প্রস্তাবিত বাজেট-বাজেট ও ঋণ করে ঘি খাওয়ার গল্প by জাহিদুজ্জামান ফারুক
সাধারণ মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে বাজেটের মূল লক্ষ্যের বিশেষ ভিন্নতা নেই। এই ভাবনা ব্যক্তিজীবন থেকে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার ক্ষেত্রেও প্রায় একইভাবে প্রযোজ্য। কিন্তু সমস্যা দাঁড়ায় সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীগোষ্ঠীর সমস্যা ও আশা-আকাঙ্ক্ষাকে পৃথকভাবে না-দেখে একটি পাত্রে সব সমস্যা ঢেলে রাজনৈতিক মেরুকরণে সমস্যার সমাধানে প্রেসক্রিপশন তৈরি ।
ব্যক্তিজীবনে যদি কেউ অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত বা দেউলিয়া হয়ে পড়ে, তখন তার প্রতিবেশী কেন, আপন আত্মীয়স্বজনও তা মেনে নিতে চায় না। সবারই এক কথা, আয় ও ব্যয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য রক্ষা করতে পারেনি বলেই ওই ব্যক্তি অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু বা দেউলিয়া। আয় থেকে ব্যয় বাড়লেই বিপদ। আয় থেকে কিছু সঞ্চয় রাখতে পারলে তা বিপদের বন্ধু। আর যদি উল্টোটি গ্রহণ করা হয়, ‘ঋণ করে ঘি খাব’, ‘আয় যা-ই থাক, বড়লোকি চাল দেখিয়ে দিন পার করব, পরেরটা পরে দেখা যাবে’, তাতে যা হওয়ার তাই হবে।
রাষ্ট্রীয় পরিকাঠামোতে আয় ও ব্যয়ের হিসাবটা একটু ভিন্ন মেরুকরণে মূল্যায়নের চেষ্টা করা হয়। মনে করা হয়, ঋণ করে যদি সম্পদ সৃষ্টি করা যায় তবে সেই ঋণ যথার্থ। ঋণের অর্থের বোঝার চেয়ে সম্পদের স্বল্পতা রাষ্ট্রযন্ত্রকে দুর্বল করে দেয়। আর সম্পদ সৃষ্টি মানেই বিনিয়োগের নতুন সম্ভাবনা। বিনিয়োগ বৃদ্ধি হলে কর্মসংস্থান তৈরি হবে এবং সম্পদ সৃষ্টির পথও প্রশস্থ হবে। অর্থনীতির এই চাকা সঠিকভাবে ঘোরাতে পারলেই বৃদ্ধি পায় জিডিপি (Gross Domestic Product)। সবারই এক কথা, জিডিপি বৃদ্ধিই সাফল্যের চাবিকাঠী । কেউ বাহবা কুড়ায় আর কেউ হাততালি দেয়। কিন্তু বাহবা আর হাততালির পেছনে কারও কান্না যে লুকিয়ে থাকতে পারে তা বেশির ভাগ সময়ই ধরা পড়ে না। এখানেই ধনতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মৌলিক দুর্বলতা। এই দুর্বলতা যাঁরা কাটিয়ে উঠতে পারেন তাঁরাই ধনতান্ত্রিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে সফল।
এবার আমি জাতীয় সংসদে পেশ করা ২০১০-১১ অর্থবছরের বাজেট নিয়ে আলোকপাত করতে চাই। এটি ঘাটতি বাজেট। আমেরিকা, জাপান বা ভারতের বাজেটেও ঘাটতি থাকে। ঘাটতি বাজেট তৈরি অন্যায় নয়। তবে ঘাটতি মেটাতে যে ঋণ ও তার সুদ আগামী প্রজন্মের জন্য সংকট তৈরি করে, তা পুর্নবিবেচনার দাবি রাখে। নয়া অর্থবছরে জাতীয় বাজেটে ঘাটতির পরিমাণ ৩৯ হাজার ২৩২ কোটি টাকা। আর অনুদানের পরিমাণ চার হাজার ৮০৯ কোটি টাকা। বাজেট ঘোষণা অনুযায়ী নয়া অর্থবছরে (২০১০-১১) সরকারের সাকল্যে রাজস্ব আয় হবে ৯৭ হাজার ৫৬৬ কোটি টাকা। ব্যয় হবে (যা বরাদ্দ আকারে ধরা হয়েছে) এক লাখ ৩২ হাজার ১৭০ কোটি টাকা।
এই এক লাখ ৩২ হাজার ১৭০ কোটি টাকার উৎস জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) করের মাধ্যমে ৭২ হাজার ৫৯০ কোটি টাকা, এনবিআর-বহির্ভূত আয় তিন হাজার ৪৫২ কোটি টাকা, করের বাইরে থেকে আয় ১৬ হাজার ৮০৫ কোটি টাকা, অনুদান চার হাজার ৮০৯ কোটি এবং দেশি-বিদেশি ঋণ ১০ হাজার ৮৩৪ কোটি টাকা। আয় থেকে রাজস্ব ব্যয় বাবদ মন্ত্রী ও সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা, সরকারি সম্পত্তির রক্ষণাবেক্ষণ এবং বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) জন্য ব্যয় হবে ৩৮ হাজার ৫০০ কোটি টাকা।
প্রশ্ন হল, এই আয়-ব্যয় আমাদের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি বা আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণে কতটুকু অবদান রাখতে পারবে ? বাঙালি সংস্কৃতিতে ঋণ করে ঘি খাওয়ার একটা প্রবাদ আছে। কিন্তু কী শারীরিক অবস্থায় ঋণ করে ঘি খেলে তা শারীরে বলবর্ধক হিসেবে কাজ করবে তা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অসুস্থ মানুষ বা দুর্বল অর্থনীতিকে শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে শুধু ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন বা ক্যাপসুল (যাকে অর্থ হিসেবে ধরছি) যথেষ্ট নয়। অসুস্থ মানুষটির জন্য প্রয়োজন সেবা-শুশ্রূষা, সঠিক সময়ে সঠিক ওষুধ এবং আস্তে আস্তে তাকে ভিটামিন দিয়ে সম্পূর্ণ সুস্থ করার পরই ঘি বা আমিষজাতীয় খাদ্য প্রদান করলে তা যেমন হজম হবে, তেমনি অসুস্থ রোগী সবল হয়ে নিজ ও পরিবারের সহায়ক শক্তি হিসেবে দাঁড়াবে। রাষ্ট্রীয় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে গতি সঞ্চার করার ক্ষেত্রে সমস্যার মূল কারণ উদ্ধার করেই সমাধানের পথ খোঁজা প্রয়োজন।
আজকের এই লেখায় আমি ঘাটতি বাজেটের মধ্যেই থাকতে চাই। ব্যয়ের আতিশয্যকে সামাল দিতে গিয়েই সরকারকে ধারদেনা করে বড় ঘাটতির বাজেট বানাতে হয়েছে। আর ঘাটতি বাজেট মোকাবিলার জন্যই সরকার ব্যাংকিং খাত ও জনসাধারণের অর্থ (জাতীয় সঞ্চয় প্রকল্প এবং অন্যান্য খাত) থেকে দেনা করছে বা করবে। সে জন্য ব্যাংকিং খাতে বিনিয়োগকারীদের অর্থ একদিকে যেমন সংকুচিত হয়ে পড়বে, অপরদিকে জনগণকেই আবার এই ঋণের সুদ বহন করতে হবে।
চলতি বছর সরকারকে ঘাটতি বাজেটের কারণে ব্যাংকসহ দেশ-বিদেশের ঋণের সুদের জন্য বাজেটের মোট বরাদ্দের প্রায় ১১ শতাংশ অর্থ দিতে হয়েছে। অর্থাৎ বাজেট বরাদ্দের এক লাখ ৩২ হাজার ১৮০ কোটি টাকার মধ্যে ১৪ হাজার ৭০৯ টাকা যাবে ঋণের সুদ হিসেবে।
যারা বাজেট প্রণয়ন বা বাস্তবায়ন করছেন তাঁরা কি বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবেন যে, গৃহীত ঋণের শুধু সুদ বাবদ এই ১৪ হাজার ৭০৯ কোটি টাকা যে ব্যয় করতে হবে তা মূল ঋণের সঙ্গে যোগ করে যে অর্থ বিনিয়োগ হবে তার চেয়ে আলোচ্য বছরে অধিক পরিমাণ সম্পদ তৈরি বা অর্জিত হবে? আমার মনে হয়, সুদের অর্থের হিসাব দূরের কথা, মূল অর্থের সঠিক হিসাবও অর্থ ব্যবহারকারী মন্ত্রণালয় দিতে পারবে না। তাহলে প্রধানমন্ত্রী বা অর্থমন্ত্রীকে যাঁরা বাংলাদেশের মতো অর্থনৈতিক অবকাঠামো বা পরিবেশে এই মুহূর্তে ধারদেনা করে বড় আকারের বাজেট প্রদানের পরামর্শ দিচ্ছেন তা আদৌ যুক্তিসংগত কি না তা ভেবে দেখতে হবে।
বিরাট ঘাটতি বাজেট করে সরকার যে ঋণ ব্যাংকিং খাত ও অন্যান্য দেশি-বিদেশি উৎস থেকে আনবে, তা কোথায় ব্যবহার করবে? দেশের কৃষি খাত, অন্যান্য উৎপাদনশীল খাতে ভর্তুকিতে ঋণের অর্থ ব্যবহারের প্রশ্ন আমি তুলছি না। কিন্তু অনুৎপাদনশীল খাতে ব্যবহার্য ঋণের অর্থ ব্যয় অবশ্যই কাঙ্ক্ষিত নয়।
ঘাটতি বাজেটের জন্য মোটা দাগে গৃহীত ঋণ যেভাবে ব্যবহার করা হয়:
১. সরকারি খাতে যেসব শিল্প ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান আছে এবং তার ব্যবস্থাপনার নামে করপোরেশনগুলো টিকিয়ে রাখা হয়েছে, তাদের বার্ষিক প্রায় ১৯ হাজার কোটি টাকা লোকসানের অর্থ জোগান দিতে হচ্ছে।
২. সরকার সম্প্রতি যে ‘রেন্টেড পাওয়ার প্লান্ট’ (ভাড়া করা বিদ্যুৎ প্রকল্প) দিয়ে জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ সরবরাহের চুক্তি করেছে, তাতে যে অর্থে এসব কোম্পানি থেকে বিদ্যুৎ কিনবে তা অর্ধেক বা তারও কম মূল্যে ভোক্তাকে সরবরাহ করতে হবে। এই খাতে নয়া অর্থবছরে সরকারকে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হবে।
৩. সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের নয়া বছরে যে বেতন-ভাতা বৃদ্ধি করা হয়েছে তার অর্থ জোগান এই ঘাটতি বাজেটের ঋণের অর্থ থেকে মেটাতে হবে।
৪. সরকারি খাতে ভোগবিলাস বাবদ যে অর্থ ব্যয় হবে তাও গৃহীত ঋণ থেকে জোগান দিতে হবে।
জার্মানিসহ ইউরোপ ও বিশ্বের অনেক দেশ তাদের বাজেটে ঘাটতি সংকুচিত করে অনেক ব্যয় ছেঁটে ফেলে শুধু ঋণ করে ঘি না খাওয়ার সিদ্ধান্তে। অনেক দেশ এবার তাদের বাজেটে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধি দূরের কথা, বিগত দিনে প্রদত্ত সুযোগ-সুবিধাও কেটে নিয়েছে, অর্থনীতিকে একটি শৃঙ্খলার মধ্যে আনার জন্য।
অপরদিকে আমরা এর বিপরীত কাজটিই করছি। হিসাব অনুযায়ী, যদি সরকারি খাতের অপচয় রোধ, দুর্নীতি বন্ধ এবং বিনিয়োগে বেসরকারি খাতকে উৎসাহ প্রদান ও এগিয়ে আনার পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়, তবে এই বড় ঘাটতি বাজেটের প্রয়োজন হবে না। ফলে বাজেটে ঋণের বোঝাও কমবে এবং একই সঙ্গে বিনিয়োগ তথা কর্মসংস্থানের নতুন সুযোগ তৈরি হবে।
আমরা একটি গরিব দেশ হয়েও দামি দামি গাড়ি, বাড়ি ও ভোগবিলাসসহ বিভিন্ন অনুৎপাদনশীল খাতে যে অর্থ বরাদ্দ দিচ্ছি তা আসে প্রবাসীদের কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা বা ব্যাংকসহ বিভিন্ন খাতের ঋণ থেকে। এই উদ্যোগ নৈতিক বা সাংবিধানিক কোনো দিক দিয়েই গ্রহণযোগ্য নয়। তাই বাজেটে প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রীর দ্রুত অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির আকাঙ্ক্ষার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েও ধার করে ঘি খাওয়ার কর্মসূচি দ্বিতীয়বার ভেবে দেখার অনুরোধ জানাব।
জাহিদুজ্জামান ফারুক: সম্পাদক, নয়া অর্থনীতি। বাংলাদেশ করসপনডেন্ট, কিয়োডো নিউজ সার্ভিস, জাপান।
রাষ্ট্রীয় পরিকাঠামোতে আয় ও ব্যয়ের হিসাবটা একটু ভিন্ন মেরুকরণে মূল্যায়নের চেষ্টা করা হয়। মনে করা হয়, ঋণ করে যদি সম্পদ সৃষ্টি করা যায় তবে সেই ঋণ যথার্থ। ঋণের অর্থের বোঝার চেয়ে সম্পদের স্বল্পতা রাষ্ট্রযন্ত্রকে দুর্বল করে দেয়। আর সম্পদ সৃষ্টি মানেই বিনিয়োগের নতুন সম্ভাবনা। বিনিয়োগ বৃদ্ধি হলে কর্মসংস্থান তৈরি হবে এবং সম্পদ সৃষ্টির পথও প্রশস্থ হবে। অর্থনীতির এই চাকা সঠিকভাবে ঘোরাতে পারলেই বৃদ্ধি পায় জিডিপি (Gross Domestic Product)। সবারই এক কথা, জিডিপি বৃদ্ধিই সাফল্যের চাবিকাঠী । কেউ বাহবা কুড়ায় আর কেউ হাততালি দেয়। কিন্তু বাহবা আর হাততালির পেছনে কারও কান্না যে লুকিয়ে থাকতে পারে তা বেশির ভাগ সময়ই ধরা পড়ে না। এখানেই ধনতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মৌলিক দুর্বলতা। এই দুর্বলতা যাঁরা কাটিয়ে উঠতে পারেন তাঁরাই ধনতান্ত্রিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে সফল।
এবার আমি জাতীয় সংসদে পেশ করা ২০১০-১১ অর্থবছরের বাজেট নিয়ে আলোকপাত করতে চাই। এটি ঘাটতি বাজেট। আমেরিকা, জাপান বা ভারতের বাজেটেও ঘাটতি থাকে। ঘাটতি বাজেট তৈরি অন্যায় নয়। তবে ঘাটতি মেটাতে যে ঋণ ও তার সুদ আগামী প্রজন্মের জন্য সংকট তৈরি করে, তা পুর্নবিবেচনার দাবি রাখে। নয়া অর্থবছরে জাতীয় বাজেটে ঘাটতির পরিমাণ ৩৯ হাজার ২৩২ কোটি টাকা। আর অনুদানের পরিমাণ চার হাজার ৮০৯ কোটি টাকা। বাজেট ঘোষণা অনুযায়ী নয়া অর্থবছরে (২০১০-১১) সরকারের সাকল্যে রাজস্ব আয় হবে ৯৭ হাজার ৫৬৬ কোটি টাকা। ব্যয় হবে (যা বরাদ্দ আকারে ধরা হয়েছে) এক লাখ ৩২ হাজার ১৭০ কোটি টাকা।
এই এক লাখ ৩২ হাজার ১৭০ কোটি টাকার উৎস জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) করের মাধ্যমে ৭২ হাজার ৫৯০ কোটি টাকা, এনবিআর-বহির্ভূত আয় তিন হাজার ৪৫২ কোটি টাকা, করের বাইরে থেকে আয় ১৬ হাজার ৮০৫ কোটি টাকা, অনুদান চার হাজার ৮০৯ কোটি এবং দেশি-বিদেশি ঋণ ১০ হাজার ৮৩৪ কোটি টাকা। আয় থেকে রাজস্ব ব্যয় বাবদ মন্ত্রী ও সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা, সরকারি সম্পত্তির রক্ষণাবেক্ষণ এবং বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) জন্য ব্যয় হবে ৩৮ হাজার ৫০০ কোটি টাকা।
প্রশ্ন হল, এই আয়-ব্যয় আমাদের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি বা আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণে কতটুকু অবদান রাখতে পারবে ? বাঙালি সংস্কৃতিতে ঋণ করে ঘি খাওয়ার একটা প্রবাদ আছে। কিন্তু কী শারীরিক অবস্থায় ঋণ করে ঘি খেলে তা শারীরে বলবর্ধক হিসেবে কাজ করবে তা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অসুস্থ মানুষ বা দুর্বল অর্থনীতিকে শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে শুধু ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন বা ক্যাপসুল (যাকে অর্থ হিসেবে ধরছি) যথেষ্ট নয়। অসুস্থ মানুষটির জন্য প্রয়োজন সেবা-শুশ্রূষা, সঠিক সময়ে সঠিক ওষুধ এবং আস্তে আস্তে তাকে ভিটামিন দিয়ে সম্পূর্ণ সুস্থ করার পরই ঘি বা আমিষজাতীয় খাদ্য প্রদান করলে তা যেমন হজম হবে, তেমনি অসুস্থ রোগী সবল হয়ে নিজ ও পরিবারের সহায়ক শক্তি হিসেবে দাঁড়াবে। রাষ্ট্রীয় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে গতি সঞ্চার করার ক্ষেত্রে সমস্যার মূল কারণ উদ্ধার করেই সমাধানের পথ খোঁজা প্রয়োজন।
আজকের এই লেখায় আমি ঘাটতি বাজেটের মধ্যেই থাকতে চাই। ব্যয়ের আতিশয্যকে সামাল দিতে গিয়েই সরকারকে ধারদেনা করে বড় ঘাটতির বাজেট বানাতে হয়েছে। আর ঘাটতি বাজেট মোকাবিলার জন্যই সরকার ব্যাংকিং খাত ও জনসাধারণের অর্থ (জাতীয় সঞ্চয় প্রকল্প এবং অন্যান্য খাত) থেকে দেনা করছে বা করবে। সে জন্য ব্যাংকিং খাতে বিনিয়োগকারীদের অর্থ একদিকে যেমন সংকুচিত হয়ে পড়বে, অপরদিকে জনগণকেই আবার এই ঋণের সুদ বহন করতে হবে।
চলতি বছর সরকারকে ঘাটতি বাজেটের কারণে ব্যাংকসহ দেশ-বিদেশের ঋণের সুদের জন্য বাজেটের মোট বরাদ্দের প্রায় ১১ শতাংশ অর্থ দিতে হয়েছে। অর্থাৎ বাজেট বরাদ্দের এক লাখ ৩২ হাজার ১৮০ কোটি টাকার মধ্যে ১৪ হাজার ৭০৯ টাকা যাবে ঋণের সুদ হিসেবে।
যারা বাজেট প্রণয়ন বা বাস্তবায়ন করছেন তাঁরা কি বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবেন যে, গৃহীত ঋণের শুধু সুদ বাবদ এই ১৪ হাজার ৭০৯ কোটি টাকা যে ব্যয় করতে হবে তা মূল ঋণের সঙ্গে যোগ করে যে অর্থ বিনিয়োগ হবে তার চেয়ে আলোচ্য বছরে অধিক পরিমাণ সম্পদ তৈরি বা অর্জিত হবে? আমার মনে হয়, সুদের অর্থের হিসাব দূরের কথা, মূল অর্থের সঠিক হিসাবও অর্থ ব্যবহারকারী মন্ত্রণালয় দিতে পারবে না। তাহলে প্রধানমন্ত্রী বা অর্থমন্ত্রীকে যাঁরা বাংলাদেশের মতো অর্থনৈতিক অবকাঠামো বা পরিবেশে এই মুহূর্তে ধারদেনা করে বড় আকারের বাজেট প্রদানের পরামর্শ দিচ্ছেন তা আদৌ যুক্তিসংগত কি না তা ভেবে দেখতে হবে।
বিরাট ঘাটতি বাজেট করে সরকার যে ঋণ ব্যাংকিং খাত ও অন্যান্য দেশি-বিদেশি উৎস থেকে আনবে, তা কোথায় ব্যবহার করবে? দেশের কৃষি খাত, অন্যান্য উৎপাদনশীল খাতে ভর্তুকিতে ঋণের অর্থ ব্যবহারের প্রশ্ন আমি তুলছি না। কিন্তু অনুৎপাদনশীল খাতে ব্যবহার্য ঋণের অর্থ ব্যয় অবশ্যই কাঙ্ক্ষিত নয়।
ঘাটতি বাজেটের জন্য মোটা দাগে গৃহীত ঋণ যেভাবে ব্যবহার করা হয়:
১. সরকারি খাতে যেসব শিল্প ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান আছে এবং তার ব্যবস্থাপনার নামে করপোরেশনগুলো টিকিয়ে রাখা হয়েছে, তাদের বার্ষিক প্রায় ১৯ হাজার কোটি টাকা লোকসানের অর্থ জোগান দিতে হচ্ছে।
২. সরকার সম্প্রতি যে ‘রেন্টেড পাওয়ার প্লান্ট’ (ভাড়া করা বিদ্যুৎ প্রকল্প) দিয়ে জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ সরবরাহের চুক্তি করেছে, তাতে যে অর্থে এসব কোম্পানি থেকে বিদ্যুৎ কিনবে তা অর্ধেক বা তারও কম মূল্যে ভোক্তাকে সরবরাহ করতে হবে। এই খাতে নয়া অর্থবছরে সরকারকে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হবে।
৩. সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের নয়া বছরে যে বেতন-ভাতা বৃদ্ধি করা হয়েছে তার অর্থ জোগান এই ঘাটতি বাজেটের ঋণের অর্থ থেকে মেটাতে হবে।
৪. সরকারি খাতে ভোগবিলাস বাবদ যে অর্থ ব্যয় হবে তাও গৃহীত ঋণ থেকে জোগান দিতে হবে।
জার্মানিসহ ইউরোপ ও বিশ্বের অনেক দেশ তাদের বাজেটে ঘাটতি সংকুচিত করে অনেক ব্যয় ছেঁটে ফেলে শুধু ঋণ করে ঘি না খাওয়ার সিদ্ধান্তে। অনেক দেশ এবার তাদের বাজেটে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধি দূরের কথা, বিগত দিনে প্রদত্ত সুযোগ-সুবিধাও কেটে নিয়েছে, অর্থনীতিকে একটি শৃঙ্খলার মধ্যে আনার জন্য।
অপরদিকে আমরা এর বিপরীত কাজটিই করছি। হিসাব অনুযায়ী, যদি সরকারি খাতের অপচয় রোধ, দুর্নীতি বন্ধ এবং বিনিয়োগে বেসরকারি খাতকে উৎসাহ প্রদান ও এগিয়ে আনার পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়, তবে এই বড় ঘাটতি বাজেটের প্রয়োজন হবে না। ফলে বাজেটে ঋণের বোঝাও কমবে এবং একই সঙ্গে বিনিয়োগ তথা কর্মসংস্থানের নতুন সুযোগ তৈরি হবে।
আমরা একটি গরিব দেশ হয়েও দামি দামি গাড়ি, বাড়ি ও ভোগবিলাসসহ বিভিন্ন অনুৎপাদনশীল খাতে যে অর্থ বরাদ্দ দিচ্ছি তা আসে প্রবাসীদের কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা বা ব্যাংকসহ বিভিন্ন খাতের ঋণ থেকে। এই উদ্যোগ নৈতিক বা সাংবিধানিক কোনো দিক দিয়েই গ্রহণযোগ্য নয়। তাই বাজেটে প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রীর দ্রুত অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির আকাঙ্ক্ষার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েও ধার করে ঘি খাওয়ার কর্মসূচি দ্বিতীয়বার ভেবে দেখার অনুরোধ জানাব।
জাহিদুজ্জামান ফারুক: সম্পাদক, নয়া অর্থনীতি। বাংলাদেশ করসপনডেন্ট, কিয়োডো নিউজ সার্ভিস, জাপান।
No comments