বিলেতের স্ন্যাপশট-বিলেতে বিশ্ব-বাঙালির মিলনমেলা by শামীম আজাদ

গত বারো বছরে লন্ডনের বৈশাখী মেলা এত বড় হয়েছে যে জনসমাগমের দিক থেকে এখন নটিং হিল গেট ফেস্টিভ্যালের পরেই এর স্থান। বাংলাদেশ, ভারত, ইউরোপ ও ইংল্যান্ডের বাঙালি-অবাঙালিসহ বিভিন্ন জাতি-ধর্ম ও বর্ণের লক্ষাধিক মানুষের সমাগম হয়েছে। শুরুটা হয়েছিল বারো বছর আগে।


শত আশা-আকাঙ্ক্ষা, হতাশা, প্রতিকূলতা, উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার আস্তর ভেদ করে অবশেষে ২০১০-এ এসে তা এক
কাঙ্ক্ষিত রূপ নিল।
এবার অ্যালেন গার্ডেন, আলতাব আলী পার্ক, উইভার্স ফিল্ড মিলে তিন-তিনটি পার্ক আর পুরো ব্রিকলেন এবং ব্রাডি ও অক্সফোর্ড হাউস, আর্টস সেন্টার মিলে হলো বাঙালির নববর্ষ উদ্যাপন। শোভাযাত্রা শুরু হলো সেই বিশপস গেট থেকে। শোভাযাত্রায় বিভিন্ন শিল্প ও সাহিত্য সংগঠন বাংলাদেশের থিম নিয়ে গত কয়েক মাসের করা ওয়ার্কশপ থেকে তৈরি করা ইমেজ ও উপাদানে সজ্জিত হয়ে ঢোল, নাচ আর গানে মাতিয়ে ছিল দশদিক। বহুজাতিক মানুষেরা ভিড় করেছিল বাংলাদেশের সংগীত, নৃত্য, সংস্কৃতি ও শিল্প-নমুনা চাখতে।
জনসমাগমের দিক থেকে এ মেলা এখন বিলেত ও ইউরোপের একটি অন্যতম বড় মেলা হয়ে গেছে। যেন তিন প্রজন্মের বাঙালি ও অবাঙালিদের এক মহাসম্মেলন। এবারের শোভাযাত্রা আরও গোছানো ও বাংলার সাজে সেজেছে। এর উল্লেখযোগ্য হলো বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের নকশি কাঁথার মাঠ, সত্যেন সেন স্কুল অব পারফর্মিং স্কুলের লক্ষ্মী পেঁচা, তাল-তরঙ্গের যান্ত্রিক বিবাহ শকটের সামনে বেদের মেয়েরা আর লাঠিখেলা। আরও শাড়ি, লুঙ্গি, ধুতি, গামছা পরে বাংলাদেশের শাপলা ও পতাকা নিয়ে ঢোলের তালে তালে নৃত্য।
দিনটি ছিল চকচকে, আর এক লাখ মানুষের জন্য ছিল নানা স্থানে নানা উপাচার। সবার জন্য কিছু না কিছু্। উইভার্স ফিল্ড পার্কে মূল মঞ্চ হলেও যেন পুরো বাংলাটাউনই উৎসবে মেতেছিল, এমনভাবে আয়োজন হয়েছে। টমাস বাস্কটন রোডে জীবজন্তুর খামারের পাশেই ছোট ছোট ওয়ার্কশপ আর শিশুদের জন্য আয়োজনসহ মঞ্চে স্থানীয় শিল্পীদের কিছু ফিউশন। আলতাব আলী পার্কে এ সময়ের বিলেতের শিল্পীদের পরিবেশনা আর সেটা শেষ করলেই পুরো ব্রিকলেনে ছিল বাংলাদেশি অথেনটিক ফুডসহ আমাদেরই উদ্ভাবন ‘ব্রিটিশ কারি’র সুগন্ধ। এবার মেলা ব্যাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশি খাবারের ম ম গন্ধ ভরেছিল বেথনাল গ্রিন রাত হারোটা পর্যন্ত। এই বিলেতে, আমাদের নববর্ষ মেলায়! ভাবা যায়?
টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিল শুধু এ মেলার অন্যতম উদ্যোক্তা নয়, ধারকও বটে। মেলাকে বুকে ধারণ করে তার স্থানও সংকুলান করে আসছে এখানকার মানুষই। বিশ্বের বিভিন্ন স্থান ও ইংলান্ডের নানা জায়গা থেকে আসা এ অতিথিদের আপ্যায়নের জন্য আগে থেকেই করতে হয় বাড়তি বাজার। মেলার আগের দিনই আমাদের বাড়ি ভরে গেছে দূর-দূরান্তের আত্মীয়স্বজনে। প্রতিটি হাউসিং স্টেট, দোকানপাট, রেস্তোরাঁ, ক্যাফে এমনকি ফুটপাতের মোড় সেজেছিল ভিন্ন পোশাকে আর মেতে উঠেছিল আনন্দের আবাহনে। দেখা গেছে কেবল লাল-সাদার সমারোহ। তরুণদের মাথায় বাঁধা বাংলাদেশের পতাকার ফেটি, শিশুদের হাতে পতাকার লাল-সবুজ, বড়দের গায়ে দেশি ফতুয়া বা পাঞ্জাবি আর মেয়েদের বর্ণীল শাড়ি। তরুণ-তরুণীদের গালে ও কপালে আঁকা বাংলাদেশ ও ইংল্যান্ডের পতাকা।
প্রতিবছরের মতো এবারও আপন মেজাজে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র সাহিত্য উৎসব ‘বইলিট’ সম্পন্ন করে। ওদিকে উইভার্স ফিল্ডে যখন কুমার বিশ্বজিৎসহ অন্যান্যের গানে দুলে উঠেছে মানুষের মহাসমুদ্র, তখনই লাগোয়া অক্সফোর্ড হাউসে কিছুটা নিভৃতে শুরু হয় কেন্দ্রের অনুষ্ঠান। ঠিক ছয়টা বাজতেই ‘আলো আমার আলো ওগো আলোয়...’ গানের সুরে সুরে ব্রিটেনে নিযুক্ত বাংলাদেশ হাইকমিশনার অধ্যাপক সাইদুর রহমান খান মঙ্গল প্রদীপ জ্বালিয়ে উৎসবের উদ্বোধন ঘোষণা করেন। এবার সমবেত কণ্ঠে ‘আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে’র সঙ্গে দর্শকেরাও যোগ দিল প্রদীপের পেছন
থেকে উদ্ভাসিত হয়ে উঠে কেন্দ্র থেকে করা নকশি কাঁথার মাঠ। সঞ্জীবের বাঁশির সুরে মূর্ত ওঠে আমাদের একতারা, রূপাসাজুর উপাখ্যান, মাটির সরা, কুলা ও বাংলাদেশের বিমূর্ত রূপ।
তারপর একে একে পরিবেশিত হয় নব উৎসব ও বহুজাতিক ঐতিহ্য নিয়ে ইংরেজি কবিতা পাঠ। কেন্দ্রের আবাসিক লেখক ও কবি স্টেভেন ওয়াটস পাঠ করেন কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর কন্যা সুমনা খানের কবিতা। তারপর ‘টেজু চৌজেন’ পড়েন সমসাময়িক ইংরেজি কবিতা। নিবিষ্ট দর্শকদের উৎসাহ পেয়ে জমে ওঠে এবারের বাংলা একাডেমী একুশে বইমেলায় প্রকাশিত বিলেতের চার কবির বই নিয়ে আলোচনা ও আবৃত্তি। প্রতিথযশা আবৃত্তিকার রূপা চক্রবর্তী ও উদয়শংকর দাশ যখন দেলোয়ার হোসেন মঞ্জু, মুজিব ইরম, আবু মকসুদ ও মিলটন রহমানকে মঞ্চে নিয়ে পাঠ ও আলোচনায় জমিয়ে তুলেছেন পুরো আসর, তখন দরজার বাইরে দেড় শতাধিক সাহিত্যপ্রেমী লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন ভেতরে প্রবেশ করার জন্য। কিন্তু ততক্ষণে হাউসফুল। বহুজাতিক উপস্থিতিতে তারপর হয়ে গেল নাটক বউ, কবিতা আলেখ্য, তাসাদ্দুক আহমেদ এমবিই সেরা স্বেচ্ছাসেবক পদক প্রদান, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শেষের কবিতার বিশেষ পরিবেশনা, নাটক ভীম বধ এবং বাংলাদেশ থেকে আগত অতিথি শিল্পী নিলুফার বানুর ‘পুরোনো দিনের গান’। দুটো নাটকই অকাল প্রয়াত রাজিব দেব মান্নার স্মরণে উৎসর্গ করা হয়। এই রাজিবই বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে নাট্য বিভাগের মধ্যমণি ছিলেন।
ঠিক মাঝামাঝি সময়ে তাসাদ্দুক আহমেদ এমবিই সেরা কর্মী পদক প্রদান করতে নবনির্বাচিত সাংসদ রুশনারা আলী প্রবেশ করেন। কেন্দ্রের অকৃত্রিম বন্ধু রুশনারা আলী সাংসদের হাতে বিজয়ীর সনদ গ্রহণ করে খাদিজা রাহমান আপ্লুত হয়ে পড়েন।
হলভর্তি মানুষ এ অনুষ্ঠান উপভোগ করতে থাকলেও ততক্ষণে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করেও ভেতরে প্রবেশ করতে না পেরে ফিরে গেছেন বিলেতের বেশ কিছু গুণীজন। নিরেট একটি সাহিত্যবিষয়ক আয়োজনে এমন সাড়া ভাবা যায়!
সবশেষে আমি ধন্যবাদ জ্ঞাপন করতে গিয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে যাই। এই বিশ্ব-বাঙালির মিলনমেলা, একই সময়ে মুসার এভারেস্ট বিজয় আর রুশনারা আলীর বিলেতের পার্লামেন্ট প্রবেশ—সব মিলে এ যেন হয়ে উঠেছিল বিলেতের বাঙালির স্বপ্নপূরণ উৎসব। বাংলা টাউন পালিত বাংলা নববর্ষের উৎসবে বাংলাদেশের মানুষের অসাম্প্র্রদায়িক শিল্প ও ঐতিহ্য প্রেমেরই বহিঃপ্রকাশ।
শামীম আজাদ: কবি ও লেখক।
shetuli@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.