শ্রদ্ধাঞ্জলি-সত্য আর সুন্দরে যাঁর বসবাস by তিতাশ চৌধুরী
আজ ২৩ ফেব্রুয়ারি অধ্যাপক জিল্লুর রহমান সিদ্দিকীর জন্মদিন। তিনি একাধারে শিক্ষাবিদ, প্রাবন্ধিক, কবি, গবেষক ও অনুবাদক। এত গুণের আধার যে মানুষটি, তাঁকে দেখামাত্রই শ্রদ্ধা করতে ইচ্ছে করে।জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী শিক্ষা প্রসারে ও বিকাশে যে ভূমিকা পালন করছেন, তা অতুলনীয়।
তিনি আমাদের দেশের যেখানে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার অভাব বোধ করেছেন, অপ্রতুল মনে করেছেন কিংবা ক্ষতিকর ভেবেছেন—সেসব বিষয় নিয়ে তিনি তাঁর ক্ষুরধার কলম সচল রেখেছেন। জাতীয় কোনো সমস্যা, সংকট কিংবা দুর্যোগে কলম ধরেছেন। এদিক বিচারে তিনি মূলত আমাদের সচেতন ও সুশীল সমাজের একজন বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য প্রতিনিধি। সে কারণে জাতির সমস্যা ও সংকটে প্রায় সব গোলটেবিল বৈঠকেই তাঁকে দেখা যায়। তিনি কয়েকটি কাগজে সমসাময়িক সমস্যা ও সংকট নিয়ে নিয়মিত কলাম লেখেন। তাঁর লেখার বিষয় বরাবরই আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।
তাঁর নিবন্ধের বিষয় যা-ই হোক না কেন—রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি, শিক্ষানীতি কিংবা ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, সভ্যতা—কোনো ক্ষেত্রেই তাঁর যুক্তি, বুদ্ধিমত্তা ও কৌশল গ্রহণযোগ্যতা হারায় না। তাঁর লেখায় অনেক ক্ষেত্রেই সত্য ও সুন্দরকে আবিষ্কার করা যায়। আড়ালের একজন সত্যিকার মানুষকে চেনা যায়। তিনি যখন বাংলাদেশের ‘মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা’ সম্পর্কে কথা বলেন, তখন তিনি অন্য রকম মানুষে পরিণত হন। তাঁর সত্তার গভীরে তখন সত্য অনুবর্ণিত হয়ে ওঠে, যা একজন মুক্তবুদ্ধি মানুষের কাজ। ২০০১ সালের নির্বাচনের পর সারা দেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়ে গঠিত তদন্ত কমিশনের তিনি ছিলেন সভাপতি। তখন অনেক খ্যাতনামা বুদ্ধিজীবী এ কাজে যুক্ত হতে রাজি হননি। জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী সেই সুশীল সমাজেরই একজন প্রতিনিধি, যিনি কোনো মিথ্যাচারে নেই, সত্য ও সুন্দরে যাঁর বসবাস। তাঁর রচনা পাঠে আমরা আলোকিত হই, বিকশিত হই এবং পূর্ণতা লাভ করি।
জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী যখন প্রবন্ধ-সাহিত্য রচনা করেন, তখনো তিনি সত্য ও সুন্দরেরই আরাধনা করেন। কখনো কখনো গদ্য নিয়েও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। বাংলা প্রবন্ধ পরিচয়-এ এর স্বাক্ষর আছে। বলতেই হয়, যুক্তিনির্ভর মননশীল প্রবন্ধ রচনায় তিনি অনেক ক্ষেত্রে সিদ্ধহস্ত। তাঁর রচনার একটি স্টাইল আছে, যাকে ‘ব্যক্তিত্ব প্রকাশক’ স্টাইল বলা যায়।
জিল্লুর রহমান সিদ্দিকীর রচনার প্রবহমান ধারাটি তাঁর একান্ত নিজস্ব। এর সঙ্গে অন্য কারও রচনাকে মেলানো যায় না। আমার দেশ, আমার ভাষা, বাঙালির আত্মপরিচয় প্রভৃতি গ্রন্থগুলোও তাঁর চিন্তা ও প্রতিভার সজীব ফসল। শেকড়-সন্ধানী তৎপরতার অনন্য দলিল।
অনুবাদেও তিনি ঈর্ষণীয় কাজ করেছেন। তাঁর অনুবাদ সব ক্ষেত্রে মূলানুগ। এর কারণ, তিনি যে ভাষা থেকে অনুবাদ করেন, সেই ভাষাটি তাঁর করায়ত্ত। তিনি প্রধানত ইংরেজি ভাষা থেকেই অনুবাদ করেন। তাই এর স্বভাব তাঁর জানা। ফলে অনুবাদে কোথাও জড়তা পরিলক্ষিত হয় না। তিনি যে শুধু ভাষারই স্বভাব জানেন, তা-ই নয়, ওই ভাষার সাহিত্য, সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য, সভ্যতা ও ভৌগোলিক অবস্থা সম্পর্কেও অভিজ্ঞ। সে কারণেই তাঁর অনুবাদ প্রাঞ্জল, স্বচ্ছ, স্বাচ্ছন্দ্য ও সাবলীল। শেক্সপিয়রের সনেট ও টেমপেস্ট ছাড়াও মিল্টনের অ্যারিওপ্যাজোটিকা ওস্যামসন অ্যাগনেশটিজ প্রভৃতি অনুবাদ এককথায় অনবদ্য।
আর তাঁর কবিতা? কবিতাকে ভালোবেসেই তিনি জীবনকে ভালোবেসেছেন কিংবা দুটোই। তিনি প্রকৃতই কবি। জীবনানন্দ দাশ যাঁদের কবি বলেন, তিনি তাঁদেরই একজন। তিনি জীবনকে ভালোবেসেছেন, মানুষকে ভালোবেসেছেন। ফলে তাঁর কবিতার কোথাও উগ্রতার রং নেই। শীতল স্নিগ্ধ পদ্মদিঘির জলের মতোই তাঁর কবিতা। সে জন্য তাঁর কবিতা আমাদের টানে শীত-সকালের রৌদ্রের মতো। তাঁর কবিতার বাক্প্রতিমা, সুর, ছন্দ, উপমা-উৎপ্রেক্ষা, রূপক, প্রতীক—সবকিছু মিলিয়েই মনোহর দেদীপ্যবান। জীবনে জীবন যোগ হওয়ার ফলেই তাঁর কবিতার রূপ-ঐশ্বর্য আমাদের এমন দুর্মর টেনেছে, বিশেষ করে তাঁর সনেটগুচ্ছগুলো।
জিল্লুর রহমান সিদ্দিকীর কবিতা সহজ কিন্তু সরল নয়; হেঁয়ালি কিন্তু রহস্যময় নয়। তাঁর কবিতায় সান্ধ্য ভাষা নেই, কিন্তু আড়াল আছে। তিনি কবিতায় কখনো কখনো কৃষ্ণ-ম্যাজিক আমদানিপূর্বক ঐন্দ্রজালিকতার সৃষ্টি করেছেন, কিন্তু আমাদের দৃষ্টিকে আচ্ছন্ন করেননি। তাঁর কবিতায় হইচই নেই, উচ্চরোল নেই, অথচ আত্মার অন্তর্গত দ্রোহ আছে কোনো কোনো কবিতায়। আমাদের জাগর চৈতন্যে তাঁর কবিতা কলরব করে ওঠে।
জিল্লুর রহমান সিদ্দিকীর কবিতার আরও একটি বৈশিষ্ট্য এই যে Wisdom and beauty-র সমন্বয়। ফলে তাঁর কবিতার সাম্রাজ্যে অনায়াসে বিচরণ করা যায়। তাঁর কবিতায় যেমন আকুলতা আছে, আবিষ্টতা আছে, তেমনি কোনোরূপ জড়তা নেই; যে জড়তা কবিতাকে আড়ষ্ট করে রাখে, কবিতা হয়ে উঠতে দেয় না—এমন একটি কবিতাও তাঁর কবিতা-সংগ্রহে চোখে পড়ল না।
বলতে ভুলে গেছি, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকীর একটি অসাধারণ গ্রন্থ চলার পথে। এটিকে অনায়াসে একটি স্মৃতিচারণামূলক উপন্যাসের মর্যাদা দেওয়া যায়।
জিল্লুর রহমান সিদ্দিকীর আজ ৮৪তম শুভ জন্মদিন। এই দিনে তাঁকে আমি আন্তরিক অভিনন্দন ও শ্রদ্ধা জানাই।
তাঁর নিবন্ধের বিষয় যা-ই হোক না কেন—রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি, শিক্ষানীতি কিংবা ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, সভ্যতা—কোনো ক্ষেত্রেই তাঁর যুক্তি, বুদ্ধিমত্তা ও কৌশল গ্রহণযোগ্যতা হারায় না। তাঁর লেখায় অনেক ক্ষেত্রেই সত্য ও সুন্দরকে আবিষ্কার করা যায়। আড়ালের একজন সত্যিকার মানুষকে চেনা যায়। তিনি যখন বাংলাদেশের ‘মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা’ সম্পর্কে কথা বলেন, তখন তিনি অন্য রকম মানুষে পরিণত হন। তাঁর সত্তার গভীরে তখন সত্য অনুবর্ণিত হয়ে ওঠে, যা একজন মুক্তবুদ্ধি মানুষের কাজ। ২০০১ সালের নির্বাচনের পর সারা দেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়ে গঠিত তদন্ত কমিশনের তিনি ছিলেন সভাপতি। তখন অনেক খ্যাতনামা বুদ্ধিজীবী এ কাজে যুক্ত হতে রাজি হননি। জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী সেই সুশীল সমাজেরই একজন প্রতিনিধি, যিনি কোনো মিথ্যাচারে নেই, সত্য ও সুন্দরে যাঁর বসবাস। তাঁর রচনা পাঠে আমরা আলোকিত হই, বিকশিত হই এবং পূর্ণতা লাভ করি।
জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী যখন প্রবন্ধ-সাহিত্য রচনা করেন, তখনো তিনি সত্য ও সুন্দরেরই আরাধনা করেন। কখনো কখনো গদ্য নিয়েও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। বাংলা প্রবন্ধ পরিচয়-এ এর স্বাক্ষর আছে। বলতেই হয়, যুক্তিনির্ভর মননশীল প্রবন্ধ রচনায় তিনি অনেক ক্ষেত্রে সিদ্ধহস্ত। তাঁর রচনার একটি স্টাইল আছে, যাকে ‘ব্যক্তিত্ব প্রকাশক’ স্টাইল বলা যায়।
জিল্লুর রহমান সিদ্দিকীর রচনার প্রবহমান ধারাটি তাঁর একান্ত নিজস্ব। এর সঙ্গে অন্য কারও রচনাকে মেলানো যায় না। আমার দেশ, আমার ভাষা, বাঙালির আত্মপরিচয় প্রভৃতি গ্রন্থগুলোও তাঁর চিন্তা ও প্রতিভার সজীব ফসল। শেকড়-সন্ধানী তৎপরতার অনন্য দলিল।
অনুবাদেও তিনি ঈর্ষণীয় কাজ করেছেন। তাঁর অনুবাদ সব ক্ষেত্রে মূলানুগ। এর কারণ, তিনি যে ভাষা থেকে অনুবাদ করেন, সেই ভাষাটি তাঁর করায়ত্ত। তিনি প্রধানত ইংরেজি ভাষা থেকেই অনুবাদ করেন। তাই এর স্বভাব তাঁর জানা। ফলে অনুবাদে কোথাও জড়তা পরিলক্ষিত হয় না। তিনি যে শুধু ভাষারই স্বভাব জানেন, তা-ই নয়, ওই ভাষার সাহিত্য, সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য, সভ্যতা ও ভৌগোলিক অবস্থা সম্পর্কেও অভিজ্ঞ। সে কারণেই তাঁর অনুবাদ প্রাঞ্জল, স্বচ্ছ, স্বাচ্ছন্দ্য ও সাবলীল। শেক্সপিয়রের সনেট ও টেমপেস্ট ছাড়াও মিল্টনের অ্যারিওপ্যাজোটিকা ওস্যামসন অ্যাগনেশটিজ প্রভৃতি অনুবাদ এককথায় অনবদ্য।
আর তাঁর কবিতা? কবিতাকে ভালোবেসেই তিনি জীবনকে ভালোবেসেছেন কিংবা দুটোই। তিনি প্রকৃতই কবি। জীবনানন্দ দাশ যাঁদের কবি বলেন, তিনি তাঁদেরই একজন। তিনি জীবনকে ভালোবেসেছেন, মানুষকে ভালোবেসেছেন। ফলে তাঁর কবিতার কোথাও উগ্রতার রং নেই। শীতল স্নিগ্ধ পদ্মদিঘির জলের মতোই তাঁর কবিতা। সে জন্য তাঁর কবিতা আমাদের টানে শীত-সকালের রৌদ্রের মতো। তাঁর কবিতার বাক্প্রতিমা, সুর, ছন্দ, উপমা-উৎপ্রেক্ষা, রূপক, প্রতীক—সবকিছু মিলিয়েই মনোহর দেদীপ্যবান। জীবনে জীবন যোগ হওয়ার ফলেই তাঁর কবিতার রূপ-ঐশ্বর্য আমাদের এমন দুর্মর টেনেছে, বিশেষ করে তাঁর সনেটগুচ্ছগুলো।
জিল্লুর রহমান সিদ্দিকীর কবিতা সহজ কিন্তু সরল নয়; হেঁয়ালি কিন্তু রহস্যময় নয়। তাঁর কবিতায় সান্ধ্য ভাষা নেই, কিন্তু আড়াল আছে। তিনি কবিতায় কখনো কখনো কৃষ্ণ-ম্যাজিক আমদানিপূর্বক ঐন্দ্রজালিকতার সৃষ্টি করেছেন, কিন্তু আমাদের দৃষ্টিকে আচ্ছন্ন করেননি। তাঁর কবিতায় হইচই নেই, উচ্চরোল নেই, অথচ আত্মার অন্তর্গত দ্রোহ আছে কোনো কোনো কবিতায়। আমাদের জাগর চৈতন্যে তাঁর কবিতা কলরব করে ওঠে।
জিল্লুর রহমান সিদ্দিকীর কবিতার আরও একটি বৈশিষ্ট্য এই যে Wisdom and beauty-র সমন্বয়। ফলে তাঁর কবিতার সাম্রাজ্যে অনায়াসে বিচরণ করা যায়। তাঁর কবিতায় যেমন আকুলতা আছে, আবিষ্টতা আছে, তেমনি কোনোরূপ জড়তা নেই; যে জড়তা কবিতাকে আড়ষ্ট করে রাখে, কবিতা হয়ে উঠতে দেয় না—এমন একটি কবিতাও তাঁর কবিতা-সংগ্রহে চোখে পড়ল না।
বলতে ভুলে গেছি, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকীর একটি অসাধারণ গ্রন্থ চলার পথে। এটিকে অনায়াসে একটি স্মৃতিচারণামূলক উপন্যাসের মর্যাদা দেওয়া যায়।
জিল্লুর রহমান সিদ্দিকীর আজ ৮৪তম শুভ জন্মদিন। এই দিনে তাঁকে আমি আন্তরিক অভিনন্দন ও শ্রদ্ধা জানাই।
No comments