এই দিনে-রক্তে ভেজা খাপড়া ওয়ার্ডের স্মৃতি by নজমুল হক

১৯৫০ সালের ২৪ এপ্রিল, রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারের খাপড়া ওয়ার্ডের সেই ভয়াবহ নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডের ঘটনা কি ভুলে যাওয়া যায়? ২৪ এপ্রিল ঘটনার পেছনের ঘটনা হলো, ১৯৪৭ সালের পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গ্রামাঞ্চলের প্রত্যন্ত প্রান্তরে কৃষক বিদ্রোহের ব্যাপক সূচনা হয়।


ভূমিহীন কৃষকদের ভূমির দাবিতে ‘লাঙল যার, জমি তার’ আন্দোলন, তেভাগা আন্দোলন, বিপ্লবী কৃষক নেত্রী ইলা মিত্রের নেতৃত্বে নাচোল কৃষক বিদ্রোহ, শ্রমিক আন্দোলন ইত্যাদি সমগ্র দেশে ব্যাপকভাবে বিস্তৃতি লাভ করতে থাকে। ওই সব আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন বামপন্থী প্রগতিশীল নেতারা।
পাকিস্তানের রাষ্ট্রক্ষমতায় তখন মুসলিম লীগ সরকার। আন্দোলনে অংশ নেওয়া নেতাদের ওপর নেমে আসে মুসলিম লীগ সরকারের নির্মম অত্যাচার, নির্যাতন। দেশের কারাগারগুলো পাইকারি গ্রেপ্তারের মাধ্যমে ভরাট করতে থাকে সরকার। রাজবন্দীদের বিভিন্ন কারাগারে অমানবিকভাবে রাখা হয়েছিল। দেশের অন্যান্য কারাগারের মতো রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারেও রাজবন্দীদের বহুবিধ সমস্যা ছিল, যা খুবই অমানবিক। খাবার সমস্যা, চিকিৎসার অব্যবস্থাপনা, একই ওয়ার্ডে বিপুলসংখ্যক বন্দী থাকার ব্যবস্থা, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, যখন-তখন রাজবন্দীদের অপমান ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। জেল কর্তৃপক্ষ সরকারের রচিত জেলকোডও মেনে চলত না। স্বাধীন দেশ, অথচ রাজবন্দীদের ন্যূনতম মর্যাদাও দেওয়া হয়নি। এসব সসম্যা নিয়ে জেল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে, কিন্তু সমস্যার সমাধান হয়নি। এসব সমস্যা সমাধানের জন্য রাজবন্দীরা প্রতীকী অনশন ও একনাগাড়ে দীর্ঘদিন অনশন করছেন। কিন্তু দাবিদাওয়া মানা হয়নি।
এসব আন্দোলনের প্রেক্ষাপটেই ২৪ এপ্রিল ঘটনার সূত্রপাত। ঘটনার দিন ২৪ এপ্রিল ভোরবেলা খাপড়া ওয়ার্ডের রাজবন্দীরা ঘুম থেকে উঠে কেউ কেউ হাত-মুখ ধুচ্ছিলেন, শরীরচর্চা করছিলেন। ঠিক সেই সময় একজন জেল প্রহরী এসে বলল, রাজবন্দীদের কয়েকজনকে এখনই তার সঙ্গে জেল অফিসে যেতে হবে। তার বক্তব্য, অফিসে জেল সুপার ও জেলার গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার জন্য ডেকে পাঠিয়েছেন। রাজবন্দীরা জানালেন, এখন সকাল, সবেমাত্র সবাই ঘুম থেকে উঠেছেন, প্রস্তুত হয়ে অফিসে যাবেন। কিন্তু প্রহরী অকারণে তর্ক শুরু করল। রাজবন্দীরা এ মুহূর্তে জেল অফিসে যেতে অপারগতা প্রকাশ করলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই জেলার আমির হোসেন উত্তেজিত হয়ে ছুটে এলেন এবং রাজবন্দীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার শুরু করলেন। তিনি হুমকি দিয়ে বললেন, এ মুহূর্তে অফিসে না গেলে পরিণাম ভালো হবে না। রাজবন্দীরা জেলারের দুর্ব্যবহারের প্রতিবাদ করলেন। আমির হোসেন অফিসে ফিরে ইংরেজ জেল সুপার মি. বিলের কাছে বিষয়টি জানালেন। তখন মি. বিল গুলি চালানোর নির্দেশ দিলেন। ইতিমধ্যে কারাগারের পাগলা ঘণ্টা বা বিপৎসংকেত বাজিয়ে দেওয়া হলো এবং তৎক্ষণাৎ জেলার আমির হোসেন জেল পুলিশ বাহিনী নিয়ে রাজবন্দীদের ওপর আক্রমণ চালালেন। প্রথমে রাজবন্দীদের খাপড়া ওয়ার্ডের লকআপে পুরে এলোপাতাড়ি লাঠিপেটা ও বেয়নেট দিয়ে আঘাত করা হলো। তারপর বাইরে থেকে তালা বন্ধ করে চালানো হলো বৃষ্টির মতো গুলি। এতে ৭ জন রাজবন্দী শহীদ হলেন। আহত হলেন প্রায় ৪০ জন। রাজবন্দীরা প্রায় সবাই ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টি, তেভাগা আন্দোলন, কৃষক আন্দোলন ও শ্রমিক আন্দোলনের নেতা-কর্মী। শহীদ হন: বিজন সেন (রাজশাহী), হানিফ শেখ (কুষ্টিয়া), দেলওয়ার হোসেন (কুষ্টিয়া), আনোয়ার হোসেন (খুলনা), সুখেন ভট্টাচার্য (ময়মনসিংহ), সুধীন ধর (রংপুর), কম্পরাম সিং (দিনাজপুর)। আহত হয়েছিলেন: আমিনুল ইসলাম (বাদশা), বাবর আলি, প্রসাদ রায় (পাবনা), সিতাংশু মৈত্র (রাজশাহী), আবদুস শহীদ, রশীদ উদ্দিন (আবু), সদানন্দ ঘোষ (বরিশাল), পরিতোষ দাশগুপ্ত, সন্তোষ দাশগুপ্ত, আবদুল হক, হিরন সেন (যশোর), অনন্ত দেব, অনিমেষ ভট্টাচার্য, প্রিয়ব্রত দাশ, নন্দ সান্যাল, সত্যেন সরকার, গরিবুল্লাহ সরদার (কুষ্টিয়া), ফটিক রায়, সত্য ভট্টাচার্য, শ্যামল সেন (বগুড়া), ডোমারাম সিং, ভূপেন পালিত, কালি সরকার, বটুক দত্ত (দিনাজপুর), গণেশ সরকার (রংপুর), নাসির (ঢাকা), সৈয়দ মনসুর হাবিব (বর্ধমান), নূরনবী চৌধুরী (মুর্শিদাবাদ), মো. ইলিয়াসসহ (বিহার) আরও অনেক রাজবন্দী আহত ও নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন।
১৯৫০ সালের ২৪ এপ্রিল খাপড়া ওয়ার্ডের সেই ভয়াবহ হত্যাকাণ্ডের পর পুরো ওয়ার্ড রক্তের স্রোতে ভেসে গিয়েছিল।
১৯৫০ সালের ২৪ এপ্রিল খাপড়া ওয়ার্ডের ভয়াবহ হত্যাকাণ্ডের পর কিছুদিন ধরে প্রতিবছর ২৪ এপ্রিল দিবসটি পালন করা হতো। শহীদদের স্মরণে নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হতো। কিন্তু এখন দিবসটি খুব একটা পালন করতে দেখা যায় না। বর্তমান প্রজন্ম খাপড়া ওয়ার্ডের হত্যাকাণ্ড ঘটনাটি জানে না বললে ভুল হবে না। খাপড়া ওয়ার্ডের রাজবন্দীদের আত্মত্যাগ ও দেশপ্রেমের তুলনা হয় না। তাঁরা সবাই চাইছিলেন, অসাম্প্রদায়িক, প্রগতিশীল একটি গণতান্ত্রিক সমাজ, শোষণমুক্ত ও সমাজতান্ত্রিক সমাজ। তাঁদের চাওয়াটা ভুল ছিল না। পদ্ধতিগত ভুল ছিল কি না, সেটা ইতিহাসের বিচার্য বিষয়।
রাজশাহী খাপড়া ওয়ার্ডের শহীদদের স্মৃতি অমর হোক।
নজমুল হক

No comments

Powered by Blogger.