চরাচর-তরগাঁওয়ে হানাদারদের হত্যাযজ্ঞ by সাইফুল ইসলাম খান

১৯৭১ সালের জুলাই মাস। শ্রাবণ মাসের বৃষ্টির পানিতে ডুবে আছে মাঠ-ঘাট। খালবিলে জল থৈ থৈ করছে। গাজীপুর জেলার উত্তর-পূর্বদিক দিয়ে বয়ে গেছে শীতলক্ষ্যা নদী। ভরা শীতলক্ষ্যার দক্ষিণ পারে কাপাসিয়া পাইলট স্কুলে পাকিস্তানি আর্মিদের ক্যাম্প।


আর নদীর দক্ষিণ পারে ডা. সিরাজুল ইসলামের বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধাদের অস্থায়ী ক্যাম্প। ভারত থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে ফিরে আসা জনদশেক মুক্তিযোদ্ধার একটি দল পালাক্রমে পাহারা দেয় গ্রাম। মুক্তিযোদ্ধাদের ভয়ে পাকিস্তানি সৈন্যরা নদী পার হতে পারে না। এ ছাড়া মাঝেমধ্যেই নদীর উত্তর পাড় থেকে ক্যাম্পের দিকে ফাঁকা গুলি ছোড়ে মুক্তিযোদ্ধারা। পাকিস্তানি আর্মিরাও পাল্টা গুলি ছোড়ে। এভাবেই কাটছে মুক্তিযুদ্ধের এ সময়টা। একদিন রাতের পাহারা শেষ করে সকালের দিকে দুজন মুক্তিযোদ্ধা নদীর পাড় দক্ষিণে রেখে পূর্বদিকে হাঁটছেন। হঠাৎ একজনের নজরে আসে নদীতে কালো ধোঁয়া। মুক্তিযোদ্ধা ওবায়দুর রহমান (পরবর্তী সময়ে জাতীয় সংসদ সদস্য) বুঝতে পারেন গানবোট আসছে। সঙ্গে সঙ্গে দুজন দৌড়ে ফিরে গেলেন তাদের অস্থায়ী ক্যাম্পে। অন্যরা তখনো ঘুমিয়ে। তিনি তাঁদের ডেকে তোলেন। তারপর তাঁরা কাপাসিয়া-টোক রাস্তার পূর্ব পাশে একটি টেকে (মাটির উঁচু টিলা) গেরিলা অবস্থান নেন। কিছুক্ষণ পর শ-খানেক পাকিস্তানি আর্মি মার্চ করে উত্তর দিকে যেতে থাকে। সুযোগ বুঝে তাঁরা তাদের লক্ষ্য করে গুলি ছুড়তে থাকেন। মুহূর্তে পাঁচ-সাতজন পাকিস্তানি সেনা লুটিয়ে পড়ে। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান শনাক্ত করতে না পেরে তারা এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণ করে। ত্রিশ-চলি্লশ মিনিট পর মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটে যান। কিন্তু পাকিস্তানি সৈন্যরা ঢুকে পড়ে গ্রামে। যাকে সামনে পায় তাকেই তারা হত্যা করে। ৮-১০ জন গ্রামবাসীকে হত্যার পর তারা তাদের ক্যাম্পে ফিরে যায়। সেদিন ছিল শনিবার। এর পরের মঙ্গলবার পাকিস্তানি হানাদারদের প্রায় ২০০ সৈন্যের একটি দল তরগাঁও গ্রামে ঢুকে নির্বিচারে গ্রামবাসীকে হত্যা করতে থাকে। আগুনে পুড়িয়ে দেয় বেশির ভাগ ঘরবাড়ি। হত্যা করে ১৫ জনের বেশি গ্রামবাসীকে। দিনভর পৈশাচিক তাণ্ডবে তছনছ করে পুরো গ্রাম। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর থেকে কাপাসিয়া মুক্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত এই গ্রামে কয়েক দফা এ রকম হত্যা-হামলা চলে। বর্তমানে বেশির ভাগ মুক্তিযোদ্ধার বয়স ষাটের ওপরে। বার্ধক্য মানুষের স্মৃতির পটে বিস্মৃতির আবরণ ফেলে। এখনো যে মুক্তিযোদ্ধারা বেঁচে আছেন, তাঁরা হয়তো কোনো ঘটনার দিন-তারিখের কথা স্পষ্টভাবে মনে করতে পারেন না। তবে ঘটনাগুলো তাঁরা ঠিকই মনের গভীরে লালন করেন সযতনে। এ কারণে যে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে তাঁদের জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় মুক্তিযুদ্ধের সময়। তাঁদের জীবনের শ্রেষ্ঠ কর্ম পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা। মুক্তিযোদ্ধাদের পাশাপাশি যেসব মানুষ শহীদ হয়েছেন, তাঁদের শহীদ হওয়ার ইতিহাস রচিত হলেই পূর্ণাঙ্গ হবে আমাদের স্বাধীনতার ইতিহাস। মুক্তিযুদ্ধকালীন ঘটনাবলি জেলা বা থানাভিত্তিক রচিত হলে একদিকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস যেমন হবে পূর্ণাঙ্গ, তেমনি শহীদদের প্রতিও প্রদর্শিত হবে যথাযথ মর্যাদা।
সাইফুল ইসলাম খান

No comments

Powered by Blogger.