সহজিয়া কড়চা-দিস টাইম ফর বাংলা—হতে পারল না by সৈয়দ আবুল মকসুদ
দক্ষিণ আফ্রিকার বিভিন্ন স্টেডিয়ামে বিশ্বকাপ ফুটবল খেলা চলছে। প্রথম দিন থেকেই সবার মতো আমিও খেলা দেখছি। না দেখে পারা যায় না বলে দেখছি। যতবার দেখছি ততবার যেমন আনন্দ পাচ্ছি, তেমনি কষ্টও হচ্ছে। অন্যের বাড়িতে অচেনা মানুষদের আনন্দফুর্তি দেখে আনন্দ পাওয়া যায়, তাতে সুখ পাওয়া যায় না।
নিজের দেশের জন্য বুকের ভেতরে লতিয়ে ওঠে একটা সূক্ষ্ম বেদনা। অক্ষমের ব্যথা। জগতের আনন্দযজ্ঞে বাংলাদেশ নেই। এবারের বেদনা একটু বড় পরিসরে। সারাটা বুকেই ছড়িয়ে আছে বেদনা—গলস্টোন কলিক বেদনার মতো। কারণ বাংলাদেশ তো নেই-ই, জোহানেসবার্গের আনন্দযজ্ঞে ভারতও নেই, পাকিস্তান নেই, চীন নেই, নেপাল নেই, শ্রীলঙ্কা নেই।
বিশ্বকাপ খেলার ব্যাপারে একটা প্যাথলজিক্যাল সুখও পেয়েছি। তা হলো খেলাটা হচ্ছে দক্ষিণ আফ্রিকায়। শতাব্দীর পর শতাব্দী ঘৃণ্য বর্ণবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের বীভৎস শিকার দক্ষিণ আফ্রিকা। বিশ শতকের শেষার্ধে যার পরিচয় নেলসন ম্যান্ডেলার দেশ বলে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রথম মেয়াদের সবচেয়ে প্রশংসনীয় কাজ ছিল আফ্রিকার নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা, ফিলিস্তিন মুক্তি-সংগ্রামের নেতা ইয়াসির আরাফাত এবং তুরস্কের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডেমিরেলকে একসঙ্গে আমন্ত্রণ করে বাংলাদেশে আনা। সেই সময় আমার সৌভাগ্য হয়েছিল ম্যান্ডেলার সঙ্গে করমর্দন করার।
তরুণ বয়স থেকেই হো চি মিন, ম্যান্ডেলা ও ইয়াসির আরাফাতের প্রতি আমার সীমাহীন শ্রদ্ধা। হো চি মিন মারা যান আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বছর দুই আগে। তাঁকে শ্রদ্ধা নিবেদন করে তখন আমি লিখেছিলাম। ম্যান্ডেলা ও আরাফাতের সঙ্গে হাত মেলাতে পেরে রোমাঞ্চিত হই।
বিশ্বকাপ ফুটবল প্রতিযোগিতা যদি মাঠে বলে লাথি মারামারির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকত, তা হলে তার আনন্দ হতো এক রকম। তখন মানুষ শুধু পায়ের জোরকেই জিন্দাবাদ দিত। কিন্তু বিশ্বকাপের উৎসবে যোগ হয়েছে অপূর্ব নান্দনিকতা। ভুভুজেলার অত্যাচার সত্ত্বেও উৎসবের প্রতিটি ক্ষেত্রেই প্রকাশ ঘটেছে নান্দনিকতার। যে লাস্যময়ী তরুণী খেলা বিশ্লেষণের অ্যাঙ্কর, তিনি শিল্পা শেঠী বা প্রিয়াঙ্কা চোপড়ার চেয়ে কম কী? কী স্মার্ট! একেবারে মেদহীন—স্লিম। স্নিগ্ধ হাসি। কণ্ঠস্বরে মাধুর্য। কী তাঁর ইংরেজি! বিশুদ্ধ ও অনর্গল। যেন ফুলের পাপড়ি দিয়ে তৈরি একটি রেলগাড়ি ছুটছে দুর্বার গতিতে। আমরা কি ৩৯ বছরে এমন একটি মেয়ে তৈরি করতে পেরেছি? সমাজ ও রাষ্ট্রকেই তৈরি করতে হয়—মানুষ আপনাআপনি তৈরি হয় না, পর্যাপ্ত মেধা নিয়ে জন্ম গ্রহণ করা সত্ত্বেও।
বিশ্বকাপের উদ্বোধনীতে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানেও ছিল চমৎকারিত্ব। এবার বিশ্বকাপ ফুটবলের অফিশিয়াল থিম সংগীত গেয়েছেন—কণ্ঠ দিয়ে শুধু নয়, সারা শরীর দিয়ে—কলাম্বিয়ান পপতারকা শাকিরা। তাঁর গানটি: ‘সামিনা মিনা...ওয়াকা ওয়াকা...দিস টাইম ফর আফ্রিকা’। এখন আফ্রিকারই পালা। জেগে ওঠা আফ্রিকার অন্তরের কথাটিই উচ্চারিত হয়েছে শাকিরার কণ্ঠে, মূর্ত হয়েছে শাকিরার দেহে। আফ্রিকান-কানাডিয়ান সংগীতশিল্পী কেনানের ‘ওয়েভিন ফ্লাগ’ শীর্ষক গানটির বাণীও খুবই উদ্দীপক।
বছর তিনেক আগে শাকিরা নয়াদিল্লি এসেছিলেন এক কনসার্টে। আমি তখন সেখানে ছিলাম। সবচেয়ে কম দামের টিকিট ছিল সম্ভবত ৪৩০ রুপি। অত টাকায় নিম্ন-মধ্যবিত্ত ঘরের ছাত্র-যুবকেরা টিকিট কিনতে পারেনি। তাই নিয়ে মহা-অসন্তোষ। হাড়হীন শাকিরাকে দেখতে স্টেডিয়ামের পাঁচিল বেয়ে উঠতে গিয়ে হাড় ভাঙে কারও কারও। সাংবাদিকেরা বিক্ষুব্ধ তরুণদের জিজ্ঞেস করেন, কেন এই হাঙ্গামা। এক তরুণ বলে: কী বলেন, মশাই? এক মিনিটে যার কোমর ও নিতম্ব দোলে ৪৩০ বার—আমরা দেখব না তাকে? [হিন্দুস্থান টাইমস]
তৃতীয় বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী ঔপন্যাসিক গেব্রিয়েল গারসিয়া মার্কেজ। কলাম্বিয়ার এই কথাশিল্পীর বয়স এখন ৮২। ক্যানসারে বহু দিন ধরে ভুগছেন। কিন্তু দেওয়ানা শাকিরার জন্য। যেমন, মাধুরীর জন্য ৮৫ বছর বয়সেও পাগল হয়েছিলেন মকবুল ফিদা হুসেন। আমার কবি খ্যাতি যেটুকু ছিল তা এখন বিলুপ্তির পথে। হুসেন ও মার্কেজের মতো বুড়োদের সুন্দরীদের রূপে মজতে দেখে আমি তখন একটি কবিতা লিখেছিলাম। তার কয়েকটি পঙিক্ত এ রকম:
মাধুরীর মধুময় হাসি
বাড়ায় আয়ু হুসেনের
তিরিশ বছর।
মাধুরী চায় কম বয়েসী সখা
—নওল যুবক।
হুসেন নাছোড়।
অসুস্থ মার্কেজ হতে চান
শাকিরার একজন ঘোড়া;
শাকিরার নাচ দেখে—ভাঁজ দেখে
নিজেকে ভাবেন
যেন ছাব্বিশ বছরের এক ছোড়া।
[মার্কেজ ও শাকিরা]
শাকিরা মাতিয়েছেন পুরুষদের আর খেলোয়াড়েরা মাতিয়েছেন নারী-পুরুষ, শিশু-কিশোর-নির্বিশেষে পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষকে। শুধু মাতাচ্ছেন না, মানুষ মারছেনও। অন্তত বাংলাদেশে। আর্জেন্টিনার পতাকা ওড়াতে গিয়ে ছাদ থেকে পড়ে মারা গেছে কেউ। বাবা-মা পতাকা কেনার টাকা দেয়নি বলে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে কেউ। সারা বাংলাদেশ ভরে গেছে আর্জেন্টিনা আর ব্রাজিলের পতাকায়। দু-তিন শ মিটার দীর্ঘ পতাকাও তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশে ম্যারাডোনা-মেসি এবং কাকা-দানি আলভেজের নামে জয়ধ্বনি ও জিন্দাবাদ দেওয়ার কথা দর্জির দোকানের মালিকদের।
এতক্ষণ আনন্দের কথা বললাম। শুরুতে সূক্ষ্ম ব্যথার কথা বলেছি। ব্যথার কারণটি ব্যাখ্যা করি। এবার বিশ্বকাপে যে ৩২টি দেশ খেলার সুযোগ পেয়েছে, তার মধ্যে অন্তত ১৬টি দেশের মানুষ ফুটবল যখন পা দিয়ে লাথি মারা তো দূরের কথা, হাত দিয়ে ছুঁয়েও দেখেনি, তখন বাঙালি ফুটবল খেলার চর্চা করত। গোটা দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলার ফুটবলারদের খ্যাতি ছিল। বাঙালির ভাগ্য-বিপর্যয় না ঘটলে কাকা-মামা-চাচা শুধু নয়, পেলে-ম্যারাডোনা বাঙালিদের ভেতর থেকেই বেরিয়ে আসত।
শৈশব-কৈশোরে রোগাটে ছিলাম বলে লুডু ছাড়া আর কোনো খেলা খেলিনি। অল্প সময়ের জন্য ফুটবল মাঠে নেমেছিলাম, কোনো প্রবালের পদাঘাত খেয়ে খেলার নেশা ছুটে যায়। তারপর থেকে ফুটবলের দর্শকের ভূমিকা পালন করছি। বাংলাদেশে দর্শক হওয়াও নিরাপদ নয়। মাঠের খেলোয়াড়দের তো ইনজুরি হতেই পারে, কিন্তু বাংলাদেশে গ্যালারির দর্শকদের ইনজুরি হওয়ার আশঙ্কাই বেশি। ঢাকা স্টেডিয়াম থেকে অনেকের সঙ্গে দৌড়ে আত্মরক্ষা করতে গিয়ে অন্তত দুবার পায়ে চোট পেয়েছিলাম।
হাঁটুতে চোট পেলে তা কয়েক দিন পরে ভালো হয়, অন্তরে চোট পেলে তার ব্যথা সহজে সারে না। এক শ বছর ধরে বাঙালি ফুটবলে খুব ভালো করছিল। পাঞ্জাবি ও পাঠানদের হাত-পায়ের গোছাগাছা ইয়া মোটা হওয়া সত্ত্বেও পাকিস্তানি আমলে বাঙালিরা ফুটবলে তাদের সমকক্ষই ছিল। স্বাধীনতার পরে আরও ভালো করবে বলে প্রত্যাশা ছিল। স্বাধীনতার পর আমাদের জাতীয় টিম খেলতে গেল ব্যাংকক ও কুয়ালালামপুর। তেজগাঁও বিমানবন্দরে আমরা তাদের উঠিয়ে দিলাম প্লেনে। বিমানের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে খেলোয়াড়েরা আমাদের দুই হাতে ভি-চিহ্ন দেখালেন। খেলে এবং বিশেষভাবে ব্যাংককে বিপুল বাজার করে যেদিন আমাদের টিম ফিরে এল, সেদিন আমরা তাদের স্বাগত জানাতে তেজগাঁও যাইনি। গেলে ভালো হতো। স্যুটকেস টানাটানিতে সাহায্য করতে পারতাম। আমাদের খেলোয়াড়দের প্রত্যাবর্তনের দিন বিমানবন্দরে শোকের ছায়া: নয়টি কি ১১টি গোলের ভার বহন করার ক্ষমতা সেদিন নতুন স্বাধীন জাতির ছিল না।
আমি না খেললেও আমার বাবা ভালো ফুটবল খেলতেন। হাফ-ব্যাক ও ইনার ফরোয়ার্ডে ভালোই খেলতেন। আমাদের ভাইদেরও কেউ কেউ ভালো খেলতেন। সুতরাং পরিবারে ফুটবল ছিল একটি আলোচ্য বিষয়। অতি শৈশবে উচ্চারিত হতে শুনেছি কয়েকটি নাম: হাফেজ রশিদ, কাল্লু খাঁ, আব্বাস মির্জা, জুম্মা খান, আহমদ ওসমান, চুনী গোস্বামী, খোন্দকার নাসিম প্রমুখ। ‘খেলার মাঠের জাদুকর সামাদ’কে নিয়ে আমার বাবা একটি লম্বা পদ্যই লিখেছিলেন।
এই উপমহাদেশে ব্যক্তিগত প্রেম-পিরিতের মধ্যেও যখন রাজনীতি ঢুকে যায়, বিশেষ করে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি, তখন খেলাধুলাও রাজনীতির ঊর্ধ্বে থাকবে, তা আশা করা যায় না। হিন্দু-মুসলমানে দেশ ভাগাভাগির আগেই উপমহাদেশের ফুটবল ভাগ হয়ে গিয়েছিল। বর্ণ হিন্দুদের যদি মোহন বাগান হয়ে থাকে, মুসলমানদের মোহামেডান। দুটি টিমই একসময় সারা ভারতকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল।
আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিলের মানুষ এবং তাদের বঙ্গীয় সমর্থকেরা জানে না যে বাংলায় তথা ভারতে প্রথম ফুটবল প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয় মহাবিদ্রোহের তিন বছর আগে, ১৮৫৪-তে। খেলাটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল কলকাতা এসপ্লানেডের ময়দানে। যে দুটি দল সেদিন খেলেছিল তারা হলো—ক্যালকাটা ক্লাব অব সিভিলিয়ানস, ইংরেজদের এবং জেন্টলম্যান অব বারাকপুর—নেটিভদের বা অধীনস্থ ভারতবাসীদের।
মহাবিদ্রোহের পরে দেশ যখন ইংরেজদের পরিপূর্ণ পদানত হয়, তখন সবকিছু গোছগাছ করার সঙ্গে সঙ্গে খেলাধুলার ব্যাপারেও উপনিবেশবাদীরা জোর দেয়। ১৮৭২-এ গঠিত হয় ক্যালকাটা ফুটবল ক্লাব। তারপর একে একে আত্মপ্রকাশ করেছে বহু ক্লাব—ডালহৌসি (১৮৮৪), আর্মেনিয়ান (১৮৮০), অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান, প্রেসিডেন্সি কলেজ ফুটবল ক্লাব, স্কটিশ চার্চ ফুটবল টিম, এরিয়ানস ক্লাব, ওয়েলিংটন, শোভাবাজার, ন্যাশনাল প্রভৃতি। ১৮৮১-তে আত্মপ্রকাশ করে মোহনবাগান। তখন ছোঁয়াছুঁয়ির দিন ছিল। উঁচু বর্ণের হিন্দুদের সঙ্গে শরীর ঘষাঘষি করা সম্ভব ছিল না নিম্ন বর্ণের হিন্দু ও গো-মাংস খাওয়া মুসলমানদের। ১৮৮৭-তে কিছু মুসলমান তরুণদের নিয়ে নবাবজাদা আমিনুল ইসলাম গঠন করেন কলকাতায় ‘জুবেলী ক্লাব’। সেটাই চার বছর পরে নবাব আমির আলী খানের নেতৃত্বে রূপান্তরিত হয় ‘মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব’-এ। প্রথম পর্যায়ে মোহামেডান স্পোর্টিং-এর গঠনে যাঁরা ভূমিকা পালন করেন তাঁদের মধ্যে স্মরণীয় সোহরাওয়ার্দী পরিবারের সদস্যরা, বিশেষ করে স্যার জাহেদ সোহরাওয়াদী, প্রথম মুসলমান গ্র্যাজুয়েট দেলোয়ার হোসেন আহমদ, বিচারপতি সৈয়দ আমির আলী, ঢাকার নবাব, মহামান্য আগা খান, নবাব সুজাত আলী বেগ, নবাব আবদুর রহমান, কোচবিহারের মহারাজা, ভূপালের নবাব, মুর্শিদাবাদের নবাব প্রমুখ। পূর্ব বাংলার লোকদের পশ্চিমবঙ্গের মানুষ তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করত। সুতরাং তাদেরও একটি নিজস্ব টিম দরকার। আত্মপ্রকাশ করল ইস্ট বেঙ্গল। খুবই শক্ত টিম।
তিরিশের দশক নাগাদ আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিলের মতো মোহনবাগান ও মোহামেডান গোটা দক্ষিণ এশিয়ায় দুর্বার শক্তি অর্জন করে। নজরুল ইসলাম মোহনবাগান ও মোহামেডান দুই দলের কাছেই ছিলেন প্রিয়। তিনি লিখলেন:
যে চরণ দিয়ে ফুটবল নিয়ে
জাগাইলে বিস্ময়,
সেই চরণের শক্তি জাগুক
আবার ভারতময়।
এখন আর আমাদের যুবকদের চরণের শক্তিতে বিস্ময় জাগে না। দোষটা তাদের নয়। তাদের আমরা তৈরি করতে পারিনি। এ আমাদের রাষ্ট্র ও রাজনীতির ব্যর্থতা। পাঁচটি আন্তর্জাতিক মানের টিম গঠনের মতো তরুণ আমাদের আছে। তাদের আমরা আনুকূল্য দিই না। তাদের পায়ের পেশি মজবুত করার ব্যবস্থা আমরা করিনি, তাদের পায়ের রগ কাটায় উৎসাহ দিয়েছি।
বিশ্বকাপের মতো আন্তর্জাতিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার একটি দিক হলো আনন্দের, আর একটি স্থানীয় উন্নয়নের দিক। স্বাগতিক দেশের যোগ্যতার ওপর নির্ভর করে উৎসবের সাফল্য-অসাফল্য। মাঠের খেলা শুধু নয়, আমি লক্ষ করেছি ব্যবস্থাপনা। দেখেছি স্টেডিয়ামগুলো, মাঠের অবস্থা। গ্যালারিতে বসার ব্যবস্থা। আমাদের কি জোহানেসবার্গ বা ডারবান স্টেডিয়ামের মতো স্টেডিয়াম আছে? আমাদের যা আছে তার অবস্থা শোচনীয়। আমাদের জাতীয় স্টেডিয়ামের ভেতরটার চেয়ে তার বাইরের বারান্দার দোকানগুলোই আসল। খেলাধুলার চেয়ে ইলেকট্রনিকের জিনিসপত্র—তা নকল হোক বা আসল হোক—ওসব কেনাকাটায় আমাদের বেশি উৎসাহ।
এই গ্রীষ্মকালেই আগে বাংলাদেশের গ্রামে-শহরে ফুটবল খেলা হতো। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মাঠে হতো। এখনো কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিদিন খেলা হচ্ছে। আগে খেলা হতো বল দিয়ে, এখন খেলা হচ্ছে রামদা ও চাপাতি দিয়ে। আগে খেলতে গিয়ে হাত-পা ভাঙত। এখনকার খেলায় প্রতিপক্ষ হাত বা একটি পা কেটে নিয়ে যাচ্ছে। আগে হতো ফুটবল প্রতিযোগিতা, এখন হয় টেন্ডার প্রতিযোগিতা।
ছাত্র ও তরুণদের দোষ দেব কেন? রাষ্ট্রের টাকায় চলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। তার উপাচার্য ও শিক্ষকেরা যদি কোনো মেয়র প্রার্থীর প্রধান এজেন্ট হন এবং মাস দুই সবকিছু ফেলে দিয়ে বৃষ্টির মধ্যে গলিতে গলিতে ভোটভিক্ষা করেন এবং স্বাধীনতার চেতনা বিতরণ করেন, তাহলে বিশ্বকাপের স্বাগতিক দেশ হবে কীভাবে? একাত্তরে তো সেই স্বপ্নই ছিল।
বিশ্বের বড় কোনো ঘটনা আমাদের চেতনায় কোনো ধাক্কা দেয় না। আমাদের ভেতরটায় পরিবর্তন আসে না। পরিবর্তন আসে বাইরে। বিশ্বকাপের পরে আমাদের একদল যুবক মাথা ন্যাড়া করবে। কেউ রাখবে থুতনিতে একচিলতে দাড়ি। কারও চুল নামবে ঘাড়ে। কেউ বাঁধবে ঝুঁটি। অন্যের যোগ্যতা দেখে আমরা যোগ্যতা অর্জনের সাধনা করি না—ভাঁড় হওয়ার চেষ্টা করি।
দোষটা তরুণদের নয়। কোনো জাতির অর্থনীতি হোক বা সংস্কৃতি হোক—সবকিছু উন্নতির মূলে নেতৃত্ব। দক্ষিণ আফ্রিকায় আজ বিশ্বকাপ হতে পারে ম্যান্ডেলার জন্য। বর্ণবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে তিনি লড়াই করেছেন জাতির মুক্তির জন্য—ক্ষমতা কুক্ষিগত করে আজীবন শাসক থাকার জন্য নয়। ক্ষমতা পেয়েও তাই তা ছুড়ে ফেলে দেন। সে জন্যই তাঁর মেয়ের নাতি মারা গেলে বিশ্ববাসী শোক করে। আমাদের নেতা মারা গেলেও করে না। সেখানেই ম্যান্ডেলার সঙ্গে আমাদের নেতাদের তফাত। আমাদের নেতার চেয়ে তাঁর নাতির দাম বেশি। নেতৃত্বের কারণেই আমাদের ‘ওয়াকা ওয়াকা—দিস টাইম ফর বাংলাদেশ’ হতে গিয়েও হলো না।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
বিশ্বকাপ খেলার ব্যাপারে একটা প্যাথলজিক্যাল সুখও পেয়েছি। তা হলো খেলাটা হচ্ছে দক্ষিণ আফ্রিকায়। শতাব্দীর পর শতাব্দী ঘৃণ্য বর্ণবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের বীভৎস শিকার দক্ষিণ আফ্রিকা। বিশ শতকের শেষার্ধে যার পরিচয় নেলসন ম্যান্ডেলার দেশ বলে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রথম মেয়াদের সবচেয়ে প্রশংসনীয় কাজ ছিল আফ্রিকার নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা, ফিলিস্তিন মুক্তি-সংগ্রামের নেতা ইয়াসির আরাফাত এবং তুরস্কের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডেমিরেলকে একসঙ্গে আমন্ত্রণ করে বাংলাদেশে আনা। সেই সময় আমার সৌভাগ্য হয়েছিল ম্যান্ডেলার সঙ্গে করমর্দন করার।
তরুণ বয়স থেকেই হো চি মিন, ম্যান্ডেলা ও ইয়াসির আরাফাতের প্রতি আমার সীমাহীন শ্রদ্ধা। হো চি মিন মারা যান আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বছর দুই আগে। তাঁকে শ্রদ্ধা নিবেদন করে তখন আমি লিখেছিলাম। ম্যান্ডেলা ও আরাফাতের সঙ্গে হাত মেলাতে পেরে রোমাঞ্চিত হই।
বিশ্বকাপ ফুটবল প্রতিযোগিতা যদি মাঠে বলে লাথি মারামারির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকত, তা হলে তার আনন্দ হতো এক রকম। তখন মানুষ শুধু পায়ের জোরকেই জিন্দাবাদ দিত। কিন্তু বিশ্বকাপের উৎসবে যোগ হয়েছে অপূর্ব নান্দনিকতা। ভুভুজেলার অত্যাচার সত্ত্বেও উৎসবের প্রতিটি ক্ষেত্রেই প্রকাশ ঘটেছে নান্দনিকতার। যে লাস্যময়ী তরুণী খেলা বিশ্লেষণের অ্যাঙ্কর, তিনি শিল্পা শেঠী বা প্রিয়াঙ্কা চোপড়ার চেয়ে কম কী? কী স্মার্ট! একেবারে মেদহীন—স্লিম। স্নিগ্ধ হাসি। কণ্ঠস্বরে মাধুর্য। কী তাঁর ইংরেজি! বিশুদ্ধ ও অনর্গল। যেন ফুলের পাপড়ি দিয়ে তৈরি একটি রেলগাড়ি ছুটছে দুর্বার গতিতে। আমরা কি ৩৯ বছরে এমন একটি মেয়ে তৈরি করতে পেরেছি? সমাজ ও রাষ্ট্রকেই তৈরি করতে হয়—মানুষ আপনাআপনি তৈরি হয় না, পর্যাপ্ত মেধা নিয়ে জন্ম গ্রহণ করা সত্ত্বেও।
বিশ্বকাপের উদ্বোধনীতে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানেও ছিল চমৎকারিত্ব। এবার বিশ্বকাপ ফুটবলের অফিশিয়াল থিম সংগীত গেয়েছেন—কণ্ঠ দিয়ে শুধু নয়, সারা শরীর দিয়ে—কলাম্বিয়ান পপতারকা শাকিরা। তাঁর গানটি: ‘সামিনা মিনা...ওয়াকা ওয়াকা...দিস টাইম ফর আফ্রিকা’। এখন আফ্রিকারই পালা। জেগে ওঠা আফ্রিকার অন্তরের কথাটিই উচ্চারিত হয়েছে শাকিরার কণ্ঠে, মূর্ত হয়েছে শাকিরার দেহে। আফ্রিকান-কানাডিয়ান সংগীতশিল্পী কেনানের ‘ওয়েভিন ফ্লাগ’ শীর্ষক গানটির বাণীও খুবই উদ্দীপক।
বছর তিনেক আগে শাকিরা নয়াদিল্লি এসেছিলেন এক কনসার্টে। আমি তখন সেখানে ছিলাম। সবচেয়ে কম দামের টিকিট ছিল সম্ভবত ৪৩০ রুপি। অত টাকায় নিম্ন-মধ্যবিত্ত ঘরের ছাত্র-যুবকেরা টিকিট কিনতে পারেনি। তাই নিয়ে মহা-অসন্তোষ। হাড়হীন শাকিরাকে দেখতে স্টেডিয়ামের পাঁচিল বেয়ে উঠতে গিয়ে হাড় ভাঙে কারও কারও। সাংবাদিকেরা বিক্ষুব্ধ তরুণদের জিজ্ঞেস করেন, কেন এই হাঙ্গামা। এক তরুণ বলে: কী বলেন, মশাই? এক মিনিটে যার কোমর ও নিতম্ব দোলে ৪৩০ বার—আমরা দেখব না তাকে? [হিন্দুস্থান টাইমস]
তৃতীয় বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী ঔপন্যাসিক গেব্রিয়েল গারসিয়া মার্কেজ। কলাম্বিয়ার এই কথাশিল্পীর বয়স এখন ৮২। ক্যানসারে বহু দিন ধরে ভুগছেন। কিন্তু দেওয়ানা শাকিরার জন্য। যেমন, মাধুরীর জন্য ৮৫ বছর বয়সেও পাগল হয়েছিলেন মকবুল ফিদা হুসেন। আমার কবি খ্যাতি যেটুকু ছিল তা এখন বিলুপ্তির পথে। হুসেন ও মার্কেজের মতো বুড়োদের সুন্দরীদের রূপে মজতে দেখে আমি তখন একটি কবিতা লিখেছিলাম। তার কয়েকটি পঙিক্ত এ রকম:
মাধুরীর মধুময় হাসি
বাড়ায় আয়ু হুসেনের
তিরিশ বছর।
মাধুরী চায় কম বয়েসী সখা
—নওল যুবক।
হুসেন নাছোড়।
অসুস্থ মার্কেজ হতে চান
শাকিরার একজন ঘোড়া;
শাকিরার নাচ দেখে—ভাঁজ দেখে
নিজেকে ভাবেন
যেন ছাব্বিশ বছরের এক ছোড়া।
[মার্কেজ ও শাকিরা]
শাকিরা মাতিয়েছেন পুরুষদের আর খেলোয়াড়েরা মাতিয়েছেন নারী-পুরুষ, শিশু-কিশোর-নির্বিশেষে পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষকে। শুধু মাতাচ্ছেন না, মানুষ মারছেনও। অন্তত বাংলাদেশে। আর্জেন্টিনার পতাকা ওড়াতে গিয়ে ছাদ থেকে পড়ে মারা গেছে কেউ। বাবা-মা পতাকা কেনার টাকা দেয়নি বলে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে কেউ। সারা বাংলাদেশ ভরে গেছে আর্জেন্টিনা আর ব্রাজিলের পতাকায়। দু-তিন শ মিটার দীর্ঘ পতাকাও তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশে ম্যারাডোনা-মেসি এবং কাকা-দানি আলভেজের নামে জয়ধ্বনি ও জিন্দাবাদ দেওয়ার কথা দর্জির দোকানের মালিকদের।
এতক্ষণ আনন্দের কথা বললাম। শুরুতে সূক্ষ্ম ব্যথার কথা বলেছি। ব্যথার কারণটি ব্যাখ্যা করি। এবার বিশ্বকাপে যে ৩২টি দেশ খেলার সুযোগ পেয়েছে, তার মধ্যে অন্তত ১৬টি দেশের মানুষ ফুটবল যখন পা দিয়ে লাথি মারা তো দূরের কথা, হাত দিয়ে ছুঁয়েও দেখেনি, তখন বাঙালি ফুটবল খেলার চর্চা করত। গোটা দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলার ফুটবলারদের খ্যাতি ছিল। বাঙালির ভাগ্য-বিপর্যয় না ঘটলে কাকা-মামা-চাচা শুধু নয়, পেলে-ম্যারাডোনা বাঙালিদের ভেতর থেকেই বেরিয়ে আসত।
শৈশব-কৈশোরে রোগাটে ছিলাম বলে লুডু ছাড়া আর কোনো খেলা খেলিনি। অল্প সময়ের জন্য ফুটবল মাঠে নেমেছিলাম, কোনো প্রবালের পদাঘাত খেয়ে খেলার নেশা ছুটে যায়। তারপর থেকে ফুটবলের দর্শকের ভূমিকা পালন করছি। বাংলাদেশে দর্শক হওয়াও নিরাপদ নয়। মাঠের খেলোয়াড়দের তো ইনজুরি হতেই পারে, কিন্তু বাংলাদেশে গ্যালারির দর্শকদের ইনজুরি হওয়ার আশঙ্কাই বেশি। ঢাকা স্টেডিয়াম থেকে অনেকের সঙ্গে দৌড়ে আত্মরক্ষা করতে গিয়ে অন্তত দুবার পায়ে চোট পেয়েছিলাম।
হাঁটুতে চোট পেলে তা কয়েক দিন পরে ভালো হয়, অন্তরে চোট পেলে তার ব্যথা সহজে সারে না। এক শ বছর ধরে বাঙালি ফুটবলে খুব ভালো করছিল। পাঞ্জাবি ও পাঠানদের হাত-পায়ের গোছাগাছা ইয়া মোটা হওয়া সত্ত্বেও পাকিস্তানি আমলে বাঙালিরা ফুটবলে তাদের সমকক্ষই ছিল। স্বাধীনতার পরে আরও ভালো করবে বলে প্রত্যাশা ছিল। স্বাধীনতার পর আমাদের জাতীয় টিম খেলতে গেল ব্যাংকক ও কুয়ালালামপুর। তেজগাঁও বিমানবন্দরে আমরা তাদের উঠিয়ে দিলাম প্লেনে। বিমানের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে খেলোয়াড়েরা আমাদের দুই হাতে ভি-চিহ্ন দেখালেন। খেলে এবং বিশেষভাবে ব্যাংককে বিপুল বাজার করে যেদিন আমাদের টিম ফিরে এল, সেদিন আমরা তাদের স্বাগত জানাতে তেজগাঁও যাইনি। গেলে ভালো হতো। স্যুটকেস টানাটানিতে সাহায্য করতে পারতাম। আমাদের খেলোয়াড়দের প্রত্যাবর্তনের দিন বিমানবন্দরে শোকের ছায়া: নয়টি কি ১১টি গোলের ভার বহন করার ক্ষমতা সেদিন নতুন স্বাধীন জাতির ছিল না।
আমি না খেললেও আমার বাবা ভালো ফুটবল খেলতেন। হাফ-ব্যাক ও ইনার ফরোয়ার্ডে ভালোই খেলতেন। আমাদের ভাইদেরও কেউ কেউ ভালো খেলতেন। সুতরাং পরিবারে ফুটবল ছিল একটি আলোচ্য বিষয়। অতি শৈশবে উচ্চারিত হতে শুনেছি কয়েকটি নাম: হাফেজ রশিদ, কাল্লু খাঁ, আব্বাস মির্জা, জুম্মা খান, আহমদ ওসমান, চুনী গোস্বামী, খোন্দকার নাসিম প্রমুখ। ‘খেলার মাঠের জাদুকর সামাদ’কে নিয়ে আমার বাবা একটি লম্বা পদ্যই লিখেছিলেন।
এই উপমহাদেশে ব্যক্তিগত প্রেম-পিরিতের মধ্যেও যখন রাজনীতি ঢুকে যায়, বিশেষ করে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি, তখন খেলাধুলাও রাজনীতির ঊর্ধ্বে থাকবে, তা আশা করা যায় না। হিন্দু-মুসলমানে দেশ ভাগাভাগির আগেই উপমহাদেশের ফুটবল ভাগ হয়ে গিয়েছিল। বর্ণ হিন্দুদের যদি মোহন বাগান হয়ে থাকে, মুসলমানদের মোহামেডান। দুটি টিমই একসময় সারা ভারতকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল।
আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিলের মানুষ এবং তাদের বঙ্গীয় সমর্থকেরা জানে না যে বাংলায় তথা ভারতে প্রথম ফুটবল প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয় মহাবিদ্রোহের তিন বছর আগে, ১৮৫৪-তে। খেলাটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল কলকাতা এসপ্লানেডের ময়দানে। যে দুটি দল সেদিন খেলেছিল তারা হলো—ক্যালকাটা ক্লাব অব সিভিলিয়ানস, ইংরেজদের এবং জেন্টলম্যান অব বারাকপুর—নেটিভদের বা অধীনস্থ ভারতবাসীদের।
মহাবিদ্রোহের পরে দেশ যখন ইংরেজদের পরিপূর্ণ পদানত হয়, তখন সবকিছু গোছগাছ করার সঙ্গে সঙ্গে খেলাধুলার ব্যাপারেও উপনিবেশবাদীরা জোর দেয়। ১৮৭২-এ গঠিত হয় ক্যালকাটা ফুটবল ক্লাব। তারপর একে একে আত্মপ্রকাশ করেছে বহু ক্লাব—ডালহৌসি (১৮৮৪), আর্মেনিয়ান (১৮৮০), অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান, প্রেসিডেন্সি কলেজ ফুটবল ক্লাব, স্কটিশ চার্চ ফুটবল টিম, এরিয়ানস ক্লাব, ওয়েলিংটন, শোভাবাজার, ন্যাশনাল প্রভৃতি। ১৮৮১-তে আত্মপ্রকাশ করে মোহনবাগান। তখন ছোঁয়াছুঁয়ির দিন ছিল। উঁচু বর্ণের হিন্দুদের সঙ্গে শরীর ঘষাঘষি করা সম্ভব ছিল না নিম্ন বর্ণের হিন্দু ও গো-মাংস খাওয়া মুসলমানদের। ১৮৮৭-তে কিছু মুসলমান তরুণদের নিয়ে নবাবজাদা আমিনুল ইসলাম গঠন করেন কলকাতায় ‘জুবেলী ক্লাব’। সেটাই চার বছর পরে নবাব আমির আলী খানের নেতৃত্বে রূপান্তরিত হয় ‘মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব’-এ। প্রথম পর্যায়ে মোহামেডান স্পোর্টিং-এর গঠনে যাঁরা ভূমিকা পালন করেন তাঁদের মধ্যে স্মরণীয় সোহরাওয়ার্দী পরিবারের সদস্যরা, বিশেষ করে স্যার জাহেদ সোহরাওয়াদী, প্রথম মুসলমান গ্র্যাজুয়েট দেলোয়ার হোসেন আহমদ, বিচারপতি সৈয়দ আমির আলী, ঢাকার নবাব, মহামান্য আগা খান, নবাব সুজাত আলী বেগ, নবাব আবদুর রহমান, কোচবিহারের মহারাজা, ভূপালের নবাব, মুর্শিদাবাদের নবাব প্রমুখ। পূর্ব বাংলার লোকদের পশ্চিমবঙ্গের মানুষ তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করত। সুতরাং তাদেরও একটি নিজস্ব টিম দরকার। আত্মপ্রকাশ করল ইস্ট বেঙ্গল। খুবই শক্ত টিম।
তিরিশের দশক নাগাদ আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিলের মতো মোহনবাগান ও মোহামেডান গোটা দক্ষিণ এশিয়ায় দুর্বার শক্তি অর্জন করে। নজরুল ইসলাম মোহনবাগান ও মোহামেডান দুই দলের কাছেই ছিলেন প্রিয়। তিনি লিখলেন:
যে চরণ দিয়ে ফুটবল নিয়ে
জাগাইলে বিস্ময়,
সেই চরণের শক্তি জাগুক
আবার ভারতময়।
এখন আর আমাদের যুবকদের চরণের শক্তিতে বিস্ময় জাগে না। দোষটা তাদের নয়। তাদের আমরা তৈরি করতে পারিনি। এ আমাদের রাষ্ট্র ও রাজনীতির ব্যর্থতা। পাঁচটি আন্তর্জাতিক মানের টিম গঠনের মতো তরুণ আমাদের আছে। তাদের আমরা আনুকূল্য দিই না। তাদের পায়ের পেশি মজবুত করার ব্যবস্থা আমরা করিনি, তাদের পায়ের রগ কাটায় উৎসাহ দিয়েছি।
বিশ্বকাপের মতো আন্তর্জাতিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার একটি দিক হলো আনন্দের, আর একটি স্থানীয় উন্নয়নের দিক। স্বাগতিক দেশের যোগ্যতার ওপর নির্ভর করে উৎসবের সাফল্য-অসাফল্য। মাঠের খেলা শুধু নয়, আমি লক্ষ করেছি ব্যবস্থাপনা। দেখেছি স্টেডিয়ামগুলো, মাঠের অবস্থা। গ্যালারিতে বসার ব্যবস্থা। আমাদের কি জোহানেসবার্গ বা ডারবান স্টেডিয়ামের মতো স্টেডিয়াম আছে? আমাদের যা আছে তার অবস্থা শোচনীয়। আমাদের জাতীয় স্টেডিয়ামের ভেতরটার চেয়ে তার বাইরের বারান্দার দোকানগুলোই আসল। খেলাধুলার চেয়ে ইলেকট্রনিকের জিনিসপত্র—তা নকল হোক বা আসল হোক—ওসব কেনাকাটায় আমাদের বেশি উৎসাহ।
এই গ্রীষ্মকালেই আগে বাংলাদেশের গ্রামে-শহরে ফুটবল খেলা হতো। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মাঠে হতো। এখনো কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিদিন খেলা হচ্ছে। আগে খেলা হতো বল দিয়ে, এখন খেলা হচ্ছে রামদা ও চাপাতি দিয়ে। আগে খেলতে গিয়ে হাত-পা ভাঙত। এখনকার খেলায় প্রতিপক্ষ হাত বা একটি পা কেটে নিয়ে যাচ্ছে। আগে হতো ফুটবল প্রতিযোগিতা, এখন হয় টেন্ডার প্রতিযোগিতা।
ছাত্র ও তরুণদের দোষ দেব কেন? রাষ্ট্রের টাকায় চলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। তার উপাচার্য ও শিক্ষকেরা যদি কোনো মেয়র প্রার্থীর প্রধান এজেন্ট হন এবং মাস দুই সবকিছু ফেলে দিয়ে বৃষ্টির মধ্যে গলিতে গলিতে ভোটভিক্ষা করেন এবং স্বাধীনতার চেতনা বিতরণ করেন, তাহলে বিশ্বকাপের স্বাগতিক দেশ হবে কীভাবে? একাত্তরে তো সেই স্বপ্নই ছিল।
বিশ্বের বড় কোনো ঘটনা আমাদের চেতনায় কোনো ধাক্কা দেয় না। আমাদের ভেতরটায় পরিবর্তন আসে না। পরিবর্তন আসে বাইরে। বিশ্বকাপের পরে আমাদের একদল যুবক মাথা ন্যাড়া করবে। কেউ রাখবে থুতনিতে একচিলতে দাড়ি। কারও চুল নামবে ঘাড়ে। কেউ বাঁধবে ঝুঁটি। অন্যের যোগ্যতা দেখে আমরা যোগ্যতা অর্জনের সাধনা করি না—ভাঁড় হওয়ার চেষ্টা করি।
দোষটা তরুণদের নয়। কোনো জাতির অর্থনীতি হোক বা সংস্কৃতি হোক—সবকিছু উন্নতির মূলে নেতৃত্ব। দক্ষিণ আফ্রিকায় আজ বিশ্বকাপ হতে পারে ম্যান্ডেলার জন্য। বর্ণবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে তিনি লড়াই করেছেন জাতির মুক্তির জন্য—ক্ষমতা কুক্ষিগত করে আজীবন শাসক থাকার জন্য নয়। ক্ষমতা পেয়েও তাই তা ছুড়ে ফেলে দেন। সে জন্যই তাঁর মেয়ের নাতি মারা গেলে বিশ্ববাসী শোক করে। আমাদের নেতা মারা গেলেও করে না। সেখানেই ম্যান্ডেলার সঙ্গে আমাদের নেতাদের তফাত। আমাদের নেতার চেয়ে তাঁর নাতির দাম বেশি। নেতৃত্বের কারণেই আমাদের ‘ওয়াকা ওয়াকা—দিস টাইম ফর বাংলাদেশ’ হতে গিয়েও হলো না।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
No comments