চারদিক-বাঁশের বাঁশিই অন্নদাতা by আঞ্জুমান আরা
যদি তুমি মানুষটিকে না দেখে
শুধু তার প্রতিবন্ধিতাকে দেখো
কে তবে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী?
শুধু তার প্রতিবন্ধিতাকে দেখো
কে তবে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী?
যদি ন্যায়বিচারের জন্য
তোমার ভাইয়ের কান্না
তুমি শুনতে না পাও
কে তবে বধির?
যদি তুমি তোমার বোনের সাথে
না মিশে তাকে আলাদা করে রাখো
কে তবে মানসিক প্রতিবন্ধী?
সব মানুষের দাবি আদায়ে
তুমি যদি না দাঁড়াতে পারো
কে তবে শারীরিক প্রতিবন্ধী?
প্রতিবন্ধী ব্যক্তির প্রতি তোমার দৃষ্টিভঙ্গিই
আমাদের সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা
এবং তোমরাও।
মুগ্ধ হয়ে কবিতাটি শুনছেন জনা বিশেক শ্রোতা। এক শ্রোতা ভিড়ের ভেতর থেকে প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন, কার কবিতা এটি।
আইয়ুব মিষ্টি হেসে খানিকটা সময় নিয়ে উত্তরে বলেন, একজন জ্যামাইকান কবি টনি ওয়াং-এর লেখা হু ইজ ডিজঅ্যাবল। উপস্থিত শ্রোতাদের ভেতর গুঞ্জন শোনা যায়। কয়েক মুহূর্তের জন্য শ্রোতারা যেন জীবনের অন্য এক অর্থ পেয়ে যান। কিন্তু তা অকৃত্রিম বলে মনে হয় না। এই কৃত্রিম ভাবটি আইয়ুবের একদমই ভালো লাগে না। ভালো না লাগার কারণ, আইয়ুব নিজে শারীরিক প্রতিবন্ধী। বাঁশিতে সুর তুলতে তুলতে খানিকটা থমকে যান তিনি।
একজন শারীরিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তির কণ্ঠে সুমিষ্ট বাঁশির সুর শুনে যখন থমকে যান উপস্থিত শ্রোতারাও, তখন আইয়ুব আপন মনে পাঠ করেন ওপরের কবিতাটি। নিজের নাম স্বাক্ষর করতে পারেন আইয়ুব, কিন্তু পড়ালেখা জানেন না। তবে স্থানীয় প্রতিবন্ধী সংগঠনের মাধ্যমে জেনেছেন তাঁদের অধিকারের কথা, জেনেছেন প্রতিবন্ধিতা সমাজ বা দেশের বোঝা নয়। আর শুনে শুনে শিখেছেন ওপরের কবিতাটি।
নাটোর সদর উপজেলার হরিশপুরের রাজীবপুর গ্রামের অলি আহমেদ ও মিনারা বেগমের ছেলে শারীরিক প্রতিবন্ধী আইয়ুব আলীর (২২) সংসার চলে বাঁশি বাজিয়ে। জেলার বিভিন্ন মেলা, হাট ও রাস্তার মোড়ে বাঁশিতে সুর তুলে সুরপিয়াসী মানুষের মনে আনন্দ দেন আইয়ুব। আর সেই সুর শুনে শ্রোতারা খুশি হয়ে যে অর্থ দেন, তা দিয়েই চলে মা-বাবাসহ তাঁকে নিয়ে তিন সদস্যের সংসার। ছোট দুই বোনের বিয়ে হয়েছে। বাবা ক্ষুদ্র চাষি। নিজের বলতে আছে ভিটেসহ দেড় বিঘা জমি। প্রতিবন্ধী আইয়ুবকে নিয়ে এখন মা-বাবার সমস্যা। তবে আইয়ুব সমস্যা হয়ে থাকতে চাননি। তাই নিজের শারীরিক সামর্থ্যের ভেতর থেকেই বাঁশি বাজানো শিখেছেন। এই বাঁশিই এখন তার বেঁচে থাকার পথ।
কেমন করে এই শারীরিক সমস্যা হলো, জানতে চাইলে বড় করে নিঃশ্বাস নিয়ে আইয়ুব জানান, তিনি জন্ম-প্রতিবন্ধী নন। ভাগ্যের পরিহাসে আজ তিনি প্রতিবন্ধী। সেই শিশুকালের কথা, কত আর বয়স হবে তাঁর! দেড় বা দুই বছর হয়তো! ওই সময় একদিন তাঁর মা তাঁকে নিয়ে বাড়ির পাশের জমিতে শাক তুলতে যান। ছোট শিশু আইয়ুবকে স্থানীয় ছোট ছেলেদের খেলার জায়গার পাশে বসিয়ে রেখে মা শাক তোলা শেষ করেন। শাক তুলে বাড়ি ফেরার পথে শিশু আইয়ুবের প্রচণ্ড জ্বর আসে। বাড়িতে নিয়ে মা-বাবা কবিরাজ দেখালেও কয়েক দিন থেকে তাঁর গায়ে জ্বর আসা-যাওয়া করে। দু-তিন দিন স্থানীয় বিভিন্ন চিকিৎসক দেখানো হলেও তাঁর জ্বর নামে না। উপায়ান্তর না দেখে বিভিন্ন জায়গায় কবিরাজি চিকিৎসাও দিতে থাকেন তাঁর মা। অবশেষে কয়েক দিন পর তাঁর জ্বর ভালো হলেও তিনি পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াতে পারেন না। অনেক চেষ্টা করেও ছেলের দুই পায়ে দাঁড়ানোর শক্তি ফেরাতে পারেননি দরিদ্র বাবা-মা। রিকশা-ভ্যানের বিয়ারিং দিয়ে বানানো গাড়িতে চলাচল করতেন আইয়ুব। ২০০৫ সালে নাটোর হরিশপুর ব্যাপ্টিস্ট মিড মিশনস হাসপাতালের ফাদার তাঁকে দান করেন একটি হুইল চেয়ার। সেই হুইল চেয়ারই এখন তাঁর একমাত্র চলাচলের ভরসা।
কেমন করে বাঁশি বাজানো শেখা, জানতে চাইলে আইয়ুব অনেক পরিতৃপ্তি নিয়েই জানালেন তাঁর সেই স্বপ্নের কথা। ছোটবেলা থেকেই বাঁশির সুরের প্রতি ছিল সীমাহীন আকর্ষণ। তাই বিভিন্ন জনের কাছ থেকে বাঁশি ধার করে নিয়ে সুর তুলতেন। আর সেই সুর মুগ্ধ হয়ে শুনতেন পথচারীরা। সুরের প্রতি তাঁর আগ্রহ দেখে দুই বছর ধরে পাশের গ্রামের বংশীবাদক রাজ্জাক তাঁকে শেখাতে থাকেন বাঁশি বাজানোর কৌশল। রাজ্জাককে তিনি ওস্তাদ মানেন। ওস্তাদের কাছে শেখা বাঁশির রাগ-সুর বাজিয়ে এখন তিনি যা আয় করেন, তা দিয়ে চলে তাঁর তিন সদস্যের সংসার। আইয়ুব বলেন, ‘এই বাঁশিই আমার অন্নদাতা। বাঁশিতে সুর তুললে ভুলে যাই পৃথিবীর সব দুঃখকষ্ট। এই সুর নিয়েই পথ চলতে চাই। সুর নিয়েই বাঁচব! জীবনসঙ্গী চাই না।’ একটু হেসে আইয়ুব বলেন, ‘প্রতিবন্ধী জীবনে কেউ ভালোবেসে এগিয়ে এলে হয়তো বাঁশির মতোই তাঁকেও সুরের মায়ায় বাঁধব।’
মানুষ স্বপ্ন নিয়ে বাঁচে। আইয়ুবের মনেও স্বপ্ন আছে। হয়তো স্বপ্নের ডালপালাও আছে। রংও আছে। প্রতিবন্ধী হওয়ায় সেই স্বপ্নের ডালপালা মেলে না। তবু সুরকে গলায় নিয়ে আশায় বুক বেঁধে আছেন আইয়ুব। এই আশাই হয়তো তাঁকে পথ দেখাবে।
তোমার ভাইয়ের কান্না
তুমি শুনতে না পাও
কে তবে বধির?
যদি তুমি তোমার বোনের সাথে
না মিশে তাকে আলাদা করে রাখো
কে তবে মানসিক প্রতিবন্ধী?
সব মানুষের দাবি আদায়ে
তুমি যদি না দাঁড়াতে পারো
কে তবে শারীরিক প্রতিবন্ধী?
প্রতিবন্ধী ব্যক্তির প্রতি তোমার দৃষ্টিভঙ্গিই
আমাদের সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা
এবং তোমরাও।
মুগ্ধ হয়ে কবিতাটি শুনছেন জনা বিশেক শ্রোতা। এক শ্রোতা ভিড়ের ভেতর থেকে প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন, কার কবিতা এটি।
আইয়ুব মিষ্টি হেসে খানিকটা সময় নিয়ে উত্তরে বলেন, একজন জ্যামাইকান কবি টনি ওয়াং-এর লেখা হু ইজ ডিজঅ্যাবল। উপস্থিত শ্রোতাদের ভেতর গুঞ্জন শোনা যায়। কয়েক মুহূর্তের জন্য শ্রোতারা যেন জীবনের অন্য এক অর্থ পেয়ে যান। কিন্তু তা অকৃত্রিম বলে মনে হয় না। এই কৃত্রিম ভাবটি আইয়ুবের একদমই ভালো লাগে না। ভালো না লাগার কারণ, আইয়ুব নিজে শারীরিক প্রতিবন্ধী। বাঁশিতে সুর তুলতে তুলতে খানিকটা থমকে যান তিনি।
একজন শারীরিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তির কণ্ঠে সুমিষ্ট বাঁশির সুর শুনে যখন থমকে যান উপস্থিত শ্রোতারাও, তখন আইয়ুব আপন মনে পাঠ করেন ওপরের কবিতাটি। নিজের নাম স্বাক্ষর করতে পারেন আইয়ুব, কিন্তু পড়ালেখা জানেন না। তবে স্থানীয় প্রতিবন্ধী সংগঠনের মাধ্যমে জেনেছেন তাঁদের অধিকারের কথা, জেনেছেন প্রতিবন্ধিতা সমাজ বা দেশের বোঝা নয়। আর শুনে শুনে শিখেছেন ওপরের কবিতাটি।
নাটোর সদর উপজেলার হরিশপুরের রাজীবপুর গ্রামের অলি আহমেদ ও মিনারা বেগমের ছেলে শারীরিক প্রতিবন্ধী আইয়ুব আলীর (২২) সংসার চলে বাঁশি বাজিয়ে। জেলার বিভিন্ন মেলা, হাট ও রাস্তার মোড়ে বাঁশিতে সুর তুলে সুরপিয়াসী মানুষের মনে আনন্দ দেন আইয়ুব। আর সেই সুর শুনে শ্রোতারা খুশি হয়ে যে অর্থ দেন, তা দিয়েই চলে মা-বাবাসহ তাঁকে নিয়ে তিন সদস্যের সংসার। ছোট দুই বোনের বিয়ে হয়েছে। বাবা ক্ষুদ্র চাষি। নিজের বলতে আছে ভিটেসহ দেড় বিঘা জমি। প্রতিবন্ধী আইয়ুবকে নিয়ে এখন মা-বাবার সমস্যা। তবে আইয়ুব সমস্যা হয়ে থাকতে চাননি। তাই নিজের শারীরিক সামর্থ্যের ভেতর থেকেই বাঁশি বাজানো শিখেছেন। এই বাঁশিই এখন তার বেঁচে থাকার পথ।
কেমন করে এই শারীরিক সমস্যা হলো, জানতে চাইলে বড় করে নিঃশ্বাস নিয়ে আইয়ুব জানান, তিনি জন্ম-প্রতিবন্ধী নন। ভাগ্যের পরিহাসে আজ তিনি প্রতিবন্ধী। সেই শিশুকালের কথা, কত আর বয়স হবে তাঁর! দেড় বা দুই বছর হয়তো! ওই সময় একদিন তাঁর মা তাঁকে নিয়ে বাড়ির পাশের জমিতে শাক তুলতে যান। ছোট শিশু আইয়ুবকে স্থানীয় ছোট ছেলেদের খেলার জায়গার পাশে বসিয়ে রেখে মা শাক তোলা শেষ করেন। শাক তুলে বাড়ি ফেরার পথে শিশু আইয়ুবের প্রচণ্ড জ্বর আসে। বাড়িতে নিয়ে মা-বাবা কবিরাজ দেখালেও কয়েক দিন থেকে তাঁর গায়ে জ্বর আসা-যাওয়া করে। দু-তিন দিন স্থানীয় বিভিন্ন চিকিৎসক দেখানো হলেও তাঁর জ্বর নামে না। উপায়ান্তর না দেখে বিভিন্ন জায়গায় কবিরাজি চিকিৎসাও দিতে থাকেন তাঁর মা। অবশেষে কয়েক দিন পর তাঁর জ্বর ভালো হলেও তিনি পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াতে পারেন না। অনেক চেষ্টা করেও ছেলের দুই পায়ে দাঁড়ানোর শক্তি ফেরাতে পারেননি দরিদ্র বাবা-মা। রিকশা-ভ্যানের বিয়ারিং দিয়ে বানানো গাড়িতে চলাচল করতেন আইয়ুব। ২০০৫ সালে নাটোর হরিশপুর ব্যাপ্টিস্ট মিড মিশনস হাসপাতালের ফাদার তাঁকে দান করেন একটি হুইল চেয়ার। সেই হুইল চেয়ারই এখন তাঁর একমাত্র চলাচলের ভরসা।
কেমন করে বাঁশি বাজানো শেখা, জানতে চাইলে আইয়ুব অনেক পরিতৃপ্তি নিয়েই জানালেন তাঁর সেই স্বপ্নের কথা। ছোটবেলা থেকেই বাঁশির সুরের প্রতি ছিল সীমাহীন আকর্ষণ। তাই বিভিন্ন জনের কাছ থেকে বাঁশি ধার করে নিয়ে সুর তুলতেন। আর সেই সুর মুগ্ধ হয়ে শুনতেন পথচারীরা। সুরের প্রতি তাঁর আগ্রহ দেখে দুই বছর ধরে পাশের গ্রামের বংশীবাদক রাজ্জাক তাঁকে শেখাতে থাকেন বাঁশি বাজানোর কৌশল। রাজ্জাককে তিনি ওস্তাদ মানেন। ওস্তাদের কাছে শেখা বাঁশির রাগ-সুর বাজিয়ে এখন তিনি যা আয় করেন, তা দিয়ে চলে তাঁর তিন সদস্যের সংসার। আইয়ুব বলেন, ‘এই বাঁশিই আমার অন্নদাতা। বাঁশিতে সুর তুললে ভুলে যাই পৃথিবীর সব দুঃখকষ্ট। এই সুর নিয়েই পথ চলতে চাই। সুর নিয়েই বাঁচব! জীবনসঙ্গী চাই না।’ একটু হেসে আইয়ুব বলেন, ‘প্রতিবন্ধী জীবনে কেউ ভালোবেসে এগিয়ে এলে হয়তো বাঁশির মতোই তাঁকেও সুরের মায়ায় বাঁধব।’
মানুষ স্বপ্ন নিয়ে বাঁচে। আইয়ুবের মনেও স্বপ্ন আছে। হয়তো স্বপ্নের ডালপালাও আছে। রংও আছে। প্রতিবন্ধী হওয়ায় সেই স্বপ্নের ডালপালা মেলে না। তবু সুরকে গলায় নিয়ে আশায় বুক বেঁধে আছেন আইয়ুব। এই আশাই হয়তো তাঁকে পথ দেখাবে।
No comments