প্রতিক্রিয়া-ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়: সাফল্য ও সংকটের প্রকৃতি by মোহাম্মদ তানজীমউদ্দিন খান
মোহীত উল আলমকে ধন্যবাদ, ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১১ তারিখে প্রথম আলোতে প্রকাশিত তাঁর ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়: বড় গৌরব, বড় পতন’ শিরোনামে লেখাটির জন্য। লেখাটিতে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষামানের অধোগতি ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন।
লেখাটির শুরুতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে তিনি লিখেছেন, ‘...পরিশ্রম করার আগ্রহ ঢাবির লোকদের নেই বলে [সে] উদ্দীপনাটা অনুপস্থিত।’ বিষয়টি যেন এমন যে, এই প্রতিষ্ঠানটির সব শিক্ষক বা শিক্ষার্থী অলসভাবে দিন যাপন করেন। এ ধরনের সাধারণীকরণ কতটুকু যৌক্তিক?
তিনি জানিয়েছেন, বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান এশিয়ার শীর্ষস্থানীয় প্রথম ১০০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যেও নেই। এটা ঠিক, এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশ্ব-শিক্ষায় অবস্থান দুর্বল থেকে দুর্বলতর হচ্ছে। কিন্তু এর মানে কি বিশ্ববিদ্যালয়টি এখন পুরোপুরি ব্যর্থ ও সম্ভাবনাহীন প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে? বর্তমান সময়ে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কি কোনোই সাফল্য নেই?
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে লেখক মোহীত উল আলম এই প্রেক্ষাপটকে মিলিয়েছেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনসহ অন্যান্য রাজনৈতিক আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামগ্রিক অবদান এবং স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে ‘প্রলম্বিত ক্ষয়িষ্ণু’ রাজনৈতিক ধারায় এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির জ্ঞানবিমুখ হয়ে ওঠাকে। তাই আমি মনে করি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে বোঝার ক্ষেত্রে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিগত বিশ্লেষণ খুবই জরুরি।
রাষ্ট্র ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্যগত ভূমিকা দুটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যের জন্ম দিয়েছে, যা মূলত এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যর্থতা আর সাফল্যের নিয়ামক হিসেবে এখন পর্যন্ত খুব সক্রিয়।
প্রথম বৈশিষ্ট্যটির আলোচনা করা যাক। রাষ্ট্রে যাঁরাই ক্ষমতাসীন কিংবা ক্ষমতাচ্যুত হন, তাঁরাই এই প্রতিষ্ঠানটিতে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করার ব্যাপারটি অন্য যেকোনো রাজনৈতিক বিষয়ের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। ফলে রাষ্ট্রের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পর্কের ভিত্তি—অস্থিরতা আর অনিশ্চয়তা। সেটা কাটাতে রাষ্ট্রের ক্ষমতাসীনেরা হয় বলপ্রয়োগের আশ্রয় নেন অথবা একরকমের পোষক-পোষিতের (পেট্রন-ক্লায়েন্ট) কাঠামোর বিকাশ ও লালনকে মূল কাজ বলে মনে করেন। মূলত এই কাঠামোটি সামরিক সরকারগুলোর ধারাবাহিকতায় ‘গণতান্ত্রিক’ রাজনৈতিক দলগুলোও এখন পর্যন্ত ব্যবহার করে আসছে। এই সুযোগে ব্যক্তিপর্যায়ে অর্থনৈতিক নিশ্চয়তা ও রাজনৈতিক ক্ষমতার ভাগ পাওয়ার ক্ষেত্রে শিক্ষকদের একটি অংশ সাদা-নীল-আকাশি-হলুদ বর্ণে বিভক্ত হয়ে মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলোকে তোষণে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। এর একটা বড় কারণ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জীবনযাপনে স্বাভাবিক মানের অনিশ্চয়তা আর অভাববোধ। শিক্ষার্থীরাও একই অবস্থার শিকার। তাদের ক্ষেত্রে এই বিষয়টির প্রাথমিক সূচনা ঘটে হলে আসন পাওয়াকে কেন্দ্র করে।
রাজনৈতিক দলগুলোর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা ও আধিপত্য বিস্তারই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোকে এবং এর বিকাশের ধারাকে দুর্বল থেকে দুর্বলতর করছে। তাই ক্ষমতার পটপরিবর্তনে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনে যাঁরা অধিষ্ঠিত হন, তাঁদেরকে টিকে থাকার জন্য উচ্চশিক্ষার মানের উন্নয়ন নিশ্চিত করার ওপর নির্ভর করতে হয় না। বরং ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সুসম্পর্কটাই মূল নিয়ামক। তার পরও এই বিশ্ববিদ্যালয়কে শিক্ষার্থী আকৃষ্ট করার জন্য বিজ্ঞাপনের ওপর নির্ভর করতে হয় না। কেননা অর্থনৈতিকভাবে সামর্থ্যহীন অথবা কম সামর্থ্যের মেধাবী শিক্ষার্থীদের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এখনো অন্যতম ভরসা। এখন প্রশ্ন হলো, প্রশাসনিকভাবে প্রতিষ্ঠানটি এত দুর্বল হওয়ার পরেও এ রকমটা কেন?
রাজনীতির ক্ষেত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গৌরবময় ইতিহাস শিক্ষার্থী-শিক্ষকদের মধ্যে একটা অহমবোধের জন্ম দেয়। এই অহমবোধের একটা অদ্ভুত প্রাণশক্তি আছে, যা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিপর্যায়ে এখনো সাফল্য পেতে ভীষণভাবে অনুপ্রাণিত করে। এটাও সত্য, এ ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রাতিষ্ঠানিক ভূমিকা খুবই দুর্বল। আর এই দুর্বলতার কারণে বিশ্ব র্যাঙ্কিংয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে খুঁজে পাওয়া যায় না। ব্যক্তিসাফল্যকে এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রাতিষ্ঠানিক সাফল্য হিসেবে তুলে ধরতে পারে না। তাই গবেষণা ও প্রকাশনা কাঠামোর ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়কে খুব বেশি মনোযোগী হতেও দেখা যায় না।
আসলে ঐতিহ্যগত ভাবমূর্তি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর সাফল্যের মূল প্রাণশক্তি। বিশ্বব্যাপী উচ্চশিক্ষা-সংক্রান্ত (মাস্টার্স ও পিএইচডি পর্যায়ে) মেধাবৃত্তি পাওয়ার ক্ষেত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখনো এগিয়ে আছে। এটা বোঝার জন্য আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের (আমার কর্মস্থল) সাফল্য বিবেচনাই যথেষ্ট। এ বিভাগের নবীন ও তরুণ শিক্ষকদের প্রায় সবাই এখন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডাসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মেধাবৃত্তি নিয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণে নিয়োজিত। জ্যেষ্ঠ শিক্ষকদের একাডেমিক অর্জন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সর্বজন-প্রশংসিত। অন্যান্য বিভাগের গবেষণা ক্ষেত্রে অবদানের কথা বিবেচনা করলেও খুব দূর-অতীতে যাওয়ার দরকার নেই। সম্প্রতি পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের ড. মইনুল হোসেনের নিক সাইমন স্কলার নির্বাচিত হওয়া অথবা অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমসের ড. মিজানুর রহমানের গ্লোবাল ডেভেলপমেন্ট নেটওয়ার্ক প্রদত্ত গোল্ড মেডেল প্রাপ্তি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কম সাফল্য নির্দেশ করে না। পাটের জিনোম ডিকোডিংয়ে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের গবেষণা-প্রচেষ্টাকে খাটো করে দেখার কিছু নেই। এখনো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কর্তৃক রচিত গবেষণাগ্রন্থ ম্যাকমিলান, রাউটলেজসহ অনেক বিখ্যাত প্রকাশনা সংস্থা থেকে বের হচ্ছে। কিছুদিন আগেই সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক শাহাদত হোসেনের আরবান পোভার্টি ইন বাংলাদেশ ম্যাকমিলান থেকে প্রকাশিত হলো। এ রকম আরও অনেক উদাহরণ আছে।
শুধু ইংরেজি বিভাগের করিডরের অভিজ্ঞতা দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে চূড়ান্ত উপসংহার টানা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। আরেকটি বিষয় হলো, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগ ও ফ্যাকাল্টি পর্যায়ে একাডেমিক কার্যক্রমকে একই রকম মানদণ্ডে বিবেচনা করাটা ঠিক নয়। অর্থনীতি, ফার্মেসি বিভাগ অথবা ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদের সাফল্যকে অন্যান্য অনেক দুর্বল বিভাগ ও ফ্যাকাল্টির একাডেমিক কার্যক্রমের ব্যর্থতার সঙ্গে মিলিয়ে ফেলাটা হবে বড় রকমের অবিচার।
মোহীত উল আলম তাঁর লেখায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হারানো গৌরব ফিরে পাওয়ার জন্য ‘দেশপ্রেমমূলক রাজনৈতিক ঐতিহ্য’ থেকে ফিরে এসে ‘মূল কাজে’ মনোনিবেশের পরামর্শ দিয়েছেন। আর সেটা বলতে তিনি বুঝিয়েছেন, রাজনীতিবিবর্জিত ‘তথ্য ও জ্ঞাননির্ভর’ মেধা গঠনকে। তাঁর এই পরামর্শটি আমার কাছে খুবই গোলমেলে মনে হয়। উচ্চশিক্ষা অর্জনের লক্ষ্য যদি তা-ই হয়, তাহলে সেখানে টেকনোক্রেটিক নলেজ ছাড়া অন্য কোনো কিছু জন্ম দেওয়া সম্ভব নয়। রাজনৈতিক বোধ ছাড়া জ্ঞান ও তথ্য নির্মাণের যে রাজনীতি, সেটাও বোঝার সামর্থ্য হারাব।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্যা রাজনৈতিক বোধের লালনে বা রাজনৈতিক ঐতিহ্যে নয়, প্রশাসনিক কাঠামোতে যে অপরাজনীতি ও দুষ্টু রাজনীতি বাসা বেঁধেছে, সেটাই মূল সমস্যা। এই সংকটপূর্ণ কাঠামোর সঙ্গে সাম্প্রতিক সময়ে যুক্ত হয়েছে আরও দুটি নতুন বিষয়। এর একটি হলো শিক্ষকদের এনজিও কার্যক্রমে অংশগ্রহণ, অপরটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোকে অনেক বেশি গুরুত্ব দেওয়া।
উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়ন নিশ্চিত করতে হলে রাষ্ট্রের সঙ্গে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পর্ক পুনর্নির্ধারণ করা প্রয়োজন। সেটা করার জন্য প্রয়োজন জাতীয় পর্যায়ে দুর্বৃত্তায়ন ও দখলের রাজনীতিতে মৌলিক পরিবর্তন আনা।
মোহাম্মদ তানজীমউদ্দিন খান: শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ; বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ার নিউ ইংল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি অধ্যয়নরত।
তিনি জানিয়েছেন, বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান এশিয়ার শীর্ষস্থানীয় প্রথম ১০০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যেও নেই। এটা ঠিক, এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশ্ব-শিক্ষায় অবস্থান দুর্বল থেকে দুর্বলতর হচ্ছে। কিন্তু এর মানে কি বিশ্ববিদ্যালয়টি এখন পুরোপুরি ব্যর্থ ও সম্ভাবনাহীন প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে? বর্তমান সময়ে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কি কোনোই সাফল্য নেই?
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে লেখক মোহীত উল আলম এই প্রেক্ষাপটকে মিলিয়েছেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনসহ অন্যান্য রাজনৈতিক আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামগ্রিক অবদান এবং স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে ‘প্রলম্বিত ক্ষয়িষ্ণু’ রাজনৈতিক ধারায় এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির জ্ঞানবিমুখ হয়ে ওঠাকে। তাই আমি মনে করি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে বোঝার ক্ষেত্রে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিগত বিশ্লেষণ খুবই জরুরি।
রাষ্ট্র ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্যগত ভূমিকা দুটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যের জন্ম দিয়েছে, যা মূলত এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যর্থতা আর সাফল্যের নিয়ামক হিসেবে এখন পর্যন্ত খুব সক্রিয়।
প্রথম বৈশিষ্ট্যটির আলোচনা করা যাক। রাষ্ট্রে যাঁরাই ক্ষমতাসীন কিংবা ক্ষমতাচ্যুত হন, তাঁরাই এই প্রতিষ্ঠানটিতে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করার ব্যাপারটি অন্য যেকোনো রাজনৈতিক বিষয়ের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। ফলে রাষ্ট্রের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পর্কের ভিত্তি—অস্থিরতা আর অনিশ্চয়তা। সেটা কাটাতে রাষ্ট্রের ক্ষমতাসীনেরা হয় বলপ্রয়োগের আশ্রয় নেন অথবা একরকমের পোষক-পোষিতের (পেট্রন-ক্লায়েন্ট) কাঠামোর বিকাশ ও লালনকে মূল কাজ বলে মনে করেন। মূলত এই কাঠামোটি সামরিক সরকারগুলোর ধারাবাহিকতায় ‘গণতান্ত্রিক’ রাজনৈতিক দলগুলোও এখন পর্যন্ত ব্যবহার করে আসছে। এই সুযোগে ব্যক্তিপর্যায়ে অর্থনৈতিক নিশ্চয়তা ও রাজনৈতিক ক্ষমতার ভাগ পাওয়ার ক্ষেত্রে শিক্ষকদের একটি অংশ সাদা-নীল-আকাশি-হলুদ বর্ণে বিভক্ত হয়ে মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলোকে তোষণে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। এর একটা বড় কারণ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জীবনযাপনে স্বাভাবিক মানের অনিশ্চয়তা আর অভাববোধ। শিক্ষার্থীরাও একই অবস্থার শিকার। তাদের ক্ষেত্রে এই বিষয়টির প্রাথমিক সূচনা ঘটে হলে আসন পাওয়াকে কেন্দ্র করে।
রাজনৈতিক দলগুলোর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা ও আধিপত্য বিস্তারই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোকে এবং এর বিকাশের ধারাকে দুর্বল থেকে দুর্বলতর করছে। তাই ক্ষমতার পটপরিবর্তনে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনে যাঁরা অধিষ্ঠিত হন, তাঁদেরকে টিকে থাকার জন্য উচ্চশিক্ষার মানের উন্নয়ন নিশ্চিত করার ওপর নির্ভর করতে হয় না। বরং ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সুসম্পর্কটাই মূল নিয়ামক। তার পরও এই বিশ্ববিদ্যালয়কে শিক্ষার্থী আকৃষ্ট করার জন্য বিজ্ঞাপনের ওপর নির্ভর করতে হয় না। কেননা অর্থনৈতিকভাবে সামর্থ্যহীন অথবা কম সামর্থ্যের মেধাবী শিক্ষার্থীদের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এখনো অন্যতম ভরসা। এখন প্রশ্ন হলো, প্রশাসনিকভাবে প্রতিষ্ঠানটি এত দুর্বল হওয়ার পরেও এ রকমটা কেন?
রাজনীতির ক্ষেত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গৌরবময় ইতিহাস শিক্ষার্থী-শিক্ষকদের মধ্যে একটা অহমবোধের জন্ম দেয়। এই অহমবোধের একটা অদ্ভুত প্রাণশক্তি আছে, যা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিপর্যায়ে এখনো সাফল্য পেতে ভীষণভাবে অনুপ্রাণিত করে। এটাও সত্য, এ ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রাতিষ্ঠানিক ভূমিকা খুবই দুর্বল। আর এই দুর্বলতার কারণে বিশ্ব র্যাঙ্কিংয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে খুঁজে পাওয়া যায় না। ব্যক্তিসাফল্যকে এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রাতিষ্ঠানিক সাফল্য হিসেবে তুলে ধরতে পারে না। তাই গবেষণা ও প্রকাশনা কাঠামোর ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়কে খুব বেশি মনোযোগী হতেও দেখা যায় না।
আসলে ঐতিহ্যগত ভাবমূর্তি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর সাফল্যের মূল প্রাণশক্তি। বিশ্বব্যাপী উচ্চশিক্ষা-সংক্রান্ত (মাস্টার্স ও পিএইচডি পর্যায়ে) মেধাবৃত্তি পাওয়ার ক্ষেত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখনো এগিয়ে আছে। এটা বোঝার জন্য আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের (আমার কর্মস্থল) সাফল্য বিবেচনাই যথেষ্ট। এ বিভাগের নবীন ও তরুণ শিক্ষকদের প্রায় সবাই এখন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডাসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মেধাবৃত্তি নিয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণে নিয়োজিত। জ্যেষ্ঠ শিক্ষকদের একাডেমিক অর্জন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সর্বজন-প্রশংসিত। অন্যান্য বিভাগের গবেষণা ক্ষেত্রে অবদানের কথা বিবেচনা করলেও খুব দূর-অতীতে যাওয়ার দরকার নেই। সম্প্রতি পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের ড. মইনুল হোসেনের নিক সাইমন স্কলার নির্বাচিত হওয়া অথবা অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমসের ড. মিজানুর রহমানের গ্লোবাল ডেভেলপমেন্ট নেটওয়ার্ক প্রদত্ত গোল্ড মেডেল প্রাপ্তি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কম সাফল্য নির্দেশ করে না। পাটের জিনোম ডিকোডিংয়ে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের গবেষণা-প্রচেষ্টাকে খাটো করে দেখার কিছু নেই। এখনো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কর্তৃক রচিত গবেষণাগ্রন্থ ম্যাকমিলান, রাউটলেজসহ অনেক বিখ্যাত প্রকাশনা সংস্থা থেকে বের হচ্ছে। কিছুদিন আগেই সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক শাহাদত হোসেনের আরবান পোভার্টি ইন বাংলাদেশ ম্যাকমিলান থেকে প্রকাশিত হলো। এ রকম আরও অনেক উদাহরণ আছে।
শুধু ইংরেজি বিভাগের করিডরের অভিজ্ঞতা দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে চূড়ান্ত উপসংহার টানা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। আরেকটি বিষয় হলো, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগ ও ফ্যাকাল্টি পর্যায়ে একাডেমিক কার্যক্রমকে একই রকম মানদণ্ডে বিবেচনা করাটা ঠিক নয়। অর্থনীতি, ফার্মেসি বিভাগ অথবা ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদের সাফল্যকে অন্যান্য অনেক দুর্বল বিভাগ ও ফ্যাকাল্টির একাডেমিক কার্যক্রমের ব্যর্থতার সঙ্গে মিলিয়ে ফেলাটা হবে বড় রকমের অবিচার।
মোহীত উল আলম তাঁর লেখায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হারানো গৌরব ফিরে পাওয়ার জন্য ‘দেশপ্রেমমূলক রাজনৈতিক ঐতিহ্য’ থেকে ফিরে এসে ‘মূল কাজে’ মনোনিবেশের পরামর্শ দিয়েছেন। আর সেটা বলতে তিনি বুঝিয়েছেন, রাজনীতিবিবর্জিত ‘তথ্য ও জ্ঞাননির্ভর’ মেধা গঠনকে। তাঁর এই পরামর্শটি আমার কাছে খুবই গোলমেলে মনে হয়। উচ্চশিক্ষা অর্জনের লক্ষ্য যদি তা-ই হয়, তাহলে সেখানে টেকনোক্রেটিক নলেজ ছাড়া অন্য কোনো কিছু জন্ম দেওয়া সম্ভব নয়। রাজনৈতিক বোধ ছাড়া জ্ঞান ও তথ্য নির্মাণের যে রাজনীতি, সেটাও বোঝার সামর্থ্য হারাব।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্যা রাজনৈতিক বোধের লালনে বা রাজনৈতিক ঐতিহ্যে নয়, প্রশাসনিক কাঠামোতে যে অপরাজনীতি ও দুষ্টু রাজনীতি বাসা বেঁধেছে, সেটাই মূল সমস্যা। এই সংকটপূর্ণ কাঠামোর সঙ্গে সাম্প্রতিক সময়ে যুক্ত হয়েছে আরও দুটি নতুন বিষয়। এর একটি হলো শিক্ষকদের এনজিও কার্যক্রমে অংশগ্রহণ, অপরটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোকে অনেক বেশি গুরুত্ব দেওয়া।
উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়ন নিশ্চিত করতে হলে রাষ্ট্রের সঙ্গে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পর্ক পুনর্নির্ধারণ করা প্রয়োজন। সেটা করার জন্য প্রয়োজন জাতীয় পর্যায়ে দুর্বৃত্তায়ন ও দখলের রাজনীতিতে মৌলিক পরিবর্তন আনা।
মোহাম্মদ তানজীমউদ্দিন খান: শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ; বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ার নিউ ইংল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি অধ্যয়নরত।
No comments