লিবিয়া-পতনের পথে গাদ্দাফি by রবার্ট ফিস্ক

সেই বৃদ্ধ, বিকারগ্রস্ত, নারী প্রহরীদের মালিক, উদ্ভট এক সবুজ বইয়ের লেখক, যিনি একদা ঘোষণা করেছিলেন শ্বেতাঙ্গদের ঘাড়ে চড়ে বেলগ্রেডে অনুষ্ঠিত জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনে হাজির হবেন, অবশেষে তিনি পতিত হচ্ছেন। নিজ দেশের ক্ষিপ্ত জনতা এখন তাঁকে তাড়া করছে।


লিবিয়ায় কল্পনা সত্য হয়ে যাচ্ছে, সত্য হয়ে যাচ্ছে আগুন এবং পুড়ছে পুলিশ স্টেশন। ত্রিপোলি ও বেনগাজিতে যারা নিহত হয়েছে, যারা প্রতিবাদ করছে, যে মহিলা গাড়ির দরজার আড়াল থেকে পিস্তল উঁচিয়ে আছে, যারা গাদ্দাফির সবুজ বইয়ের সিমেন্টের প্রতিকৃতি ভাঙছে, তারা কি তাঁর লেখালেখির পাঠক? বন্দুকযুদ্ধ, আগুনের শিখা এবং সেলফোনের গুঞ্জন যেন সেই শাসনব্যবস্থার সমাধিলিপি, সময়ে সময়ে আমরা যাকে সমর্থন করে এসেছিলাম।
মাত্র কয়েক দিন আগেও, যখন রাজপথে জনতার ক্রোধ উপচে পড়ছে, সে রকম সময়েও তিনি তাঁর এক পুরোনো বন্ধুকে বলছিলেন, কোনো ভালো সার্জন জানা আছে কি না, যিনি তাঁর মুখটাকে বদলে দেবেন? গল্পটি সত্য। বুড়ো খোকাকে এখন পাগলাটে দেখায়, তোবড়ানো গাল, উদ্ভ্রান্ত চোখ, আরবিতে একে বলে মাগনুন, মানে পাগল। প্রহসনের নায়ক তাঁর পতনের দিনে পরিণত হচ্ছেন গুরুতর ট্র্যাজেডির কেন্দ্রবিন্দুতে। অস্থির হয়ে নিচ্ছেন শেষ প্রসাধন, একটু পরেই ঢুকবেন মঞ্চের শেষ দৃশ্যে।
যখন বেনগাজি ও ত্রিপোলি আগুনে পুড়ছে, তখন তাঁর বিশ্বস্ত ছেলে সাইফ আল ইসলাম আল গাদ্দাফি বাবার পক্ষে দাঁড়িয়েছেন। হুমকি দিচ্ছেন, যদি লিবীয়রা শান্ত না হয়, তাহলে ‘গৃহযুদ্ধ বেধে যাবে’। এই ধনী হাঁদারাম ঘোষণা করেছেন, ‘ভুলে যাও তেল-গ্যাস সম্পদের কথা, গৃহযুদ্ধ বেধে যাবে।’ বাবার প্রিয় ছেলে যখন টেলিভিশনে ভাষণ দিচ্ছিলেন, তখন তাঁর মাথার পেছনে দেখা যাচ্ছিল সবুজ ভূমধ্যসাগর, যেন তাঁর মাথা থেকে বেরোনো এক দলা কাদা। এটা যেন ভাষণ নয়, ৪২ বছরের শাসনের অন্তিম বাণী।
তিনি যেন সেই স্বৈরশাসক, যে তলব করছে অস্তিত্বহীন এক সেনাবাহিনীকে, যারা তাঁকে আর তাঁর রাজধানীকে রক্ষা করবে। অবশেষে তিনি দুষছেন তাঁর নিজ জাতিকে। হিটলারের কথা ভুলে যান, গাদ্দাফির মতো কেউ নন। তিনি একই সঙ্গে মিকি মাউস ও সাধুপুরুষ, ব্যাটম্যান ও ক্লার্ক গ্যাবল এবং ওমর আল মুখতারের চরিত্রে অভিনয়কারী অ্যান্থনি কুইন (লায়ন অব ডেজার্ট ছবিতে লিবীয় নেতা ওমর আল মুখতারের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন অ্যান্থনি কুইন), নিরো ও মুসোলিনি। এঁদের মধ্যে সবচেয়ে তুখোড় অভিনেতা হলেন এই ব্যক্তি—মুয়াম্মার গাদ্দাফি। তিনি একটি বই লিখেছেন, যার শিরোনাম আজকে তাঁর অবস্থার সঙ্গে মিলে যায়: নরক হতে পলায়ন ও অন্যান্য গল্প। ফিলিস্তিন সমস্যার সমাধান তাঁর চোখে এক রাষ্ট্র গড়ে তোলা, যার নাম হবে ইসরায়েলিস্তিন।
অথচ তিনিই তাঁর দেশ থেকে লিবিয়ায় বসবাসকারী অর্ধেক ফিলিস্তিনিকে বিতাড়ন করেছিলেন; বলেছিলেন, হেঁটে চলে যাও তোমাদের হারানো মাতৃভূমিতে। তিনি আরব লিগ থেকে বেরিয়ে এসে বলেছিলেন, এই সংস্থার কোনো প্রাসঙ্গিকতা নেই। এরপর মিসরে এক সম্মেলনকেন্দ্রে ভুল করে তিনি ঢুকে পড়েছিলেন প্রসাধনের কক্ষে, পরে মিসরের খলিফা মোবারক তাঁকে হাত ধরে সম্মেলনকক্ষে নিয়ে যান, তখন তাঁর মুখে ঝুলছিল চিকন হাসি।
লিবিয়ায় আমরা যা দেখছি, তা যদি সত্যিকার বিপ্লব হয়ে থাকে, তাহলে অচিরেই আমরা দেখতে পাব লুটপাট। অবশ্য তার আগেই যদি পশ্চিমা দূতাবাসগুলোর লোকজন লকারবি ও ১৯৮৯ সালের ইউটিএ বিমান বিস্ফোরণ এবং বার্লিন ডিস্কোতে বোমা বিস্ফোরণ সম্পর্কে লিবিয়ার ভাষ্যসংবলিত ফাইলগুলো পেয়ে না যায়। তিনি আইরিশ রিপাবলিকান আর্মিকে অস্ত্র সরবরাহ করেছেন, হত্যা করেছেন প্রতিপক্ষদের এবং এক ব্রিটিশ নারী পুলিশকে। প্রতিবেশী শাদে আগ্রাসন চালিয়েছেন, কারবার করেছেন ব্রিটিশ তেলকুবেরদের সঙ্গে। লকারবি বিমান বিস্ফোরণের প্রতিশোধে ১৯৮৬ সালে যুক্তরাষ্ট্র ত্রিপোলির প্রেসিডেন্ট প্রাসাদে বোমাবর্ষণ করলে বেশ কয়েকজন বেসামরিক ব্যক্তিসহ মারা যান তাঁর পালিত কন্যা। আবার তিনিই লকারবির হোতা বলে অভিযুক্ত আল মাগরেহিকে ব্রিটেনের হাত থেকে ছাড়িয়ে দেশে নিয়ে এসেছেন। গাদ্দাফির পতনের পর হয়তো এসব বিষয়ের আসল খবর বিশ্ব জানতে পারবে।
এবং কে জানে তাঁর সবুজ গ্রন্থের মহাফেজখানায় আর কী কী লুকানো আছে। হয়তো সেখানে আমরা পাব সম্প্রতি ব্রিটেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী লর্ড ব্লেয়ারের সফরের সময়কার গোপন কথোপকথন। ব্লেয়ারের সঙ্গে তাঁর করমর্দনের পরের দিনই সৌদি আরব অভিযোগ করে, গাদ্দাফি নাকি পাশ্চাত্যের ঘনিষ্ঠ মিত্র সৌদির বাদশাহ আবদুল্লাহকে হত্যার পরিকল্পনা করছিলেন।
একসময় এই ব্যক্তিকে পাশ্চাত্য সবচেয়ে বেশি ভয় করত, কিছুদিন আগে ভাবত মিত্র আর এখন দেখাচ্ছে ঘৃণা। গাদ্দাফি লিখেছেন, যিশুখ্রিষ্টের ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার ঘটনা একটা বানানো গল্প।
আরবে বহু বছর যাবৎ গাদ্দাফির পতনের গল্প প্রচলিত। দশকের পর দশক শত্রুরা তাঁকে হত্যার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে। আর বহু বছর ধরেই লিবিয়ার জাতীয়তাবাদীদের মৃত্যু হচ্ছে গাদ্দাফির নির্যাতনকেন্দ্রে, ইসলামপন্থীরা মার খাচ্ছে রাজপথে।তিনি তাদের সবাইকেই খতম করেছেন। ১৯৭৯ সালে তিনি বেনগাজি শহরের রাজপথে প্রকাশ্যে প্রতিবাদী ছাত্রদের লাশ ঝুলিয়ে রেখেছিলেন। আমি এখানে লিবিয়ার মানবাধিকার নেতা মানসুর আল কিখিয়ার নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার কথা তো বলিইনি। তিনি সে সময় মিসরে এক মানবাধিকার সম্মেলনে লিবিয়ায় রাজনৈতিক বন্দীদের হত্যার অভিযোগ করেছিলেন। সেখান থেকেই তিনি নিখোঁজ হন। এবং এটাও মনে রাখা দরকার, ৪২ বছর আগে ব্রিটেনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গাদ্দাফির অভ্যুত্থানকে সমর্থন করেছিল। সে সময় পুতুল শাসক, দুর্নীতিগ্রস্ত রাজা ইদ্রিসকে হটিয়ে গাদ্দাফি ক্ষমতায় এসেছিলেন। তখনো এবং কিছুদিন আগেও তারা গাদ্দাফির ব্যাপারে দারুণ উৎসাহী ছিল এবং আছে। সে জন্যই ব্লেয়ার এই তেলকুবের রাষ্ট্রে সফর করেন এবং গাদ্দাফিকে আলিঙ্গন করেন।
লিবিয়ার এক বিরোধী গোষ্ঠী কয়েক বছর আগে আমাদের বলেছিল, ‘গাদ্দাফি আমাদের বিশ্বাস করাতে চান, তাঁর জীবদ্দশায় মানবতার যত অগ্রগতি হয়েছে, তিনি তার সবেরই পথপ্রদর্শক।’
বেলগ্রেডের সেই জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনে গাদ্দাফি গিয়েছিলেন এক প্লেনভর্তি উট নিয়ে, তিনি তাদের দুধ খাবেন বলে। কিন্তু তাঁকে শ্বেতাঙ্গদের ঘাড়ে চড়তে দেওয়া হয়নি।
লন্ডনের দি ইনডিপেন্ডেন্ট থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত
রবার্ট ফিস্ক: ব্রিটিশ সাংবাদিক, মধ্যপ্রাচ্য বিশেষজ্ঞ।

No comments

Powered by Blogger.