সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ-নেতিবাচক রাজনীতি আমাদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছে? by আবু সাঈদ খান

রাজনীতিকে ইতিবাচক ধারায় ফিরিয়ে আনতে হলে দরকার রাজনৈতিক নেতৃত্বের জনকল্যাণমুখী দৃষ্টিভঙ্গি। নেতৃত্বকে দলের চেয়ে জাতীয় স্বার্থ, সুবিধাপ্রাপ্তদের চেয়ে সুবিধাবঞ্চিতদের অধিকারের প্রতি নজর দিতে হবে। মনে রাখতে হবে, দেশের আইন প্রণয়ন, উন্নয়ন, জনকল্যাণ, সবকিছুরই মূলে রাজনীতি। রাজনীতি যদি ইতিবাচক না হয়, তবে দেশের অগ্রযাত্রা আশা করা যায় না।


তাই দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের স্বার্থেই রাজনীতিতে পরিবর্তন আনতে হবে


বাংলাদেশের রাজনীতিতে ইতিবাচক ও নেতিবাচক দুই প্রবণতাই আছে। তবে যখন ইতির চেয়ে নেতির দাপট বেশি, ইস্যুর চেয়ে নন-ইস্যুর আধিক্য; তখন গণতন্ত্রের যাত্রা কোন পথে তা নিয়ে সংশয় থেকে যায়। রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণ করলে এটি সহজে বোঝা যায়।
সম্প্রতি নতুন অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট সংসদে উত্থাপিত হয়েছে। প্রত্যাশা ছিল, বাজেট নিয়ে সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে তুমুল তর্ক-বিতর্ক হবে। দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতির ক্ষেত্রে করণীয় বিষয়গুলো নিয়ে সংসদে কথা হবে। দ্রব্যমূল্য-সিএনজি-বাসভাড়া বৃদ্ধি বিষয়ে বাদ-প্রতিবাদ হবে। অতি সম্প্রতি কনোকো-ফিলিপসের সঙ্গে সমুদ্রের দুটি ব্লকে গ্যাস উত্তোলনের জন্য সম্পাদিত চুক্তির বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে আলোচিত হবে। প্রাধান্য পাবে সংবিধান সংশোধনের বিষয়ও। কিন্তু না, এসব জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে কোনো বাদানুবাদ নেই। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, প্রশাসনের গণতান্ত্রিকীকরণ ও বিকেন্দ্রীকরণ ইত্যাদি নিয়েও সাংসদদের উৎসাহ নেই। শেয়ারবাজারের কেলেঙ্কারির হোতাদের শাস্তি বিধানের বিষয়টিতে ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বী দল দুটি নীরব। সব ছাপিয়ে এখন রাজনৈতিক অঙ্গন সর্বাধিক আলোচিত হচ্ছে কেবল তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যু। যদিও আলোচনার অনেকটাই হচ্ছে সংসদের বাইরে। তত্ত্বাবধায়ক ইস্যু অগুরুত্বপূর্ণ, তা বলছি না। তবে এটি আগাম ইস্যু। নির্বাচন হতে যখন আরও দুই বছরের বেশি সময় বাকি, তখন এটি নিয়ে এই মুহূর্তে 'এসপার নয় ওসপার' হওয়ার মানে নেই।
সবারই জানা আছে, সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে অসাংবিধানিক বলা হয়েছে। তবে রায়ে এ কথাও উলি্লখিত হয়েছে, প্রয়োজনে দুই মেয়াদ পর্যন্ত এটি বহাল রাখা যেতে পারে। দুই মেয়াদে এটি থাকবে কি-না তা নির্ধারণের দায় সংসদের ওপর বর্তেছে। তাই এ নিয়ে সংসদে আলোচনা হওয়াই যুক্তিযুক্ত। সংসদের বাইরেও আলোচনা হতে পারে। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে অনর্থক জল ঘোলা করা হয়েছে। আদালতের পূর্ণাঙ্গ রায় ঘোষিত হওয়ার আগেই ক্ষমতাসীন দলের নেতারা একদিকে বলে দিলেন, আদালতের রায় অনুযায়ী দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে। এ বক্তব্য ছিল অনভিপ্রেত। আর বিরোধী দলও ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের কথা শুনে সঙ্গে সঙ্গে হরতালের ডাক দিল। সেটিও ছিল অনাকাঙ্ক্ষিত। প্রথমে ১২ ঘণ্টা, তারপর ৩৬ ঘণ্টা হরতাল পালিত হলো। গাড়ি পুড়ল। পুলিশ নামাল, বিরোধীদের ধড়পাকড় করল। হরতালে সরকারের মন্ত্রী-এমপি-আমলাদের কোনো ক্ষতি হয়নি। আর্থিক ক্ষতি হয়নি বিরোধী দলের নেতাদেরও। ক্ষতির সরাসরি শিকার হলো রিকশা-ভ্যান শ্রমিক, ফেরিওয়ালা, ফলমূল-সবজি বিক্রেতা, ক্ষুদে দোকানদারসহ দিন আনে দিন খাওয়া হতদরিদ্র মানুষ। ক্ষতি হয়েছে আড়তদার ব্যবসায়ীদেরও। তবে তারা সে ক্ষতি দাম বাড়িয়ে পুষিয়ে নিতে পারবে। তাই চূড়ান্ত বিচারে ক্ষতি সাধারণ মানুষেরই।
এ হলো ক্ষতির দৃশ্যমান দিক। আর আগাম ইস্যুতে রাজনৈতিক অঙ্গন উত্তপ্ত হওয়ায় আড়ালে থেকে গেল ক্ষতির আরেক দিক। সেটি হলো_ দ্রব্যমূল্য, সিএনজির মূল্যবৃদ্ধি, বাসভাড়া বৃদ্ধি, বাজেট এবং গ্যাস উত্তোলন চুক্তি নিয়ে আলোচনা হলো না। সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় জনগণকে সম্পৃক্ত করা হলো না। এটি যে ভ্রান্ত ও আত্মঘাতী রাজনীতি তা নিয়ে সংশয়ের অবকাশ নেই।
লক্ষণীয়, রাজনৈতিক অঙ্গন উত্তপ্ত থাকায় সরকারের লাভের খতিয়ান বেশ বড়। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির জন্য তাদের খুব বেশি সমালোচিত হতে হচ্ছে না। সিএনজি ভাড়া বৃদ্ধির জন্য কৈফিয়ত দিতে হচ্ছে না। বাজেট কতটুকু দিনবদলের, তা নিয়েও তেমন বিতর্কের মুখে পড়তে হচ্ছে না। হয়তো রক্ষা পেয়ে গেল শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির সংশ্লিষ্ট হোতারাও। নীরবে সম্পাদিত হয়ে গেল বিদেশিদের সঙ্গে গ্যাস উত্তোলন চুক্তি। এতে দলের রাজনীতি-ব্যবসায়ীরা বেজায় খুশি। বিরোধী দলের লাভ কি কম? মহাজোট সরকারের দ্রব্যমূল্য, বাসভাড়া বৃদ্ধির কারণে তাদের দলের ব্যবসায়ী-রাজনীতিকরা লাভবান হবে, শেয়ারবাজারের কেলেঙ্কারিতে বিপদে থাকা তাদের নেতারাও রেহাই পেল। আর মহাজোট সরকারের হাত দিয়েই হয়ে গেল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে খুশি করার কাজ। ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বী দল দুটির শ্রেণীস্বার্থ এক, বিরোধ শুধু ক্ষমতার মসনদ নিয়ে। তাই ক্ষমতার মসনদে বসার জন্য যে খেলা_ সেটিই হয়ে উঠছে মুখ্য। তবে এ খেলার ভয়ানক বিপদও আছে। ষড়যন্ত্রের শক্তি মওকা পেয়ে যেতে পারে। আর তা হয়ে উঠতে পারে দুই দলের জন্যই মর্মপীড়ার কারণ ।
আজকের এই নন-ইস্যুকে ইস্যু করা, আগাম ইস্যুতে উত্তপ্ত হওয়া, সংসদ বর্জন করার রাজনীতির মধ্য দিয়ে পুলকিত হচ্ছে বাইরের স্বার্থান্ধ শক্তি। স্বাধীনতার চলি্লশ বছরেও আমরা সাবালক হইনি। ওদের কাছে ধরনা দিচ্ছি, গৃহবিবাদ মেটানোর জন্য সালিশ মানছি। আমরা খতিয়ে দেখছি না, কেন আফ্রিকার সম্পদসমৃদ্ধ দেশগুলো দেশের সম্পদের ওপর কর্তৃত্ব হারিয়েছে। কেন মধ্যপ্রাচ্য এত সম্পদসমৃদ্ধ হয়েও নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারেনি। পাকিস্তানের ঘটনাবলিও বিবেচ্য। আত্মঘাতী রাজনীতির পরিণতিতে সেখানে বিদেশি সেনাদের অনুপ্রবেশ ঘটেছে। পরনির্ভরতা ও রাজনৈতিক বিরোধ তাদের এ দুর্ভাগ্যের জন্য দায়ী।
একদা বলা হতো যে, বিদেশি সাহায্য ছাড়া আমাদের চলবে না। এখন তো আমাদের খাদ্য আমরাই উৎপন্ন করছি, বাজেটের সিংহভাগ অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে জোগান দিচ্ছি। তবে কেন এই দাসসুলভ মানসিকতা! এ সত্য আমাদের শাসকরা বোঝেন না তা নয়, তারপরও ধরনা দেন তাদের কাছে। কেননা এর সঙ্গে গোষ্ঠীস্বার্থ জড়িত। ক্ষমতায় থাকার জন্য আশীর্বাদ প্রয়োজন। তবে সেই আশীর্বাদ বর্ষণে যে সর্বদাই ফল দেবে, এমনটা আশা করা যায় না। এ প্রসঙ্গে বলতে হয়, সপ্তম নৌবহরের হুমকি দিয়ে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঠেকানো যায়নি। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সরকারের প্রতি আন্তর্জাতিক প্রভুদের ১০০ ভাগ সমর্থন ছিল। কিন্তু এরশাদকে রক্ষা করতে পারেনি। ১/১১-এর ফর্মুলা দিয়েও তা বাস্তবায়ন করতে ব্যর্থ হয়েছে তারা। প্রমাণিত হয়েছে, জনতার শক্তি এখানে অপরাজেয়। সেই গণদেবতাকে তুষ্ট করে দৈত্যকুলের প্রতি আনুগত্য এক লজ্জাকর অধ্যায়।
এই জনবিচ্ছিন্ন নেতিবাচক রাজনীতিতে লাভবান হচ্ছে আমলাতন্ত্র। স্বাধীন দেশের উপযোগী জনপ্রশাসন গড়ে তোলার অঙ্গীকার থেকে আমরা ক্রমেই সরে যাচ্ছি। এখনও শাসন-প্রশাসন আমলাদের দ্বারাই পরিচালিত। এমনকি তাদের হাতেই বাজেট তৈরি হচ্ছে। এবারের বাজেট প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় এমপিদের কেন সম্পৃক্ত করা হয়নি; সে অভিযোগ মহাজোটের সাংসদদেরই। আর সাধারণ মানুষের মতামত দেওয়ার সুযোগ কই? গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে বাজেট প্রণয়নের ক্ষেত্রে শ্রেণী-পেশার সংগঠনগুলোর ভূমিকা রাখার সুযোগ রয়েছে। এ নিয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনা হয়। তাই সর্বস্তরের মানুষের মতামতের প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায়।
এখানে আমলাদের দ্বারা প্রণীত বাজেটে সংসদকে অনুমোদন দিতে হয়। বলা আবশ্যক, রাজনৈতিক নেতৃত্বের বিরুদ্ধে যত সমালোচনাই থাকুক, তাদের সঙ্গে যতটুকু জনগণের সম্পর্ক আছে, সেটি আমলাদের নেই। আমলাদের কখনও জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে হয় না, তা করতে হয় জনপ্রতিনিধিদেরই। আর জনপ্রতিনিধিরা যদি বাজেট প্রণয়ন থেকে দূরে থাকেন, তা হলে সেখানে জনমতের প্রতিফলন কী করে পড়বে? কী করে বাস্তবায়িত হবে দিনবদলের ভিশন?
এখানেই রাজনৈতিক নেতৃত্বের দেউলিয়াপনা। রাজনীতি রাজনীতিকদের কাছে নেই। নিবেদিতপ্রাণ নেতাকর্মীরা ছিটকে পড়েছেন। জেঁকে বসেছেন মৌসুমি রাজনীতিকরা। রাজনীতি তাদের কাছে বাণিজ্য বা বাণিজ্যের হাতিয়ার। তাই সরকার বদলের সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় নেতাদের আখের গোছানোর প্রতিযোগিতা। সেই প্রতিযোগিতার মূর্ত রূপ চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, দখলবাজি। ক্ষমতাসীন দলের লোকেরা যখন আখের গোছাতে থাকে, তখন বিরোধী দলও অপেক্ষা করে। পালাবদলে তাদের ভাগ্যও সুপ্রসন্ন হয়।
রাজনীতি থেকে 'নীতি' আজ বিসর্জিত। পেশির কাছে মেধাবীরা পরাজিত। এর প্রতিফলন ঘটেছে সামগ্রিক রাজনীতিতে। তাই রাজনীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে গদি রক্ষা আর দখলের খেলায়। এ কারণেই 'ইতি'র চেয়ে 'নেতি', ইস্যুর চেয়ে নন-ইস্যু বা আগাম ইস্যু নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গন সরগরম।
এ প্রসঙ্গে ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধী দলের নেতাদের বক্তৃতা-বিবৃতির কথা উল্লেখ করা যায়। ক্ষমতাসীন দলের মন্ত্রী-এমপিরা যতটা তাদের করণীয় বা কর্মসূচি ব্যাখ্যা করেন, তার কয়েকগুণ বেশি বিরোধী দলের প্রতি বিষোদ্গার করেন। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, বিদ্যুৎ সংকটসহ জনজীবনের সংকটের পেছনে বিরোধী দলের ষড়যন্ত্রের কথা বলেন। আর বিরোধী দলও পাল্টা বক্তব্যে বিষোদ্গারই করে। এই পাল্টাপাল্টি বিষোদ্গার থেকে বাদ যাচ্ছেন না বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানও। তাদের জড়িয়ে অশ্রাব্য ভাষার কথা চালাচালিও হয়েছে। এভাবেই চলছে হানাহানি ও কাদা ছোড়াছুড়ির রাজনীতি। এর ফলে সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে দূরত্ব বাড়ছে। বেড়ে চলেছে হরতাল-হামলা-মামলার রাজনীতি।
এই রাজনীতিকে ইতিবাচক ধারায় ফিরিয়ে আনতে হলে দরকার রাজনৈতিক নেতৃত্বের জনকল্যাণমুখী দৃষ্টিভঙ্গি। নেতৃত্বকে দলের চেয়ে জাতীয় স্বার্থ, সুবিধাপ্রাপ্তদের চেয়ে সুবিধাবঞ্চিতদের অধিকারের প্রতি নজর দিতে হবে। মনে রাখতে হবে, দেশের আইন প্রণয়ন, উন্নয়ন, জনকল্যাণ, সবকিছুরই মূলে রাজনীতি। রাজনীতি যদি ইতিবাচক না হয়, তবে দেশের অগ্রযাত্রা আশা করা যায় না। তাই দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের স্বার্থেই রাজনীতিতে পরিবর্তন আনতে হবে। আর সে দায়িত্ব সরকার ও বিরোধী দল উভয়েরই।

আবু সাঈদ খান : সাংবাদিক
ask_bangla71@yahoo.com
www.abusayeedkhan.com
 

No comments

Powered by Blogger.