সরল গরল-সংবিধান পুনর্মুদ্রণে বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্নীতি by মিজানুর রহমান খান

বিশ্বকাপ ক্রিকেটের জাল টিকিট উদ্ধারের চমক কাটতে না কাটতেই আমরা একটা তঞ্চকতাপূর্ণ সংবিধানও পেলাম। বাংলাদেশের সংবিধান পুনর্মুদ্রণের ক্ষেত্রে ভয়াবহ বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্নীতি হয়েছে। আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ এ পর্যন্ত ১১৬ অনুচ্ছেদ সম্পর্কে মুদ্রণপ্রমাদ স্বীকার করেন।


অবশ্য প্রথম আলোর প্রতিবেদক শুধু একটি বিষয়ে তাঁর মত জানতে চেয়েছিলেন। তবে আমাদের কাছে তাঁর বর্ণিত ‘মুদ্রণপ্রমাদ’ এর অর্থ হলো দুর্নীতি ও দুরভিসন্ধি যে ঘটেছে, সেটার একটা স্বীকৃতি। এখানে যে জাল-জালিয়াতি ঘটেছে, সেটা আমরা দালিলিকভাবে প্রমাণ দিতেও সক্ষম। এটা আসলে এমনই চরম অসততা, জাতির সঙ্গে যা বিশ্বাসঘাতকতার শামিল। শাসকগোষ্ঠীর কেউ কেউ সংবিধানকে খোলামকুচি মনে করে। আর সে কারণেই তাঁরা এমন অভাবনীয় দুষ্কর্ম করতে পারল। সংসদীয় বিশেষ কমিটি কিংবা যেসব বিশেষজ্ঞকে এর আগে কমিটিতে ডাকা হয়েছিল, তাঁরা এ বিষয়টি উপেক্ষা করতে পারেন না। আইন মন্ত্রণালয়সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি ও বিশেষ কমিটি উভয়ের উচিত হবে আইন মন্ত্রণালয়কে তলব করা।
বড় গরজ সুপ্রিম কোর্টের। কারণ তাঁদেরই জানা উচিত, তাঁরা এখন ‘ভীতি বা অনুগ্রহ, অনুরাগ বা বিরাগের বশবর্তী না হয়ে’ কোন সংবিধান ‘রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তা বিধান’ করছেন? পুনর্মুদ্রিত সংবিধানের আওতায় বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি দেশের পরবর্তী রাষ্ট্রপতিকে শপথ পড়ানোর অধিকার হারিয়েছেন।
আইনমন্ত্রী দাবি করেছেন মনের মাধুরী মিশিয়ে, তিনি ও তাঁর মন্ত্রণালয়ের লেজিসলেটিভ উইংয়ের নির্বোধ কিংবা ধুরন্ধর কর্মকর্তারা যে সংবিধান পুনর্মুদ্রণ করেছেন, সেটাই নাকি প্রজাতন্ত্রের কার্যকর সংবিধান। কিঞ্চিৎ স্বস্তি পেলাম, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ও আবদুল মতিন খসরু আমাদের জানাচ্ছেন যে পুনর্মুদ্রিত সংবিধানকে ‘খসড়া সংবিধান’ ধরে নিয়ে তাঁরা তাঁদের প্রতিবেদন তৈরি করবেন। তাহলে প্রশ্ন দাঁড়ায়, বাংলাদেশে কোন সংবিধানটি এখন বলবৎ? আমরা আইনমন্ত্রীর কথার ওপরই গুরুত্ব দেব। তাঁর সই অনুযায়ী, ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১১ থেকে পুনর্মুদ্রিত সংবিধানের প্রধান্য আমরা ধরে নেব।
বর্তমান প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক পঞ্চম সংশোধনীর মামলায় একটি ছক তৈরি করেছিলেন। তাতে কোন অনুচ্ছেদের পরিবর্তে কোন অনুচ্ছেদ বসবে, তা তিনি অর্থাৎ হাইকোর্ট বিভাগ নির্দিষ্ট করেন। সেখানে ছিল আটটি অনুচ্ছেদ ও প্রস্তাবনা বাহাত্তরের সংবিধানে যেমন ছিল, তেমনই পুনর্বহাল হবে। হাইকোর্ট আর সবকিছুই মার্জনা করেছিলেন। আপিল বিভাগ সব ক্ষেত্রে হাইকোর্টের সঙ্গে একমত হননি। কতিপয় ক্ষেত্রে তাঁরা মার্জনা করে দেওয়া বিষয় নিয়েও আলোচনা করেন। পরিবর্তন আনেন। এর ফল দাঁড়ায় এই যে হাইকোর্ট বিভাগের রায়ের অস্পষ্টতা আপিল বিভাগের রায়ে কিছু ক্ষেত্রে স্পষ্ট হয়েছে। আবার কিছু ক্ষেত্রে সেই অস্পষ্টতা ও দ্ব্যর্থকতা আরও প্রকট হয়। তদুপরি যে বিবেচনায় সংবিধানের কয়েক ডজন জায়গায় হাত দেওয়া হয়েছে, তার কোনো সুযুক্তি খাড়া করা যাবে না।
সংবিধান সংশোধনসংক্রান্ত বিশেষ কমিটিতে আইন মন্ত্রণালয়ের লেজিসলেটিভ ড্রাফটিং উইং একটি খসড়া পাঠিয়েছিল। এতে প্রায় ৪০টি অনুচ্ছেদ সংশোধনের একটা চিন্তা-ভাবনার প্রতিফলন আমরা দেখতে পেয়েছিলাম। বিশেষ কমিটি এ বিষয়ে কোনো ধরনের লিখিত অনুশীলন করেছে বলে আমাদের জানা নেই। আমরা বরং দেখলাম যে কমিটি ওই খসড়া আইন কমিশনে পাঠাল এবং আইন কমিশন অত্যন্ত দায়সারাভাবে এর উত্তর দিল। তখন আইন কমিশনের চেয়ারম্যান পদে ছিলেন স্বনামধন্য বিচারপতি মোহাম্মদ আবদুর রশীদ। তাঁর হাত দিয়ে ওই ধরনের একটি মুসাবিদা কী করে বেরুতে পারল, সেটা অনাদিকালের জন্য একটা প্রশ্নবোধক চিহ্ন হয়ে থাকবে। তাঁর পদত্যাগের সেটা অন্যতম কারণ হলে অবাক হব না। কারণ বিশেষ কমিটিতে তিনি আমন্ত্রিত ছিলেন। আইন কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে তিনি সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের সঙ্গে একাত্ম ছিলেন। তাঁদের মত ছিল, এভাবে ছাপানো ঠিক হবে না। যদিও ভিন্ন কারণ কিন্তু এখন তাঁরা বলতেই পারেন, তাঁদের মত বহাল থাকলে আমরা হয়তো জাল সংবিধান পেতাম না।
সরকারের লেজিসলেটিভ শাখার বুদ্ধিবৃত্তিক অসততা সম্পর্কে চার মাস আগে আমরা লিখলাম ‘উদ্ভট উটের পিঠে পঞ্চম সংশোধনী’। জিয়ার আমলে ‘উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ’ শীর্ষক কবিতা লিখেছিলেন কবি শামসুর রাহমান। তখন আমাদের সেই অনুভূতিটাই গ্রাস করেছিল। কারণ আমরা দেখেছিলাম, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পর্যন্ত সংবিধান যেভাবে ছিল, সেভাবে তারা তা পুনরুজ্জীবনের পরিকল্পনা করে। এখন আইন মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা তাই দাবি করতে পারেন যে তাঁরা তো লুকিয়ে করেননি। প্রস্তাবিত সংশোধনীর খসড়া সংসদীয় কমিটিতে দিয়েছেন। আমাদের জানা মতে, কথাটি আংশিক সত্য। এখানে আমাদের বক্তব্য দুটি। প্রথমত, বিশেষ কমিটি আইন মন্ত্রণালয়ের খসড়ার বিষয়ে কোনো মত না দিয়ে থাকলে কমিটিকে বলতে হবে, তারা কেন সেটা দেয়নি? দ্বিতীয়ত, ওই সময় তারা বিশেষ কমিটিতে যে ধরনের বিবরণী পাঠিয়েছিল, তার চেয়ে আরও বহু দূর তারা কেন গেল? এভাবে সংশোধনের ম্যান্ডেট তারা কোথা থেকে, কার কাছ থেকে নিল? পুনর্মুদ্রিত সংবিধানের প্রায় অর্ধশত স্থানে পরবির্তন আনা হয়েছে, যার সঙ্গে হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগের রায়ের মিল নেই। দেখে-শুনে মনে হচ্ছে, প্রত্যেকে ‘পছন্দমতো বেছে নিন’ সূত্র ব্যবহার করেছে। যখন যার যেটা মনে হয়েছে, সে সেটা বেছে নিয়েছে। হয়তো কেউ সদিচ্ছা নিয়েও করতে পারে। কিন্তু তাকে করুণা ছাড়া কোনো কৃতিত্ব দেওয়ার সুযোগ থাকবে কি?
সংসদীয় কমিটি ও আইন কমিশনে পাঠানো বিবরণীতে ছিল না; অথচ নতুন ছাপা হওয়া সংবিধানে যা দেখলাম, তার মধ্যে ১৯৭২ সালের দালাল আইন পুনর্বহাল অন্যতম। পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে ১৯৭৩ সালে হয়েছিল আন্তর্জাতিক অপরাধ আইন। আর দেশীয় যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে সর্বাগ্রে প্রণীত হলো ১৯৭২ সালের দালাল আইন। তখন সংসদ ও সংবিধান ছিল না। রাষ্ট্রপতি আদেশ দিয়ে করেছিলেন। পঞ্চম সংশোধনীতে তা লুপ্ত হলো। তিয়াত্তরের আইনের লক্ষ্য ছিল ১৯৫ জন পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীর বিচার। কিসিঞ্জারের ষড়যন্ত্রের কারণে আমরা সেটা পারিনি। এরপর গত নির্বাচনের পর আমরা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্রত নিলাম। তিয়াত্তরের আইনে মূল যুদ্ধাপরাধীদের সঙ্গে অক্সিলারি ফোর্স বা সহায়ক শক্তির সদস্যদেরও বিচারের ব্যবস্থা ছিল। শুনেছি, যুদ্ধাপরাধের দায়ে বর্তমানে যারা বন্দী আছেন, তাঁদের অন্যতম সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে আটকানো কঠিন হচ্ছে। কারণ প্রমাণ করতে হবে যে তিনি অক্সিলারি ফোর্সের সদস্য ছিলেন। কিন্তু সদস্য না থেকেও তিনি বা অন্য কারও প্রকৃত অপরাধ আরও ভয়ংকর হতে পারে। তাঁদের বিচার হবে তাহলে কী করে? সে কারণে ১৯৭২ সালের দালাল আইন জিন্দা করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিল। যদি সত্য হয় যে সেই ‘সদিচ্ছা’ থেকেই দালাল আইন পুনর্বহাল করা হয়েছে। আরও দুটি বিধান আনা হয়েছে, যাতে দালাল আইনে দণ্ডিত ব্যক্তিরা ভোটাধিকার পাবেন না। সংসদ সদস্য হতে পারবেন না। কেউ সাংসদ হয়ে গেলেও তাঁর সদস্যপদ বাতিল হবে। তাহলে বলব, ভুল শুধু ভুলের জন্ম দেয়। আর দ্বিতীয় ভুল আরও বড় বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। আমরা প্রকৃত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাই। বিচারের নামে হীন রাজনীতি চাই না। সে কারণে আমরা বলব, দালাল আইন জিন্দা করতে চাইলে পরিচ্ছন্ন হাতে আসুন। এখন যদি ওই আইন বহাল ধরে নিয়ে তার আওতায় কারও বিরুদ্ধে মামলা হয়, তাহলে সরকারের মুখ রক্ষা হলেও হতে পারে। কিন্তু তাতে জনস্বার্থ নতুন করে হুমকিগ্রস্ত হতে পারে। কারণ পুনর্মুদ্রিত সংবিধানের আওতায় দালাল আইনের প্রয়োগ করলে সেই আইন উচ্চ আদালতে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে পারে। আর সে ক্ষেত্রে প্রকৃত অপরাধীকে পার পেতে দেওয়ার জন্য বর্তমান সরকারকেই তার দায়দায়িত্ব নিতে হবে।
আমাদের সন্দেহ করার যথেষ্ট কারণ আছে যে সংকীর্ণ ও হঠকারী চিন্তা কাজ করেছে সংবিধান পুনর্মুদ্রণে। আদালতের কাঁধে বন্দুক রেখে সংবিধান পুনর্মুদ্রণ করে নেওয়ার মধ্যে রাজনৈতিক সততা এক আনা যদি বা থাকে, মনে হচ্ছে, বাকি পনেরো আনাই ছিল অসততা। এর আরেকটি অকাট্য প্রমাণ হলো ১১৬ অনুচ্ছেদে হাত দেওয়া। বিচার বিভাগ পৃথক্করণের পর থেকে আইন মন্ত্রণালয় নামের প্রশাসনযন্ত্রটি, যার পেছনে আছে সংস্থাপনের থাবা, তারা সুপ্রিম কোর্টে ফাইল পাঠানো মেনে নিতে পারেনি। অধস্তন আদালতের বিচারকদের বদলি ও নিয়ন্ত্রণভার সংস্থাপন মন্ত্রণালয় মেরেকুটে খাচ্ছিল। সেই ক্ষমতা তাদের হাত থেকে ফসকায়। এখানে আমরা মনে রাখব, বিচার বিভাগ পৃথক্করণ যাতে না হয়, সে জন্য শফিক আহমেদ ও মওদুদ আহমদরা ঐক্যবদ্ধ ছিলেন এবং এখনো আছেন। সে কারণে ১১৬ অনুচ্ছেদ থেকে ধোঁকাবাজির মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শ কথাটি তুলে নেওয়া কোনো কাকতালীয় বিষয় নয়। আপিল বিভাগ নির্দিষ্টভাবে শুধু ১১৬ অনুচ্ছেদটিকেই অনতিবিলম্বে সংশোধন করতে বলেছিলেন। এবং তাঁরা নির্দিষ্ট করে বাহাত্তরের সংবিধানেই ফিরে যেতে বলেছিলেন। তার চেয়েও বড় কথা, আওয়ামী লীগ এবং তাদের সমগ্র প্রশাসনযন্ত্র গোটা জাতিকে তেমনই কোরাস শোনাচ্ছে—চলো চলো বাহাত্তরে চলো। তখন তারা প্রতারণাপূর্ণ উপায়ে আমাদের পঁচাত্তরের দিকে নিয়ে গেছে। জ্বালিয়েছে চতুর্থ সংশোধনীর পিদিম। আইনমন্ত্রী ১৯ ফেব্রুয়ারি প্রথম আলোকে বলেন, ১১৬ অনুচ্ছেদে মুদ্রণপ্রমাদ ঘটেছে। গতকাল সেই অসত্য কথন প্রথম আলোয় বিস্ময়চিহ্ন দিয়ে ছাপা হয়েছে।
গত ১১ অক্টোবর এই কলামে ‘উদ্ভট উটের পিঠে পঞ্চম সংশোধনী’ শীর্ষক লেখায় লিখেছিলাম, ‘বিচার বিভাগের স্বাধীনতা বিনাশে কি কোনো নিপুণ হাত সক্রিয় হয়ে উঠেছে?’ বলেছিলাম, বাজিকরেরা যেন সংবিধান নিয়ে বাজি না ধরে। কিন্তু তা-ই হলো। আপাতত সংবিধানবাজিরই জিত হলো। সংবিধান নিয়ে ফতোয়াবাজরা কল্কে পেল।
এই কলামে তখন আরও লেখা হয়েছিল, ‘পঞ্চম সংশোধনীর মূল রায় প্রণেতা এখন প্রধান বিচারপতি। তাঁর রায় বিকৃত করা হলে, ভিন্ন উদ্দেশ্যে ব্যবহারে চেষ্টা করা হলে তা শুধু বাড়তি জটিলতাই ডেকে আনবে। সরকার কিংবা সংসদ যদি সংবিধানে পরিবর্তন আনতে চায়, তবে তাকে সামনের দরজা দিয়ে তা করতে হবে। আদালতের কাঁধে বন্দুক রেখে নয়।’ এখন আমরা দেখলাম, ঠিক সেই কাজটিই করা হয়েছে। এর চেয়ে নিষ্ঠুর রসিকতা কে কবে শুনেছে আর শুনবে যে সুপ্রিম কোর্ট এমন রায় দিয়েছেন, যাতে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ধুলায় মিশে যায়? আইন মন্ত্রণালয় কার্যত প্রকারান্তরে মাসদার হোসেন মামলার নন্দিত রায় ধ্বংস করছে। কারণ পুনর্মুদ্রিত সংবিধান মানে অধস্তন আদালতের নিয়ন্ত্রণ এবং শৃঙ্খলা বিধানে প্রধানমন্ত্রীর নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা। গত অক্টোবরে আইনমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেছিলাম। তিনি আমাকে বারংবার বলেছিলেন, ‘আমরা এখনো চূড়ান্ত কিছু করিনি।’ এখন সংবিধান পুনর্মুদ্রণের পর সংসদীয় বিশেষ কমিটি নতুন সুর ধরেছে। আমরা এখনো চূড়ান্ত করিনি। ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের কৌতুক মনে পড়ছে। চোরটা যখন ঘরে ঢুকল, তখন টের পেয়েও গৃহস্থ ভাবছে, দেখি না ব্যাটা কী করে।
আমরা অনুমান করে নেব, পুনর্মুদ্রিত সংবিধানের কপি সুপ্রিম কোর্টের কাছে যাবে। ৫০০ কপির কিছু কপি সুপ্রিম কোর্টে যাবে না, তা হতে পারে না। বিশেষ করে আইনমন্ত্রীর প্রমাদসংক্রান্ত বক্তব্যের পর সুপ্রিম কোর্ট তা আমলে না নিয়ে পারবেন না। তাই আপিল বিভাগের কাছ থেকে জনগণ পঞ্চম সংশোধনী মামলার রায় পরবর্তী পুনর্মুদ্রিত সংবিধান বিষয়ে সুয়োমোটো উদ্যোগ আশা করতে পারে। আসলে শুধু আপিল বিভাগের সঙ্গে প্রতারণার জন্যই নয়, ধর্মসংক্রান্ত বিধান এবং সে বিষয়ে সংসদনেত্রী তথা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্যের কারণেও পুনর্মুদ্রিত সংবিধানের কার্যকারিতা স্থগিত করা দরকার। প্রধানমন্ত্রী এর আগে বলেছিলেন, কোনো দল নিষিদ্ধ হবে না। সংবিধানের ১২ অনুচ্ছেদের কারণে নয়, ৩৮ অনুচ্ছেদের শর্তাংশের কারণে যেকোনো ধর্মের নামে বাংলাদেশে যেখানে যত সমিতি, সংঘ বা দল রয়েছে, তারা বেঁচে থাকার অধিকার হারিয়েছে। জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ হয়ে গেছে। এখন কথা হলো, এটা গণতান্ত্রিক কি না। সাম্প্রদায়িক রাজনীদির বিষদাঁত ভাঙতে ৩৮ অনুচ্ছেদ বর্তমানকালে অপরিহার্য কি না, সেটা ভিন্ন তর্ক। বিসমিল্লাহ, ধর্মনিরপেক্ষতা ও রাষ্ট্রধর্ম রাখার যে অসামঞ্জস্য সেটা সহনীয়, কিন্তু ৩৮ অনুচ্ছেদ বহাল রাখা এবং ধর্মীয় সংগঠনের তৎপরতা চলতে দেওয়ার মধ্যে যে সংঘাত, তা সহনীয় নয়। আইনের মানদণ্ডে উপেক্ষণীয় নয়। মুহূর্তকালের জন্যও নয়।
সংবিধান প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন। এই আইনে একটি বিষয় নিষিদ্ধ থাকবে অথচ তথাকথিত রাজনৈতিক বাস্তবতায় তা মান্য করা সম্ভব হবে না, সে রকম একটা ব্যবস্থা চলতে দেওয়া যায় না। কারণ তার পরিণতি ভয়ংকর হতে বাধ্য। নাগরিকদের মধ্যে এবং রাষ্ট্রযন্ত্রে যে যেখানেই আছেন, তাঁদের মধ্যে এই বোধ তৈরি হবে যে সংবিধান লঙ্ঘিত হতে থাকলে কোনো সমস্যা নেই। পুনর্মুদ্রিত সংবিধান তো একটি মামুলি পুস্তক প্রকাশনা হতে পারে না। একুশের বইমেলায় প্রতিদিন অনেক মুড়িমুড়কির মোড়ক উন্মোচিত হয়। এখন পুনর্মুদ্রিত সংবিধানের মোড়ক উন্মোচন করা থেকে বিরত থাকলেই তো নিশ্চিন্ত থাকা যাবে না।
প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন সর্বোচ্চ পবিত্র আমানত নিয়ে সব রকম খামখেয়ালি অবিলম্বে বন্ধ হোক। অন্যথায় বাংলাদেশ রাষ্ট্র একটি অভাবনীয় নৈরাজ্যের ঘূর্ণাবর্তে নিক্ষিপ্ত হতে পারে। নাগরিকেরা আইন অমান্যে আসক্ত হবে। তারা কখনো বলবে, সংবিধানে নিষিদ্ধ থাকলেই কি, ওসব অমান্য করার দৃষ্টান্ত তো রাষ্ট্রই তৈরি করেছে। সুতরাং মাঝেমধ্যে বা সুবিধা অনুযায়ী এটা অমান্য করাটা রেওয়াজ হিসেবে চালিয়ে নিলে দোষ কী? সে কারণে আমাদের প্রস্তাব হচ্ছে, ১০ ফেব্রুয়ারি পুনর্মুদ্রিত সংবিধানের কার্যকারিতা অন্তর্বর্তীকালীন মেয়াদে স্থগিত রাখা হোক। তবে এ জন্য নির্বাহী বিভাগের কোনো নির্দেশ এখন সম্ভবত বৈধ হবে না। পুনর্মুদ্রণের মধ্য দিয়ে তাদের সেই এখতিয়ার হয়তো লুপ্ত হয়েছে। এটা করতে হলে এখন আপিল বিভাগে যেতে হবে। সেখানে গিয়ে বলতে হবে, আমরা আদালতের রায় মেনেছি কিন্তু এটা বাস্তবায়নের (বিশেষ করে ৩৮ অনুচ্ছেদ) জন্য আমাদের সময় লাগবে। বল গড়িয়ে এখন আবার পল্টন প্রান্তে, সুপ্রিম কোর্টে।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.