যুক্তি তর্ক গল্প-কঠোর আইন ও শাস্তি কি ইভ টিজিং বন্ধ করতে পারে? by আবুল মোমেন

মেয়েদের, বিশেষত কিশোরীদের উত্ত্যক্ত করার ঘটনা এমন ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছেছে যে পরিণতিতে সাম্প্রতিককালে দেশে বহু কিশোরী আত্মহত্যার আশ্রয় নিয়েছে। ছেলেদের এই নিষ্ঠুরতা এবং মেয়েদের এই চরম আত্মনিগ্রহ নিশ্চয়ই সমাজ বা সমাজমানসের সুস্থতার লক্ষণ নয়। ধর্ষণ ও শ্লীলতাহানির ঘটনাও মারাত্মকভাবে বেড়ে চলেছে।


এর সঙ্গে নারীর ওপর যৌন নির্যাতন ও লিঙ্গবৈষম্যের ব্যাপকতা দেখেও এ সমাজকে সুস্থ বলা যাবে না। অসুস্থতার দায় প্রধানত পুরুষকেই বহন করতে হবে, কারণ এসব নির্যাতন ও বৈষম্যের প্রণেতা ও প্রয়োগকারী পুরুষ, আর শিকার নারী।
ইতিমধ্যে দেশে নারী নির্যাতনবিরোধী কঠোর আইন হয়েছে, এর যথেচ্ছ প্রয়োগও চলছে। কিন্তু পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি, বরং অবনতি রোধ করা যাচ্ছে না। শিশু ও নারী নির্যাতনবিরোধী কঠোর আইন কার্যকর থাকা অবস্থাতেই দেশে ইভ টিজিং বেড়ে চলেছে। গত কয়েক বছরে এর ভয়ংকর পরিণতি হিসেবে অন্তত আটটি মেয়ের আত্মহননের মর্মস্পর্শী খবর আমরা সংবাদপত্রের মাধ্যমে জেনেছি। আমার আশঙ্কা, সংবাদপত্রের, তথা আমাদের অগোচরে দেশের আনাচকানাচে এ রকম ঘটনা আরও ঘটে থাকাই স্বাভাবিক। সবাই চান, এ রকম ঘটনার পুনরাবৃত্তি অবিলম্বে বন্ধ হোক। সাধারণত আমাদের দাবি হয়ে থাকে, অপরাধীদের বিচার করে যেন কঠোর শাস্তি দেওয়া হয়। ইভ টিজিং-বিরোধী মিছিলে অংশ নিয়ে মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী সবাইকে আশ্বস্ত করতে চেয়েছেন এই বলে যে ইভ টিজিং বন্ধ করার জন্য প্রয়োজনে আরও কঠোর আইন প্রণয়ন ও তা কঠোরভাবে প্রয়োগ করা হবে। কঠোর আইন ও শাস্তি নিয়ে আপত্তি না তুলেও বলব, শুধু এতে আমি আশ্বস্ত হতে পারি না। কারণ, আমার মনে গভীর সংশয় আছে এই সামাজিক ব্যাধির দাওয়াই আইনি-পুলিশি ব্যবস্থা কি না, তা নিয়ে।
আমি জানি, সমাজে একদল আছেন, যাঁরা এই ব্যাধির নিদান হিসেবে মেয়েদের কঠোর পর্দার অন্দরালে বন্দী করতে চাইবেন। আমি নিশ্চিত, খোঁজ নিলে দেখা যাবে ইভ টিজিং ও ধর্ষণ-শ্লীলতাহানির শিকার যাঁরা হয়েছেন-হচ্ছেন, তাঁদের মধ্যে নেকাব-বোরকা পরিহিতরাও বাদ যাচ্ছেন না। আইন, এমনকি সামাজিক-ধর্মীয় বিধানও এসব অনাচার ও বিকৃতি ঠেকাতে পারছে না। কারণ, এই ব্যাধিটির ধরন ভিন্ন, এর উৎস পুরুষের—এবং অনেকাংশে নারীরও—শারীরিক-মানসিক সত্তার মধ্যেই নিহিত। আমাদের সমাজ বালক ও বালিকার, তথা পুরুষ ও নারীর বিকাশের জন্য স্বাভাবিক বাতাবরণ ও পথ তৈরি করতে পারেনি, তাই আচরণ ও প্রতিক্রিয়ায় অস্বাভাবিকতা দেখা দিচ্ছে। আমাদের মনোযোগ সেখানেই নিবদ্ধ করা দরকার।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর কয়েকটি অসামান্য ছোটগল্পে বালকদের মনোজগতের খবর নিয়েছেন এবং তাদের দিক থেকে কিছু সমস্যা বোঝার ও আমাদের বোঝার চেষ্টা করেছেন। তেমন একটি গল্প ছুটি। তাতে বেয়াড়া বালক ফটিকের সমস্যাটা বোঝাতে গিয়ে আমাদের জানাচ্ছেন—‘তেরো-চৌদ্দ বছরের ছেলের মতো পৃথিবীতে এমন বালাই আর নাই। ... স্নেহও উদ্রেক করে না, তাহার সঙ্গ-সুখও বিশেষ প্রার্থনীয় নহে। তাহার মুখে আধো-আধো কথাও ন্যাকামি, পাকা কথাও জ্যাঠামি এবং কথামাত্রই প্রগল্ভতা। হঠাৎ কাপড়চোপড়ের পরিমাণ রক্ষা না করিয়া বেমানানরূপে বাড়িয়া উঠে, লোকে সেটা তাহার কুশ্রী স্পর্ধাস্বরূপ জ্ঞান করে। তাহার শৈশবের লালিত্য এবং কণ্ঠস্বরের মিষ্টতা সহসা চলিয়া যায়; লোকে সেজন্য তাহাকে মনে মনে অপরাধ না দিয়া থাকিতে পারে না। শৈশব এবং যৌবনের অনেক দোষ মাপ করা যায়, কিন্তু এই সময়ের কোনো স্বাভাবিক অনিবার্য ত্রুটিও যেন অসহ্য বোধ হয়।’
সত্যিই কিশোরকাল তথা বয়ঃসন্ধি যে মানবজীবনের এক বিশেষ কাল, যখন ছেলেমেয়েরা শরীর-মনের নানা পরিবর্তনের মুখে কারও সঙ্গ, সাহচর্য ও মমতার জন্য মুখিয়ে থাকে, কিন্তু এ সমাজ সে বিষয়ে একটুও সচেতন নয়, প্রয়োজনীয় সংবেদনশীলতা দেখানো তো দূরের কথা। বলা দরকার, জৈবিক ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক কারণে ছেলেদের ছটফটানি এ সময়ে একটু বেশিই হয়। ফলে এই সময়ে বাড়ির সঙ্গে, পরিবারের ও সমাজের সঙ্গে ছেলেটার বন্ধন আলগা হয়ে যেতে পারে, সে নিঃসঙ্গ হতে কিংবা সঙ্গদোষে পড়তে পারে। অস্থিরতা, ব্যাকুলতায়, দিশেহারা ছেলেটার শক্ত বেপরোয়া খোলসের ভেতরে কিন্তু বাস করে একটি কাঙাল ভঙ্গুর অসহায় মন। সেটা প্রয়োজনীয় খোরাক পায় না বলে সে প্রবৃত্তিচালিত আচরণ দিয়ে নিজেকে সমাজের সনাতন প্রবল পুরুষতন্ত্রের এক সচল প্রতিভূ রূপে জাহির করতে চায়। তার থেকে যত অনাসৃষ্টি অঘটন ঘটে।
খ্রিষ্টীয় মহামানব সন্ত অগাস্টিনের স্বীকারোক্তি, রুশ কথাসাহিত্যিক লিয়েভ তলস্তোয়ের ছেলেবেলা ও বালকবেলার স্মৃতিকথা, কিংবা মহাত্মা গান্ধীর আত্মজীবনী মাই এক্সপেরিয়েন্স উইথ্ ট্রুথ পড়লে এই মনীষীকুলের জীবনেও বয়ঃসন্ধি কী কঠিন সংকট হয়ে এসেছিল, তা জানা যাবে।
আগেই বলেছি, ছেলে-মেয়ে সবার জীবনে বয়ঃসন্ধির পরিবর্তনগুলোর সঙ্গে তাদের শারীরিক-মানসিক সত্তার যোগ নিহিত, স্বাভাবিক ও মৌলিক। সেখানে আইন ও শাস্তির মতো নিরপেক্ষ কঠোর নিদান অচল ও অকার্যকর। তারচেয়ে মানবিক আচরণ স্নেহ-প্রীতি-মমতা অনেক ফলপ্রসূ।
এ সময়ে কেবল শরীরে পরিবর্তন ঘটছে তা তো নয়, মনেরও বিকাশ ঘটতে থাকে। ছোট্ট অন্তরে বাইরের বার্তা পৌঁছায়, ছোট গণ্ডি ভেঙে যেন বড় হওয়ার সাধ জাগে, স্বার্থ ছেড়ে মহৎ হতে ইচ্ছা করে ইত্যাদি। প্রায় এই বয়সেরই বালক তো ক্ষুদিরাম। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অসংখ্য বীর ও শহীদ তো কিশোরই ছিল। তাহলে যার মধ্যে মহৎ হওয়ার, নায়ক হওয়ার গুণাবলি থাকে, সে কেন এই সমাজে দুর্বৃত্ত ও খলনায়কে পরিণত হয়েছে? সে প্রশ্নের মুখোমুখি তো আমাদের হতে হবে।
আমরা জানি, কোনো সমাজের সবাই হিরো হয় না বা ভিলেন হয় না। সাধারণত মধ্যপথের যাত্রী থাকে বেশি, নানা সমস্যা-সংকটের ভেতর দিয়ে শেষ পর্যন্ত তারা গতানুগতিক পথেই থিতু হয়। কিন্তু সমস্যা হয় যাদের প্রবণতা, সংবেদনশীলতা তীব্র, অনেক সময় মাত্রাছাড়া, যারা ব্যতিক্রমী পথে চলার তাগিদ বোধ করে তাদের নিয়ে। তাদের বেশির ভাগের ক্ষেত্রে হিরো হওয়ার পথ রুদ্ধ হলে তারা ভিলেন হওয়ার পথ ধরতেও কুণ্ঠিত হয় না। আর আমাদের অবুঝ, উদাসীন এবং বিধানসর্বস্ব সমাজ তাদের পরিত্যাগ করে সত্যিই অপরাধীতে পরিণত হতে দেয়।
‘অথচ, এই বয়সেই স্নেহের জন্যে কিঞ্চিৎ অতিরিক্ত কাতরতা মনে জন্মায়। এই সময়ে সে যদি কোন সহূদয় ব্যক্তির নিকট হইতে স্নেহ কিম্বা সখ্য লাভ করিতে পারে তবে তাহার নিকট আত্মবিক্রীত হইয়া থাকে।’ সেই ছুটি গল্পে রবীন্দ্রনাথ এই উপলব্ধির কথা লিখেছেন। আসলে এই বয়সের ছেলেমেয়েরা বাস্তব জগৎ থেকে, তার পরিচিতজনের মধ্যে রোল মডেল খোঁজে, খুব চায় কাউকে শ্রদ্ধা করতে, অনুপ্রাণিত হয় যোগ্য মানুষের নির্দেশনা মানতে। এটাই তো জীবনপথের যাত্রীকে সঠিক পথে পরিচালিত করার বয়স। তাই তো এ বয়সের ছেলেমেয়েরা নাটকের দল করে, কবিতা-পত্রিকা প্রকাশ করে, সামাজিক সংগঠন গড়ে, দলে মিলে স্কাউট-গাইড হয়, বড় কাজের ডাক পেলে তাতে ঝাঁপিয়ে পড়তে চায়। তাদের সামনে রোল মডেল হয়েছি আমরা? তাদের সঙ্গে নিচ্ছি, কাজে ডাকছি কজন? আমরা জীবন গড়ার বিচিত্র বিপুল সম্ভারের হদিশ রাখি না, কেবল আইন, শাস্ত্র ও বিধানের চোখ রাঙানি দিয়ে সমাধান খুঁজি।
এভাবে বয়ঃসন্ধির ছেলেমেয়েদের কাছে এ সমাজের অপরাধ দ্বিগুণ হচ্ছে। একবার তাদের সম্ভাবনার মুকুল ফোটার জন্য প্রয়োজনীয় সহযোগিতা না দিয়ে আর দ্বিতীয়বার তাদের কেবল অবরুদ্ধ করার কৌশল প্রয়োগ করে।
আমরা একটা সুস্থ সুষম স্বাভাবিক সমাজের কথা ভাবি না কেন? বয়ঃসন্ধির ছেলেকে বশ করার প্রধান অস্ত্র হচ্ছে—হ্যাঁ, আইন ও শাস্তি নয়—স্নেহ। যদি বলি সমাজে স্নেহের আকাল পড়েছে, তবে কি ভুল বলা হবে? আশা করি, এক সন্তানের মায়েদের নিজ সন্তানের প্রতি অন্ধস্নেহ ও ভালোবাসার সঙ্গে আমার এ চাহিদাকে কেউ গুলিয়ে ফেলবেন না। নিঃস্বার্থ স্নেহ এ সমাজ দেখেছে, জানে এবং এখনো কিছু তার অবশিষ্ট আছে। কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। পঞ্চাশোর্ধ্বরা ভাবুন, মামা-খালা-ফুফু-দাদি-নানি-নানাদের কাছ থেকে কেমন স্নেহ পেতেন। পাড়াতুতো খালা-বুবু-দাদাদের স্নেহ-প্রীতির কথাও ভাবুন। সমাজ মনুষ্যত্ব রচনা করে স্নেহ-প্রীতির মতো মানবিক গুণাবলির বন্ধনে, হারানো মনুষ্যত্ব ফিরেও পাবে এসবের চর্চাতেই, আইন বা শাস্তির কঠোরতায় নয়।
গত কিছুদিনে বিভিন্ন অঞ্চলে শিক্ষিকাদের ছোট ছোট বৈঠকে মতবিনিময় করেছি এ বিষয়েই। তাঁরা আমার সঙ্গে সহমত হন যে ফটিকদের—অর্থাৎ বয়ঃসন্ধির বালকদের—যদি স্নেহের আন্তরিকতাটুকু বুঝতে দেওয়া যায়, যদি স্পর্শের আওতায় আনা ও রাখা যায় (মাথায় হাত বুলিয়ে, পিঠ চাপড়ে দিয়ে বা আরও) তবে তাঁদের ফাঁকি দিয়ে কোনো ছেলেই ধর্ষক বা উত্ত্যক্তকারী হতে পারে না। আদতে ওই বয়সের ছেলে সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের উক্তিটি চরম সত্য—‘এই সময়ে যদি সে কোন সহূদয় ব্যক্তির নিকট হইতে স্নেহ কিম্বা সখ্য লাভ করিতে পারে তবে তাহার নিকট আত্মবিক্রীত হইয়া থাকে।’ যে এই আনুগত্যের সুযোগ পায় না তার আহত বুভুক্ষু কাঙাল স্নেহকাতর সত্তাটি তখন প্রত্যাঘাত হানে, প্রায়শ নারীর প্রতি যৌন নির্যাতনের পথ ধরে। সে দাসত্ব ছেড়ে প্রভুত্বের অহংকারে বেপরোয়া হয়ে ওঠে। ব্যাপারটা অনেকটাই সাপের বিষ নামানোর মতো। যোগ্য-দক্ষ ওঝাই পারেন এ কাজ; শস্ত্রধারী পুলিশ আর অন্ধ আদালতের নয় এ কাজ।
এখানে এ কথাটাও বলা দরকার, যে কিশোরীরা আতঙ্কে-অভিমানে-অপমানে আত্মহত্যা করেছে, তাদেরও প্রয়োজন ছিল সহূদয় আপনজনের স্নেহ ও সখ্য। তাহলে হয়তো চরম সিদ্ধান্ত তাদের নিতে হতো না।
না, আইন একেবারে থাকবে না তা নয়; শাস্তিও থাকবে, তবে তা হবে অগত্যা, অপরাধ যখন ঘটে যাবে। কিন্তু আমরা তো সেই সমাজের কথা বলছি যে ভারসাম্যপূর্ণ মানবিক সমাজে ছেলেমেয়েরা সুস্থ স্বাভাবিকভাবে তাদের নিহিত সত্তারও বিকাশ ঘটানোর সুযোগ পাবে। সেখানে অপরাধ হবে ব্যতিক্রমী অঘটন, যা কদাচিৎ ঘটবে।
আবুল মোমেন: কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.