সময়ের প্রতিবিম্ব-অভাজনের বাজেট ভাবনা by এবিএম মূসা
জাতীয় সংসদে আমাদের বিজ্ঞ অর্থমন্ত্রীর বাজেট পেশের পর কতিপয় সংবাদপত্রের পাতায় শিরোনাম পড়লাম, ‘জনগণের জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়বে’। মনে হলো পত্রিকার প্রতিবেদক একটি রসিকতা করেছেন। গত কয়েক বছর দ্রব্যমূল্য পাগলা ঘোড়ার মতো ছুটছে, কখনো থমকেও দাঁড়িয়েছে, কিন্তু পিছু হটেনি।
তা হলে ‘বাড়বে’ নতুন খবর হয় কী করে? বস্তুত বাড়া-কমার সঙ্গে অর্থমন্ত্রীর রাষ্ট্রীয় বাজেট পেশের ও তাঁর বক্তৃতার সময়ে সাংসদদের টেবিল চাপড়ানোর কী সম্পর্ক?
এখন বাজেট মানে জনগণের জীবনযাত্রার মান নির্ধারণ নয়। বাজেট হচ্ছে বড় বড় বুলি, প্রবৃদ্ধির হার অথবা জিডিপি, বাংলায় যাকে বলে জাতীয় কিংবা জনপ্রতি আয়ের হিসাব। সাধারণ পাঠক এসব বোঝে না, বুঝতেও চায় না। আমার মতো অর্থনীতিতে স্বল্পজ্ঞানসম্পন্ন পুরোনো জমানার সাংবাদিকের পক্ষেও পুরোপুরি বোঝা ও ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। কারণ আওয়ামী লীগের বর্তমান সরকারের, এককালের সামরিক শাসন আমলের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের বাজেট বুঝতে হলে বাজেট সম্পর্কে জনগণের ধারণা জানতে হবে না, এতৎসম্পর্কীয় জ্ঞান থাকতে হবে। সেই জ্ঞান আমার নেই, তবু নিজস্ব ধারায় আলোচনা করতে হচ্ছে। কারণ সবাই মনে করেন, সাংবাদিক হচ্ছেন ‘জ্যাক অব অলট্রেড মাস্টার অব নান।’ সাংবাদিক সবই বোঝেন, আসলে কিছুই বোঝেন না।
তবু সাংবাদিকের অহমিকাবোধ নিয়ে বুঝতে চেয়েছি সরকারের বার্ষিক বাজেট বলতে সাধারণ জ্ঞানে কী বোঝায়, অতীতে কী বুঝতাম, আমার মনে হয় বর্তমানে বাজেট বলতে সাধারণ মানুষ বোঝে, সরকারের আয় বৃদ্ধি ও তাদের দৈনন্দিন দুর্ভোগের পরিমাণের আওতা বাড়ানোর বর্তমান ব্যবস্থার নাম বাজেট। এ ব্যবস্থাটি একসময়ে জনগণের নিজস্ব সাংসারিক আয়-ব্যয়ের বাজেট আর্থিক সুবিধা-অসুবিধা, সুখ-দুঃখের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিল। এখন বাজেট শুধু একটি রাষ্ট্রীয় রীতি, সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক জীবনযাত্রার মানদণ্ডের সঙ্গে সম্পর্কহীন।
কবে যেন, সেই অর্ধশতাব্দী আগে স্নাতক শ্রেণীতে ‘অর্থনীতি’ বিষয়টি পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত করেছিলাম। ইংরাজি-বাংলা বাধ্যতামূলক ছিল, এ ছাড়া আরও তিনটি বিষয় ছিল পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত। আমি নিলাম রাষ্ট্রবিজ্ঞান, অর্থনীতি আর আরবি। এর বাইরে দর্শন, ইতিহাস অথবা অঙ্ক নেওয়া যেত। সেগুলোর পাঠের বহর ছিল বিস্তৃত, তাই আমার পছন্দের বাইরে ছিল। আরবি নিলাম, কারণ হুজুরেরা নাকি নম্বর বেশি দিতেন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের নোটবই পড়লেই পাশের নম্বর পাওয়া যেত। নেপথ্যে বলে রাখি, এখন নাকি সব নোটবই পুস্তকাকারে নিষিদ্ধ। তবে দৈনিক পত্রিকার পাতায় নোটবইয়ের বিরুদ্ধে প্রতিবেদন ছাপা হয় আর ‘পাঠ্য সহায়ক’ নামে নোটবইয়ের বিষয়বস্তু ছাপা হয়। শুনেছি, নিষিদ্ধ বই থেকে টুকে নিয়েই তা করা হয়। আমার প্রাথমিক অর্থনীতি জ্ঞান অর্জন আদি নোটবইয়ের কয়েকটি পাতা মুখস্থ করে। দেশ-বিদেশের অর্থনীতির খোঁজখবর, রাষ্ট্রীয় ও সরকারি আয়-ব্যয়ের, বিশ্ব অর্থনীতির অথবা ট্যাক্স বা সরকারের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর আরোপের নানা ব্যবস্থার বিবরণ থাকত। তখনো উৎস কর, মূসক, ভ্যাট ইত্যাদি কৌশলী কর আদায়ের পন্থা আবিষ্কৃত হয়নি। সংখ্যাতত্ত্ব বা অঙ্কশাস্ত্রে জ্ঞান অর্জনের প্রয়োজন ছিল না। ম্যাক্রো মাইক্রো শব্দদ্বয়ের নাম না শুনলেও চলত। এসআরও একটি বাজেটবহির্ভূত নীতিবিগর্হিত স্বেচ্ছাচারী কর আরোপের পদ্ধতি। বস্তুত এসআরও নির্বাহী বিভাগের করারোপ, জনগণের সংসদে পাস করা আয়-ব্যয়ের প্রস্তাবনা ও কর নির্ধারণের প্রতি অবজ্ঞা ও তাচ্ছিল্য প্রদর্শন মনে হতে পারে।
প্রাক্-স্বাধীনতা আমলে অর্থনীতিতে ভিন্ন কারণে রাষ্ট্রীয় বাজেট আলোচনায় রাজনীতির প্রভাবও ছিল মুখ্য। বাজেট বরাদ্দে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি অর্থনৈতিক বৈষম্য ছিল প্রগতিশীল পত্রিকাগুলোর মূল আলোচ্য বিষয়। সেগুলো বিশ্লেষণ করতেন অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ, আখলাকুর রহমান, আনিসুর রহমান, ড. নুরুল ইসলাম, রেহমান সোবহান প্রমুখ অর্থনীতিবিদেরা। এসব বুঝতে সাহায্য করতেন কয়েকজন বাঙালি আমলা, যাঁরা পরিকল্পনা কমিশনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তাঁদের বিশ্লেষিত পূর্ব ও পশ্চিমের অর্থনৈতিক বৈষম্য, বঞ্চনা আর অসাম্যের সহজ-সরল ব্যাখ্যাই বাংলাদেশের স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধীনতার দাবির মূল ভিত্তি রচনা করেছিল। উন্নয়ন খাতে পূর্বাঞ্চলের বরাদ্দে শুভংকরের ফাঁকি তাঁরাই আমাদের বুঝিয়ে দিতেন। তাঁরা বোঝাতেন, আমরা সহজ-সরল ভাষায় পত্রিকার পাতায় বোঝানো কথা ওপরে দিতাম। হিসাব কষে বোঝাতেন, পশ্চিমাঞ্চল কী পেল আর পূর্বাঞ্চল কী পায়নি। সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রচারের মূল বক্তব্য ছিল ‘বৈষম্য’। সারা বাংলাদেশ ছেয়ে গিয়েছিল বৈষম্যের হিসাব দেওয়া প্রচারপত্রে। শিরোনাম ছিল ‘পূর্ব পাকিস্তান শ্মশান কেন?’ এরই এখন বিকল্প ভাবনা শপিং মলে কেন উপচে পড়া ভিড়, বাড়ির কর্তাকে কেন বাজার থেকে শূন্য হাতে ফিরতে হয়। কেন পত্রিকায় শিরোনাম হয়, ‘বাড়ছে আর বাড়ছে’। এসব প্রশ্নের জবাব অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতায় নেই; জবাব নেবেন জনগণ আরও সাড়ে তিন বছর পর।
অতীত ও বর্তমানের বাজেটের তুলনামূলক আলোচনা একটু দীর্ঘায়িত করছি। তখন কেন্দ্রীয় পাকিস্তান সরকারের বাজেট নিয়ে যে আলোচনা হতো, তাতেও ‘ওরা কী পেল আর আমরা কী পাইনি’ তারই বিস্তারিত বর্ণনা থাকত। এ ছাড়া অসীম জ্ঞানসম্পন্ন বাঙালি অর্থনীতিবিদ অর্থনীতিতে নতুন তত্ত্ব আবিষ্কার করলেন। সেটি ছিল অবিভক্ত ভারতের ‘টু নেশন’ ধারণার অনুকরণে ‘টু ইকোনমি’। সাধারণ অর্থে বোঝাতেন, দুই অঞ্চলের জন্য পৃথক অর্থ বরাদ্দের প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করতেন। চুয়ান্ন সালের যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনী প্রচারণায়, বঙ্গবন্ধুর ছয় দফায় আর সত্তরের নির্বাচনী গণজোয়ার সৃষ্টিতে পরোক্ষে ‘টু ইকোনমি’ অর্থাৎ দুই অঞ্চলের দুই রকমের অর্থনৈতিক উন্নতির ধারা আর প্রবৃদ্ধি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এখন স্বাধীন দেশে রয়েছে ‘টু সোসাইটি’ তথা উচ্চ আর নিম্নবিত্তের আয়-ব্যয়ের অসামঞ্জস্য। তখনকার ভাবনা ছিল, সাড়ে সাত কোটি নর-নারীকে নিঃস্ব করে পশ্চিম পাকিস্তানে চৌদ্দ পরিবারের গড়ে ওঠা সম্পদের পরিমাণের বিবরণ। বলাবাহুল্য, করাচি, পরবর্তী সময়ে ইসলামাবাদে তৈরি বাজেট আলোচনায় এসবই ছিল সাধারণের বোধগম্য। এখন সাধারণ মানুষ ভেবে কূল পায় না চৌদ্দ পরিবার বাংলাদেশ হওয়ার পর কীভাবে চৌদ্দ লাখ হয়ে গেল? আমি বলব, এ প্রশ্নের উত্তর পাবেন ‘বাড়ছে আর বাড়ছে শিরোনামে’।
এখন সাধারণ মানুষের রাষ্ট্রীয় বাজেটের মর্যাদা, প্রয়োজনীয়তা ও কার্যকরতা বোঝার স্বরূপও বদলেছে। পাকিস্তানি আমলে বাজেট নিয়ে দুশ্চিন্তা ছিল, কিসের ওপর কত ট্যাক্স বসল। এখন সরকারের করারোপ পদ্ধতি ও নীতি গৌণ, ‘সিন্ডিকেট’ যা নির্ধারণ করবে তা-ই এখন মুখ্য। তারা সংসদে সরকারের প্রস্তাবিত করারোপ নিয়ে আলোচনা করে না, চকবাজার, মৌলভীবাজার আর খাতুনগঞ্জ ও বকশীবাজারে কত বাড়ছে, তা নিয়েই তাদের দুর্ভাবনা। আগে ভাবত কবে ধান উঠবে, চালের দাম কমবে। সেই ভাবনারও ইতি ঘটেছে। এখন ভাবে, কার গুদামে কত ধান চাল মজুদ হচ্ছে। একটুখানি চিন্তাশীল নাগরিক মুচকি হেসে ভাবে, কোন সরকারের আমলের বাজেটে কোন ব্যবসায়ী-শিল্পপতির অথবা ক্ষমতাসীনদের পেয়ারের লোকদের স্বার্থে কোনটির আমদানি-রপ্তানিতে শুল্ক বাড়ে-কমে। ভ্যাট নামক নতুন সাঁড়াশি আক্রমণের জটিল পন্থাটি তারা বুঝতে পারে না। তবে এটুকু টের পায়, সিন্দাবাদের বোঝাটি তাদের কাঁধে চাপিয়ে মন্ত্রী বলেন, জনগণের ওপর প্রত্যক্ষ করভার চাপানো হয়নি।
এমতাবস্থায় স্বাধীন বাংলাদেশে অতীতের স্বল্প জ্ঞান ও সহজ ধারণা নিয়ে বাজেট আলোচনা অথবা সমালোচনা যতখানি জটিল ভাবছি, আসলে ততখানি অবোধ্য নয়। সাধারণ মানুষ বা ব্যবসায়ীদের প্রতিক্রিয়া নিয়ে এখন পত্রিকায় অর্থনীতি-রিপোর্টারও মাথা ঘামান না। আমরা ম্যালথাসের জনসংখ্যা বৃদ্ধির কুফল, কৃষিপণ্যের উৎপাদন, কিসের ওপর ট্যাক্স বাড়ল আর কমল, এসবই শুধু প্রথম পাতার কয়েকটি কলমে সীমাবদ্ধ পর্যালোচনা করতাম। এসবই ছিল সাধারণ মানুষের নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের চাহিদা ও মূল্য বৃদ্ধি, আয়-ব্যয়ের সামঞ্জস্য নিয়ে টুকিটাকি আলোচনা। সাম্প্রতিককালে মানে বাজেট তথা অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণে, রাষ্ট্রীয় আয়-ব্যয়ের হিসাবে সরকারের অর্থমন্ত্রীর বাজেট জনগণের সাধারণ সুখ-দুঃখ ভাবনার দিনযাপনের আর প্রাণ ধারণের গ্লানির সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। এখন কতিপয় তত্ত্ব আর অবোধ্য তত্ত্বে ভরপুর অর্থমন্ত্রীর বাজেটের সঙ্গে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা, আগাম দুর্ভাবনার কোনো সম্পর্ক নেই। জনগণ বোঝে না জিডিপি কী, তার সঙ্গে চাল-ডাল-তেলের দামের কী সম্পর্ক। তার আরও অনেক কঠিন সব শব্দচয়ন হয়েছে বাজেট বক্তৃতায়। ম্যাক্রো আর মাইক্রো, এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বৈশ্বিক অর্থায়ন। এসব পত্রিকার পাতায় সীমাবদ্ধ, সাধারণ মানুষের দুঃসহ আর্থিক যন্ত্রণায় এসবের স্থান নেই। তারা সকালে বাজারে যাওয়ার আগে পত্রিকার পাতায় পড়া ছাপানো শব্দগুলো ভুলে যায়।
অর্থমন্ত্রী নিম্নবিত্তের সারা জীবনের সঞ্চয় দিয়ে কেনা গাড়ি চড়ার প্রয়োজনীয়তাকে বিলাসিতা মনে করে প্রকারভেদে ট্যাক্স বসিয়েছেন। তাদের থেকে নেওয়া অতিরিক্ত বা উদ্বৃত্ত অর্থ দিয়ে উচ্চবিত্তের দামি গাড়ি কেনার শখ মেটাচ্ছেন। যাঁরা সংসদে মন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতার সময়ে টেবিল চাপড়িয়েছেন, সেই জনপ্রতিনিধিদের অবশ্য এ নিয়ে কোনো দুশ্চিন্তা নেই। কারণ তাঁদের তো গাড়ির জন্য ট্যাক্সই দিতে হবে না। বাজেট নিয়ে সাধারণ ভাবনায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ‘একটি পরিবার, একটি খামার’ প্রকল্পের বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি স্থান পায় না। তবে অর্থমন্ত্রী একজন স্বল্পবিত্তের মানুষের ‘একটি পরিবার, ছোট একটি ফ্ল্যাট’ তথা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে কেনা ‘এতটুকু বাসার’ স্বপ্ন অলীক কল্পনার রূপ দিয়েছেন, বিশ্লেষকেরা বলছেন, বাড়ি ফ্ল্যাটের দাম বাড়ছে। নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষ যাবে কোথায়? বস্তিতেও ঠাঁই হবে না, কারণ সেগুলো আগুনে পুড়ে ছাই হচ্ছে, মাথা গোঁজার ছোট কামরার বাড়িটি ধসে পড়েছে। তবে একটি সান্ত্বনা, পূর্তমন্ত্রী যতই হুমকি-ধমকি দিন ভূমিদস্যুদের বিলে-খালে বাড়ি তৈরির ধূর্ত পরিকল্পনার বাস্তবায়ন বন্ধ হবে না বরং তাদের পোয়াবারো, এখন হাওরের মাঝে জমি বিক্রি হবে।
অভাজনের বাজেট আলোচনা দীর্ঘায়িত করব না, তবে নিম্ন ও মধ্যবিত্তের গাড়ির ওপর করের টেলিভিশন-ফ্রিজের ওপর করের মাজেজা ব্যাখ্যা করে বিজ্ঞজনোচিত না হলেও ব্যঙ্গাত্মক মতামত দেওয়ার অনেক রসিকজনের সঙ্গে কথাবার্তা হয়। গত শুক্রবার মসজিদে যাওয়ার পথে আমার প্রবীণ প্রতিবেশীর সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে এসব আলোচনা করছিলাম। তিনি পরিহাসের সুরে বললেন, ‘আরে, জনগণের কথা বাদ দেন। সরকারের প্রতাবশালী অথবা নীতিনির্ধারকদের কার কোথায় স্বার্থ কোন শিল্পে বা ব্যবসায় কতখানি অংশীদারি, তা জানতে আপনার অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের খোঁজখবর নিতে বলুন।’ হাঁটার পথে থমকে দাঁড়িয়ে দূরের মানিক মিয়া এভিনিউয়ে দুবার ন্যাম ফ্ল্যাটগুলো দেখিয়ে বললেন, ওগুলোর কিন্তু দাম অথবা ভাড়ার ওপর কর বাড়েনি। সেখানে যাঁরা থাকেন, তাঁদের বর্গফুটের হিসাব করতে হয় না। জীবনযাত্রার ব্যয় সে তো আমার-আপনার ভাবনা। অর্থমন্ত্রীর বাজেট সংসদে পেশ করার পর মাননীয় স্পিকারের আহ্বানে যাঁরা সমস্বরে ‘হ্যাঁ’ বলবেন, তাঁরা তো নিজেদের আয়-ব্যয়ের হিসাব মেলাতে আগেই বেতন-ভাতা বাড়িয়ে নিয়েছেন।
মসজিদের পথটির শেষ প্রান্তে যখন পৌঁছেছি, প্রতিবেশী পথযাত্রীর মন্তব্য কানে এল, ‘শুনছি, বাড়ি বাড়ি নাকি রাজস্ব বোর্ডের লোক যাবে আয়ের উৎসের সন্ধানে করদাতা খুঁজতে। অতি উত্তম উদ্যোগ, কিন্তু শুভকর্মের সূচনাটি মন্ত্রী-সাংসদদের বাড়ি থেকে শুরু্ন করলে ভালো হয় না? নির্বাচনের আগে যে তাঁদের আয়-ব্যয়ের হিসাব-নিকাশের কথা প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, তার কী হলো?’ মসজিদের প্রবেশের মুখে বললেন, ‘অর্থমন্ত্রীর জ্ঞানগর্ভ বাজেট বুঝতে হবে না, কাল সকালে বাজারে গিয়ে নিজের বাজেট মেলাবেন, মুদি দোকানির কাছে খাতুনগঞ্জ-মৌলভীবাজারের পরিস্থিতি জেনে নেবেন।’
এবিএম মূসা: সাংবাদিক।
এখন বাজেট মানে জনগণের জীবনযাত্রার মান নির্ধারণ নয়। বাজেট হচ্ছে বড় বড় বুলি, প্রবৃদ্ধির হার অথবা জিডিপি, বাংলায় যাকে বলে জাতীয় কিংবা জনপ্রতি আয়ের হিসাব। সাধারণ পাঠক এসব বোঝে না, বুঝতেও চায় না। আমার মতো অর্থনীতিতে স্বল্পজ্ঞানসম্পন্ন পুরোনো জমানার সাংবাদিকের পক্ষেও পুরোপুরি বোঝা ও ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। কারণ আওয়ামী লীগের বর্তমান সরকারের, এককালের সামরিক শাসন আমলের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের বাজেট বুঝতে হলে বাজেট সম্পর্কে জনগণের ধারণা জানতে হবে না, এতৎসম্পর্কীয় জ্ঞান থাকতে হবে। সেই জ্ঞান আমার নেই, তবু নিজস্ব ধারায় আলোচনা করতে হচ্ছে। কারণ সবাই মনে করেন, সাংবাদিক হচ্ছেন ‘জ্যাক অব অলট্রেড মাস্টার অব নান।’ সাংবাদিক সবই বোঝেন, আসলে কিছুই বোঝেন না।
তবু সাংবাদিকের অহমিকাবোধ নিয়ে বুঝতে চেয়েছি সরকারের বার্ষিক বাজেট বলতে সাধারণ জ্ঞানে কী বোঝায়, অতীতে কী বুঝতাম, আমার মনে হয় বর্তমানে বাজেট বলতে সাধারণ মানুষ বোঝে, সরকারের আয় বৃদ্ধি ও তাদের দৈনন্দিন দুর্ভোগের পরিমাণের আওতা বাড়ানোর বর্তমান ব্যবস্থার নাম বাজেট। এ ব্যবস্থাটি একসময়ে জনগণের নিজস্ব সাংসারিক আয়-ব্যয়ের বাজেট আর্থিক সুবিধা-অসুবিধা, সুখ-দুঃখের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিল। এখন বাজেট শুধু একটি রাষ্ট্রীয় রীতি, সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক জীবনযাত্রার মানদণ্ডের সঙ্গে সম্পর্কহীন।
কবে যেন, সেই অর্ধশতাব্দী আগে স্নাতক শ্রেণীতে ‘অর্থনীতি’ বিষয়টি পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত করেছিলাম। ইংরাজি-বাংলা বাধ্যতামূলক ছিল, এ ছাড়া আরও তিনটি বিষয় ছিল পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত। আমি নিলাম রাষ্ট্রবিজ্ঞান, অর্থনীতি আর আরবি। এর বাইরে দর্শন, ইতিহাস অথবা অঙ্ক নেওয়া যেত। সেগুলোর পাঠের বহর ছিল বিস্তৃত, তাই আমার পছন্দের বাইরে ছিল। আরবি নিলাম, কারণ হুজুরেরা নাকি নম্বর বেশি দিতেন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের নোটবই পড়লেই পাশের নম্বর পাওয়া যেত। নেপথ্যে বলে রাখি, এখন নাকি সব নোটবই পুস্তকাকারে নিষিদ্ধ। তবে দৈনিক পত্রিকার পাতায় নোটবইয়ের বিরুদ্ধে প্রতিবেদন ছাপা হয় আর ‘পাঠ্য সহায়ক’ নামে নোটবইয়ের বিষয়বস্তু ছাপা হয়। শুনেছি, নিষিদ্ধ বই থেকে টুকে নিয়েই তা করা হয়। আমার প্রাথমিক অর্থনীতি জ্ঞান অর্জন আদি নোটবইয়ের কয়েকটি পাতা মুখস্থ করে। দেশ-বিদেশের অর্থনীতির খোঁজখবর, রাষ্ট্রীয় ও সরকারি আয়-ব্যয়ের, বিশ্ব অর্থনীতির অথবা ট্যাক্স বা সরকারের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর আরোপের নানা ব্যবস্থার বিবরণ থাকত। তখনো উৎস কর, মূসক, ভ্যাট ইত্যাদি কৌশলী কর আদায়ের পন্থা আবিষ্কৃত হয়নি। সংখ্যাতত্ত্ব বা অঙ্কশাস্ত্রে জ্ঞান অর্জনের প্রয়োজন ছিল না। ম্যাক্রো মাইক্রো শব্দদ্বয়ের নাম না শুনলেও চলত। এসআরও একটি বাজেটবহির্ভূত নীতিবিগর্হিত স্বেচ্ছাচারী কর আরোপের পদ্ধতি। বস্তুত এসআরও নির্বাহী বিভাগের করারোপ, জনগণের সংসদে পাস করা আয়-ব্যয়ের প্রস্তাবনা ও কর নির্ধারণের প্রতি অবজ্ঞা ও তাচ্ছিল্য প্রদর্শন মনে হতে পারে।
প্রাক্-স্বাধীনতা আমলে অর্থনীতিতে ভিন্ন কারণে রাষ্ট্রীয় বাজেট আলোচনায় রাজনীতির প্রভাবও ছিল মুখ্য। বাজেট বরাদ্দে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি অর্থনৈতিক বৈষম্য ছিল প্রগতিশীল পত্রিকাগুলোর মূল আলোচ্য বিষয়। সেগুলো বিশ্লেষণ করতেন অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ, আখলাকুর রহমান, আনিসুর রহমান, ড. নুরুল ইসলাম, রেহমান সোবহান প্রমুখ অর্থনীতিবিদেরা। এসব বুঝতে সাহায্য করতেন কয়েকজন বাঙালি আমলা, যাঁরা পরিকল্পনা কমিশনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তাঁদের বিশ্লেষিত পূর্ব ও পশ্চিমের অর্থনৈতিক বৈষম্য, বঞ্চনা আর অসাম্যের সহজ-সরল ব্যাখ্যাই বাংলাদেশের স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধীনতার দাবির মূল ভিত্তি রচনা করেছিল। উন্নয়ন খাতে পূর্বাঞ্চলের বরাদ্দে শুভংকরের ফাঁকি তাঁরাই আমাদের বুঝিয়ে দিতেন। তাঁরা বোঝাতেন, আমরা সহজ-সরল ভাষায় পত্রিকার পাতায় বোঝানো কথা ওপরে দিতাম। হিসাব কষে বোঝাতেন, পশ্চিমাঞ্চল কী পেল আর পূর্বাঞ্চল কী পায়নি। সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রচারের মূল বক্তব্য ছিল ‘বৈষম্য’। সারা বাংলাদেশ ছেয়ে গিয়েছিল বৈষম্যের হিসাব দেওয়া প্রচারপত্রে। শিরোনাম ছিল ‘পূর্ব পাকিস্তান শ্মশান কেন?’ এরই এখন বিকল্প ভাবনা শপিং মলে কেন উপচে পড়া ভিড়, বাড়ির কর্তাকে কেন বাজার থেকে শূন্য হাতে ফিরতে হয়। কেন পত্রিকায় শিরোনাম হয়, ‘বাড়ছে আর বাড়ছে’। এসব প্রশ্নের জবাব অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতায় নেই; জবাব নেবেন জনগণ আরও সাড়ে তিন বছর পর।
অতীত ও বর্তমানের বাজেটের তুলনামূলক আলোচনা একটু দীর্ঘায়িত করছি। তখন কেন্দ্রীয় পাকিস্তান সরকারের বাজেট নিয়ে যে আলোচনা হতো, তাতেও ‘ওরা কী পেল আর আমরা কী পাইনি’ তারই বিস্তারিত বর্ণনা থাকত। এ ছাড়া অসীম জ্ঞানসম্পন্ন বাঙালি অর্থনীতিবিদ অর্থনীতিতে নতুন তত্ত্ব আবিষ্কার করলেন। সেটি ছিল অবিভক্ত ভারতের ‘টু নেশন’ ধারণার অনুকরণে ‘টু ইকোনমি’। সাধারণ অর্থে বোঝাতেন, দুই অঞ্চলের জন্য পৃথক অর্থ বরাদ্দের প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করতেন। চুয়ান্ন সালের যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনী প্রচারণায়, বঙ্গবন্ধুর ছয় দফায় আর সত্তরের নির্বাচনী গণজোয়ার সৃষ্টিতে পরোক্ষে ‘টু ইকোনমি’ অর্থাৎ দুই অঞ্চলের দুই রকমের অর্থনৈতিক উন্নতির ধারা আর প্রবৃদ্ধি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এখন স্বাধীন দেশে রয়েছে ‘টু সোসাইটি’ তথা উচ্চ আর নিম্নবিত্তের আয়-ব্যয়ের অসামঞ্জস্য। তখনকার ভাবনা ছিল, সাড়ে সাত কোটি নর-নারীকে নিঃস্ব করে পশ্চিম পাকিস্তানে চৌদ্দ পরিবারের গড়ে ওঠা সম্পদের পরিমাণের বিবরণ। বলাবাহুল্য, করাচি, পরবর্তী সময়ে ইসলামাবাদে তৈরি বাজেট আলোচনায় এসবই ছিল সাধারণের বোধগম্য। এখন সাধারণ মানুষ ভেবে কূল পায় না চৌদ্দ পরিবার বাংলাদেশ হওয়ার পর কীভাবে চৌদ্দ লাখ হয়ে গেল? আমি বলব, এ প্রশ্নের উত্তর পাবেন ‘বাড়ছে আর বাড়ছে শিরোনামে’।
এখন সাধারণ মানুষের রাষ্ট্রীয় বাজেটের মর্যাদা, প্রয়োজনীয়তা ও কার্যকরতা বোঝার স্বরূপও বদলেছে। পাকিস্তানি আমলে বাজেট নিয়ে দুশ্চিন্তা ছিল, কিসের ওপর কত ট্যাক্স বসল। এখন সরকারের করারোপ পদ্ধতি ও নীতি গৌণ, ‘সিন্ডিকেট’ যা নির্ধারণ করবে তা-ই এখন মুখ্য। তারা সংসদে সরকারের প্রস্তাবিত করারোপ নিয়ে আলোচনা করে না, চকবাজার, মৌলভীবাজার আর খাতুনগঞ্জ ও বকশীবাজারে কত বাড়ছে, তা নিয়েই তাদের দুর্ভাবনা। আগে ভাবত কবে ধান উঠবে, চালের দাম কমবে। সেই ভাবনারও ইতি ঘটেছে। এখন ভাবে, কার গুদামে কত ধান চাল মজুদ হচ্ছে। একটুখানি চিন্তাশীল নাগরিক মুচকি হেসে ভাবে, কোন সরকারের আমলের বাজেটে কোন ব্যবসায়ী-শিল্পপতির অথবা ক্ষমতাসীনদের পেয়ারের লোকদের স্বার্থে কোনটির আমদানি-রপ্তানিতে শুল্ক বাড়ে-কমে। ভ্যাট নামক নতুন সাঁড়াশি আক্রমণের জটিল পন্থাটি তারা বুঝতে পারে না। তবে এটুকু টের পায়, সিন্দাবাদের বোঝাটি তাদের কাঁধে চাপিয়ে মন্ত্রী বলেন, জনগণের ওপর প্রত্যক্ষ করভার চাপানো হয়নি।
এমতাবস্থায় স্বাধীন বাংলাদেশে অতীতের স্বল্প জ্ঞান ও সহজ ধারণা নিয়ে বাজেট আলোচনা অথবা সমালোচনা যতখানি জটিল ভাবছি, আসলে ততখানি অবোধ্য নয়। সাধারণ মানুষ বা ব্যবসায়ীদের প্রতিক্রিয়া নিয়ে এখন পত্রিকায় অর্থনীতি-রিপোর্টারও মাথা ঘামান না। আমরা ম্যালথাসের জনসংখ্যা বৃদ্ধির কুফল, কৃষিপণ্যের উৎপাদন, কিসের ওপর ট্যাক্স বাড়ল আর কমল, এসবই শুধু প্রথম পাতার কয়েকটি কলমে সীমাবদ্ধ পর্যালোচনা করতাম। এসবই ছিল সাধারণ মানুষের নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের চাহিদা ও মূল্য বৃদ্ধি, আয়-ব্যয়ের সামঞ্জস্য নিয়ে টুকিটাকি আলোচনা। সাম্প্রতিককালে মানে বাজেট তথা অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণে, রাষ্ট্রীয় আয়-ব্যয়ের হিসাবে সরকারের অর্থমন্ত্রীর বাজেট জনগণের সাধারণ সুখ-দুঃখ ভাবনার দিনযাপনের আর প্রাণ ধারণের গ্লানির সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। এখন কতিপয় তত্ত্ব আর অবোধ্য তত্ত্বে ভরপুর অর্থমন্ত্রীর বাজেটের সঙ্গে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা, আগাম দুর্ভাবনার কোনো সম্পর্ক নেই। জনগণ বোঝে না জিডিপি কী, তার সঙ্গে চাল-ডাল-তেলের দামের কী সম্পর্ক। তার আরও অনেক কঠিন সব শব্দচয়ন হয়েছে বাজেট বক্তৃতায়। ম্যাক্রো আর মাইক্রো, এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বৈশ্বিক অর্থায়ন। এসব পত্রিকার পাতায় সীমাবদ্ধ, সাধারণ মানুষের দুঃসহ আর্থিক যন্ত্রণায় এসবের স্থান নেই। তারা সকালে বাজারে যাওয়ার আগে পত্রিকার পাতায় পড়া ছাপানো শব্দগুলো ভুলে যায়।
অর্থমন্ত্রী নিম্নবিত্তের সারা জীবনের সঞ্চয় দিয়ে কেনা গাড়ি চড়ার প্রয়োজনীয়তাকে বিলাসিতা মনে করে প্রকারভেদে ট্যাক্স বসিয়েছেন। তাদের থেকে নেওয়া অতিরিক্ত বা উদ্বৃত্ত অর্থ দিয়ে উচ্চবিত্তের দামি গাড়ি কেনার শখ মেটাচ্ছেন। যাঁরা সংসদে মন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতার সময়ে টেবিল চাপড়িয়েছেন, সেই জনপ্রতিনিধিদের অবশ্য এ নিয়ে কোনো দুশ্চিন্তা নেই। কারণ তাঁদের তো গাড়ির জন্য ট্যাক্সই দিতে হবে না। বাজেট নিয়ে সাধারণ ভাবনায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ‘একটি পরিবার, একটি খামার’ প্রকল্পের বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি স্থান পায় না। তবে অর্থমন্ত্রী একজন স্বল্পবিত্তের মানুষের ‘একটি পরিবার, ছোট একটি ফ্ল্যাট’ তথা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে কেনা ‘এতটুকু বাসার’ স্বপ্ন অলীক কল্পনার রূপ দিয়েছেন, বিশ্লেষকেরা বলছেন, বাড়ি ফ্ল্যাটের দাম বাড়ছে। নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষ যাবে কোথায়? বস্তিতেও ঠাঁই হবে না, কারণ সেগুলো আগুনে পুড়ে ছাই হচ্ছে, মাথা গোঁজার ছোট কামরার বাড়িটি ধসে পড়েছে। তবে একটি সান্ত্বনা, পূর্তমন্ত্রী যতই হুমকি-ধমকি দিন ভূমিদস্যুদের বিলে-খালে বাড়ি তৈরির ধূর্ত পরিকল্পনার বাস্তবায়ন বন্ধ হবে না বরং তাদের পোয়াবারো, এখন হাওরের মাঝে জমি বিক্রি হবে।
অভাজনের বাজেট আলোচনা দীর্ঘায়িত করব না, তবে নিম্ন ও মধ্যবিত্তের গাড়ির ওপর করের টেলিভিশন-ফ্রিজের ওপর করের মাজেজা ব্যাখ্যা করে বিজ্ঞজনোচিত না হলেও ব্যঙ্গাত্মক মতামত দেওয়ার অনেক রসিকজনের সঙ্গে কথাবার্তা হয়। গত শুক্রবার মসজিদে যাওয়ার পথে আমার প্রবীণ প্রতিবেশীর সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে এসব আলোচনা করছিলাম। তিনি পরিহাসের সুরে বললেন, ‘আরে, জনগণের কথা বাদ দেন। সরকারের প্রতাবশালী অথবা নীতিনির্ধারকদের কার কোথায় স্বার্থ কোন শিল্পে বা ব্যবসায় কতখানি অংশীদারি, তা জানতে আপনার অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের খোঁজখবর নিতে বলুন।’ হাঁটার পথে থমকে দাঁড়িয়ে দূরের মানিক মিয়া এভিনিউয়ে দুবার ন্যাম ফ্ল্যাটগুলো দেখিয়ে বললেন, ওগুলোর কিন্তু দাম অথবা ভাড়ার ওপর কর বাড়েনি। সেখানে যাঁরা থাকেন, তাঁদের বর্গফুটের হিসাব করতে হয় না। জীবনযাত্রার ব্যয় সে তো আমার-আপনার ভাবনা। অর্থমন্ত্রীর বাজেট সংসদে পেশ করার পর মাননীয় স্পিকারের আহ্বানে যাঁরা সমস্বরে ‘হ্যাঁ’ বলবেন, তাঁরা তো নিজেদের আয়-ব্যয়ের হিসাব মেলাতে আগেই বেতন-ভাতা বাড়িয়ে নিয়েছেন।
মসজিদের পথটির শেষ প্রান্তে যখন পৌঁছেছি, প্রতিবেশী পথযাত্রীর মন্তব্য কানে এল, ‘শুনছি, বাড়ি বাড়ি নাকি রাজস্ব বোর্ডের লোক যাবে আয়ের উৎসের সন্ধানে করদাতা খুঁজতে। অতি উত্তম উদ্যোগ, কিন্তু শুভকর্মের সূচনাটি মন্ত্রী-সাংসদদের বাড়ি থেকে শুরু্ন করলে ভালো হয় না? নির্বাচনের আগে যে তাঁদের আয়-ব্যয়ের হিসাব-নিকাশের কথা প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, তার কী হলো?’ মসজিদের প্রবেশের মুখে বললেন, ‘অর্থমন্ত্রীর জ্ঞানগর্ভ বাজেট বুঝতে হবে না, কাল সকালে বাজারে গিয়ে নিজের বাজেট মেলাবেন, মুদি দোকানির কাছে খাতুনগঞ্জ-মৌলভীবাজারের পরিস্থিতি জেনে নেবেন।’
এবিএম মূসা: সাংবাদিক।
No comments