টানা হরতালে গতিহীন অর্থনীতি-ব্যবসা স্থবির কমেছে আয় বেড়েছে দাম by রাজীব আহমেদ

মিরপুরের কাজীপাড়া ও শেওড়াপাড়া এলাকায় ফেরি করে সবজি বিক্রি করেন খলিলুর রহমান। হরতালের দুই দিন তিনি সবজি বিক্রি বন্ধ রেখেছেন। এক দিনে তাঁর আয় হতো ৫০০-৬০০ টাকা। দুই দিনের হরতালে তিনি প্রায় এক হাজার ২০০ টাকা আয় থেকে বঞ্চিত হয়েছেন।


রাস্তার বিক্রেতা খলিলুর রহমান যেমন কোনো আয় করতে পারেননি, তেমনি নিউ মার্কেটের দোকান-মালিকরাও বঞ্চিত হয়েছেন দুই দিনের আয় থেকে। তাঁদের ক্ষতির অঙ্ক অনেক বড়।
আয় না হওয়ায় খলিলুর রহমান দুই দিন খরচ কম করেছেন। নিউ মার্কেট বন্ধ থাকায় আশপাশের ব্যাংকগুলোয় আমানত কমে গেছে। এভাবে ঢাকাসহ দেশের বিরাটসংখ্যক মানুষ আয়বঞ্চিত থেকে খরচ কম করায় এবং বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে কোনো লেনদেন না হওয়ায় হরতালের পরস্পর সংযুক্ত প্রভাবে (চেইন ইফেক্ট) দুই দিন অর্থনীতি ছিল গতিহীন, আজও সেটা থাকবে। শুধু শহর এলাকার অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমজীবী মানুষের আয় কমে যাওয়া নয়, সাধারণের ওপর হরতালের সরাসরি প্রভাব পড়েছে পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায়। ঢাকার বাজারে পণ্যের সরবরাহ কমে গেছে, যার কারণে দামও বেড়ে গেছে।
এক দিনের হরতালে কী পরিমাণ ক্ষতি হয়, এর সাম্প্রতিক কোনো গবেষণা নেই। ২০০৫ সালে জাতিসংঘের সংস্থা ইউএনডিপি এক গবেষণায় জানায়, বাংলাদেশে এক দিনের হরতালে ৫৫৪ কোটি টাকার ক্ষতি হয়। তবে সংস্থাটির মতে, দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি অনেক বেশি। আর্থিক ক্ষতি ছাড়াও হরতাল দেশের নেতিবাচক ভাবমূর্তি গড়ে তোলে। বৈদেশিক বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হয়। ইউএনডিপি ২০০৫ সালে যখন ওই গবেষণা করে তখন বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) আকার ছিল চার লাখ ১৫ হাজার কোটি টাকা। এখন সেটা প্রায় দ্বিগুণ। গত অর্থবছরে এর আকার ছিল সাত লাখ ৮৭ হাজার কোটি টাকা। এক দিনে এখন মোট দেশজ উৎপাদনের পরিমাণ প্রায় দুই হাজার ১০০ কোটি টাকা। আকার দ্বিগুণ হলে ক্ষতিও প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে ধরে নেওয়া যায়।
হরতাল হলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয় শিল্প ও সেবা খাতের। দেশের জিডিপির ৮০ শতাংশ অবদান শিল্প ও সেবা খাতের। কৃষির অবদান কমছে। ২০০৫-০৬ অর্থবছরে কৃষির অবদান ছিল ২২ শতাংশ। এখন সেটা ২০ শতাংশে এসেছে। শিল্প ও সেবা খাতের অবদান বেড়ে যাওয়ায় হরতালের একদিনে ক্ষতির পরিমাণও বেড়েছে।
কারওয়ান বাজারের সবজির আড়তের মালিক ইয়াসিন চৌধুরী ময়না জানান, সাধারণ দিনে কারওয়ান বাজারে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে এক হাজার থেকে এক হাজার ৫০০টি পণ্যবোঝাই ট্রাক আসে। কিন্তু গত দুই দিনের হরতালে ট্রাক এসেছে ৪০০ থেকে ৫০০টি। যেখানে ১০ থেকে ১৫ কোটি টাকার লেনদেন হয়, সেখানে লেনদেন হয়েছে তিন ভাগের একভাগ।
ইয়াসিন চৌধুরীর কথা অনুমাননির্ভর। কিন্তু ঢাকায় যে পণ্য সরবরাহ ও বেচাকেনা কমে গেছে, তা বাজারে গেলেই বোঝা যায়। বাজারে গতকাল বিক্রি হয়েছে বিবর্ণ সবজি, বরফে থাকতে থাকতে রং পাল্টে যাওয়া মাছ। শুধু কারওয়ান বাজারে হরতালের প্রভাব সম্পর্কে এক ব্যবসায়ী বলেন, পণ্য পরিবহন কমে যাওয়ায় ট্রাকচালক ও শ্রমিকরা বেকার থেকেছেন, কারওয়ান বাজারের ভ্যানচালকরা পণ্য পরিবহন করতে না পেরে আয় হারিয়েছেন, পান-সিগারেট বিক্রেতারা ক্রেতা পাননি, কারওয়ান বাজারের হোটেলগুলোয় বিক্রি কম হয়েছে, সবজির আড়তে যাঁরা দৈনিক শ্রম বিক্রি করেন, তাঁরা দুই দিন কাজ কম পেয়েছেন। এমনকি কারওয়ান বাজারে যাঁরা সবজি কুড়িয়ে দিন চালান, তাঁদেরও কষ্ট পেতে হয়েছে।
কারওয়ান বাজারে বিক্রি কমে যাওয়ায় ওই এলাকার ব্যাংকগুলোয় টাকা জমা পড়েছে অনেক কম। দুই দিন লেনদেন কম হওয়ায় ব্যাংকগুলোরও আয় কমে গেছে। চাহিদা না থাকায় পণ্যের উৎপাদন কম হয়েছে। দুই দিনের হরতালে দেশে মোট দেশজ উৎপাদন কিছুটা হলেও কমে গেছে। এভাবে দেশের অর্থনীতির সব ক্ষেত্রেই নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে হরতাল।
ব্যবসায়ীরা জানান, গত দুই দিনের হরতাল বর্তমান সরকারের আমলের অন্য হরতালগুলোর চেয়ে কড়াভাবে পালিত হয়েছে। ফলে ক্রেতা একেবারেই কম। গতকাল ঢাকার প্রধান প্রধান মার্কেট- শ্যামবাজার, বাবুবাজার, মৌলভীবাজারসহ বিভিন্ন পণ্যের আড়ত, বিভিন্ন পাইকারি বাজার একেবারেই বন্ধ ছিল, খুচরা যন্ত্রাংশের বাজার নওয়াবপুর রোডসহ সব বাজারই বন্ধ ছিল। কিছু দোকান হয়তো কয়েক ঘণ্টার জন্য খুলেছে; কিন্তু তারা ক্রেতা পায়নি।
হরতালের কারণে পণ্যের সরবরাহ কমে যাওয়ায় দাম বেড়ে গেছে। পাশাপাশি পরোক্ষভাবেও হরতাল দাম বাড়িয়েছে পণ্যের। বাংলাদেশ ভোজ্য তেল ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. আলী ভুট্টো এই পরোক্ষ কারণটি জানান। তিনি বলেন, মাসে তিন-চার দিন হরতাল হলে ওইসব দিনে ব্যবসায়ীদের কোনো আয় হয় না। কিন্তু দোকানভাড়াসহ অন্যান্য খরচ অপরিবর্তিত থেকে যায়। ফলে এক দিনের কমে যাওয়া আয় যোগ হয় পণ্যের দামে। যার প্রভাব পড়ে ক্রেতাদের ওপর।
ওই ব্যবসায়ী জানান, মৌলভীবাজারে দোকান হরতালে কিছু সময়ের জন্য খুলেছিল; কিন্তু কোনো ক্রেতা আসেনি কেনার জন্য।
দেশের সবচেয়ে বড় খুচরা যন্ত্রাংশের বাজার নওয়াবপুরের দোকানগুলো দুই দিন পুরো বন্ধ ছিল। ফলে ওইসব দোকানে কোনো কেনাবেচা হয়নি। একজন দোকানমালিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ইচ্ছে করলে মার্কেটের ভেতরের দোকান খোলা রাখা যায়। কিন্তু ভয়ে কেউ খোলা রাখতে চান না। খোলা রাখতে বিরোধীদলীয় লোকেরা চিহ্নিত করে রাখে। পরে তাঁরা সরকারে এসে প্রতিশোধ নেয় অথবা দোকানের সামনে বোমা ফাটায়। অতীতে এমন ঘটনা ঘটেছে বলে কেউ খোলা রাখতে চান না।
মফস্বল শহর বা গ্রামে হরতাল অত কড়াভাবে পালিত না হলেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। ঢাকার পণ্যের আড়তগুলো বন্ধ থাকলে জেলায় পণ্য যেতে পারে না। আবার কারওয়ান বাজারে যেসব ট্রাক পণ্য নিয়ে আসে, সেগুলো আবার ঢাকা থেকে পণ্য নিয়ে জেলায় ফিরে যায়। কিন্তু ঢাকার কোনো ট্রিপ না থাকায় ট্রাক আসে না বলেও জানান ইয়াসিন চৌধুরী। ঢাকা থেকে পণ্য না গেলে জেলা-উপজেলায় বেচাকেনা কমে যায়। ফলে পুরো অর্থনীতির গতিশীলতা নষ্ট হয়।
হরতালে দেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানি খাত পোশাক শিল্প আওতামুক্ত থাকে। কিন্তু তার পরও এ খাতকে ভোগান্তিতে পড়বে হয় হরতালের কারণে। হরতাল দীর্ঘায়িত না করার আহ্বান জানিয়ে বিজিএমইএ গতকাল এক বিজ্ঞপ্তিতে বলেছে, পোশাক শিল্প হরতালের আওতামুক্ত হলেও বাস্তবতা হচ্ছে, একটি অর্ডার সম্পন্ন করতে হলে সহযোগী বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠান যেমন- বস্ত্র কারখানা, এক্সেসরিজ, ওয়াশিং, ডায়িং, প্রিন্টিং, প্যাকেজিং প্রভৃতির সঙ্গে প্রতিনিয়ত যোগাযোগ রক্ষা করতে হয়। তাই যেকোনো সামান্য প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারী কার্যক্রমই এ শিল্পের স্বাভাবিক কার্যক্রমকে বিঘি্নত করে। এক ঘণ্টা বিলম্বের জন্য যদি তৈরি পোশাক জাহাজীকরণ করা সম্ভব না হয়, সে ক্ষেত্রে রপ্তানি কার্যক্রমে অতিরিক্ত ঝুঁকি বাড়ে এবং নানাভাবে ক্ষতির মুখে পড়তে হয়।

No comments

Powered by Blogger.