জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ-অতিরিক্ত জনসংখ্যা কি বোঝা নয়? by শিশির মোড়ল

প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেত্রী শেখ হাসিনা ২ জুন জাতীয় সংসদে বলেছেন, ‘বাংলাদেশের বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে আমি শক্তি মনে করি, বোঝা নয়। তাই জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে কত দূর পর্যন্ত যাব, তা আমাদের ভাবতে হবে। বিশ্বের অনেক দেশে যে অস্বাভাবিক হারে জনসংখ্যা, বিশেষ করে যুব জনগোষ্ঠী কমে যাচ্ছে, তা কাজে লাগানোর তাগিদ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী মন্তব্য করেছেন, ব্যক্তিগতভাবে আমি বাংলাদেশের জনসংখ্যাকে কোনো সমস্যা মনে করি না।’


প্রধানমন্ত্রীর এ বক্তব্য কতটা বাস্তবমুখী আর কতটা ইউটোপিয়ান, তা অবশ্যই আলোচনার দাবি রাখে। পূর্ববর্তী সরকারগুলো তো বটেই, বর্তমান সরকারের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির সঙ্গেও তাঁর এ বক্তব্য সংগতিপূর্ণ নয়। এতে এ কর্মসূচিতে নিয়োজিত সরকারি কর্মকর্তারা যেমন ভুল বার্তা পেতে পারেন, তেমনি তাঁরা ব্যর্থতা আড়াল করারও সুযোগ পাবেন।
অস্বীকার করার উপায় নেই, গণমাধ্যমে হাজারো বিষয়ের ভিড়ে জনসংখ্যার বিষয়টি আলাদা করে আর নজর কাড়ে না। মূল ধারার উন্নয়ন আলোচনায় জনসংখ্যার চেয়ে বেশি গুরুত্ব পায় দক্ষ জনশক্তি। কিন্তু দক্ষ জনশক্তি কীভাবে গড়ে তোলা হবে, কত দিনে তা সম্ভব হবে, সে সম্পর্কে কোনো দিকনির্দেশনা নেই।
জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে সরকারের একটি জাতীয় নীতি ও কর্মসূচি থাকলেও তা বাস্তবায়নের হার মন্থর। শরিক মৌলবাদী দলগুলোর বিরোধিতার কারণে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন জোট সরকার জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচিকে অগ্রাহ্য করেছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। এ অভিযোগ যে শুধু জনসংখ্যা বিশেষজ্ঞদের নয়, আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতারাও করতেন। তাঁরা কি আগের অবস্থান থেকে সরে এসেছেন? জোটের জনসংখ্যা-নীতিকেই মেনে নিচ্ছেন?
দেশের আর্থ-সামাজিক বাস্তবতা কী? বাংলাদেশ পৃথিবীর সর্বাধিক জনসংখ্যাধিক্য দেশ। প্রতি বর্গকিলোমিটারে বাস করে এক হাজার ১০০ মানুষ, যার তুলনা নগররাষ্ট্র সিঙ্গাপুর ছাড়া কোথাও পাওয়া যাবে না। সিঙ্গাপুরের লোকসংখ্যার প্রায় শতভাগ শিক্ষিত, প্রশিক্ষিত। বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ ক্ষুধা, দারিদ্র্য, অপুষ্টি, রোগব্যাধির শিকার। অতিরিক্ত জনসংখ্যা প্রাকৃতিক পরিবেশকে কেবল বিপন্নই করছে না, বাড়াচ্ছে সামাজিক অস্থিরতা ও অপরাধ। সম্প্রতি পুরান ঢাকার নিমতলীতে যে ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটল, তারও মূলে ছিল অতিরিক্ত জনসংখ্যা। অপ্রশস্ত সড়ক, ঘিঞ্জি গলি। একই স্থানে বাসাবাড়ি, চায়ের দোকান, কারখানা ও রাসায়নিক পদার্থের গুদাম। কোথাও এতটুকু ফাঁকা জায়গা নেই।
অতিরিক্ত জনসংখ্যার কারণে পরিবেশ বিপন্ন হচ্ছে, বনভূমি উজাড় হচ্ছে, নদী-নালা জলাশয় সব দখল হয়ে যাচ্ছে। কি গ্রাম, কি শহর—সবখানেই জনসংখ্যার চাপ বাড়ছে। স্বাধীনতার আগে যে ঢাকা শহরের লোকসংখ্যা ছিল ১০ লাখ, সেখানে আজ এক কোটি ৩০ লাখ লোকের বাস। সেই অনুপাতে শহরের আয়তন বাড়েনি। বাড়বে কীভাবে? মানুষের সংখ্যা যত বাড়ছে, শস্যজমি তত কমে যাচ্ছে। প্রতিদিন আড়াই হাজার নতুন মানুষ ঢাকা শহরে স্থায়ীভাবে যুক্ত হচ্ছে।
বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার পরপরই জনসংখ্যার সমস্যাকে দেশের অন্যতম প্রধান সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন। ১৯৭৫ সালে তিনি যে দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি ঘোষণা করেছিলেন, তাতেও জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছিল। ওই বছরের ২৬ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ভাষণ দিতে গিয়েও বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন: ‘একটা কথা ভুলে গেলে চলবে না যে প্রত্যেক বৎসর আমাদের ৩০ লক্ষ লোক বাড়ে। আমার জায়গা হল ৫৫ হাজার বর্গমাইল। যদি আমাদের প্রত্যেক বৎসর ৩০ লক্ষ লোক বাড়ে তাহলে ২৫-৩০ বৎসরে বাংলার কোন জমি থাকবে না হালচাষ করার জন্য। বাংলার মানুষ বাংলার মানুষের মাংস খাবে। সে জন্য আমাদের পপুলেশন কন্ট্রোল, ফ্যামিলি প্লানিং করতে হবে।’
বঙ্গবন্ধুর এই বক্তব্যে জনসংখ্যা সমস্যার ভয়াবহতা উপলব্ধি করা যায়। প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় (১৯৭৩—১৯৭৮) জনসংখ্যা সমস্যাকে এক নম্বর জাতীয় সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। ৩৫ বছর পর সেই সমস্যা আরও প্রকট হয়েছে।
যদিও জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ ঠিক এর বিপরীত ধারণাই দেয়। তিনি যে জনসংখ্যাকে সম্পদে পরিণত করতে চাইছেন, তার একটি চালচিত্রটা দেখা যাক। জাতিসংঘ অধিভুক্ত একটি সংস্থার পরিসংখ্যানমতে, বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি ছাড়িয়েছে। প্রতি ১১ সেকেন্ডে একটি নবজাতকের জন্ম হচ্ছে। প্রতিবছর ৩০ লাখ লোক যুক্ত হচ্ছে। এই জনঘনত্ব ভারতের তুলনায় চার গুণ, চীনের চেয়ে আট গুণ বেশি। ৩৩ শতাংশ মা কিশোরী এবং তাঁরা পুষ্টিহীন শিশুর জন্ম দেন। জনসংখ্যা ও স্বাস্থ্য জরিপ মতে, পাঁচ বছরের কম বয়সী ৪১ শতাংশ শিশুর ওজন কম। ৪৩ শতাংশ শিশু খর্বকায়। এরা কি জনসম্পদ? এদের দিয়ে কি দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলা সম্ভব? কখনোই নয়। দক্ষ জনশক্তির জন্য চাই সুস্থ ও সবল শিশু।
যে দেশে এখনো ৪০ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে, কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর অর্ধেক বেকার বা ছদ্ম বেকার , সে দেশে অতিরিক্ত জনসংখ্যা কখনোই জনশক্তিতে রূপান্তরিত হতে পারে না। শক্তিধর অর্থনীতির দেশ ভারত ও চীন যেখানে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি জোরদার করছে, সেখানে বাংলাদেশে এ কর্মসূচিকে অগ্রাহ্য করা বা ভিন্ন চিন্তা হবে আত্মহত্যার শামিল।
প্রধানমন্ত্রী বিদেশে দক্ষ যুব জনশক্তি পাঠানোর কথা বলেছেন। কতজনকে পাঠানো সম্ভব? বর্তমানে বছরে চার-সাড়ে চার লাখ লোক চাকরি নিয়ে বিদেশে যাওয়ার সুযোগ পায়। সেই সংখ্যা যদি দ্বিগুণও হয়, তাহলেও সমস্যার সমাধান হবে না। প্রতিবছর তো ৩০ লাখ মানুষ যুক্ত হচ্ছে। বাকিরা কোথায় যাবে? চাকরি না পেয়ে অনেকেই নানা রকম অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে পড়ছে। দারিদ্র্য নামের আজন্ম পাপ নিয়ে যারা পৃথিবীতে আসে, তারা কেবল পরিবার নয়, সমাজ আর রাষ্ট্রেরও বোঝা হয়ে পড়ে। বর্তমানে দেশে যে জনসংখ্যা আছে, তা স্থিতিশীল রাখতে জন-উর্বরতা বা নিট প্রজনন হার-১-এ (এনআরআর-১) সীমিত রাখতে হবে। বর্তমানে এই হার ২ দশমিক ৭।
প্রধানমন্ত্রী বাড়তি জনসংখ্যাকে সমস্যা মনে না করলেও বিশেষজ্ঞরা খুবই উদ্বিগ্ন। পরিকল্পনা কমিশনের জনসংখ্যা বিভাগের সাবেক প্রধান মোহাম্মদ এ মাবুদের মতে, বর্তমানে দেশে মাথাপিছু জমির পরিমাণ ১৪ ডেসিমেল। ৪০ বছর পর অর্থাৎ ২০৫০ সালে মাথাপিছু জমি কমে দাঁড়াবে আট ডেসিমেলে।
অধ্যাপক মাহফুজ চৌধুরী, যিনি জনসংখ্যা সমস্যা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করেছেন, তিনি বলেছেন, বাংলাদেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে যে ভয়াবহ পরিস্থিতি অপেক্ষা করছে, তার প্রতি এত দিন যথাযথ মনোযোগ দেওয়া হয়নি। কিন্তু সমস্যাকে অগ্রাহ্য বা পাশ কাটিয়ে গেলেই তা শেষ হয়ে যায় না। তাতে এই দারিদ্র্যপীড়িত দেশটির পরিস্থিতি হবে আরও ভয়াবহ।
জনসংখ্যার এই মাত্রাতিরিক্ত চাপ ব্যাপক প্রভাব ফেলছে সমাজ ও রাষ্ট্রে। আবাসন, পরিবহনসহ সব খাতে সংকট বাড়ছে। জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশে ঘটেছে বিপর্যয়। হাসপাতালগুলো উপচে পড়ার পরও অসংখ্য নারী-পুরুষ ও শিশু বিনা চিকিৎসায় মারা যাচ্ছে। অতিরিক্ত জনসংখ্যা বাড়িয়েছে শিক্ষাসংকটও। চরম দারিদ্র্যের কারণে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক শিশু স্কুলে যাওয়ারই সুযোগ পাচ্ছে না, শৈশবেই তারা ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করতে বাধ্য হয়।
যেসব দেশে যুব জনসংখ্যা কমে যাচ্ছে, সেসব দেশে দক্ষ জনশক্তি রপ্তানির কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী। তাঁর বক্তব্যে সদিচ্ছার প্রকাশ থাকলেও বাস্তবানুগ নয়। বর্তমানে প্রায় ৭০ লাখ বাংলাদেশি নাগরিক বিদেশে আছেন, তাঁরা সবাই ভালো আছেন, সে কথা হলফ করে বলা যাবে না। মধ্যপ্রাচ্যে কর্মরতদের বেশির ভাগ অদক্ষ। অনেকে মানবেতর জীবনযাপনে বাধ্য হচ্ছেন। কেউ কেউ আদম বেপারিদের খপ্পরে পড়ে সর্বস্বান্ত। প্রধানমন্ত্রী নিজ চোখেই সৌদি আরব ও মালয়েশিয়ার শ্রমিকদের দুরবস্থা দেখে এসেছেন।
তা ছাড়া আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারে শ্রমিকের চাহিদা আগামী ১০ বা ২০ বছরে কী দাঁড়াবে, তা কেউ বলতে পারছে না। সে-সম্পর্কিত কোনো তথ্যও সরকারের কাছে আছে বলে মনে হয় না। নিছক অনুমানের ওপর ভিত্তি করে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের মতো অতি আবশ্যকীয় সমস্যাটি পাশ কাটানো হবে অবিবেচনাপ্রসূত, অদূরদর্শী ও আত্মঘাতী।
প্রধানমন্ত্রী স্বীকার করুন আর না-ই করুন, জনসংখ্যা বৃদ্ধি রোধে এখনই কার্যকর ব্যবস্থা না নিতে পারলে, অদূরভবিষ্যতে মানুষের ভারেই বাংলাদেশ তলিয়ে যাবে, জলবায়ু পরিবর্তনে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ার জন্য অপেক্ষা করতে হবে না।
শিশির মোড়ল: সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.