ড. ইউনূস গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা নন by রাহাত খান
গ্রামীণ ব্যাংক-সংক্রান্ত নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মামলা এখন সুপ্রিম কোর্টে। ১৫ মার্চ থেকে দুই সপ্তাহের জন্য সুপ্রিম কোর্ট মামলার শুনানি মুলতবি করেছেন। বিচারাধীন কোনো মামলার বিষয়ে কথা বলার এখতিয়ার কারো নেই। আমারও নেই। এই নিবন্ধে আমি শুধু ড. মুহাম্মদ ইউনূস সম্পর্কে আমার ব্যক্তিগত কিছু পর্যবেক্ষণ তুলে ধরছি।
খুবই বড় মাপের একজন মানুষ ড. ইউনূস। শান্তির জন্য নোবেল পুরস্কার জয় করে তিনি গোটা দেশকেই বিশ্বদরবারে সম্মানিত করেছেন। তাঁর জন্য বাংলাদেশি হিসেবে অবশ্যই গৌরব বোধ করি।
তবে একটি ভুল তথ্য তাঁর ওপর আরোপ করা হয়। বলা হয়, তিনি গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা। কথাটা সত্য নয়। ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা বাংলাদেশ সরকার। দেশের প্রচলিত আইন এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রবিধান ও তদারকির আওতায় একটি বিশেষায়িত ব্যাংক হিসেবে ১৯৯০ সালে এর প্রতিষ্ঠা। ড. ইউনূসকে প্রতিষ্ঠাতা ম্যানেজিং ডাইরেক্টর পর্যন্ত বলা যেতে পারে। তবে গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা তিনি নন কোনোক্রমেই।
গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা না হলেও ব্যাংকের সর্বেসর্বা ব্যক্তি তিনিই। ব্যাংকটির প্রসারে ও প্রচারে তাঁর বিশাল ভূমিকাকেও খাটো করে দেখা যায় না কিছুতেই। শুধু একটা ব্যাপারে অনেকের মতো আমার মনেও খটকা আছে। জানতে ইচ্ছে হয়, ব্যাংক পরিচালনা এবং নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে ড. ইউনূস দ্বিতীয় ব্যক্তি তৈরি করেননি কেন? খালেদ শামসের মতো অসাধারণ এক ব্যক্তি গ্রামীণ ব্যাংকের দ্বিতীয় নেতা হিসেবে তৈরি হচ্ছেন বলে বহুকাল আমরা শুনেছিলাম। হঠাৎ একদিন শুনি খালেদ শামস আর গ্রামীণ ব্যাংকে নেই। তাঁকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। সরিয়ে দিয়ে খালেদ সাহেবকে গ্রামীণের অন্য কোন প্রকল্পে দেওয়া হয়েছে, তা আমার ঠিক জানা নেই। গ্রামীণ ব্যাংকের পরিচালনা-নেতৃত্বে এরপর দ্বিতীয় স্থানে দীপাল বড়ুয়া নামে এক ব্যক্তির নাম শুনেছিলাম। তিনিও এখন নেই বলে জানি। অর্থাৎ ড. ইউনূস গ্রামীণ ব্যাংক পরিচালনায় অসাধারণ দক্ষতা ও যোগ্যতার পরিচয় দিয়েছেন ঠিকই। তবে কোনো সংস্থাকে প্রতিষ্ঠানে (ইনস্টিটিউশন) পরিণত করতে হলে সেখানে যে দ্বিতীয়, তৃতীয় নেতৃত্ব তৈরি করতে হয় এ ব্যাপারে কোনো মনোযোগ দেননি ড. ইউনূস। কেন দেননি তা তিনিই জানেন। তবে আমার মতো অনেকে মনে করেন, এটা শুধু যে ড. ইউনূসের এক ব্যর্থতা তা নয়, এর পেছনে আজীবন গ্রামীণ ব্যাংক পরিচালনার এবং গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে যা খুশি করার একটা নেতিবাচক প্রবণতা কাজ করছে।
বয়স হলে মানুষ সরকারি চাকরি থেকে অবসর নেবে, এটাই তো আইন। এটাই তো নিয়ম। কিন্তু দেখেশুনে আমার ধারণা জন্মেছে যে সারা দুনিয়ায় তোলপাড় তুলে হলেও ড. ইউনূস যেন আমৃত্যু গ্রামীণ ব্যাংকের এমডি পদে ন্যস্ত থাকতে চান। ড. ইউনূস গ্রামীণ ব্যাংকের এমডি না থাকলে ৮০ লাখ দরিদ্র মানুষের এই ব্যাংক নাকি মুখ থুবড়ে পড়বে_ এমন কথাও ইউনূস সমর্থক ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর কাছ থেকে শোনা যায়। ড. ইউনূস ব্যাংকের (গ্রামীণ) এমডি না থাকলে ব্যাংক অস্তিত্ব সংকটে পড়বে_ এমনটাই যদি হয়, তাহলে এখনই তো তাঁর বয়স ৭১ বছর, নোবেল পুরস্কার জিতলেও মৃত্যু তো তাঁকে রেহাই দেবে না। যথাসময়ে দেশ ও জাতিকে শোকসাগরে ভাসিয়ে তিনি প্রাণত্যাগ করবেন, তখন গ্রামীণ ব্যাংকের কী হবে? তাহলে তো ব্যাংকের স্বার্থে ড. ইউনূসকে অমর থাকতে হয়। সেটা কি সম্ভব?
গ্রামীণ ব্যাংকে ড. ইউনূসকে থাকতেই হবে। এটা যে নোবেল বিজয়ীর শুধু একটা আত্মসম্মানের প্রশ্ন, তা মোটেই নয়। গ্রামীণ ব্যাংকে তাঁর এমডি পদে থাকার ওপর নির্ভর করছে আমার জানামতে, বিশ্বের বহু আন্তর্মহাদেশীয় বাণিজ্যগোষ্ঠীর ব্যবসায়িক স্বার্থ। বাণিজ্য-স্বার্থ থাকতেই পারে, সেটা কোনো বেআইনি বা অবাঞ্ছিত বিষয় নয়। তবে অনেকে বলেন, গ্রামীণ ব্যাংকের মতো কোনো বিশেষায়িত ব্যাংকের প্ল্যাটফর্মে কাজ করার কতগুলো সুবিধা পাওয়া যায়। যেমন কো-লেটারাল বা ইক্যুইটি দিতে হয় না। ট্যাঙ্ দিতে হয় না। এসব সুবিধা ব্যবহার করতে পারলে বিশ্ব ও দেশীয় বাজারে পণ্যমূল্য প্রতিযোগিতামূলক রেখেও লভ্যাংশ কতটা উচ্চ হারে পাওয়া সম্ভব, সেটা নিশ্চয়ই বিশদ ব্যাখ্যার প্রয়োজন পড়ে না। শান্তির জন্য নোবেল বিজয়ী একটা বিশাল মাপের মানুষ। নিজের সম্মান তিনি নিজেই রক্ষা করবেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের অব্যাহতিপত্র পাওয়ার পর সসম্মানে নিজেই সরে যাবেন_এটাই তো কাম্য ছিল। কিন্তু তেমনটি হয়নি। সারা বিশ্ব, বিশেষত পাশ্চাত্য ভূখণ্ডে তাঁর পদচ্যুতি নিয়ে নানা প্রতিবাদ উচ্চারিত হয়েছে। নানা হৈচৈ হয়েছে। ড. ইউনূসকে যেন গ্রামীণ ব্যাংকের এমডি রাখতেই হবে। তা না হলে সর্বনাশ হয়ে যাবে!
কার সর্বনাশ? এ বিষয়ে মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকলাম। সব কিছু পরিষ্কার করে বলার তো দরকার নেই। ৩৫ থেকে ৪০ পার্সেন্ট সুদ নিয়ে কোনো ব্যাংক দারিদ্র্য মোচন করতে পারবে, এটা মূর্খের স্বর্গে বাস করার মতোই অলীক কল্পনা। বাংলাদেশে শোচনীয় দারিদ্র্যদশা মোচন, শিশুমৃত্যুর হার কমানো, প্রসূতি মৃত্যুর হার কমানো, নারীর ক্ষমতায়ন, জন্মহার কমানো, গ্রামে ও বস্তিতে স্যানিটেশন ব্যবস্থার বহুল উন্নয়ন_এসব ব্যাপারে এরই মধ্যে বাংলাদেশের ব্র্যাক, প্রশিকা, নিজেরা করি, কারিতাস প্রভৃতি এনজিওর অনেক সাফল্যের রেকর্ড (সাকসেস স্টোরি) রয়েছে_গ্রামীণ ব্যাংকের এসব কার্যক্রমের কোনো বালাই-ই ছিল না। তারা দেয় গরিব মানুষকে উচ্চ হারে শুধু ঋণ। এক হিসেবে সুদের ব্যবসাই বলা যায়। তাই গ্রামীণ ব্যাংককে দিয়ে দেশের দারিদ্র্যমোচন খুব একটা হয়েছে বলে মনে করার কারণ নেই।
তবু দারিদ্র্যমোচন, সমাজে দারিদ্র্যের দরুন অস্থিরতা সৃষ্টির ভয়াবহতা ঠেকানো, দরিদ্র মানুষের ঘরে ঘরে সুখ ও স্বস্তি উপচে পড়া_এসব মহান কর্ম ও কীর্তির স্বীকৃতি হিসেবেই শান্তিতে ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। বিষয়টি অনেকের কাছেই তাজ্জব বলে মনে হয়েছে। সমাজে সামান্য কিছু ক্ষেত্র ছাড়া যিনি গ্রামীণ ব্যাংকের উচ্চ হারের ক্ষুদ্রঋণে দারিদ্র্যমোচনে তেমন সফল হননি, যিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় গণহত্যাকারী পাকিস্তানের বিপক্ষে কোনো প্রতিবাদ জানাননি, আমেরিকায় নিরাপদ আশ্রয়ে থেকে যিনি আত্মরক্ষায় সচেষ্ট ছিলেন, দেশের প্রাকৃতিক ও রাজনৈতিক বিপর্যয়ের সময় যিনি সর্বদা তাঁর নেপথ্যচারিতা ও নিষ্ক্রিয়তা রক্ষা করেছেন নির্লিপ্তভাবে_সেই তিনি, ব্যবসা-বাণিজ্যের শিরোমণি ড. মুহাম্মদ ইউনূস পেলেন শান্তির জন্য নোবেল পুরস্কার। শান্তি পুরস্কারের প্রতি নোবেল কমিটির এই দৃষ্টিভঙ্গিকে পরিহাস ছাড়া আর কী বলা যায়।
ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে একজন প্রতিভাধর উদ্যোগী ও দক্ষ লোক হিসেবে আমি বরাবরই শ্রদ্ধা করে আসছি। তবু কিছু দুঃখ আমার আছে তাঁর ব্যাপারে। কিছু প্রশ্নও আমার আছে তাঁর বিপক্ষে। বাংলাদেশে তাঁর জন্ম, বাংলাদেশি বলে তাঁর পরিচিতি, অথচ আশ্চর্যের বিষয় ড. ইউনূস কোনো দিন, এমনকি নোবেলপ্রাপ্তির পরও বাঙালির গর্ব ও ঐতিহ্যের প্রতীক শহীদ মিনারে যাননি। কোনো দিন যাননি সাভারের স্বাধীনতা স্মৃতিসৌধে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি, জাতির জনক; ড. ইউনূস কোনো দিন জাতির জনকের সমাধিতে যাননি, কোনো দিন তাঁকে দেখা যায়নি বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে কিছু বলতে। বাঙালি জাতির জনক এবং বাঙালির যা কিছু গৌরবময় অর্জন_সেসবের প্রতি ড. ইউনূসের এই উপেক্ষা এবং নাক-উঁচু ভাব আমাকে খুব দুঃখ দেয়। বাঙালি জাতিকে নিয়ে গর্ব করে না এমন লোক লাঠির জোরে প্রতিষ্ঠার যতটা উচ্চতায়ই উঠুন তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান বজায় রাখা কঠিন। ওয়ান-ইলেভেনের পর রাজনীতিবিদদের তিনি ঢালাওভাবে দুর্নীতিবাজ বলেছিলেন। কেন বলেছিলেন ড. ইউনূস? গণতান্ত্রিক বিশ্ব তো পরিচালনা করেন রাজনীতিবিদরাই_সুধীসমাজ নয়। ড. ইউনূস, আপনি ১০ বছর থাকার শর্তে দেশ শাসন করতেও রাজি ছিলেন। এসবই মানুষের কাছে আপনার মর্যাদাকে খাটো করে। মামলায় কী হয় জানি না। সময়েই সেটা জানা যাবে। তবে ইতিমধ্যে নোবেল পুরস্কার বিজয়ের মাধ্যমে অর্জিত বিশাল ভাবমূর্তির অনেকটাই আপনি খুইয়েছেন। এটা জাতিগতভাবে আমাদের জন্য খুবই দুঃখজনক।
লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক
তবে একটি ভুল তথ্য তাঁর ওপর আরোপ করা হয়। বলা হয়, তিনি গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা। কথাটা সত্য নয়। ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা বাংলাদেশ সরকার। দেশের প্রচলিত আইন এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রবিধান ও তদারকির আওতায় একটি বিশেষায়িত ব্যাংক হিসেবে ১৯৯০ সালে এর প্রতিষ্ঠা। ড. ইউনূসকে প্রতিষ্ঠাতা ম্যানেজিং ডাইরেক্টর পর্যন্ত বলা যেতে পারে। তবে গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা তিনি নন কোনোক্রমেই।
গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা না হলেও ব্যাংকের সর্বেসর্বা ব্যক্তি তিনিই। ব্যাংকটির প্রসারে ও প্রচারে তাঁর বিশাল ভূমিকাকেও খাটো করে দেখা যায় না কিছুতেই। শুধু একটা ব্যাপারে অনেকের মতো আমার মনেও খটকা আছে। জানতে ইচ্ছে হয়, ব্যাংক পরিচালনা এবং নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে ড. ইউনূস দ্বিতীয় ব্যক্তি তৈরি করেননি কেন? খালেদ শামসের মতো অসাধারণ এক ব্যক্তি গ্রামীণ ব্যাংকের দ্বিতীয় নেতা হিসেবে তৈরি হচ্ছেন বলে বহুকাল আমরা শুনেছিলাম। হঠাৎ একদিন শুনি খালেদ শামস আর গ্রামীণ ব্যাংকে নেই। তাঁকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। সরিয়ে দিয়ে খালেদ সাহেবকে গ্রামীণের অন্য কোন প্রকল্পে দেওয়া হয়েছে, তা আমার ঠিক জানা নেই। গ্রামীণ ব্যাংকের পরিচালনা-নেতৃত্বে এরপর দ্বিতীয় স্থানে দীপাল বড়ুয়া নামে এক ব্যক্তির নাম শুনেছিলাম। তিনিও এখন নেই বলে জানি। অর্থাৎ ড. ইউনূস গ্রামীণ ব্যাংক পরিচালনায় অসাধারণ দক্ষতা ও যোগ্যতার পরিচয় দিয়েছেন ঠিকই। তবে কোনো সংস্থাকে প্রতিষ্ঠানে (ইনস্টিটিউশন) পরিণত করতে হলে সেখানে যে দ্বিতীয়, তৃতীয় নেতৃত্ব তৈরি করতে হয় এ ব্যাপারে কোনো মনোযোগ দেননি ড. ইউনূস। কেন দেননি তা তিনিই জানেন। তবে আমার মতো অনেকে মনে করেন, এটা শুধু যে ড. ইউনূসের এক ব্যর্থতা তা নয়, এর পেছনে আজীবন গ্রামীণ ব্যাংক পরিচালনার এবং গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে যা খুশি করার একটা নেতিবাচক প্রবণতা কাজ করছে।
বয়স হলে মানুষ সরকারি চাকরি থেকে অবসর নেবে, এটাই তো আইন। এটাই তো নিয়ম। কিন্তু দেখেশুনে আমার ধারণা জন্মেছে যে সারা দুনিয়ায় তোলপাড় তুলে হলেও ড. ইউনূস যেন আমৃত্যু গ্রামীণ ব্যাংকের এমডি পদে ন্যস্ত থাকতে চান। ড. ইউনূস গ্রামীণ ব্যাংকের এমডি না থাকলে ৮০ লাখ দরিদ্র মানুষের এই ব্যাংক নাকি মুখ থুবড়ে পড়বে_ এমন কথাও ইউনূস সমর্থক ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর কাছ থেকে শোনা যায়। ড. ইউনূস ব্যাংকের (গ্রামীণ) এমডি না থাকলে ব্যাংক অস্তিত্ব সংকটে পড়বে_ এমনটাই যদি হয়, তাহলে এখনই তো তাঁর বয়স ৭১ বছর, নোবেল পুরস্কার জিতলেও মৃত্যু তো তাঁকে রেহাই দেবে না। যথাসময়ে দেশ ও জাতিকে শোকসাগরে ভাসিয়ে তিনি প্রাণত্যাগ করবেন, তখন গ্রামীণ ব্যাংকের কী হবে? তাহলে তো ব্যাংকের স্বার্থে ড. ইউনূসকে অমর থাকতে হয়। সেটা কি সম্ভব?
গ্রামীণ ব্যাংকে ড. ইউনূসকে থাকতেই হবে। এটা যে নোবেল বিজয়ীর শুধু একটা আত্মসম্মানের প্রশ্ন, তা মোটেই নয়। গ্রামীণ ব্যাংকে তাঁর এমডি পদে থাকার ওপর নির্ভর করছে আমার জানামতে, বিশ্বের বহু আন্তর্মহাদেশীয় বাণিজ্যগোষ্ঠীর ব্যবসায়িক স্বার্থ। বাণিজ্য-স্বার্থ থাকতেই পারে, সেটা কোনো বেআইনি বা অবাঞ্ছিত বিষয় নয়। তবে অনেকে বলেন, গ্রামীণ ব্যাংকের মতো কোনো বিশেষায়িত ব্যাংকের প্ল্যাটফর্মে কাজ করার কতগুলো সুবিধা পাওয়া যায়। যেমন কো-লেটারাল বা ইক্যুইটি দিতে হয় না। ট্যাঙ্ দিতে হয় না। এসব সুবিধা ব্যবহার করতে পারলে বিশ্ব ও দেশীয় বাজারে পণ্যমূল্য প্রতিযোগিতামূলক রেখেও লভ্যাংশ কতটা উচ্চ হারে পাওয়া সম্ভব, সেটা নিশ্চয়ই বিশদ ব্যাখ্যার প্রয়োজন পড়ে না। শান্তির জন্য নোবেল বিজয়ী একটা বিশাল মাপের মানুষ। নিজের সম্মান তিনি নিজেই রক্ষা করবেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের অব্যাহতিপত্র পাওয়ার পর সসম্মানে নিজেই সরে যাবেন_এটাই তো কাম্য ছিল। কিন্তু তেমনটি হয়নি। সারা বিশ্ব, বিশেষত পাশ্চাত্য ভূখণ্ডে তাঁর পদচ্যুতি নিয়ে নানা প্রতিবাদ উচ্চারিত হয়েছে। নানা হৈচৈ হয়েছে। ড. ইউনূসকে যেন গ্রামীণ ব্যাংকের এমডি রাখতেই হবে। তা না হলে সর্বনাশ হয়ে যাবে!
কার সর্বনাশ? এ বিষয়ে মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকলাম। সব কিছু পরিষ্কার করে বলার তো দরকার নেই। ৩৫ থেকে ৪০ পার্সেন্ট সুদ নিয়ে কোনো ব্যাংক দারিদ্র্য মোচন করতে পারবে, এটা মূর্খের স্বর্গে বাস করার মতোই অলীক কল্পনা। বাংলাদেশে শোচনীয় দারিদ্র্যদশা মোচন, শিশুমৃত্যুর হার কমানো, প্রসূতি মৃত্যুর হার কমানো, নারীর ক্ষমতায়ন, জন্মহার কমানো, গ্রামে ও বস্তিতে স্যানিটেশন ব্যবস্থার বহুল উন্নয়ন_এসব ব্যাপারে এরই মধ্যে বাংলাদেশের ব্র্যাক, প্রশিকা, নিজেরা করি, কারিতাস প্রভৃতি এনজিওর অনেক সাফল্যের রেকর্ড (সাকসেস স্টোরি) রয়েছে_গ্রামীণ ব্যাংকের এসব কার্যক্রমের কোনো বালাই-ই ছিল না। তারা দেয় গরিব মানুষকে উচ্চ হারে শুধু ঋণ। এক হিসেবে সুদের ব্যবসাই বলা যায়। তাই গ্রামীণ ব্যাংককে দিয়ে দেশের দারিদ্র্যমোচন খুব একটা হয়েছে বলে মনে করার কারণ নেই।
তবু দারিদ্র্যমোচন, সমাজে দারিদ্র্যের দরুন অস্থিরতা সৃষ্টির ভয়াবহতা ঠেকানো, দরিদ্র মানুষের ঘরে ঘরে সুখ ও স্বস্তি উপচে পড়া_এসব মহান কর্ম ও কীর্তির স্বীকৃতি হিসেবেই শান্তিতে ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। বিষয়টি অনেকের কাছেই তাজ্জব বলে মনে হয়েছে। সমাজে সামান্য কিছু ক্ষেত্র ছাড়া যিনি গ্রামীণ ব্যাংকের উচ্চ হারের ক্ষুদ্রঋণে দারিদ্র্যমোচনে তেমন সফল হননি, যিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় গণহত্যাকারী পাকিস্তানের বিপক্ষে কোনো প্রতিবাদ জানাননি, আমেরিকায় নিরাপদ আশ্রয়ে থেকে যিনি আত্মরক্ষায় সচেষ্ট ছিলেন, দেশের প্রাকৃতিক ও রাজনৈতিক বিপর্যয়ের সময় যিনি সর্বদা তাঁর নেপথ্যচারিতা ও নিষ্ক্রিয়তা রক্ষা করেছেন নির্লিপ্তভাবে_সেই তিনি, ব্যবসা-বাণিজ্যের শিরোমণি ড. মুহাম্মদ ইউনূস পেলেন শান্তির জন্য নোবেল পুরস্কার। শান্তি পুরস্কারের প্রতি নোবেল কমিটির এই দৃষ্টিভঙ্গিকে পরিহাস ছাড়া আর কী বলা যায়।
ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে একজন প্রতিভাধর উদ্যোগী ও দক্ষ লোক হিসেবে আমি বরাবরই শ্রদ্ধা করে আসছি। তবু কিছু দুঃখ আমার আছে তাঁর ব্যাপারে। কিছু প্রশ্নও আমার আছে তাঁর বিপক্ষে। বাংলাদেশে তাঁর জন্ম, বাংলাদেশি বলে তাঁর পরিচিতি, অথচ আশ্চর্যের বিষয় ড. ইউনূস কোনো দিন, এমনকি নোবেলপ্রাপ্তির পরও বাঙালির গর্ব ও ঐতিহ্যের প্রতীক শহীদ মিনারে যাননি। কোনো দিন যাননি সাভারের স্বাধীনতা স্মৃতিসৌধে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি, জাতির জনক; ড. ইউনূস কোনো দিন জাতির জনকের সমাধিতে যাননি, কোনো দিন তাঁকে দেখা যায়নি বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে কিছু বলতে। বাঙালি জাতির জনক এবং বাঙালির যা কিছু গৌরবময় অর্জন_সেসবের প্রতি ড. ইউনূসের এই উপেক্ষা এবং নাক-উঁচু ভাব আমাকে খুব দুঃখ দেয়। বাঙালি জাতিকে নিয়ে গর্ব করে না এমন লোক লাঠির জোরে প্রতিষ্ঠার যতটা উচ্চতায়ই উঠুন তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান বজায় রাখা কঠিন। ওয়ান-ইলেভেনের পর রাজনীতিবিদদের তিনি ঢালাওভাবে দুর্নীতিবাজ বলেছিলেন। কেন বলেছিলেন ড. ইউনূস? গণতান্ত্রিক বিশ্ব তো পরিচালনা করেন রাজনীতিবিদরাই_সুধীসমাজ নয়। ড. ইউনূস, আপনি ১০ বছর থাকার শর্তে দেশ শাসন করতেও রাজি ছিলেন। এসবই মানুষের কাছে আপনার মর্যাদাকে খাটো করে। মামলায় কী হয় জানি না। সময়েই সেটা জানা যাবে। তবে ইতিমধ্যে নোবেল পুরস্কার বিজয়ের মাধ্যমে অর্জিত বিশাল ভাবমূর্তির অনেকটাই আপনি খুইয়েছেন। এটা জাতিগতভাবে আমাদের জন্য খুবই দুঃখজনক।
লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক
No comments