খোলা হাওয়া-ভালো ক্রিকেট খেললে জয় অনেক রকমের by সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম
আইসিসি ওয়ার্ল্ড কাপ ক্রিকেটের দশম আসরের শুভ উদ্বোধন হলো। এ অনুষ্ঠানটি ঘিরে দেশবাসীর প্রত্যাশাটা ছিল অনেক বড়, তার অনেকখানিই নিশ্চয় জমকালো উদ্বোধন পর্বটি মিটিয়েছে। অনুষ্ঠানটি মাঠে অথবা টিভিতে যাঁরা দেখেছেন, তাঁরা নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন, ভালো একটা কিছু করে দেখানোর সামর্থ্য বাংলাদেশের আছে।
কয়েক মাস আগে দিল্লিতে যে কমনওয়েলথ গেমস হয়ে গেল, তার উদ্বোধন ও সমাপনী অনুষ্ঠান দুটিও কিছুটা টিভিতে দেখেছি। সে তুলনায় নিশ্চয় পিছিয়ে ছিল না আমাদের অনুষ্ঠানটি। গত দু-এক বছর বাংলাদেশের ক্রিকেট যে উন্নতি করেছে, তার সঙ্গে এই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের একটা যোগসূত্র আছে। আমার মনে হয়েছে, ক্রিকেটে উন্নতির পেছনে খেলোয়াড়দের যে রকম একটা একাগ্রতা রয়েছে, তাগিদ এবং জিদও রয়েছে, অনুষ্ঠানটির পেছনেও যেন তা-ই ছিল। এক জায়গায় উন্নতি হলে অন্য জায়গায় তার ছোঁয়া লাগে। এখন দেশবাসী বসে আছেন দেখার জন্য বাংলাদেশ দল কতটা এগোতে পারে। হয়তো কোয়ার্টার ফাইনাল, সেমিফাইনাল পর্যন্ত যাবে দলটি, হয়তো প্রথম রাউন্ডে ছিটকে পড়ার বেদনা তাকে সইতে হবে। কিন্তু আমি নিশ্চিত, আগের মতো পড়ে পড়ে মার খাবে না দলটি। যদি সেমিফাইনাল পর্যন্ত যায়, খুব অবাক হব না। কেননা, দলটি আত্মবিশ্বাস খুঁজে পেয়েছে। যেমন পেয়েছে দেশটি। নতুন একটি সময় যাচ্ছে বাংলাদেশের জন্য, নতুন একটি সময় যাচ্ছে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের জন্যও। আবারও সেই একই যোগসূত্র: এক জায়গায় উন্নতি হলে অন্য জায়গায় তার প্রভাব পড়ে। ব্যাপারটা একটু ব্যাখ্যা করা যাক।
গত জাতীয় নির্বাচনের দিন আমি একটা রিকশায় চেপে আধা দিন ঢাকা শহরের অনেক ভোটকেন্দ্র ভ্রমণে গিয়েছিলাম। প্রথম আলো থেকে অনুরোধ ছিল, নির্বাচন কেমন হচ্ছে, তা নিয়ে একটা লেখা লিখতে। আধা দিনের অভিজ্ঞতা আমার জন্য ছিল খুবই প্রীতিকর। নির্বাচনটি ছিল শান্তিপূর্ণ, কোথাও তেমন কোনো কলহ-বিবাদ ছিল না। কিন্তু সবচেয়ে বড় ব্যাপারটি ছিল তারুণ্যের আধিপত্য। অসংখ্য তরুণ প্রথমবারের মতো ভোট দিয়েছে। তাদের অনেকের সঙ্গে কথা হয়েছিল। সবাই বলছিল, তারা পরিবর্তন চায়। তারা পুরোনো ধারার রাজনীতি চায় না, পেশিশক্তি চায় না, পশ্চাদমুখী চিন্তা চায় না, সাম্প্রদায়িকতা চায় না। তারা চায় সামনে এগিয়ে যেতে। যে দেশটি একেবারে শূন্য থেকে জাহাজ বানানো শুরু করে এমন দেশের কাছে জাহাজ বিক্রি করছে, যে দেশ একসময় তাকে জাহাজ সরবরাহ করত, সে দেশ তো এগোবেই। সে দেশ তো এগোনোর জন্য পথে নেমেই পড়েছে। এখন পেছনে ফিরে যেতে সে অপারগ। বাড়ি ফিরতে ফিরতে সেদিন আমার বুঝতে বাকি ছিল না, নির্বাচনের ফল কী হবে। একই সঙ্গে অবশ্য শঙ্কাও হচ্ছিল, নির্বাচনে না হয় জিতল একটি দল/জোট, কিন্তু তারুণ্যের এই বিশাল প্রত্যাশা মেটানোর জন্য সে কি তৈরি? নির্বাচনের পর দুটি বছর চলে গেছে, তরুণদের প্রত্যাশার কতটা পূরণ হয়েছে, সে হিসাব তারা করেছে। তরুণেরা এখন অপেক্ষায় আছে। গত ২০ বছরের নড়বড়ে গণতন্ত্রচর্চাও তাদের শিখিয়েছে, ধৈর্যহারা হলে চলবে না। আরও তিনটি বছর আছে। যদি এর মধ্যে প্রত্যাশাগুলো মিটতে থাকে, ভালো; যদি না মেটে, তাহলে আগামী ভোটের দিন দেখা যাবে। আমাদের রাজনীতিবিদদের থেকে তরুণেরা অনেক এগিয়ে। রাজনীতিবিদদের একটি অংশ তরুণদের জ্বালাও-পোড়াওয়ের রাস্তায় নিয়ে যেতে চায়, ‘দেশ বাঁচানোর’ হরতালের বোমা তাদের ওপর চাপিয়ে দেয়, মিসরীয় কায়দার সরকার উৎ খাতের ঘোষণা দেয়, কিন্তু তরুণেরা তাদের কথায় কান দিচ্ছে না। তারা ২০-৩০ বছর আগের তরুণ নয়, তারা নতুন জমানার তরুণ। তারা নিয়মে বিশ্বাস করে, কাজে বিশ্বাস করে। একটা কিছু করে দেখানোতে বিশ্বাস করে। তাদের অনেকে শেয়ারবাজারে সর্বস্ব হারিয়ে পথে বসেছে; সাময়িক ক্রোধ ও হতাশা থেকে তারা মতিঝিলে গোলযোগ করে, কিন্তু দিনশেষে বাড়ি ফিরে আগামী দিন নিয়ে ভাবে। তাদের টাকা লুটে হাতির মতো মোটা হয়ে গেল হাতে গোনা কিছু লুটেরা। তাদের নামও মানুষ জানে এবং মানুষ এ-ও জানে, এদের কিছুই হবে না। অথচ যত উপহাস-পরিহাস, তা হয় এই তরুণদের নিয়ে। জুয়া খেলতে নেমেছে বলে অনেকে তাদের তিরস্কারও করে। এই তরুণেরা কিন্তু কোনো বড় নাশকতায় নামেনি, দেশ অচল করে দেয়নি। কারও নামে মামলা হলে দেশে হরতাল হয়, অথচ সর্বস্ব হারিয়েও তরুণেরা হরতাল না ডেকে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে। এই তারুণ্যভরা বাংলাদেশ আমাকে অবাক করে, আমাকে ভাবায়, অভিভূত করে। আমাদের ক্রিকেট নিয়ে যে এত উন্মাদনা, তার কারণ এই খেলাটিতে এই তরুণেরা তাদের আবেগ বিনিয়োগ করেছে। দলের খেলোয়াড়েরা তরুণ, তাদের সমর্থকেরাও তরুণ। ফলে একটি অবধারিত রসায়নে পড়ে ক্রিকেট জ্বরে দেশটি কাঁপছে। এই ক্রিকেট যদি সামনে না এগোয়, এই অসংখ্য তরুণকেই তো তা হতাশ করবে। সেটি এই নতুন বাংলাদেশে সম্ভব নয়।
যেদিন বিশ্বকাপ ক্রিকেটের টিকিট বিক্রি শুরু হয় ঢাকায়, তার আগের দিন রাতে বনানীর ১১ নম্বর সড়ক দিয়ে ফিরছিলাম রাত সাড়ে ১০টার দিকে। রাস্তাটিতে ঢুকেই চোখে পড়ল, এক পাশে দীর্ঘ লাইন। কেউ দাঁড়িয়ে, বেশির ভাগ বসে—সবাই তরুণ। এত রাতে এরা করা? এ রকম প্রশ্ন মনে আসতে একদল তরুণকে ব্যাপারটি জিজ্ঞেস করলাম। তারা হেসে জানাল, টিকিটের লাইনে দাঁড়িয়েছে। ১০-১২ ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকে হয়তো টিকিট পাবে, হয়তো পাবে না। আমি অবাক হলাম। এ রকম অনিশ্চিত প্রাপ্তির জন্য এত দীর্ঘ সময় অপেক্ষা? অথচ মুখের হাসি দেখে মনে হলো, যেন অপেক্ষার পর শুধু টিকিট নয়, জাতীয় দলে খেলার সুযোগটাই পেয়ে যাচ্ছে এরা সবাই। এর পরের কদিনের ইতিহাস তো সবারই জানা। লাইনের দৈর্ঘ্য বেড়েছে, প্রতীক্ষার সময় ৩০ ঘণ্টায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে। তার পরও খালি হাতে ফিরে গেছে অনেকেই। কিন্তু কোথাও কোনো সন্ত্রাস নেই, গোলযোগ নেই। এই যে অদ্ভুত এক শৃঙ্খলা, এর সঙ্গে আমাদের আগে কি পরিচয় ছিল? রেশনের দোকানের লাইন? কিন্তু সে তো দয়ার জন্য হত্যে দেওয়া। ক্রিকেটের টিকিট তো দয়া নয়, অর্জন। অর্জনের জন্য লাইন? আমার আরও মনে হয়েছে, এই শৃঙ্খলা সম্ভব হয়েছে যেসব কারণে তার একটি ছিল এই যে, এ লাইনে রাজনীতি ছিল না। এ লাইন বেলাইন করতে ছাত্রনেতারা ছিল না। তারুণ্যের সুন্দর একটি প্রকাশ যদি দেখে থাকি টিকিটের জন্য লাইনে, এর কদর্য প্রকাশ দেখি ছাত্ররাজনীতির বেপরোয়া ঔদ্ধত্যে, এই ঔদ্ধত্য আমি দেখতে চাই না। কিন্তু চোখে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে একদল বিবেকহীন, বুদ্ধিহীন তরুণ। এরা পরিবর্তনের বিপক্ষে। পরিবর্তনপ্রত্যাশী তরুণেরা দাঁড়িয়েছিল টিকিটের লাইনে। তারা ১৯ তারিখ মাঠে যাবে, বাংলাদেশের প্রতিটি খেলার দিন মাঠে যাবে, আর পরিবর্তন চাইবে। পড়ে পড়ে মার খাওয়াটা তারা ক্ষমা করবে না, লড়াই করে হারাটা ক্ষমা করবে।
বাংলাদেশের ক্রিকেট দলের খেলোয়াড়েরাও তা জানে। নড়াইলের সেই ভাগ্যবঞ্চিত ছেলেটি, যে ২০০৭ সালের বিশ্বকাপে ভারতের বিরুদ্ধে আগুনের গোলা ছুড়েছিল, সেও বলছে, প্রতিটি ম্যাচই হবে ‘ফাইনাল’। আমাদের হাসিমুখ দলনেতাও জানাল, ১০০ ভাগ উজাড় করে দিয়ে খেলবে। এখন দলটি জিতলেও তার উদ্যাপনে থাকে সংযম। পেশাজীবিতার ছাপ পড়েছে দলটির খেলায়, আচরণে। এই উন্নতিটা প্রয়োজন ছিল।
আমি মাঠে গিয়ে খেলা দেখার চেয়ে নিজের ঘরে টিভির সামনে বসে খেলা দেখতে পছন্দ করি। কিন্তু এবার অন্তত একদিন মাঠে যাব। আমার ছেলে বিদেশে বসে ইন্টারনেটে টিকিট কিনেছে। তার জন্য একটা, আমার জন্য একটা। সম্ভবত আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে যেদিন বাংলাদেশ খেলবে, সেদিনের জন্য। সেদিন গ্যালারিতে থাকবে তারুণ্যের সমারোহ। সেখানে দেশের পতাকা হাতে আমিও বসব। ধুমধাড়াক্কা ওপেনার ছেলেটি যখন বল মেরে মাঠ ছাড়িয়ে চাটগাঁয় তার বাড়ির ঠিকানায় পাঠিয়ে দেবে, হাততালি দেব। প্রতিপক্ষের উইকেট পড়লে হইহই করব। কিন্তু অসহায় আত্মসমর্পণের আলামত দেখলে বাড়ির পথ ধরব। এত তরুণের মাঝখানে বসে তাদের মতো যদি ভাবতে না পারি, তাহলে কেন মাঠে যাওয়া। আমি আরও চাইব, দলটি, যাকে বলে ‘ফেয়ার প্লে’র চর্চা করুক। একটা ক্যাচ ধরেও পেছনের পা-টা যদি বাউন্ডারির দড়িতে সামান্য ছুঁয়ে যায়, সে খেলোয়াড় নিজ থেকেই বলুক, আউট নয়। প্রতিপক্ষের খেলোয়াড় রান নিতে গিয়ে ধাক্কা লেগে পড়ে গেলে স্ট্যাম্প বল না ছোঁয়াক। সারা বিশ্বের মানুষ দেখবে আমাদের। ফেয়ার প্লে ভালোবাসে না, এমন মানুষ পৃথিবীতে কমই আছে। তাদের সমীহ জাগাক দলটি।
কাপটা আমাদের হাতে এলে আমরা পুলকে ভাসব অনেক দিন। কিন্তু কাপ না জিতলে, এমনকি বেশি দূর যেতে না পারলেও আক্ষেপ থাকবে না, যদি দেখি সামর্থ্যের সেরাটা দিয়েছে সবাই; আর শিল্পিত, শোভন খেলা খেলেছে প্রতিটি ম্যাচে। এ রকমটা হলে তারুণ্যেরই জয় হবে, যে জয় আমাদের খুবই প্রয়োজন।
২.
খেলা নিয়ে লিখতে গিয়ে রাজনীতি টেনে আনাটা নিশ্চয় বিরক্তিকর। কিন্তু তার পরও রাজনীতির উল্লেখ অপরিহার্য হয়ে পড়েছে এ জন্য যে, এই বিশ্বকাপ এই দেশটির জন্যও একটি পরীক্ষা। না, আয়োজনের পরীক্ষার কথা আমি বলছি না, যে পরীক্ষায় পাস করাটা কঠিন হবে না। উদ্বোধনী অনুষ্ঠান যদি সকাল হয়, দিনটা কেমন হবে আপনারা ওই সকাল দেখেই তা নিশ্চয় বুঝেছেন। পরীক্ষা অন্য জায়গায়। ওই যে সামর্থ্যের শতভাগ উজাড় করে দেওয়া। নিজের জন্য না খেলে দলের জন্য খেলা, দেশের জন্য প্রাণপণ লড়ে যাওয়া, শোভন খেলা বা ফেয়ার প্লেতে সবাইকে ছাড়িয়ে বিশ্বের সমীহ আদায় করা, বিজয়ে দিশেহারা না হওয়া। এ কি শুধু ক্রিকেটে? এ কি শুধু তরুণদের অঙ্গীকার? এই অঙ্গীকার, এই ধনুভাঙা পণ কি আসতে পারে না আমাদের রাজনীতিবিদদের থেকে, দেশের জন্য নিজের সামর্থ্য শতভাগ উজাড় করে দেওয়া ইত্যাদি?
এত দিন যে খেলা চলছে দেশটাতে, তা ক্রিকেট নয়। দিস ইজ নট ক্রিকেট। এখন সবাই যদি লাল-সবুজের দলটির মতো উজ্জীবিত, যথাযথ ‘ক্রিকেট’ খেলতাম, কোথায় যে যেতে পারতাম আমরা!
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: কথাসাহিত্যিক। অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
গত জাতীয় নির্বাচনের দিন আমি একটা রিকশায় চেপে আধা দিন ঢাকা শহরের অনেক ভোটকেন্দ্র ভ্রমণে গিয়েছিলাম। প্রথম আলো থেকে অনুরোধ ছিল, নির্বাচন কেমন হচ্ছে, তা নিয়ে একটা লেখা লিখতে। আধা দিনের অভিজ্ঞতা আমার জন্য ছিল খুবই প্রীতিকর। নির্বাচনটি ছিল শান্তিপূর্ণ, কোথাও তেমন কোনো কলহ-বিবাদ ছিল না। কিন্তু সবচেয়ে বড় ব্যাপারটি ছিল তারুণ্যের আধিপত্য। অসংখ্য তরুণ প্রথমবারের মতো ভোট দিয়েছে। তাদের অনেকের সঙ্গে কথা হয়েছিল। সবাই বলছিল, তারা পরিবর্তন চায়। তারা পুরোনো ধারার রাজনীতি চায় না, পেশিশক্তি চায় না, পশ্চাদমুখী চিন্তা চায় না, সাম্প্রদায়িকতা চায় না। তারা চায় সামনে এগিয়ে যেতে। যে দেশটি একেবারে শূন্য থেকে জাহাজ বানানো শুরু করে এমন দেশের কাছে জাহাজ বিক্রি করছে, যে দেশ একসময় তাকে জাহাজ সরবরাহ করত, সে দেশ তো এগোবেই। সে দেশ তো এগোনোর জন্য পথে নেমেই পড়েছে। এখন পেছনে ফিরে যেতে সে অপারগ। বাড়ি ফিরতে ফিরতে সেদিন আমার বুঝতে বাকি ছিল না, নির্বাচনের ফল কী হবে। একই সঙ্গে অবশ্য শঙ্কাও হচ্ছিল, নির্বাচনে না হয় জিতল একটি দল/জোট, কিন্তু তারুণ্যের এই বিশাল প্রত্যাশা মেটানোর জন্য সে কি তৈরি? নির্বাচনের পর দুটি বছর চলে গেছে, তরুণদের প্রত্যাশার কতটা পূরণ হয়েছে, সে হিসাব তারা করেছে। তরুণেরা এখন অপেক্ষায় আছে। গত ২০ বছরের নড়বড়ে গণতন্ত্রচর্চাও তাদের শিখিয়েছে, ধৈর্যহারা হলে চলবে না। আরও তিনটি বছর আছে। যদি এর মধ্যে প্রত্যাশাগুলো মিটতে থাকে, ভালো; যদি না মেটে, তাহলে আগামী ভোটের দিন দেখা যাবে। আমাদের রাজনীতিবিদদের থেকে তরুণেরা অনেক এগিয়ে। রাজনীতিবিদদের একটি অংশ তরুণদের জ্বালাও-পোড়াওয়ের রাস্তায় নিয়ে যেতে চায়, ‘দেশ বাঁচানোর’ হরতালের বোমা তাদের ওপর চাপিয়ে দেয়, মিসরীয় কায়দার সরকার উৎ খাতের ঘোষণা দেয়, কিন্তু তরুণেরা তাদের কথায় কান দিচ্ছে না। তারা ২০-৩০ বছর আগের তরুণ নয়, তারা নতুন জমানার তরুণ। তারা নিয়মে বিশ্বাস করে, কাজে বিশ্বাস করে। একটা কিছু করে দেখানোতে বিশ্বাস করে। তাদের অনেকে শেয়ারবাজারে সর্বস্ব হারিয়ে পথে বসেছে; সাময়িক ক্রোধ ও হতাশা থেকে তারা মতিঝিলে গোলযোগ করে, কিন্তু দিনশেষে বাড়ি ফিরে আগামী দিন নিয়ে ভাবে। তাদের টাকা লুটে হাতির মতো মোটা হয়ে গেল হাতে গোনা কিছু লুটেরা। তাদের নামও মানুষ জানে এবং মানুষ এ-ও জানে, এদের কিছুই হবে না। অথচ যত উপহাস-পরিহাস, তা হয় এই তরুণদের নিয়ে। জুয়া খেলতে নেমেছে বলে অনেকে তাদের তিরস্কারও করে। এই তরুণেরা কিন্তু কোনো বড় নাশকতায় নামেনি, দেশ অচল করে দেয়নি। কারও নামে মামলা হলে দেশে হরতাল হয়, অথচ সর্বস্ব হারিয়েও তরুণেরা হরতাল না ডেকে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে। এই তারুণ্যভরা বাংলাদেশ আমাকে অবাক করে, আমাকে ভাবায়, অভিভূত করে। আমাদের ক্রিকেট নিয়ে যে এত উন্মাদনা, তার কারণ এই খেলাটিতে এই তরুণেরা তাদের আবেগ বিনিয়োগ করেছে। দলের খেলোয়াড়েরা তরুণ, তাদের সমর্থকেরাও তরুণ। ফলে একটি অবধারিত রসায়নে পড়ে ক্রিকেট জ্বরে দেশটি কাঁপছে। এই ক্রিকেট যদি সামনে না এগোয়, এই অসংখ্য তরুণকেই তো তা হতাশ করবে। সেটি এই নতুন বাংলাদেশে সম্ভব নয়।
যেদিন বিশ্বকাপ ক্রিকেটের টিকিট বিক্রি শুরু হয় ঢাকায়, তার আগের দিন রাতে বনানীর ১১ নম্বর সড়ক দিয়ে ফিরছিলাম রাত সাড়ে ১০টার দিকে। রাস্তাটিতে ঢুকেই চোখে পড়ল, এক পাশে দীর্ঘ লাইন। কেউ দাঁড়িয়ে, বেশির ভাগ বসে—সবাই তরুণ। এত রাতে এরা করা? এ রকম প্রশ্ন মনে আসতে একদল তরুণকে ব্যাপারটি জিজ্ঞেস করলাম। তারা হেসে জানাল, টিকিটের লাইনে দাঁড়িয়েছে। ১০-১২ ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকে হয়তো টিকিট পাবে, হয়তো পাবে না। আমি অবাক হলাম। এ রকম অনিশ্চিত প্রাপ্তির জন্য এত দীর্ঘ সময় অপেক্ষা? অথচ মুখের হাসি দেখে মনে হলো, যেন অপেক্ষার পর শুধু টিকিট নয়, জাতীয় দলে খেলার সুযোগটাই পেয়ে যাচ্ছে এরা সবাই। এর পরের কদিনের ইতিহাস তো সবারই জানা। লাইনের দৈর্ঘ্য বেড়েছে, প্রতীক্ষার সময় ৩০ ঘণ্টায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে। তার পরও খালি হাতে ফিরে গেছে অনেকেই। কিন্তু কোথাও কোনো সন্ত্রাস নেই, গোলযোগ নেই। এই যে অদ্ভুত এক শৃঙ্খলা, এর সঙ্গে আমাদের আগে কি পরিচয় ছিল? রেশনের দোকানের লাইন? কিন্তু সে তো দয়ার জন্য হত্যে দেওয়া। ক্রিকেটের টিকিট তো দয়া নয়, অর্জন। অর্জনের জন্য লাইন? আমার আরও মনে হয়েছে, এই শৃঙ্খলা সম্ভব হয়েছে যেসব কারণে তার একটি ছিল এই যে, এ লাইনে রাজনীতি ছিল না। এ লাইন বেলাইন করতে ছাত্রনেতারা ছিল না। তারুণ্যের সুন্দর একটি প্রকাশ যদি দেখে থাকি টিকিটের জন্য লাইনে, এর কদর্য প্রকাশ দেখি ছাত্ররাজনীতির বেপরোয়া ঔদ্ধত্যে, এই ঔদ্ধত্য আমি দেখতে চাই না। কিন্তু চোখে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে একদল বিবেকহীন, বুদ্ধিহীন তরুণ। এরা পরিবর্তনের বিপক্ষে। পরিবর্তনপ্রত্যাশী তরুণেরা দাঁড়িয়েছিল টিকিটের লাইনে। তারা ১৯ তারিখ মাঠে যাবে, বাংলাদেশের প্রতিটি খেলার দিন মাঠে যাবে, আর পরিবর্তন চাইবে। পড়ে পড়ে মার খাওয়াটা তারা ক্ষমা করবে না, লড়াই করে হারাটা ক্ষমা করবে।
বাংলাদেশের ক্রিকেট দলের খেলোয়াড়েরাও তা জানে। নড়াইলের সেই ভাগ্যবঞ্চিত ছেলেটি, যে ২০০৭ সালের বিশ্বকাপে ভারতের বিরুদ্ধে আগুনের গোলা ছুড়েছিল, সেও বলছে, প্রতিটি ম্যাচই হবে ‘ফাইনাল’। আমাদের হাসিমুখ দলনেতাও জানাল, ১০০ ভাগ উজাড় করে দিয়ে খেলবে। এখন দলটি জিতলেও তার উদ্যাপনে থাকে সংযম। পেশাজীবিতার ছাপ পড়েছে দলটির খেলায়, আচরণে। এই উন্নতিটা প্রয়োজন ছিল।
আমি মাঠে গিয়ে খেলা দেখার চেয়ে নিজের ঘরে টিভির সামনে বসে খেলা দেখতে পছন্দ করি। কিন্তু এবার অন্তত একদিন মাঠে যাব। আমার ছেলে বিদেশে বসে ইন্টারনেটে টিকিট কিনেছে। তার জন্য একটা, আমার জন্য একটা। সম্ভবত আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে যেদিন বাংলাদেশ খেলবে, সেদিনের জন্য। সেদিন গ্যালারিতে থাকবে তারুণ্যের সমারোহ। সেখানে দেশের পতাকা হাতে আমিও বসব। ধুমধাড়াক্কা ওপেনার ছেলেটি যখন বল মেরে মাঠ ছাড়িয়ে চাটগাঁয় তার বাড়ির ঠিকানায় পাঠিয়ে দেবে, হাততালি দেব। প্রতিপক্ষের উইকেট পড়লে হইহই করব। কিন্তু অসহায় আত্মসমর্পণের আলামত দেখলে বাড়ির পথ ধরব। এত তরুণের মাঝখানে বসে তাদের মতো যদি ভাবতে না পারি, তাহলে কেন মাঠে যাওয়া। আমি আরও চাইব, দলটি, যাকে বলে ‘ফেয়ার প্লে’র চর্চা করুক। একটা ক্যাচ ধরেও পেছনের পা-টা যদি বাউন্ডারির দড়িতে সামান্য ছুঁয়ে যায়, সে খেলোয়াড় নিজ থেকেই বলুক, আউট নয়। প্রতিপক্ষের খেলোয়াড় রান নিতে গিয়ে ধাক্কা লেগে পড়ে গেলে স্ট্যাম্প বল না ছোঁয়াক। সারা বিশ্বের মানুষ দেখবে আমাদের। ফেয়ার প্লে ভালোবাসে না, এমন মানুষ পৃথিবীতে কমই আছে। তাদের সমীহ জাগাক দলটি।
কাপটা আমাদের হাতে এলে আমরা পুলকে ভাসব অনেক দিন। কিন্তু কাপ না জিতলে, এমনকি বেশি দূর যেতে না পারলেও আক্ষেপ থাকবে না, যদি দেখি সামর্থ্যের সেরাটা দিয়েছে সবাই; আর শিল্পিত, শোভন খেলা খেলেছে প্রতিটি ম্যাচে। এ রকমটা হলে তারুণ্যেরই জয় হবে, যে জয় আমাদের খুবই প্রয়োজন।
২.
খেলা নিয়ে লিখতে গিয়ে রাজনীতি টেনে আনাটা নিশ্চয় বিরক্তিকর। কিন্তু তার পরও রাজনীতির উল্লেখ অপরিহার্য হয়ে পড়েছে এ জন্য যে, এই বিশ্বকাপ এই দেশটির জন্যও একটি পরীক্ষা। না, আয়োজনের পরীক্ষার কথা আমি বলছি না, যে পরীক্ষায় পাস করাটা কঠিন হবে না। উদ্বোধনী অনুষ্ঠান যদি সকাল হয়, দিনটা কেমন হবে আপনারা ওই সকাল দেখেই তা নিশ্চয় বুঝেছেন। পরীক্ষা অন্য জায়গায়। ওই যে সামর্থ্যের শতভাগ উজাড় করে দেওয়া। নিজের জন্য না খেলে দলের জন্য খেলা, দেশের জন্য প্রাণপণ লড়ে যাওয়া, শোভন খেলা বা ফেয়ার প্লেতে সবাইকে ছাড়িয়ে বিশ্বের সমীহ আদায় করা, বিজয়ে দিশেহারা না হওয়া। এ কি শুধু ক্রিকেটে? এ কি শুধু তরুণদের অঙ্গীকার? এই অঙ্গীকার, এই ধনুভাঙা পণ কি আসতে পারে না আমাদের রাজনীতিবিদদের থেকে, দেশের জন্য নিজের সামর্থ্য শতভাগ উজাড় করে দেওয়া ইত্যাদি?
এত দিন যে খেলা চলছে দেশটাতে, তা ক্রিকেট নয়। দিস ইজ নট ক্রিকেট। এখন সবাই যদি লাল-সবুজের দলটির মতো উজ্জীবিত, যথাযথ ‘ক্রিকেট’ খেলতাম, কোথায় যে যেতে পারতাম আমরা!
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: কথাসাহিত্যিক। অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments