* তদন্তকারীরা বললেন, অগ্রগতি এক কথায় শূন্য-* ইলিয়াস আলীর স্ত্রীর আক্ষেপ-'সবাই শুধু জানতে আসে জানাতে পারে না কিছুই' by পারভেজ খান ও এস এম আজাদ
'কেউ কোনো শর্ত দেওয়া দূরে থাক, নিজেকে সান্ত্বনা দেওয়ার মতো সামান্যতম আশ্বাসটুকুও পাইনি। জানি না আমার স্বামী এখন কোথায় আছেন, কেমন আছেন। আমি রাজনীতি বুঝি না, সংসার বুঝি। অবুঝ সন্তানদের আহাজারি আমি থামাতে পারছি না। এলোমেলো নিউজ লিখে আমাকে আর বিপর্যস্ত করবেন না।
আপনারাও চেষ্টা করুন। আমার শুধু একটাই চাওয়া- আমি আমার স্বামীকে ফিরে পেতে চাই।' নিখোঁজ বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলীর স্ত্রী তাহসিনা রুশদীর লুনা গতকাল সোমবার সকালে সাংবাদিকদের কাছে এভাবে অনুনয় করেন।
অন্যদিকে ইলিয়াস আলীর নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা তদন্তের অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলেন, 'এক কথায় শূন্য।'
এদিকে উত্তর বাড্ডার জিএম প্লাজা থেকে ওই রাতে (ইলিয়াস আলীর নিখোঁজ হওয়ার রাত) দুই ব্যক্তি অপহৃত হওয়ার ঘটনার তদন্তে নেমেছেন গোয়েন্দারা। গতকাল কালের কণ্ঠে এ বিষয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ পাওয়ার পর থেকেই তাঁরা মাঠে নেমেছেন। একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা জানান, ওই রাতে ওখান থেকে দুজন অপহৃত হয়েছেন- এ রকম তথ্য তাঁরা পেয়েছেন। প্রাথমিক তদন্তে অভিযোগের প্রমাণও পাওয়া গেছে। কয়েকজনের কাছ থেকে জানা গেছে, যে দুজনকে অপহরণ করা হয়, তাঁদের সঙ্গে ইলিয়াস আলী ও তাঁর গাড়িচালক আনসারের চেহারার মিল আছে। আবার অমিলের কথাও কেউ কেউ বলেছেন। কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী বলেছেন, এই অপহরণের ঘটনাটি ঘটেছে রাত ১২টার দিকে। তাঁরা অনেকটা নিশ্চিত হয়েই এটা বলছেন। আবার ইলিয়াস আলী রাত ১২টা পর্যন্ত রপসী বাংলা হোটেলে অবস্থান করেছেন- এটাও নিশ্চিত। তাই ব্যাপারটি তাঁরা গভীরভাবে তদন্ত করছেন।
ইলিয়াস আলীর নিখোঁজ হওয়ার ঘটনার ব্যাপারে উচ্চপদস্থ একজন সাবেক গোয়েন্দা কর্মকর্তা (সামরিক বিভাগে ছিলেন) গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, তাঁর কাছে মনে হচ্ছে এই নিখোঁজের ঘটনার পর তদন্তসংশ্লিষ্ট বিভাগ কোথাও কোনো না কোনোভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তাদের আন্তরিকতায় কিছুটা ঘাটতি আছে বলেও তাঁর কাছে মনে হচ্ছে। আর সব প্রচারমাধ্যমের ভূমিকাও সঠিক নয়। কয়েকটি পত্রিকা সংবাদ পরিবেশনের ক্ষেত্রে খুব একটা দায়িত্বশীলতা দেখাতে পারছে বলে মনে হয় না। বরং বলা চলে, তারা উল্টো ক্ষতি করছে। আর রাজনীতিবিদরা তো যা করছেন, তাকে রাজনৈতিক ফায়দা লোটা বা পলিটিক্যাল বিজনেস বলা চলে। আর এর শিকার হচ্ছে ইলিয়াসের পরিবার। তৈরি হচ্ছে একটি নোংরা দৃষ্টান্ত, যা ভবিষ্যতের জন্য ভালো নয়। ইলিয়াস আলীর যদি কোনো বড় ধরনের ক্ষতি না হয়ে থাকে, তবে এসব কারণে সেটা হতেই বা কতক্ষণ? ইলিয়াস আলী যদি কোনো রাজনৈতিক বা রাষ্ট্রীয় ষড়যন্ত্রের শিকার না হয়ে থাকেন, যদি এলাকার আধিপত্য বিস্তার বা পূর্বশত্রুতা নিয়ে প্রতিপক্ষের শিকার হয়ে থাকেন তবে বর্তমান অবস্থায় সেখান থেকে বের হয়ে আসাও বিপজ্জনক। বলা চলে সম্ভাবনা কম। তাই এর দায়-দায়িত্ব সরকার আর বিরোধী দল উভয়ের ওপরই বর্তাবে।
পুলিশের আইজি খন্দকার হাসান মাহমুদ গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ইলিয়াস আলীকে উদ্ধারের প্রচেষ্টায় তাঁদের আন্তরিকতার কোনো কমতি নেই। তাঁরা সাধ্যমতো চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তবে এখন পর্যন্ত বলার মতো কোনো অগ্রগতি নেই।
র্যাবের মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার সোহায়েল বলেন, ইলিয়াস আলীর মুক্তির ব্যাপারে একটি মহল থেকে শর্ত দেওয়া হয়েছে বলে যে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে, তার পেছনে কোনো যুক্তি নেই। এটি হাস্যকর। শর্ত দিলে কে শর্ত দিচ্ছে, কাকে শর্ত দিচ্ছে, কী শর্ত দিচ্ছে- সেটা স্পষ্ট হলেই তো নিখোঁজ-রহস্য উন্মোচিত হয়ে যায়। এ রকম কোনো তথ্য স্পষ্ট হলে তদন্তসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের জন্যও সুবিধা হয়।
কমান্ডার সোহায়েল বলেন, এখন পর্যন্ত তাঁদের কাছে মনে হচ্ছে এই নিখোঁজ-রহস্যের পেছনে বৃহত্তর সিলেটের কোনো নেপথ্য কারণ লুকিয়ে আছে। তাঁরাও বিষয়টি জোরালোভাবে খতিয়ে দেখছেন। তবে এখন পর্যন্ত তদন্তের অগ্রগতি এককথায় শূন্য।
গতকাল সকালে বনানীর বাসভবনে ইলিয়াস আলীর স্ত্রী তাহসিনা রুশদীর লুনা কালের কণ্ঠকে বলেন, 'গোয়েন্দা কর্মকর্তারা আমার কাছে আসছেন। সাংবাদিকরা আসছেন। র্যাব-পুলিশ আসছে। সবাই আমার কাছে নানান তথ্য জানতে আসছেন। সবাই শুধু জানতেই চান। সম্ভাব্য কারণ কী, আমি কাউকে সন্দেহ করি কি না, আমার স্বামী কাদের সঙ্গে বেশি মিশেছে, তিনি কখনো কোনো আশঙ্কার কথা বলেছেন কি না- জানতে চান নানান তথ্য। কিন্তু আমাকে কেউ কিছু জানাতে পারছে না। সবারই জানার আগ্রহ অনেক। কিন্তু আমার আগ্রহ শুধু একটাই। আমি জানতে চাই আমার স্বামী কোথায়?'
ইলিয়াস আলীর মুক্তির ব্যাপারে কেউ কোনো শর্ত দিয়েছে কি না জানতে চাইলে লুনা বলেন, এগুলো ভিত্তিহীন কথা।
আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'আমাকে ভয় দেখাবে কে? চাপ দিবে কে? আমি মাথা তুলে দাঁড়াতে পারছি না। আমার পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গেছে। যা রটছে, এগুলো বাজে কথা। আর আমি কোনো চাপকেই ভয় করি না। কে শর্ত দিবে? কিসের শর্ত? কিসের চাপ? আমি সব শর্ত মেনে আমার স্বামীকে ফেরত চাই। কিন্তু কেউ কোনো শর্ত নিয়েও আসছে না। এলে তো অন্তত এটুকু বুঝতে পারতাম যে আমার স্বামী বেঁচে আছে। সেটাও তো পারছি না। এত কষ্ট আর যন্ত্রণায় আছি, যেটা কাউকে বুঝিয়ে বলা সম্ভব নয়।'
সাংবাদিকদের সহযোগিতা কামনা করে তিনি বলেন, 'আপনারা এই বিপদের মাঝে আমাদের পাশে দাঁড়ান। আমার স্বামীকে খুঁজে বের করার ব্যাপারে সহযোগিতা করুন। দয়া করে আমার সন্তানদের এতিম করবেন না।'
তিনি সরকারেরর প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, 'ছয় দিন হয়ে গেছে, আমার স্বামী নিখোঁজ হয়ে আছেন। কিছু একটা করুন।'
ইলিয়াস আলীর সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে কি না- এমন এক প্রশ্নের জবাবে তাহসিনা রুশদীর বলেন, 'যোগাযোগ হলেও তো বুঝতে পারতাম সে বেঁচে আছে।'
অন্য এক সূত্র থেকে জানা যায়, গতকাল দুপুরের দিকে তাহসিনা রুশদীর অসুস্থ হয়ে পড়েন। এ সময় পারিবারিক চিকিৎসক বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্ডিওলজি বিভাগের সহকারী রেজিস্ট্রার ডা. মনোয়ারুল কাদির তাঁকে দেখতে আসেন। পরে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, তাহসিনার উচ্চ রক্তচাপ। ডায়াবেটিসও আছে। মানসিক চাপটা তাই ঝুঁকিপূর্ণ। তাঁর বিশ্রামের প্রয়োজন।
এদিকে ইলিয়াস আলী যে রাতে নিখোঁজ হন, ওই রাতেই উত্তর বাড্ডা এলাকার মুসা মার্কেট (জিএম প্লাজা শপিং কমপ্লেক্স) থেকে দুই ব্যক্তিকে অপহরণ করার ঘটনা গতকাল কালের কণ্ঠে প্রকাশিত হলে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। র্যাব, পুলিশসহ সরকারের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন গতকাল ওই মার্কেটে যান এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে কথা বলেন।
দুপুরে ওই মার্কেটে গিয়ে দেখা যায়, সাততলা ভবনটির নিচতলার বেশির ভাগ দোকান বন্ধ। কালের কণ্ঠে প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তি ধরে সকাল থেকে পুলিশ ও সাদা পোশাকের গোয়েন্দারা ভবনের নিরাপত্তাকর্মী বজলুকে (কালের কণ্ঠে ভুলবশত 'ফজলু' ছাপা হয়েছে) খুঁজছেন। বজলুকে সকাল থেকে কেউ খুঁজে পাচ্ছে না। সাততলা ভবনের নিচতলায় ১৩টি দোকান। দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলায় ব্যাগ তৈরির একটি কারখানা। এর তত্ত্বাবধায়ক সরোয়ার হোসেন বলেন, গতকালই তিনি জেনেছেন মার্কেটের নিচতলা থেকে কে বা কারা কয়েকজনকে ধরে নিয়ে গেছে।
ব্যবসায়ীদের কয়েকজন কালের কণ্ঠকে বলেন, সকালে পুলিশ দোকানে গিয়ে খোঁজখবর নেওয়ার পর ভয়ে অনেকে দোকান খোলেননি। মার্কেটের একটি দোকান তিন মাস ধরে ফাঁকা।
কাপড় ব্যবসায়ী মিজানুর রহমান ও নুজায়রা সুতার ঘরের মালিক আয়াত উদ্দিন জানান, রাত ৮টার পর দোকান বন্ধ করে তাঁরা চলে গেছেন। পরে শুনেছেন, মঙ্গলবার রাতে নাকি তাঁদের পাশের খালি দোকান থেকে দুজনকে সন্ত্রাসীরা ধরে নিয়ে গেছে।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী বজলু ও তাঁর স্ত্রী শাহিদা বেগম মার্কেটের সামনে সবজি বিক্রি করেন। রাতে মার্কেটে নিরাপত্তাকর্মীর কাজ করেন বজলু। তিনি মার্কেটের অদূরেই শওকতের টিনশেডের বাসায় ভাড়া থাকেন। দুপুরে তাঁর বাসায় গিয়ে তালা দেখা যায়। মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হয়। পরে তিনি দেখা করেন। শাহিদা বেগম জানান, গতকাল সকাল ১১টার দিকে তিনজন লোক এসে বজলুকে খুঁজে দোকান ভাড়া নেওয়ার কথা বলে। এরপর বজলু জানতে পারেন, ওরা গোয়েন্দা বিভাগের লোক। তার পরই তিনি ভয়ে গা ঢাকা দিয়েছেন।
বিকেলে কালের কণ্ঠের সঙ্গে যোগাযোগ হয় বজলুর। আশ্বস্ত করা হলে তিনি বলেন, ওই রাতে কয়েকজন অস্ত্রধারী এসে তাঁকে জিজ্ঞেস করে, মার্কেটে কেউ আছে কি না। বজলু জানান, খালি দোকানের মধ্যে কয়েকজনকে তিনি দেখেছেন। ওই সময় সাত-আটজন মার্কেটে ঢুকে ওই দোকানে যায়। সেখানে চারজন ছিল। দুজন লুঙ্গি পরা। দুজন প্যান্ট-শার্ট পরা। তাদের চারজনকেই ধরে নিয়ে যায় মোটরসাইকেলে আসা ব্যক্তিরা। ওই সময় একজনকে স্যার বলে ডাকা হয়েছে বলে জানান বজলু। লুঙ্গি পরা দুজনকে কিছদূর নেওয়ার পর ওরা ছেড়ে দেয়।
মার্কেটের অন্য এক শ্রমিক জানান, বজলু ঠিক বলেছে। দুজন লুঙ্গি পরা লোকও ছিল। তবে ওরা ওই অস্ত্রধারীদের সঙ্গেই এসেছিল। অপহৃত দুই ব্যক্তি যে দোকানে লুকিয়েছিল, সেটা ওরাই দেখিয়ে দেয়। যাওয়ার সময় ওরা লুঙ্গি পরা দুজনকে ছেড়ে দেয়।
অন্যদিকে ইলিয়াস আলীর নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা তদন্তের অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলেন, 'এক কথায় শূন্য।'
এদিকে উত্তর বাড্ডার জিএম প্লাজা থেকে ওই রাতে (ইলিয়াস আলীর নিখোঁজ হওয়ার রাত) দুই ব্যক্তি অপহৃত হওয়ার ঘটনার তদন্তে নেমেছেন গোয়েন্দারা। গতকাল কালের কণ্ঠে এ বিষয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ পাওয়ার পর থেকেই তাঁরা মাঠে নেমেছেন। একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা জানান, ওই রাতে ওখান থেকে দুজন অপহৃত হয়েছেন- এ রকম তথ্য তাঁরা পেয়েছেন। প্রাথমিক তদন্তে অভিযোগের প্রমাণও পাওয়া গেছে। কয়েকজনের কাছ থেকে জানা গেছে, যে দুজনকে অপহরণ করা হয়, তাঁদের সঙ্গে ইলিয়াস আলী ও তাঁর গাড়িচালক আনসারের চেহারার মিল আছে। আবার অমিলের কথাও কেউ কেউ বলেছেন। কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী বলেছেন, এই অপহরণের ঘটনাটি ঘটেছে রাত ১২টার দিকে। তাঁরা অনেকটা নিশ্চিত হয়েই এটা বলছেন। আবার ইলিয়াস আলী রাত ১২টা পর্যন্ত রপসী বাংলা হোটেলে অবস্থান করেছেন- এটাও নিশ্চিত। তাই ব্যাপারটি তাঁরা গভীরভাবে তদন্ত করছেন।
ইলিয়াস আলীর নিখোঁজ হওয়ার ঘটনার ব্যাপারে উচ্চপদস্থ একজন সাবেক গোয়েন্দা কর্মকর্তা (সামরিক বিভাগে ছিলেন) গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, তাঁর কাছে মনে হচ্ছে এই নিখোঁজের ঘটনার পর তদন্তসংশ্লিষ্ট বিভাগ কোথাও কোনো না কোনোভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তাদের আন্তরিকতায় কিছুটা ঘাটতি আছে বলেও তাঁর কাছে মনে হচ্ছে। আর সব প্রচারমাধ্যমের ভূমিকাও সঠিক নয়। কয়েকটি পত্রিকা সংবাদ পরিবেশনের ক্ষেত্রে খুব একটা দায়িত্বশীলতা দেখাতে পারছে বলে মনে হয় না। বরং বলা চলে, তারা উল্টো ক্ষতি করছে। আর রাজনীতিবিদরা তো যা করছেন, তাকে রাজনৈতিক ফায়দা লোটা বা পলিটিক্যাল বিজনেস বলা চলে। আর এর শিকার হচ্ছে ইলিয়াসের পরিবার। তৈরি হচ্ছে একটি নোংরা দৃষ্টান্ত, যা ভবিষ্যতের জন্য ভালো নয়। ইলিয়াস আলীর যদি কোনো বড় ধরনের ক্ষতি না হয়ে থাকে, তবে এসব কারণে সেটা হতেই বা কতক্ষণ? ইলিয়াস আলী যদি কোনো রাজনৈতিক বা রাষ্ট্রীয় ষড়যন্ত্রের শিকার না হয়ে থাকেন, যদি এলাকার আধিপত্য বিস্তার বা পূর্বশত্রুতা নিয়ে প্রতিপক্ষের শিকার হয়ে থাকেন তবে বর্তমান অবস্থায় সেখান থেকে বের হয়ে আসাও বিপজ্জনক। বলা চলে সম্ভাবনা কম। তাই এর দায়-দায়িত্ব সরকার আর বিরোধী দল উভয়ের ওপরই বর্তাবে।
পুলিশের আইজি খন্দকার হাসান মাহমুদ গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ইলিয়াস আলীকে উদ্ধারের প্রচেষ্টায় তাঁদের আন্তরিকতার কোনো কমতি নেই। তাঁরা সাধ্যমতো চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তবে এখন পর্যন্ত বলার মতো কোনো অগ্রগতি নেই।
র্যাবের মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার সোহায়েল বলেন, ইলিয়াস আলীর মুক্তির ব্যাপারে একটি মহল থেকে শর্ত দেওয়া হয়েছে বলে যে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে, তার পেছনে কোনো যুক্তি নেই। এটি হাস্যকর। শর্ত দিলে কে শর্ত দিচ্ছে, কাকে শর্ত দিচ্ছে, কী শর্ত দিচ্ছে- সেটা স্পষ্ট হলেই তো নিখোঁজ-রহস্য উন্মোচিত হয়ে যায়। এ রকম কোনো তথ্য স্পষ্ট হলে তদন্তসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের জন্যও সুবিধা হয়।
কমান্ডার সোহায়েল বলেন, এখন পর্যন্ত তাঁদের কাছে মনে হচ্ছে এই নিখোঁজ-রহস্যের পেছনে বৃহত্তর সিলেটের কোনো নেপথ্য কারণ লুকিয়ে আছে। তাঁরাও বিষয়টি জোরালোভাবে খতিয়ে দেখছেন। তবে এখন পর্যন্ত তদন্তের অগ্রগতি এককথায় শূন্য।
গতকাল সকালে বনানীর বাসভবনে ইলিয়াস আলীর স্ত্রী তাহসিনা রুশদীর লুনা কালের কণ্ঠকে বলেন, 'গোয়েন্দা কর্মকর্তারা আমার কাছে আসছেন। সাংবাদিকরা আসছেন। র্যাব-পুলিশ আসছে। সবাই আমার কাছে নানান তথ্য জানতে আসছেন। সবাই শুধু জানতেই চান। সম্ভাব্য কারণ কী, আমি কাউকে সন্দেহ করি কি না, আমার স্বামী কাদের সঙ্গে বেশি মিশেছে, তিনি কখনো কোনো আশঙ্কার কথা বলেছেন কি না- জানতে চান নানান তথ্য। কিন্তু আমাকে কেউ কিছু জানাতে পারছে না। সবারই জানার আগ্রহ অনেক। কিন্তু আমার আগ্রহ শুধু একটাই। আমি জানতে চাই আমার স্বামী কোথায়?'
ইলিয়াস আলীর মুক্তির ব্যাপারে কেউ কোনো শর্ত দিয়েছে কি না জানতে চাইলে লুনা বলেন, এগুলো ভিত্তিহীন কথা।
আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'আমাকে ভয় দেখাবে কে? চাপ দিবে কে? আমি মাথা তুলে দাঁড়াতে পারছি না। আমার পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গেছে। যা রটছে, এগুলো বাজে কথা। আর আমি কোনো চাপকেই ভয় করি না। কে শর্ত দিবে? কিসের শর্ত? কিসের চাপ? আমি সব শর্ত মেনে আমার স্বামীকে ফেরত চাই। কিন্তু কেউ কোনো শর্ত নিয়েও আসছে না। এলে তো অন্তত এটুকু বুঝতে পারতাম যে আমার স্বামী বেঁচে আছে। সেটাও তো পারছি না। এত কষ্ট আর যন্ত্রণায় আছি, যেটা কাউকে বুঝিয়ে বলা সম্ভব নয়।'
সাংবাদিকদের সহযোগিতা কামনা করে তিনি বলেন, 'আপনারা এই বিপদের মাঝে আমাদের পাশে দাঁড়ান। আমার স্বামীকে খুঁজে বের করার ব্যাপারে সহযোগিতা করুন। দয়া করে আমার সন্তানদের এতিম করবেন না।'
তিনি সরকারেরর প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, 'ছয় দিন হয়ে গেছে, আমার স্বামী নিখোঁজ হয়ে আছেন। কিছু একটা করুন।'
ইলিয়াস আলীর সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে কি না- এমন এক প্রশ্নের জবাবে তাহসিনা রুশদীর বলেন, 'যোগাযোগ হলেও তো বুঝতে পারতাম সে বেঁচে আছে।'
অন্য এক সূত্র থেকে জানা যায়, গতকাল দুপুরের দিকে তাহসিনা রুশদীর অসুস্থ হয়ে পড়েন। এ সময় পারিবারিক চিকিৎসক বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্ডিওলজি বিভাগের সহকারী রেজিস্ট্রার ডা. মনোয়ারুল কাদির তাঁকে দেখতে আসেন। পরে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, তাহসিনার উচ্চ রক্তচাপ। ডায়াবেটিসও আছে। মানসিক চাপটা তাই ঝুঁকিপূর্ণ। তাঁর বিশ্রামের প্রয়োজন।
এদিকে ইলিয়াস আলী যে রাতে নিখোঁজ হন, ওই রাতেই উত্তর বাড্ডা এলাকার মুসা মার্কেট (জিএম প্লাজা শপিং কমপ্লেক্স) থেকে দুই ব্যক্তিকে অপহরণ করার ঘটনা গতকাল কালের কণ্ঠে প্রকাশিত হলে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। র্যাব, পুলিশসহ সরকারের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন গতকাল ওই মার্কেটে যান এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে কথা বলেন।
দুপুরে ওই মার্কেটে গিয়ে দেখা যায়, সাততলা ভবনটির নিচতলার বেশির ভাগ দোকান বন্ধ। কালের কণ্ঠে প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তি ধরে সকাল থেকে পুলিশ ও সাদা পোশাকের গোয়েন্দারা ভবনের নিরাপত্তাকর্মী বজলুকে (কালের কণ্ঠে ভুলবশত 'ফজলু' ছাপা হয়েছে) খুঁজছেন। বজলুকে সকাল থেকে কেউ খুঁজে পাচ্ছে না। সাততলা ভবনের নিচতলায় ১৩টি দোকান। দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলায় ব্যাগ তৈরির একটি কারখানা। এর তত্ত্বাবধায়ক সরোয়ার হোসেন বলেন, গতকালই তিনি জেনেছেন মার্কেটের নিচতলা থেকে কে বা কারা কয়েকজনকে ধরে নিয়ে গেছে।
ব্যবসায়ীদের কয়েকজন কালের কণ্ঠকে বলেন, সকালে পুলিশ দোকানে গিয়ে খোঁজখবর নেওয়ার পর ভয়ে অনেকে দোকান খোলেননি। মার্কেটের একটি দোকান তিন মাস ধরে ফাঁকা।
কাপড় ব্যবসায়ী মিজানুর রহমান ও নুজায়রা সুতার ঘরের মালিক আয়াত উদ্দিন জানান, রাত ৮টার পর দোকান বন্ধ করে তাঁরা চলে গেছেন। পরে শুনেছেন, মঙ্গলবার রাতে নাকি তাঁদের পাশের খালি দোকান থেকে দুজনকে সন্ত্রাসীরা ধরে নিয়ে গেছে।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী বজলু ও তাঁর স্ত্রী শাহিদা বেগম মার্কেটের সামনে সবজি বিক্রি করেন। রাতে মার্কেটে নিরাপত্তাকর্মীর কাজ করেন বজলু। তিনি মার্কেটের অদূরেই শওকতের টিনশেডের বাসায় ভাড়া থাকেন। দুপুরে তাঁর বাসায় গিয়ে তালা দেখা যায়। মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হয়। পরে তিনি দেখা করেন। শাহিদা বেগম জানান, গতকাল সকাল ১১টার দিকে তিনজন লোক এসে বজলুকে খুঁজে দোকান ভাড়া নেওয়ার কথা বলে। এরপর বজলু জানতে পারেন, ওরা গোয়েন্দা বিভাগের লোক। তার পরই তিনি ভয়ে গা ঢাকা দিয়েছেন।
বিকেলে কালের কণ্ঠের সঙ্গে যোগাযোগ হয় বজলুর। আশ্বস্ত করা হলে তিনি বলেন, ওই রাতে কয়েকজন অস্ত্রধারী এসে তাঁকে জিজ্ঞেস করে, মার্কেটে কেউ আছে কি না। বজলু জানান, খালি দোকানের মধ্যে কয়েকজনকে তিনি দেখেছেন। ওই সময় সাত-আটজন মার্কেটে ঢুকে ওই দোকানে যায়। সেখানে চারজন ছিল। দুজন লুঙ্গি পরা। দুজন প্যান্ট-শার্ট পরা। তাদের চারজনকেই ধরে নিয়ে যায় মোটরসাইকেলে আসা ব্যক্তিরা। ওই সময় একজনকে স্যার বলে ডাকা হয়েছে বলে জানান বজলু। লুঙ্গি পরা দুজনকে কিছদূর নেওয়ার পর ওরা ছেড়ে দেয়।
মার্কেটের অন্য এক শ্রমিক জানান, বজলু ঠিক বলেছে। দুজন লুঙ্গি পরা লোকও ছিল। তবে ওরা ওই অস্ত্রধারীদের সঙ্গেই এসেছিল। অপহৃত দুই ব্যক্তি যে দোকানে লুকিয়েছিল, সেটা ওরাই দেখিয়ে দেয়। যাওয়ার সময় ওরা লুঙ্গি পরা দুজনকে ছেড়ে দেয়।
No comments