কলকাতার চিঠি-কার্টুন-কাণ্ড এবং দশে দশ by অমর সাহা
আবার রাজনৈতিক উত্তাপ বাড়ছে পশ্চিমবঙ্গে। সাম্প্রতিক কালের দুটি ঘটনা এই রাজনৈতিক উত্তাপ বাড়িয়ে দিয়েছে। এক. কার্টুন-কাণ্ড এবং দুই. দশে দশ প্রসঙ্গ। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপক ই-মেইলে সরকারবিরোধী একটি কার্টুন ফরোয়ার্ড করে বিপাকে পড়েন। লাঞ্ছিত হন সরকারি দলের কর্মী বাহিনীর হাতে।
আর মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ১৯ এপ্রিল বৃহস্পতিবার পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪ পরগনা জেলার বসিরহাটে একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে ঘোষণা করেন, তাঁর সরকার ক্ষমতা গ্রহণের ১০ মাসের মধ্যে ১০ বছরের কাজ সম্পন্ন করে ফেলেছেন। এবার লক্ষ্য, ওই সব কাজের ওপর তদারক বা নজরদারি করা। আরও বলেছেন, আগামী পাঁচ বছরে তিনি এই রাজ্যের এমন উন্নতি করবেন, যাতে বাংলা ভারতের গর্ব হবে।
এই দুটি ঘটনাই রাজনৈতিক উত্তাপ বাড়িয়ে দেয় গোটা পশ্চিমবঙ্গসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে। এ নিয়ে সমালোচনার ঝড়ও ওঠে দেশব্যাপী। আসলে সংবাদপত্রে কার্টুন আঁকা কোনো অপরাধ নয়, এটা গণতান্ত্রিক একটি অধিকারও বটে। মতপ্রকাশের স্বাধীনতার একটি অঙ্গও। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, রেলমন্ত্রী মুকুল রায় এবং সাবেক রেলমন্ত্রী দীনেশ ত্রিবেদীর ছবির সঙ্গে কিছু কথা জুড়ে করা হয়েছিল এ কার্টুনটি। সেই কার্টুনটি পেয়েছিল যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়নশাস্ত্রের অধ্যাপক অম্বিকেশ মহাপাত্র। সেটিই তিনি ফরোয়ার্ড করে বিপাকে পড়েন। থাকতেন তিনি গড়িয়ার একটি আবাসনে। এই আবাসনের অফিস থেকেই ই-মেইল করা হয় ওই কার্টুনটি। ব্যস, সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয় তৃণমূল কর্মীরা চড়াও হন তাঁর বাসভবনে। তাঁকে লাঞ্ছিত করে ১২ এপ্রিল বৃহস্পতিবার রাতেই নিয়ে যান পূর্ব যাদবপুর থানায়। সারা রাত বসিয়ে রাখা হয় তাঁকে। পরের দিন আলীপুর আদালতে তোলা হলে আদালত অধ্যাপককে জামিনে মুক্তি দেন। এই ঘটনা ছড়িয়ে পড়লে যাদবপুরের ছাত্র-শিক্ষক এবং কর্মচারীরা ক্ষোভে ফেটে পড়েন। তাঁরা প্রতিবাদ জানান। প্রতিবাদ ওঠে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। মিছিল, সভা, সমাবেশ হয় কলকাতায়। দাবি ওঠে, অধ্যাপককে লাঞ্ছনাকারী তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তারের। পুলিশ গ্রেপ্তার করে চার তৃণমূল নেতা-কর্মীকে। সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা জামিনও পেয়ে যান। আর এ ঘটনা ঘটার পরপরই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বলেছিলেন, ’অন্যায় করেছে, তাই গ্রেপ্তার হয়েছে।’
এ ঘটনার পর পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কর্মরত শিক্ষকেরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে থাকেন। তাঁরাও দাবি তোলেন, অবিলম্বে তুলতে হবে অধ্যাপকের বিরুদ্ধে মামলা। কলকাতার বিভিন্ন মহলে এর তীব্র প্রতিক্রিয়া ছড়িয়ে পড়ে। বিভিন্ন রাজনৈতিক মহল থেকে ঘটনার নিন্দা জানিয়ে বলা হয়, মুখ্যমন্ত্রীর আরও ধৈর্য ধারণ করতে হবে। একটি কার্টুনের মন্তব্য নিয়ে তাঁকে এত অসহিষ্ণু হলে চলবে না। তাঁকে ধৈর্যশীল হতে হবে।
দ্বিতীয় ঘটনাটি ঘটে বৃহস্পতিবার ১৯ এপ্রিল। বসিরহাটে এক জনসভায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘোষণা দেন, তাঁর ১০ মাসের সরকার ১০ বছরের কাজ সম্পন্ন করে ফেলেছে। এখন সেই সব কাজের তদারক করা হচ্ছে। ক্ষমতা গ্রহণের তিন মাসের মাথায় মমতা বলেছিলেন, তিন মাসেই পাঁচ বছরের কাজ সম্পন্ন করেছেন তিনি।
মমতার চটকদারি এই কথায় হঠাৎ করে রাজনৈতিক উত্তাপ বেড়ে যায় পশ্চিমবঙ্গে। প্রশ্ন ওঠে, তাহলে এখন কী করবেন মমতা? বিজেপির রাজ্য সভাপতি রাহুল সিনহা তো বলেই ফেলেছেন, ১০ মাসে ১০ বছরের কাজ করা হলে পাঁচ বছরে তো ৬০ বছরের কাজ সম্পন্ন করবেন মমতা। তাহলে ভবিষ্যতে যে-ই ক্ষমতায় আসুক, তাদের আর কাজ করতে হবে না?
রাহুল সিনহা আরও বলেছেন, ‘এ তো ঘোষণার সরকার, কথা বলার সরকার। গিনেস বুকে যদি সেরা ঘোষণার জন্য পুরস্কার দেওয়ার বিধান থাকত, তবে সেই পুরস্কার মমতাই পেতেন।’ তিনি কটাক্ষ করে এ কথাও বলেন, অপেক্ষা করুন, কিছুদিনের মধ্যেই এর ফল পেতে শুরু করবেন। আরও বলেন, ধামাচাপা দিয়ে এভাবে সরকার চলতে পারে না। আরেক রাজনৈতিক নেতা বলেছেন, মমতা নিজেই পরীক্ষা নিয়েছেন, খাতা দেখেছেন, নম্বর দিয়েছেন এবং ফলাফল ঘোষণা করেছেন। এ সরকার তো বিভ্রান্ত, দিশাহীন সরকার। আবার সিপিএমের সাবেক সাংসদ শমীক লাহিড়ী বলেছেন, এখন দুষ্কৃতকারীদের হাতে চলে যাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গ। ব্যর্থতা ঢাকতে তাই এই প্রচার। অথচ, এই সরকার এখন সংবাদমাধ্যমের ওপরও খবরদারি শুরু করেছে। কোন সংবাদপত্র লাইব্রেবিতে রাখা হবে, কোন টেলিভিশন মানুষ দেখবে, তা-ও বলে দিচ্ছেন মমতা। আবার এই সরকারের কর্মী বাহিনীর হাতে কলকাতায় প্রকাশ্য রাজপথে সাংবাদিক লাঞ্ছিত হন, বস্তিবাসী লাঞ্ছিত হয়। আবার প্রবীণ সাংবাদিক সুখরঞ্জন দাসগুপ্ত বলেছেন, কোথায় সমস্যার সমাধান হলো? দার্জিলিং এখনো অশান্ত। সিঙ্গুরের অনিচ্ছুক কৃষকেরা জমি পাননি, জঙ্গলমহলে মাওবাদী তৎপরতা বন্ধ হয়নি। কেবল কিষানজিকে হত্যা করেই জঙ্গলমহল সমস্যার সমাধান করা যায়নি। জঙ্গলমহলে আবার তৎপর হয়েছে মাওবাদীরা। আজও ওডিশায় মাওবাদীদের হাতে অপহূত বিধায়ককে উদ্ধার করতে পারেনি ওডিশা সরকার। ওডিশার পাশেই আমাদের রাজ্য। কোথায় সব সমস্যার সমাধান হয়ে গেল?
আর এরই মধ্যে এই কার্টুন-কাণ্ড নিয়ে নতুন একটি গান বেঁধেছেন প্রখ্যাত সংগীতশিল্পী এবং তৃণমূল সাংসদ কবীর সুমন। এর আগে তিনি গান বেঁধেছিলেন মাওবাদী নেতা কিষেনজি, ছত্রধর মাহাতকে নিয়েও। এবার বাঁধলেন কার্টুন-কাণ্ড নিয়ে। কটাক্ষ করেছেন পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে।
শুধু কি তাই, এবার রাজনৈতিক লড়াইয়ে নেমে তৃণমূলের এক রাজনৈতিক নেতা তো সিপিএমকে পারিবারিক ও সামজিকভাবেও বর্জনের ডাক দিয়েছেন!
গত ১৫ এপ্রিল উত্তর ২৪ পরগনার হাবড়ায় তৃণমূল কর্মী সম্মেলনে এক অভিনব পরামর্শ দেন পশ্চিমবঙ্গের খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক। মন্ত্রী বলেন, সিপিএম নেতা বা কর্মীর পরিবারের সঙ্গে তৃণমূলের কারোর বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করা যাবে না। শুধু তা-ই নয়, সিপিএম নেতা-কর্মীরা কোনো চায়ের দোকানে বসলে সেখানে বসবে না তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা। শুধু তা-ই নয়, কোনো চায়ের দোকানে তৃণমূল কর্মীরা বসলে সেখানে সিপিএম কর্মী ঢুকলে উঠে যেতে হবে তৃণমূল নেতা-কর্মীদের। মন্ত্রী আরও বলেছেন, তৃণমূলের কারোর সিপিএম আত্মীয় থাকলে তাদের সঙ্গেও কোনো যোগাযোগ রাখা যাবে না। মন্ত্রীর এই বক্তব্য নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক মহলে প্রতিক্রিয়া দেখা দিলেও রেলমন্ত্রী মুকুল রায় জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের পাশে দাঁড়িয়ে বলে দেন, ঠিকই বলেছেন খাদ্যমন্ত্রী।
তাই লাগামহীন নানা মন্তব্য ঘিরে আবার উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক অঙ্গন। সবারই এক কথা, পশ্চিমবঙ্গ কি গণতন্ত্রের ঐতিহ্য হারাতে বসেছে? কারণ, ক্ষমতায় আসার আগেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘোষণা দিয়েছিলেন, ‘বদলা নয় বদল চাই, দলতন্ত্র নয় গণতন্ত্র চাই’। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকেরা মনে করছেন, মমতার সেই স্লোগান থেকে এখন সরে যাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার।
অমর সাহা: প্রথম আলোর কলকাতা প্রতিনিধি।
No comments