এই দিনে-কী করে এল বাংলা ভাষা by শিখ্তী সানী
আমরা বাংলায় কথা বলি, বাংলায় গান গাই। আমাদের প্রতিবাদের ভাষা যেমন বাংলা, তেমনি উৎসাহ-উদ্দীপনায় আমরা চিৎকার করে উঠি এই বাংলায়। আজ রক্তঝরা অমর একুশে। মহান শহীদ দিবস। আজ আমাদের গর্বের দিন, মায়ের ভাষার ঋণ শোধবার দিন। অনেক প্রাপ্তি ও অনেক বেদনার দিন আজ।
বাঙালি সত্তায় আজ তাই জেগে উঠবে অপরিমেয় প্রাণচাঞ্চল্য, ধ্বনিত হবে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি’। ভাষার জন্য আমাদের এ আত্মত্যাগ ৫০ হাজার বর্গমাইলের বাংলাদেশের সীমা ছাড়িয়ে আজ বিশ্বের দরবারে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। মাতৃভাষার প্রতি আমাদের অকৃত্রিম ভালোবাসায় আমাদের সঙ্গে সিক্ত হবে বিশ্ববাসী। ২৮টি দেশের সমর্থনে এবং বাংলাদেশের প্রস্তাব অনুসারে ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক সংস্থা ইউনেসকো। সে সুবাদেই ২০০০ সাল থেকে একুশে ফেব্রুয়ারি মর্যাদা পেয়েছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে।
ভাষা নিয়ত বিবর্তনশীল। বাংলা ভাষাও নানা ভাষার ভিড়ে খুঁজে নিয়েছে নিজের বৈশিষ্ট্য ও ভাষারীতি। ধারণা করা হয়, ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা থেকেই বাংলা ভাষার উদ্ভব ও বিবর্তন। এই ভাষা খ্রিষ্টপূর্ব প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে ইউরোপ, ইরান ও ভারতের বিস্তৃত অঞ্চলে বিকাশ লাভ করে। এই ভাষায় ভাষাভাষীরা আগে কাস্পিয়ন সাগরের উপকূলে বসবাস করত। ধীরে ধীরে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে জীবিকা নির্বাহের জন্য অভিবাসনের প্রয়োজন পড়ে যায়। ইউরোপের পশ্চিম অঞ্চল থেকে ধীরে ধীরে একটি দল প্রথমে ইরানে প্রবেশ করে। সেখান থেকে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত দিয়ে পাকিস্তানে প্রবেশ করে। তারা ভারতের উত্তরাঞ্চলে বসবাসের পর সংখ্যা বৃদ্ধির কারণে বিভিন্ন সময় ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। যাযাবর এ জনগোষ্ঠী এই উর্বর উত্তর ভারতীয় অঞ্চলে স্থায়ী বসবাসের সিদ্ধান্ত নেয়। তাতে বসবাসরত অনার্য সম্প্রদায়ের সঙ্গে সংঘর্ষে অনার্য ভাষাগোষ্ঠী পরাজিত হয়। তারা চলে যায় দক্ষিণাঞ্চলে। ইন্দো-ইউরোপীয় এই ভাষাভাষীরা এভাবেই ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চল, ইরান ও ভারতে বসবাস গড়ে তোলে। ফলে মূল ভাষাগোষ্ঠীর সঙ্গে তাদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এতে মূল ভাষা ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চল, ইরান ও ভারতে স্থানীয় ভাষা ও অন্যান্য প্রভাবকের উপস্থিতিতে পরিবর্তিত হয়ে যায়। মূল ভাষা আঞ্চলিক ভাষায় রূপ লাভ করে।
ইন্দো-ইউরোপীয় এ ভাষাকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়—কেন্তম ও শতম। শতম বাল্টো-স্লাভীয়, আর্মেনীয়, ইন্দো-ইরানীয়—এ তিনটি ভাষায় বিকাশ লাভ করে। ইন্দো-ইরানীয় আবার ইরানীয় ও ভারতীয় ভাগে রূপ লাভ করে। ভারতীয় ভাষাকে দেখা গেছে, বৈদিক সংস্কৃত ও প্রাকৃত ভাষায় বিবর্তিত হতে। প্রাকৃত ভাষা থেকেই পূর্ণাঙ্গ ভাষারীতিতে আবির্ভূত হয় বাংলা, হিন্দি, অসমীয়, গুজরাটি, মারাঠি, পাঞ্জাবি। প্রাকৃত ভাষা থেকে ভাষা হিসেবে বাংলার উদ্ভবের ক্ষেত্রেও ভাষাতত্ত্ববিদদের মধ্যে দুটি মত বিদ্যমান। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে একদল ভাষাবিদ মনে করেন, মাগধী প্রাকৃত থেকেই বাংলা ভাষার জন্ম। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহসহ অন্য দলের ভাষাবিদদের ধারণা, গৌড় প্রাকৃত থেকে গৌড় অপভ্রংশ এবং এই গৌড় অপভ্রংশ থেকেই বাংলার জন্ম। আমাদের বাংলা ভাষার জন্ম। প্রাচীন বাংলার স্থিতিকাল ৬৫০ থেকে ১২০০ খ্রিষ্টাব্দ, মধ্য বাংলার সময়কাল ১২০০-১৮০০ খ্রিষ্টাব্দ ও আধুনিক বাংলার সূত্রপাত ১৮০০ থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত। আধুনিক বাংলা ভাষা সাধু, চলিত ও আঞ্চলিক—এই ত্রয়ী রীতিতে আবর্তিত হয়ে আসছে। আমাদের এ উপকূলে এভাবেই বাংলা ভাষা তার বিকাশ লাভ করেছে। মাঝে বিশাল একটি সময়জুড়ে ভিন্ন অঞ্চলের শাসকগোষ্ঠী ও অভিবাসনের প্রভাবে এ ভাষায় এসেছে নানা পরিবর্তন। ব্রিটিশ ভারত ভেঙে পাকিস্তান হওয়ার কয়েক বছরের মধ্যেই পূর্ব বাংলাবাসী তাদের আত্মপরিচয় ও স্বাতন্ত্র্যবোধ রক্ষার প্রয়োজন অনুভব করে। প্রথমেই আঘাত আসে আমাদের প্রাণের ভাষা বাংলার ওপর। মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠায় পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠীর অবজ্ঞা ও অবহেলার প্রতিবাদে ফেটে পড়ে এ অঞ্চলের ভাষাভাষীরা। ১৯৪৮ সালের ২১ ও ২৩ মার্চ ঢাকায় পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর উর্দু ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা বানানোর ভাষণ থেকে শুরু হয় মায়ের ভাষার সম্মান আনতে আমাদের আন্দোলন। ঘনিয়ে আসে ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই আমতলায় ১৪৪ ধারা ভেঙে সমবেত হয় বিক্ষুব্ধ ছাত্ররা। এগিয়ে যায় ছাত্ররা। শক্ত মুঠো, প্রতিবাদের স্লোগান আর দৃঢ়প্রতিজ্ঞা নিয়ে কণ্ঠে ফেটে পড়ে, ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’। পশ্চিমা শাসকদের হস্তক্ষেপে পুলিশ বর্বর আঘাত হানে ছাত্রদের ওপর। গুলিতে শহীদ হন রফিক, বরকত, জব্বার, সালামসহ নাম না জানা শহীদেরা। কিন্তু থামিয়ে রাখা যায়নি ছাত্রদের। মাথা নত করতেই হয় শাসকগোষ্ঠীকে।
অনেক রক্ত, অনেক আত্মত্যাগে অর্জিত আমাদের বাংলা ভাষা। আমাদের মায়ের ভাষা। আধুনিকতা, বিশ্বায়ন ও পরিবর্তনের জোয়ারে হারিয়ে যাচ্ছে ভাষা। ভাষা বাঁচিয়ে রাখে সেই ভাষার মানুষগুলো। তাই বাংলা ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব আমাদেরই। আমাদেরই রক্ষা করতে হবে বাংলা ভাষার ক্ষয়কে, আমরা কি সেই দায়িত্ব গ্রহণ করব না? আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে সবাইকে তাদের মাতৃভাষা রক্ষার দায়িত্ব গ্রহণে আহ্বান রইল। বিনম্র শ্রদ্ধা রইল সব ভাষাশহীদের প্রতি।
ভাষা নিয়ত বিবর্তনশীল। বাংলা ভাষাও নানা ভাষার ভিড়ে খুঁজে নিয়েছে নিজের বৈশিষ্ট্য ও ভাষারীতি। ধারণা করা হয়, ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা থেকেই বাংলা ভাষার উদ্ভব ও বিবর্তন। এই ভাষা খ্রিষ্টপূর্ব প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে ইউরোপ, ইরান ও ভারতের বিস্তৃত অঞ্চলে বিকাশ লাভ করে। এই ভাষায় ভাষাভাষীরা আগে কাস্পিয়ন সাগরের উপকূলে বসবাস করত। ধীরে ধীরে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে জীবিকা নির্বাহের জন্য অভিবাসনের প্রয়োজন পড়ে যায়। ইউরোপের পশ্চিম অঞ্চল থেকে ধীরে ধীরে একটি দল প্রথমে ইরানে প্রবেশ করে। সেখান থেকে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত দিয়ে পাকিস্তানে প্রবেশ করে। তারা ভারতের উত্তরাঞ্চলে বসবাসের পর সংখ্যা বৃদ্ধির কারণে বিভিন্ন সময় ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। যাযাবর এ জনগোষ্ঠী এই উর্বর উত্তর ভারতীয় অঞ্চলে স্থায়ী বসবাসের সিদ্ধান্ত নেয়। তাতে বসবাসরত অনার্য সম্প্রদায়ের সঙ্গে সংঘর্ষে অনার্য ভাষাগোষ্ঠী পরাজিত হয়। তারা চলে যায় দক্ষিণাঞ্চলে। ইন্দো-ইউরোপীয় এই ভাষাভাষীরা এভাবেই ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চল, ইরান ও ভারতে বসবাস গড়ে তোলে। ফলে মূল ভাষাগোষ্ঠীর সঙ্গে তাদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এতে মূল ভাষা ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চল, ইরান ও ভারতে স্থানীয় ভাষা ও অন্যান্য প্রভাবকের উপস্থিতিতে পরিবর্তিত হয়ে যায়। মূল ভাষা আঞ্চলিক ভাষায় রূপ লাভ করে।
ইন্দো-ইউরোপীয় এ ভাষাকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়—কেন্তম ও শতম। শতম বাল্টো-স্লাভীয়, আর্মেনীয়, ইন্দো-ইরানীয়—এ তিনটি ভাষায় বিকাশ লাভ করে। ইন্দো-ইরানীয় আবার ইরানীয় ও ভারতীয় ভাগে রূপ লাভ করে। ভারতীয় ভাষাকে দেখা গেছে, বৈদিক সংস্কৃত ও প্রাকৃত ভাষায় বিবর্তিত হতে। প্রাকৃত ভাষা থেকেই পূর্ণাঙ্গ ভাষারীতিতে আবির্ভূত হয় বাংলা, হিন্দি, অসমীয়, গুজরাটি, মারাঠি, পাঞ্জাবি। প্রাকৃত ভাষা থেকে ভাষা হিসেবে বাংলার উদ্ভবের ক্ষেত্রেও ভাষাতত্ত্ববিদদের মধ্যে দুটি মত বিদ্যমান। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে একদল ভাষাবিদ মনে করেন, মাগধী প্রাকৃত থেকেই বাংলা ভাষার জন্ম। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহসহ অন্য দলের ভাষাবিদদের ধারণা, গৌড় প্রাকৃত থেকে গৌড় অপভ্রংশ এবং এই গৌড় অপভ্রংশ থেকেই বাংলার জন্ম। আমাদের বাংলা ভাষার জন্ম। প্রাচীন বাংলার স্থিতিকাল ৬৫০ থেকে ১২০০ খ্রিষ্টাব্দ, মধ্য বাংলার সময়কাল ১২০০-১৮০০ খ্রিষ্টাব্দ ও আধুনিক বাংলার সূত্রপাত ১৮০০ থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত। আধুনিক বাংলা ভাষা সাধু, চলিত ও আঞ্চলিক—এই ত্রয়ী রীতিতে আবর্তিত হয়ে আসছে। আমাদের এ উপকূলে এভাবেই বাংলা ভাষা তার বিকাশ লাভ করেছে। মাঝে বিশাল একটি সময়জুড়ে ভিন্ন অঞ্চলের শাসকগোষ্ঠী ও অভিবাসনের প্রভাবে এ ভাষায় এসেছে নানা পরিবর্তন। ব্রিটিশ ভারত ভেঙে পাকিস্তান হওয়ার কয়েক বছরের মধ্যেই পূর্ব বাংলাবাসী তাদের আত্মপরিচয় ও স্বাতন্ত্র্যবোধ রক্ষার প্রয়োজন অনুভব করে। প্রথমেই আঘাত আসে আমাদের প্রাণের ভাষা বাংলার ওপর। মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠায় পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠীর অবজ্ঞা ও অবহেলার প্রতিবাদে ফেটে পড়ে এ অঞ্চলের ভাষাভাষীরা। ১৯৪৮ সালের ২১ ও ২৩ মার্চ ঢাকায় পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর উর্দু ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা বানানোর ভাষণ থেকে শুরু হয় মায়ের ভাষার সম্মান আনতে আমাদের আন্দোলন। ঘনিয়ে আসে ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই আমতলায় ১৪৪ ধারা ভেঙে সমবেত হয় বিক্ষুব্ধ ছাত্ররা। এগিয়ে যায় ছাত্ররা। শক্ত মুঠো, প্রতিবাদের স্লোগান আর দৃঢ়প্রতিজ্ঞা নিয়ে কণ্ঠে ফেটে পড়ে, ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’। পশ্চিমা শাসকদের হস্তক্ষেপে পুলিশ বর্বর আঘাত হানে ছাত্রদের ওপর। গুলিতে শহীদ হন রফিক, বরকত, জব্বার, সালামসহ নাম না জানা শহীদেরা। কিন্তু থামিয়ে রাখা যায়নি ছাত্রদের। মাথা নত করতেই হয় শাসকগোষ্ঠীকে।
অনেক রক্ত, অনেক আত্মত্যাগে অর্জিত আমাদের বাংলা ভাষা। আমাদের মায়ের ভাষা। আধুনিকতা, বিশ্বায়ন ও পরিবর্তনের জোয়ারে হারিয়ে যাচ্ছে ভাষা। ভাষা বাঁচিয়ে রাখে সেই ভাষার মানুষগুলো। তাই বাংলা ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব আমাদেরই। আমাদেরই রক্ষা করতে হবে বাংলা ভাষার ক্ষয়কে, আমরা কি সেই দায়িত্ব গ্রহণ করব না? আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে সবাইকে তাদের মাতৃভাষা রক্ষার দায়িত্ব গ্রহণে আহ্বান রইল। বিনম্র শ্রদ্ধা রইল সব ভাষাশহীদের প্রতি।
No comments