বিশ্বায়িত একুশ-আমাদের ঘরে ঘরে শহীদ, মাঠে মাঠে মিনার by ফারুক ওয়াসিফ
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার ভেঙে ফেলার সময় পাকিস্তানি সেনারা দম্ভ করে বলেছিল, ‘হার ঘর শহীদ মিনার বানা দেঙ্গা’। অর্থাৎ প্রতিটি ঘরকেই শহীদ মিনার বানিয়ে দেব। হ্যাঁ, তারা প্রায় প্রতিটি ঘরেই কাউকে না কাউকে শহীদ করেছিল। ভেঙে ফেলেছিল দেশের সব শহীদ মিনার।
আর সেই শহীদদের উত্তরসূরিরা প্রতিটি প্রাঙ্গণে, প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে স্থায়ীভাবে এবং একুশে দিবসের আগে যার যার বাড়ির আঙিনায় ও পাড়ার মাঠে শহীদ মিনার বানিয়ে জবাব দিয়েছে, ‘আমাদের প্রতিটি ঘরেই শহীদ, আমাদের প্রতিটি প্রাঙ্গণেই শহীদ মিনার’।
দিন যায় বছর যায়, আর ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি আরও দূরে চলে যায়, শহীদদের কবরের মাটি আরও পুরোনো হয়। কিন্তু প্রতিবছর নতুন নতুন শহীদ মিনার দাঁড়ায় বাংলাদেশজুড়ে। এখন বাংলার ভাষাশহীদদের স্মরণে নির্মিত মিনার বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় মানবীয় সাংস্কৃতিক স্থাপত্য। একই চেতনায় একই আদলে আর কোনো সাংস্কৃতিক স্থাপত্য এত বেশি সংখ্যায় বিশ্বে আর নির্মিত হয়নি। কেবল বাংলাদেশেই নয়, বিশ্বের যেখানেই বাংলাদেশিদের মোটামুটি উপস্থিতি আছে, সেখানেই এক বা একাধিক শহীদ মিনার দাঁড়িয়ে আছে। নতুন নতুন দেশে, নতুন নতুন শহরে শহীদ মিনার প্রতিষ্ঠিত হতেই থাকছে।
শহীদ মিনার ও একুশে আজ বিশ্বায়িত। একই দিনে বহু দেশে এত বড় সেক্যুলার সাংস্কৃতিক জমায়েতও আর হয় না। বাংলার অজস্র কিশোর-তরুণের উদ্যম ও ভালোবাসায় প্রতি একুশের ভোরে বাংলার মাটিতে মাথা তোলে হাজারো নতুন শহীদ মিনার। হোক তা ক্ষণিকের, কিন্তু যারা বানায় তাদের কাছে এর মূল্য অসীম। কিশোর-কিশোরীদের হাতে গড়া জাতীয় শহীদ মিনারের আদলের এসব আনাড়ি স্থাপত্যই প্রমাণ, ৫৯ বছর পরও একুশের ধার কিছুমাত্র ক্ষয় হয়নি। বরং তা হয়েউঠেছে এই ভূখণ্ডের সব শহীদের অবদানের মাথা উঁচু করা মিনার।
বাংলাদেশের যেখানেই যান সেখানেই শহীদ মিনার! শহর তো দূরের কথা, শহীদ মিনারহীন কোনো গ্রাম বাংলাদেশে আছে কি না সন্দেহ। দেশে বা বিদেশে যেখানেই বাঙালির আস্তানা, সেখানেই মাথা তুলেছে একটি বা দুটি বা অনেক শহীদ মিনার। ব্রিটেনের রাজধানী লন্ডনের টাওয়ার হ্যামলেটের আলতাব আলী পার্কে দাঁড়িয়ে আছে জাতীয় শহীদ মিনারের আদলের একটি শহীদ মিনার। লন্ডনের ওল্ডহ্যামেও তৈরি হয়েছে আরেকটি শহীদ মিনার। প্রতিবছর ২১ ফেব্রুয়ারি মধ্যরাতে বরফ পড়া শীতের মধ্যে নিউইয়র্কের জাতিসংঘ প্লাজা ও ইস্ট রিভার নদীর তীরে বাংলাভাষীরা জড়ো হন শহীদ স্মৃতির সম্মানে। এ রকম আরও আছে জাপানে, অস্ট্রেলিয়ায়, কানাডায় ও ভারতে। এ সত্য রটতে আর বাকি নেই: বাংলাদেশ শহীদের দেশ, শহীদ মিনারেরও দেশ।
এর থেকেও বড় সত্য, পৃথিবীতে আর কোনো দেশে, আর কোনো জাতীয় ঘটনার স্মরণে এত বেশি সেক্যুলার স্থাপত্য নির্মিত হয়নি। আজ বিশুদ্ধ বিশ্বাসে বলা যায়, উপাসনা কেন্দ্র ছাড়া আর কোনো সাংস্কৃতিক প্রতীককে এত বেশি ভালোবাসা ও বন্দনা দেয়নি কোনো জাতি। বাঙালির জাতীয়তাবোধের নির্মাণ এবং জাতিরাষ্ট্র গড়ার প্রেরণা এই মিনার। এই দিবসে এবং এই মিনারে সব জাতির সব মানুষের অধিকার। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণায় তা আরও প্রতিষ্ঠিতই হলো। দেশে বা বিদেশে যে কেউই মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসায় কোনো কিছু গড়তে চাইলে এই শহীদ মিনার গড়তে পারেন। আর কোনো জাতীয় স্মারকের এমন আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা আছে কি না, আমার জানা নেই। বাংলাদেশের যে কেউই যেকোনো সময় শহীদ মিনার বানাতে পারে এবং তার পাদদেশে দিতে পারে শ্রদ্ধাঞ্জলি।
পশ্চিমা দুনিয়ায় সবচেয়ে নন্দিত সাংস্কৃতিক স্থাপত্য আমেরিকার নিউইয়র্ক শহরের স্ট্যাচু অব লিবার্টি। কিন্তু এটি এক ও অনন্য। এর অজস্র অনুকৃতি বাজারে বিক্রি হয়, কিন্তু সেগুলো স্যুভেনির, শহীদ মিনারের আবেগ ও সম্মান তা জাগায় না। হিরোশিমায় পারমাণবিক ট্র্যাজেডি স্মরণে জাপানের হিরোশিমা নগরে হিরোশিমা শান্তি উদ্যান, হিরোশিমা শান্তি জাদুঘর এবং ভাস্কর্য স্থাপিত হলেও এগুলো কেবল যেখানটায় বোমা বর্ষিত হয়েছিল সেখানটায় নির্মিত। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো এবং বর্তমান রাশিয়ায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহত বীরদের স্মরণে প্রতিটি লড়াইয়ের ময়দানে মনুমেন্ট বা ভাস্কর্য স্থাপিত হলেও, সেসবের কোনো একক আদল নেই।
দেশের প্রতি ১০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রায় আটটিতেই শহীদ মিনার মিলবে। গত বছরের সরকারি হিসাবে দেশে প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক এবং কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় মিলিয়ে দুই লাখ ২৮ হাজার ছয়টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। এ ছাড়া জেলা, উপজেলা, পৌরসভা, থানা ও ইউনিয়নের মিলিত সংখ্যা পাঁচ হাজার ৯৪৭টি। এসবের ৮০ শতাংশেরও বেশিতে যদিও শহীদ মিনার স্থাপিত আছে। এই হিসাবে বাংলাদেশে শহীদ মিনারের আনুমানিক সংখ্যা দুই লাখেরও বেশি। পাড়া-মহল্লার ক্লাবগুলোর সামনেও শহীদ মিনার দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। জাতীয় তিনটি দিবস—একুশে ফেব্রুয়ারি, ছাব্বিশে মার্চ ও ষোলোই ডিসেম্বরে এসব মিনারে মানুষ পুষ্পমাল্য দিয়ে ভালোবাসা জানায়। একুশের প্রভাতে দেশব্যাপী ছাত্র-তরুণেরা আবেগ ও ভালোবাসা ঢেলে ইট বা বাঁশ দিয়ে ক্ষণিকের জন্য হাজার হাজার শহীদ মিনার তৈরি করে। এভাবেই তারা একুশের চেতনাকে জাগ্রত রাখে জনগণের হূদয়ে ও সমাজের মূল্যবোধে। সেই বায়ান্ন থেকে একাত্তরে যেমন আজও, তেমনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও তরুণ শিক্ষার্থীরাই ছিল গণতান্ত্রিক ও মানবিক সংস্কৃতি আর রাজনীতি প্রতিষ্ঠার অগ্রণী লড়াকু। আজও তাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষার্থীরাই একুশের আপন আশ্রয় হয়ে আছে।
আরেক দিক থেকেও শহীদ মিনার অতুলনীয়। আমাদের শহীদ মিনার কেবল অতীতের স্মৃতিচিহ্ন নয়, জীবন্ত সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। প্রতি একুশের রাতে শহীদ মিনার ফুলে আর মানুষের ভালোবাসার জমায়েতে নতুন হয়ে ওঠে, জীবন্ত হয়ে ওঠে। আমাদের সংস্কৃতির মানবিকতা-অসাম্প্রদায়িকতা ও অন্যায় বিরোধিতার জীবন্ত প্রেরণা। তাই প্রতিবাদের প্রয়োজনে, শোকের নীরবতায়, বিজয়ের উদ্যাপনে মানুষ ছুটে আসে দেশব্যাপী ছড়ানো সব শহীদ মিনারের পদতলে। কি রাজনৈতিক সভা, কি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, কি জাতীয় বীরদের অন্তিম শ্রদ্ধা প্রদর্শন—সব ক্ষেত্রেই শহীদ মিনারের মঞ্চ ও সোপানই প্রিয় ও পবিত্র স্থান। মুক্তিযুদ্ধের সম্মানে নির্মিত জাতীয় স্মৃতিসৌধের সঙ্গে এখানেই এর ফারাক। জাতীয় স্মৃতিসৌধ স্মৃতির প্রতীক, আর শহীদ মিনার চেতনাকে শাণিত করার মঞ্চ। জাতীয় স্মৃতিসৌধ রাষ্ট্রিক, শহীদ মিনার সামাজিক। শহীদ মিনার তাই কেবল অতীতের স্মারকই নয়, তা বর্তমানেও শুভবোধের শক্তির উৎস। তবে বায়ান্ন থেকে একাত্তর পর্যন্ত শহীদ মিনারের আবহ ও তাৎপর্য যেমন ছিল, এখন তেমনটা নেই। তখন শহীদ মিনার ও একুশে দিবসটি ছিল প্রতিবাদ ও বিদ্রোহের প্রতীক। স্বাধীনতার পর এই দিবসের মর্ম এবং এই মিনারের আবহকে সুকৌশলে কেবল শোকের মধ্যে আটকে রাখা হয়। গত বছরে জাতীয় শহীদ মিনারের সর্বজনীন চরিত্র ক্ষুণ্ন করে কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়, যা একুশের চেতনা ও শহীদ মিনারের বৈশিষ্ট্যের বিরোধী। শহীদ মিনার যত দিন জনগণের হাতে থাকবে, যত দিন সর্বজনীন থাকবে, তত দিন তা পথ দেখাবে। শহীদ মিনার আমাদের প্রতিরোধ চেতনার প্রাণভোমরা। আমাদের মানবিক সংস্কৃতির আত্মা। এই আত্মা বাঁচলেই আমরা বাঁচব।
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক।
farukwasif@yahoo.com
দিন যায় বছর যায়, আর ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি আরও দূরে চলে যায়, শহীদদের কবরের মাটি আরও পুরোনো হয়। কিন্তু প্রতিবছর নতুন নতুন শহীদ মিনার দাঁড়ায় বাংলাদেশজুড়ে। এখন বাংলার ভাষাশহীদদের স্মরণে নির্মিত মিনার বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় মানবীয় সাংস্কৃতিক স্থাপত্য। একই চেতনায় একই আদলে আর কোনো সাংস্কৃতিক স্থাপত্য এত বেশি সংখ্যায় বিশ্বে আর নির্মিত হয়নি। কেবল বাংলাদেশেই নয়, বিশ্বের যেখানেই বাংলাদেশিদের মোটামুটি উপস্থিতি আছে, সেখানেই এক বা একাধিক শহীদ মিনার দাঁড়িয়ে আছে। নতুন নতুন দেশে, নতুন নতুন শহরে শহীদ মিনার প্রতিষ্ঠিত হতেই থাকছে।
শহীদ মিনার ও একুশে আজ বিশ্বায়িত। একই দিনে বহু দেশে এত বড় সেক্যুলার সাংস্কৃতিক জমায়েতও আর হয় না। বাংলার অজস্র কিশোর-তরুণের উদ্যম ও ভালোবাসায় প্রতি একুশের ভোরে বাংলার মাটিতে মাথা তোলে হাজারো নতুন শহীদ মিনার। হোক তা ক্ষণিকের, কিন্তু যারা বানায় তাদের কাছে এর মূল্য অসীম। কিশোর-কিশোরীদের হাতে গড়া জাতীয় শহীদ মিনারের আদলের এসব আনাড়ি স্থাপত্যই প্রমাণ, ৫৯ বছর পরও একুশের ধার কিছুমাত্র ক্ষয় হয়নি। বরং তা হয়েউঠেছে এই ভূখণ্ডের সব শহীদের অবদানের মাথা উঁচু করা মিনার।
বাংলাদেশের যেখানেই যান সেখানেই শহীদ মিনার! শহর তো দূরের কথা, শহীদ মিনারহীন কোনো গ্রাম বাংলাদেশে আছে কি না সন্দেহ। দেশে বা বিদেশে যেখানেই বাঙালির আস্তানা, সেখানেই মাথা তুলেছে একটি বা দুটি বা অনেক শহীদ মিনার। ব্রিটেনের রাজধানী লন্ডনের টাওয়ার হ্যামলেটের আলতাব আলী পার্কে দাঁড়িয়ে আছে জাতীয় শহীদ মিনারের আদলের একটি শহীদ মিনার। লন্ডনের ওল্ডহ্যামেও তৈরি হয়েছে আরেকটি শহীদ মিনার। প্রতিবছর ২১ ফেব্রুয়ারি মধ্যরাতে বরফ পড়া শীতের মধ্যে নিউইয়র্কের জাতিসংঘ প্লাজা ও ইস্ট রিভার নদীর তীরে বাংলাভাষীরা জড়ো হন শহীদ স্মৃতির সম্মানে। এ রকম আরও আছে জাপানে, অস্ট্রেলিয়ায়, কানাডায় ও ভারতে। এ সত্য রটতে আর বাকি নেই: বাংলাদেশ শহীদের দেশ, শহীদ মিনারেরও দেশ।
এর থেকেও বড় সত্য, পৃথিবীতে আর কোনো দেশে, আর কোনো জাতীয় ঘটনার স্মরণে এত বেশি সেক্যুলার স্থাপত্য নির্মিত হয়নি। আজ বিশুদ্ধ বিশ্বাসে বলা যায়, উপাসনা কেন্দ্র ছাড়া আর কোনো সাংস্কৃতিক প্রতীককে এত বেশি ভালোবাসা ও বন্দনা দেয়নি কোনো জাতি। বাঙালির জাতীয়তাবোধের নির্মাণ এবং জাতিরাষ্ট্র গড়ার প্রেরণা এই মিনার। এই দিবসে এবং এই মিনারে সব জাতির সব মানুষের অধিকার। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণায় তা আরও প্রতিষ্ঠিতই হলো। দেশে বা বিদেশে যে কেউই মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসায় কোনো কিছু গড়তে চাইলে এই শহীদ মিনার গড়তে পারেন। আর কোনো জাতীয় স্মারকের এমন আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা আছে কি না, আমার জানা নেই। বাংলাদেশের যে কেউই যেকোনো সময় শহীদ মিনার বানাতে পারে এবং তার পাদদেশে দিতে পারে শ্রদ্ধাঞ্জলি।
পশ্চিমা দুনিয়ায় সবচেয়ে নন্দিত সাংস্কৃতিক স্থাপত্য আমেরিকার নিউইয়র্ক শহরের স্ট্যাচু অব লিবার্টি। কিন্তু এটি এক ও অনন্য। এর অজস্র অনুকৃতি বাজারে বিক্রি হয়, কিন্তু সেগুলো স্যুভেনির, শহীদ মিনারের আবেগ ও সম্মান তা জাগায় না। হিরোশিমায় পারমাণবিক ট্র্যাজেডি স্মরণে জাপানের হিরোশিমা নগরে হিরোশিমা শান্তি উদ্যান, হিরোশিমা শান্তি জাদুঘর এবং ভাস্কর্য স্থাপিত হলেও এগুলো কেবল যেখানটায় বোমা বর্ষিত হয়েছিল সেখানটায় নির্মিত। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো এবং বর্তমান রাশিয়ায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহত বীরদের স্মরণে প্রতিটি লড়াইয়ের ময়দানে মনুমেন্ট বা ভাস্কর্য স্থাপিত হলেও, সেসবের কোনো একক আদল নেই।
দেশের প্রতি ১০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রায় আটটিতেই শহীদ মিনার মিলবে। গত বছরের সরকারি হিসাবে দেশে প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক এবং কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় মিলিয়ে দুই লাখ ২৮ হাজার ছয়টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। এ ছাড়া জেলা, উপজেলা, পৌরসভা, থানা ও ইউনিয়নের মিলিত সংখ্যা পাঁচ হাজার ৯৪৭টি। এসবের ৮০ শতাংশেরও বেশিতে যদিও শহীদ মিনার স্থাপিত আছে। এই হিসাবে বাংলাদেশে শহীদ মিনারের আনুমানিক সংখ্যা দুই লাখেরও বেশি। পাড়া-মহল্লার ক্লাবগুলোর সামনেও শহীদ মিনার দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। জাতীয় তিনটি দিবস—একুশে ফেব্রুয়ারি, ছাব্বিশে মার্চ ও ষোলোই ডিসেম্বরে এসব মিনারে মানুষ পুষ্পমাল্য দিয়ে ভালোবাসা জানায়। একুশের প্রভাতে দেশব্যাপী ছাত্র-তরুণেরা আবেগ ও ভালোবাসা ঢেলে ইট বা বাঁশ দিয়ে ক্ষণিকের জন্য হাজার হাজার শহীদ মিনার তৈরি করে। এভাবেই তারা একুশের চেতনাকে জাগ্রত রাখে জনগণের হূদয়ে ও সমাজের মূল্যবোধে। সেই বায়ান্ন থেকে একাত্তরে যেমন আজও, তেমনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও তরুণ শিক্ষার্থীরাই ছিল গণতান্ত্রিক ও মানবিক সংস্কৃতি আর রাজনীতি প্রতিষ্ঠার অগ্রণী লড়াকু। আজও তাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষার্থীরাই একুশের আপন আশ্রয় হয়ে আছে।
আরেক দিক থেকেও শহীদ মিনার অতুলনীয়। আমাদের শহীদ মিনার কেবল অতীতের স্মৃতিচিহ্ন নয়, জীবন্ত সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। প্রতি একুশের রাতে শহীদ মিনার ফুলে আর মানুষের ভালোবাসার জমায়েতে নতুন হয়ে ওঠে, জীবন্ত হয়ে ওঠে। আমাদের সংস্কৃতির মানবিকতা-অসাম্প্রদায়িকতা ও অন্যায় বিরোধিতার জীবন্ত প্রেরণা। তাই প্রতিবাদের প্রয়োজনে, শোকের নীরবতায়, বিজয়ের উদ্যাপনে মানুষ ছুটে আসে দেশব্যাপী ছড়ানো সব শহীদ মিনারের পদতলে। কি রাজনৈতিক সভা, কি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, কি জাতীয় বীরদের অন্তিম শ্রদ্ধা প্রদর্শন—সব ক্ষেত্রেই শহীদ মিনারের মঞ্চ ও সোপানই প্রিয় ও পবিত্র স্থান। মুক্তিযুদ্ধের সম্মানে নির্মিত জাতীয় স্মৃতিসৌধের সঙ্গে এখানেই এর ফারাক। জাতীয় স্মৃতিসৌধ স্মৃতির প্রতীক, আর শহীদ মিনার চেতনাকে শাণিত করার মঞ্চ। জাতীয় স্মৃতিসৌধ রাষ্ট্রিক, শহীদ মিনার সামাজিক। শহীদ মিনার তাই কেবল অতীতের স্মারকই নয়, তা বর্তমানেও শুভবোধের শক্তির উৎস। তবে বায়ান্ন থেকে একাত্তর পর্যন্ত শহীদ মিনারের আবহ ও তাৎপর্য যেমন ছিল, এখন তেমনটা নেই। তখন শহীদ মিনার ও একুশে দিবসটি ছিল প্রতিবাদ ও বিদ্রোহের প্রতীক। স্বাধীনতার পর এই দিবসের মর্ম এবং এই মিনারের আবহকে সুকৌশলে কেবল শোকের মধ্যে আটকে রাখা হয়। গত বছরে জাতীয় শহীদ মিনারের সর্বজনীন চরিত্র ক্ষুণ্ন করে কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়, যা একুশের চেতনা ও শহীদ মিনারের বৈশিষ্ট্যের বিরোধী। শহীদ মিনার যত দিন জনগণের হাতে থাকবে, যত দিন সর্বজনীন থাকবে, তত দিন তা পথ দেখাবে। শহীদ মিনার আমাদের প্রতিরোধ চেতনার প্রাণভোমরা। আমাদের মানবিক সংস্কৃতির আত্মা। এই আত্মা বাঁচলেই আমরা বাঁচব।
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক।
farukwasif@yahoo.com
No comments