মধ্যপ্রাচ্য-নতুন রাজনৈতিক যুদ্ধের শুরু by সামির আমিন

আরব বিশ্বে যা ঘটছে, তার নাম সামাজিক বিদ্রোহ। বিকল্প সৃষ্টির সম্ভাবনা ধরে এসব বিদ্রোহ। এমনকি দীর্ঘ মেয়াদে সমাজতান্ত্রিক ভাবধারাও লাভবান হবে এসব আন্দোলন থেকে। এ জন্যই পুুঁজিবাদী ব্যবস্থা, বৈশ্বিক একচেটিয়া পুঁজিবাদ এসব আন্দোলনকে সফল হতে দেবে না।


আন্দোলনগুলো নষ্ট করার জন্য তারা সর্বশক্তি নিয়োগ করবে, অর্থনৈতিক চাপ দেবে, এমনকি সামরিক হুমকিও সৃষ্টি করবে। পরিস্থিতি অনুযায়ী তারা কোথাও ফালতু ফ্যাসিস্ট কিংবা সরাসরি ফ্যাসিবাদকেই মদদ দেবে। অথবা কায়েম করবে নতুন সামরিক একনায়কত্ব। ওবামার কোনো কথাই বিশ্বাস করা যাবে না। ওবামা মানে বুশই, কেবল ভাষাটা ভিন্ন। সব সময়ই মার্কিন নেতারা মুখে এক বলেন এবং করেন আরেকটা। বাস্তবতা হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র মোবারককে টিকিয়ে রেখেছিল। কিন্তু যখন দেখল, তাঁকে রাখার চেয়ে বিদায় দিলেই বেশি লাভ, তখন তারা সেটাই করেছে। তা হলেও নিজেদের জন্য সহায়ক পরিস্থিতি ঠিকই টিকিয়ে রেখেছে: সামরিক বাহিনী ও পুলিশ। সম্ভবত তারা এখন মুসলিম ব্রাদারহুডের সঙ্গে যোগসাজশ করে এই দুই শক্তিকে আরও বলবান করবে। আসলে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বের মনে কাজ করছে পাকিস্তানি মডেল। তারা গণতন্ত্র চায় না, তারা চায় ক্ষমতার এমন এক ঢালাই তৈরি করতে, যাকে বলা যায় ইসলামি সামরিকতন্ত্র। তবে মিসরের বিক্ষোভকারীদের বড় অংশই এই পরিকল্পনা সম্পর্কে জানে। মিসরীয়রা রাজনৈতিকভাবে খুবই সচেতন। মিসরের ইতিহাস হলো বারবার অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আসার ইতিহাস। উনিশ শতকের গোড়া থেকেই এটা হয়ে আসছে এবং বারবারই নিজেদের সীমাবদ্ধতার জন্যই তারা পরাজিত হয়েছে। তবে প্রধান কারণ ছিল বাইরের শক্তির আগ্রাসন ও হস্তক্ষেপ।
মোটামুটিভাবে গামাল আবদেল নাসেরের নেতৃত্বে মিসরে একটি সংগতিপূর্ণ ব্যবস্থা গড়ে ওঠে। এর ত্রুটি ও সমালোচনা আছে। কিন্তু নাসের আন্তর্জাতিক ঔপনিবেশিক শক্তির খপ্পর থেকে দেশকে বের করতে শিল্পায়নের কর্মসূচি হাতে নিয়েছিলেন। আর উপনিবেশবাদ চেয়েছিল, মিসর কেবল তুলাই রপ্তানি করে যাক, কৃষিভিত্তিকই থেকে যাক। নাসেরের প্রশাসন মধ্যবিত্তের স্বার্থে অনেক কিছু করেছিল, তাদের আয় বাড়িয়েছিল এবং এগুলো করা হয়েছিল গরিবদের ওপর বাড়তি চাপ না দিয়েই। কিন্তু ১৯৫৬ ও ১৯৬৭ সালের ইসরায়েলি সামরিক আগ্রাসন মোকাবিলা করতে গিয়ে সব বদলে গেল। তারপর এলেন আনোয়ার সাদাত এবং তার পরে হোসনি মোবারক। তাঁরা দুজনই মিসরের উৎপাদনব্যবস্থা তছনছ করে দিলেন, অর্থনীতি হয়ে পড়ল মুনাফাসন্ধানী। তাঁদের আমলের তথাকথিত উচ্চ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির অনেক প্রশংসা করে বিশ্বব্যাংক। কিন্তু এই গলাবাজি পুরোটাই ভুয়া। এটা আসলে ধোঁকা। মিসরের প্রবৃদ্ধি খুবই নাজুক, এটা মূলত বাইরের অর্থনীতি এবং তেলকুবের দেশগুলোর সাহায্যের ওপর নির্ভরশীল। তাই যেই বৈশ্বিক মন্দা দেখা দিল, অমনি মিসরের অর্থনীতির দম ফুরিয়ে গেল। এই পতনের গতির সঙ্গী হলো ব্যাপক বৈষম্য ও বেকারত্ব। বিপুলসংখ্যক তরুণ-তরুণী হলেন এর শিকার। পরিস্থিতিটাই ছিল বিস্ফোরক এবং সেই বিস্ফোরণ অবশেষে ঘটল। এর গর্ভ থেকেই এখন জন্মাচ্ছে নতুন এক রাজনৈতিক যুদ্ধ, যা কেবল শাসক দলের পতন অথবা গণতান্ত্রিক স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার আদি দাবির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকার নয়।
এর মধ্যে দেখা যাচ্ছে, মুসলিম ব্রাদারহুড নিজেদের ‘উদার’ হিসেবে দেখাতে চাইছে। কেন সেটা করছে? কারণ সেটাই তাদের করতে বলা হয়েছে। মুসলিম ব্রাদারহুড কখনোই উদার ছিল না। তারা কোনো ধর্মীয় আন্দোলন করে না, তারা করে রাজনৈতিক আন্দোলন এবং ধর্ম তাদের হাতিয়ার। ১৯২০ সালে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তি এবং স্থানীয় রাজতন্ত্র মিলে এই দলটি প্রতিষ্ঠা করে। তখন থেকেই দলটি সক্রিয়ভাবে কমিউনিস্ট-বিরোধী, ‘উদারতাবিরোধী’ এক অগণতান্ত্রিক শক্তি। এটাই তাদের অস্তিত্বের ভিত্তি এবং সেটা তারা খোলাখুলিই স্বীকার করে। তারা প্রকাশ্যেই বলে: একবার নির্বাচনে জয়ী হলে, সেটাই হবে শেষ নির্বাচন। কেননা, যে নির্বাচনব্যবস্থা পাশ্চাত্য থেকে আমদানি করা, তা ইসলামবিরোধী। এদিক থেকে আসলে তারা মোটেই বদলায়নি। বাস্তবত, রাজনৈতিক ইসলাম সর্বদাই যুক্তরাষ্ট্রকে সমর্থন করে এসেছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে তালেবান তৈরি করেছে এবং বলেছে, তারা নাকি মুক্তির বীর। আর যখন তালেবানরা কমিউনিস্ট আমলে প্রতিষ্ঠিত মেয়েদের স্কুলগুলো বন্ধ করে দিল, তখন যুক্তরাষ্ট্রে এমন নারীবাদীদের দেখা গেল, যারা বলল, ‘আমাদের আফগানিস্তানের নিজস্ব “ঐতিহ্য”কে সম্মান করা উচিত।’ যুক্তরাষ্ট্র দ্বিমুখী এক খেলা খেলছে। একদিকে তারা এই রাজনৈতিক ইসলামকে সমর্থন করে, অন্যদিকে এর অজুহাতে নিজেদের সমাজে তারা বর্ণবাদকে জায়েজ করে, অভিবাসীদের হেয় করে এবং মুসলিমপ্রধান দেশে সামরিক আগ্রাসন চালায়। এই কৌশলেরই অংশ হিসেবে মিসরের হোসনি মোবারক কদাচ রাজনৈতিক ইসলামের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালাননি। বরং তিনি একে সিস্টেমের অংশ করে নিয়েছেন।
মোবারক কার্যত মিসরীয় সমাজের সাব-কন্ট্রাক্টরি তুলে দিয়েছিলেন মুসলিম ব্রাদারহুডের হাতে। তিনি তিনটি কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠানে এদের প্রতিষ্ঠা করেছেন: বিচার বিভাগ, শিক্ষাব্যবস্থা ও টেলিভিশন। কিন্তু সামরিক শাসকেরা এগুলোর ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব নিজেদের হাতে রেখেছিলেন এবং সেটাই তাঁরা এখনো চান। মুসলিম ব্রাদারহুডের সঙ্গে তাঁদের দ্বন্দ্ব এখানেই। আমেরিকা এই মামুলি অন্তর্দ্বন্দ্বকে কাজে লাগায় এবং উভয়কে পরস্পরের বিরুদ্ধে চালিয়ে উভয়কেই বশে রাখে। এদের সবার মধ্যে জরুরি ঐক্যটি হলো, এরা সবাই পুঁজিবাদ যেমন, তেমনভাবেই তাকে মেনে নিয়েছে। মুসলিম ব্রাদারহুড কখনোই আন্তরিকভাবে পরিস্থিতির কোনো বদল ঘটাতে চায়নি। যেমন ধরা যাক, ২০০৭-০৮ সালে যখন বড় আকারে শ্রমিক ধর্মঘট চলছিল, তখন ব্রাদারহুডের এমপিরা সরকারের সঙ্গে মিলে শ্রমিকদের বিরুদ্ধে ভোট দেন এবং সিদ্ধান্ত পাস করেন। বড় জোতদারেরা যখন কৃষকদের জমি থেকে উচ্ছেদ করছিল, তখনো মুসলিম ব্রাদারহুড কৃষক আন্দোলনের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়। তাদের কাছে ব্যক্তিগত সম্পত্তি, মুক্তবাণিজ্য আর মুনাফা হলো অতি পবিত্র জিনিস।
দীর্ঘ মেয়াদে মধ্যপ্রাচ্যের সামনের পথটা এখনো অনিশ্চিত। সামরিক বাহিনীগুলোর মতো মুসলিম ব্রাদারহুডও মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন আধিপত্য এবং ইসরায়েলের সঙ্গে সখ্য যেমন আছে, তেমনটা বজায় রাখার পক্ষে। এরা সবাই যে রকম পরিতৃপ্তির সঙ্গে ফিলিস্তিনের বাদবাকি অংশেও ইসরায়েলের উপনিবেশ কায়েম হতে দিচ্ছে, তাতে এদের কাছ থেকে আশা করার কিছু আর থাকে না।
অ্যাক্সিস অব লজিক-এ ইংরেজিতে দেওয়া সাক্ষাৎকার থেকে রূপান্তর ফারুক ওয়াসিফ
সামির আমিন: মিসরীয় অর্থনীতিবিদ, ওয়ার্ল্ড সোশ্যাল ফোরামের পুরোধা।

No comments

Powered by Blogger.