ পাহাড় ধসের স্মৃতি হয়তো অনেকের মন থেকে এখনও মুছে যায়নি। প্রচণ্ড বর্ষণের মধ্যে চট্টগ্রাম শহরের উপকণ্ঠে সেদিন এক মানবেতর পরিস্থিতি জন্ম নিয়েছিল। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় মাটির নিচে চাপা পড়া আহত-নিহত মানুষকে উদ্ধার করাও কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
সে পাহাড় ধসে ১২৫ জন নিহত হওয়ার পর গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজসহ সমাজের নানা পর্যায় থেকে পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস বন্ধ করার দাবি উঠেছিল। ভবিষ্যতে যাতে এ ধরনের বিয়োগান্ত ঘটনা না ঘটে সে জন্য পাহাড় ধসের কারণ অনুসন্ধান করে বিহিত ব্যবস্থা করার দাবিও ছিল। এই প্রেক্ষাপটে গঠিত হয়েছিল দুটি তদন্ত কমিটি। কমিটি অনুসন্ধান করে ১৮টি কারণ চিহ্নিত করেছে। পাহাড়ধস ও পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস ঠেকাতে ৩৬ দফা করণীয়ও ধার্য করেছিল। ইতিমধ্যে ৪টি বছর কেটে গেছে। এ পর্যন্ত ৩৬ করণীয়র একটিও বাস্তবায়িত হয়নি। চট্টগ্রাম শহরে, শহরতলিতে পাহাড়গুলো এখন প্রভাবশালী, ক্ষমতাধরদের দখলে। তারা ইচ্ছামতো পাহাড় কাটছেন, পাহাড়কে পতনের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে সে পাহাড়ের পাদদেশে নির্মাণ করছেন নিম্নআয়ের মানুষের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ আবাসস্থল। প্রাকৃতিক সম্পদ ধ্বংস করে, মানুষকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে চলছে রমরমা বাণিজ্য। এবারের বর্ষার প্রাক্কালে চট্টগ্রামের পাহাড় নিয়ে সচিত্র একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে রোববারের সমকালে। তাতে পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসের যে চিত্র পাওয়া গেল তাতে লক্ষাধিক মানুষ আগের মতোই মৃত্যুঝুঁকির মধ্যেই রয়েছেন। এ কয় বছরের পরিস্থিতির অবনতি বৈ উন্নতি হয়নি। এ কথা সত্য, পাহাড়ের পাদদেশে বসবাসরত লক্ষাধিক মানুষকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া কঠিন ব্যাপার। কিন্তু সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়গুলো থেকে মানুষ সরাবার উদ্যোগও বিগত বছরগুলোতে এতটুকু এগোয়নি। বরং সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, ব্যক্তি উদ্যোগের কারণে একের পর এক পাহাড় বিলুপ্ত হয়েছে। আবাসিক এলাকা গড়ে উঠেছে। আর যে পাহাড় টিকে আছে তাও খোরাক হয়েছে লোভীদের। অথচ ভূমিবৈচিত্র্য, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও ভারসাম্য রক্ষার জন্য বিদ্যমান পাহাড়গুলো সংরক্ষণ করা অত্যাবশ্যক। অথচ জরুরি এসব বিষয় দায়িত্বরত প্রতিষ্ঠানের কর্তাদেরও নজরে এ যাবৎ আসেনি। ফলে জলাবদ্ধতা বেড়েছে, নাজুক পাহাড়ের সংখ্যা বেড়েছে, প্রাকৃতিক সম্পদ ধ্বংস হয়েছে আর বেড়েছে মানুষের জীবন ও সম্পদের ঝুঁকি। সুপারিশ ছিল ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়গুলোতে বনায়ন করে, গাইড ওয়াল নির্মাণ করে, পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করে সেগুলোকে রক্ষা করার; কিন্তু আদতে পাহাড় রক্ষার কোনো উদ্যোগই আসেনি। বরং ক্ষমতাবানদের লোভের দাপটে পাহাড় দূরের কথা, মানুষের প্রাণ রক্ষাই কঠিন হয়ে পড়েছে। তদন্ত কমিটির সুপারিশে পাহাড় দখল ও ধ্বংসের পেছনের প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ থাকলেও তেমন ব্যবস্থার দেখা এ যাবৎ মেলেনি। মজার ব্যাপার, যাদের ব্যবস্থা নেওয়ার কথা তারা নিজেরাই অভিযুক্ত। আমরা মনে করি, এভাবে দিনের পর দিন বিষয়টিকে উপেক্ষা করলে আবারও কোনো বিয়োগান্ত ও ভয়াবহ ঘটনা জন্ম নিতে পারে। আকস্মিক কোনো দুর্ঘটের চেয়ে বড় কথা, প্রাকৃতিক সম্পদের বিনাশ প্রকৃতিতে প্রভাব ফেলবে। ফলে সরকারের পক্ষ থেকে আশু উদ্যোগ আসা উচিত। চট্টগ্রামের পাহাড় ও পাহাড়ের পাদদেশে বসবাসরত মানুষ রক্ষায় দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হোক। তদন্ত কমিটি যে সুপারিশ করেছিল তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ আসুক।
No comments