শৈশব-কী করে পারলাম শিশুদের শৈশব কেড়ে নিতে? by মেহতাব খানম

আমার তখন পাঁচ কি ছয় বছর বয়স। রেডিওতে ‘মায়া বন বিহারিণী হরিণী’ এই গানটি কয়েকবার শোনার পর প্রায় মুখস্থ হয়ে যাওয়ায় আমি একদিন বেশ উঁচু স্বরে গাইছিলাম—‘দূর হতে আমি তারে সাধিব, গোপনে বিরহডোরে বাঁধিব’।


গানের কথার অর্থ আমার কাছে মোটেও পরিষ্কার ছিল না বলে এর কোনো আবেদনও অনুভব করছিলাম না, হয়তো বা গানের সুরটিতে ভালো লাগা ছিল। এ সময় হঠাৎ আমার মায়ের তীক্ষ চিৎকার শুনতে পেলাম। তিনি বেশ রাগ করে আমাকে বললেন, এই গানটি আমার কচিমুখে একটুও মানাচ্ছে না। আমি যেন এরপর থেকে ছোটদের গানগুলো গাই। সেদিন অবশ্য আমার অপরাধটা ভালো করে বুঝতে পারিনি। খুব অভিমান হয়েছিল গানটি এভাবে থামিয়ে দেওয়া হয়েছিল বলে। অপমান বোধও হয়েছিল বাড়ির অন্যদের সামনে বকুনি খেয়ে। তবে আমাকে কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থায় দেখে মা আমাকে কাছে ডেকে আদর করে বুঝিয়ে বলেছিলেন—সব বয়সের মানুষের জন্য সব গান নয়। পরে আরও ভালোভাবে বুঝেছিলাম, আমার মা আমার মধ্যে শৈশবের স্বভাবসুলভ আচরণই দেখতে চেয়েছিলেন।
প্রতিটি মানুষের আচরণে তার চিন্তাধারা এবং আবেগের প্রতিফলন ঘটে এবং সেটি যখন তার বয়সের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয় তখন তার একটি স্বাভাবিক সৌন্দর্য এবং পবিত্রতা থাকে, যা অন্যদের কাছেও উপভোগ্য হয়। কিন্তু ইদানীং খুদে ছেলেমেয়েদের দিয়ে যেসব গান গাইয়ে টেলিভিশনে যে প্রতিযোগিতার অনুষ্ঠান দেখানো হচ্ছে, তাতে মনে হচ্ছে না এই শিশুদের প্রাপ্তবয়স্ক প্রেমিক-প্রেমিকার মতো রোমান্টিক ভাবভঙ্গি নিয়ে কেউ মাথা ঘামাচ্ছেন।
কিছুদিন আগে একটি কিশোর উপন্যাস পড়ছিলাম। সেখানে কৈশোরে থাকা ছেলেটি তার বাবার পরকীয়া প্রেমের ঘটনা নিয়ে মায়ের সঙ্গে একাত্মতা বোধ করছে। বিষয়টি নিয়ে আমি ভাবনায় পড়ে গিয়েছিলাম। কারণ, এই কিশোরের কষ্টের সঙ্গে আমার কাছে সাহায্য নিতে আসা কিছু পরিবারের অসহায় মুখগুলো একাকার হয়ে গিয়েছিল। অবশ্য সমাজে সাধারণত যা ঘটে তারই প্রতিচ্ছবি সাহিত্য, নাটক, সিনেমায় দেখা যায়। কিন্তু আমি তো আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি, ছোট্ট আর কচি মনগুলো কতটা বিপর্যস্ত হয় যখন তারা তাদের মা-বাবাকে অন্য কারও সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়তে দেখে। তারা তখন হঠাৎ করে শৈশবের স্বাভাবিক উচ্ছলতা হারিয়ে বড়দের মতো আচরণ করতে থাকে। বাবার এ ধরনের আচরণের জন্য মা যখন বিমর্ষ থাকেন তখন শিশুটি মায়ের একজন অভিভাবক বনে গিয়ে মাকে নানাভাবে খুশি করার জন্য অক্লান্ত চেষ্টা চালাতে থাকে। সে যদি মায়ের কোনো মন্তব্য থেকে বুঝতে পারে যে বাবা বিশ্বাসভঙ্গ করেছেন, তাহলে মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারিয়ে ফেলতে পারে এবং নিজেদের জীবনে সম্পর্ক গড়তে গিয়ে খুব বেশি হোঁচট খায়। উপন্যাসটি পড়ার সময় বারবার মনে হচ্ছিল সেখানে এ বিষয়টির উপস্থাপন না হলেই ভালো হতো। তার চেয়ে বরং শিশু-কিশোরদের নির্মল আনন্দের খোরাক হয় এমন বিষয় থাকলে এই যান্ত্রিক যুগেও ওদের মনটা সুখানুভূতিতে ভরে যেত। সুন্দর একটি ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখার সময়টিতে তাদের সামনে ভালো দৃষ্টান্তগুলো তুলে ধরা উচিত বলেই আমার ধারণা।
এ দেশের অগণিত শিশুদের পড়ালেখা শিখে মানুষ হওয়ার পেছনের কাহিনির সঙ্গে শৈশব হারানোর বেদনা কি আমরা অনুভব করতে পারি? একটি কলেজপড়ুয়া ছেলে আমাকে বলেছিল, তার জীবনের সবচেয়ে দুর্বিষহ আর অন্ধকার সময় ছিল ছয় থেকে আট বছর বয়স পর্যন্ত। সেই সময়ে একটি তথাকথিত নামকরা বিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দেওয়ার জন্য যে কঠোর পরিশ্রমের ভেতর দিয়ে তাকে যেতে হয়েছিল, সেই স্মৃতি এখনো তাড়া করে বেড়ায় ওকে। ওই দুটো বছর সে কোনো খেলাধুলা করেনি, প্রকৃতি দেখেনি, ভালো করে এক দিনও ঘুমায়নি পর্যন্ত। জানালায় দাঁড়িয়ে অন্যদের যখন বাইরে খেলতে দেখেছে, তখন ওর মনে হতো ওর চেয়ে বড় দুঃখী পৃথিবীতে আর কেউ নেই। ছেলেটির অভিযোগ ছিল, বাবা-মা ওর জীবন থেকে শৈশবের দুটো বছর কেড়ে নিয়েছেন। এ দেশের হতভাগ্য শিশুদের চাওয়া-পাওয়াগুলোর সঙ্গে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অর্জনকে সাধারণত জুড়ে দেওয়া হয়। অসুস্থ প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারী বাবা-মায়েরা সন্তানদের বলেন, তোমরা পরীক্ষায় ভালো করতে পারলে সবকিছু পাবে। অনেক সময়ই আমাদের সন্তানরা অভিভাবকদের প্রত্যাশা অনুযায়ী অর্জনে ব্যর্থ হচ্ছে এবং হীনম্মন্যতার শিকার হচ্ছে। এতে করে আত্মমর্যাদা এবং আত্মবিশ্বাস কমে যাচ্ছে আর যত নামজাদা বিদ্যালয়েই সে পড়ুক না কেন, জীবনে সুন্দরভাবে চলার সক্ষমতা ধীরে ধীরে হারিয়ে ফেলছে।
এ দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যে শিক্ষকেরা পড়াচ্ছেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রে তারা শিশু বিকাশের ওপর প্রশিক্ষণ নেন না। তাঁরা অনেকেই নিজেদের মন ও শরীরের প্রতি যথেষ্ট যত্নবান বলে মনে হয় না। প্রাক-বিদ্যালয় এবং প্রাথমিক পর্যায়ে যে শিক্ষকদের অনেক বেশি শিশু মনোবিজ্ঞানের চর্চা প্রয়োজন, সে কথাটি আমরা বিবেচনায় রেখেছি বলে মনে হয় না। ফলে শিশুরা শিক্ষাজীবনের শুরুতেই লেখাপড়াকে বোঝা হিসেবে দেখে বলে একটি নিরানন্দ শৈশবের ভেতর দিয়ে যেতে যেতে খুব তাড়াতাড়ি প্রাণচাঞ্চল্য হারিয়ে ফেলে। এ দেশের শহরবাসী শিশুরা আর রূপকথার স্বপ্নীল রাজ্যে বিচরণ করে না। তারা যন্ত্রের সামনে বসে নিরন্তর কম্পিউটার গেম খেলছে। ইন্টারনেটে ঢুকে নানা ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত বিষয়ের সঙ্গে পরিচিত হচ্ছে। স্যাটেলাইটের মাধ্যমেও টেলিভিশনে শিশুদের জন্য অনুপযোগী এমন অনেক কিছু দেখছে। দেশের বাংলা প্রাইভেট চ্যানেলগুলোতেও শুধু ছোট শিশুদের কথা ভেবে তৈরি করা শিক্ষামূলক ও বিনোদনমূলক কোনো অনুষ্ঠান হয় না। সত্যি কথা বলতে কি টেলিভিশনে শুধু বড়দের মনোরঞ্জনের জন্য প্রোগ্রাম তৈরি করা হচ্ছে। নাটকগুলোর বিষয়বস্তু এবং ভাষা কোনোটিই শিশু-উপযোগী নয় অথচ শিশুরা আর কিছু না পেয়ে সেগুলোই দেখছে বড়দের সঙ্গে বসে। আর শিশুসুলভ সরল মনটা হারিয়ে ফেলছে।
মনে হচ্ছে গোটা সমাজটাই এখন শুধু ব্যবসায়িক সাফল্যের কথা ভাবছে। এ সমাজের বাসিন্দা হিসেবে সামাজিক দায়বদ্ধতার কথা আমরা প্রায় বিস্মৃত হয়েছি। আমরা দেখতে পাচ্ছি শহর এলাকার ভূমিদস্যুরা শিশুদের জন্য উন্মুক্ত জায়গার প্রয়োজনীয়তার কথা সম্পূর্ণ ভুলে গিয়ে প্রতিটি ইঞ্চি জায়গার ওপর ইট বসিয়ে দিচ্ছেন। এ দেশের সরকার এবং জনতাও নীরবে দৃশ্যগুলো প্রত্যক্ষণ করছে। কক্সবাজার এবং কুয়াকাটার সমুদ্রসৈকতও ভূমিদস্যুদের হাত থেকে রক্ষা পায়নি। আমরা কেউ প্রতিবাদ করছি না যখন টেলিভিশনে বিজ্ঞাপন দেখানো হচ্ছে একটি ছোট শিশু কেঁদে কেঁদে বলছে, ‘কক্সবাজারে কি আমাদের একটি ফ্ল্যাট হবে না?’ কোন ধরনের উদাহরণ আমরা তুলে ধরছি শিশুদের সামনে? এ ধরনের বিজ্ঞাপনের যে ক্ষতিকর প্রভাব শিশুদের মনে পড়তে পারে তা নিয়ে কি কেউ ভাবছি? একটি ছোট্ট শিশু বড়দের মতো ফ্ল্যাটের স্বপ্ন দেখে, তা-ও আবার সমুদ্রসৈকতে। শিশুদের কি আমরা কিছু বড় মানুষদের মতো লোভী আর স্বার্থপর করে তুলতে চাইছি? বাংলাদেশে যেটুকু উন্মুক্ত জায়গা ছিল, সেটিও আর আগামী প্রজন্মের জন্য থাকবে বলে মনে হচ্ছে না। কিছুদিন পরে যদি দেখি সুন্দরবনের বাঘ, হরিণ ও অন্য প্রাণীদের মেরে সেখানেও ব্যবসার উদ্দেশ্যে ইটের ইমারত তৈরি হচ্ছে, তাহলে বোধহয় অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
সুলেখক ও কথাসাহিত্যিক শাহাদুজ্জামান গত ২৩ এপ্রিল প্রথম আলোয় লিখেছেন, মানুষের সারা জীবনকে যদি এক পাল্লায় এবং শৈশবকে আরেক পাল্লায় রাখা হয়, তাহলে শৈশবের পাল্লাই ভারী হয় এবং একটি মিষ্টি স্বপ্নের মতো শৈশব চলে আমাদের সঙ্গে সঙ্গে। আমাদের শিশুদের মনে কি ভবিষ্যতে সে রকম কোনো মিষ্টি স্বপ্ন থাকবে, যা প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পরও তাদের বারবার সেখানে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে? মনে তো হয় না।
মেহতাব খানম: অধ্যাপক, মনোবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.