সরকারি অফিস, ব্যাংক, বিপণিবিতানে ভাঙচুর-হরতালে অশান্ত বিশ্বনাথ, নিহত ২
ইলিয়াস আলীর নির্বাচনী এলাকা সিলেটের বিশ্বনাথে গতকাল সোমবার হরতাল চলাকালে পুলিশ ও বিএনপির নেতা-কর্মীদের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়েছে। এ সময় পুলিশের গুলিতে যুবদলের এক নেতাসহ দুজন নিহত হন। সংঘর্ষে আহত হয়েছেন বিশ্বনাথ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাসহ (ওসি) আট পুলিশ ও বিএনপির শতাধিক নেতা-কর্মী।
বিক্ষুব্ধ নেতা-কর্মীরা উপজেলা পরিষদ চত্বরে অবস্থিত বেশকিছু সরকারি অফিস ও শহরে কয়েকটি ব্যাংকের শাখা কার্যালয় ও বিপণিবিতানে ব্যাপক ভাঙচুর করেন। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) গাড়িসহ বেশ কিছু গাড়িতে আগুন দেন তাঁরা।
এ ছাড়া গতকাল দ্বিতীয় দিনের হরতালেও রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে পুলিশের সঙ্গে হরতালকারীদের বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষ, ককটেল বিস্ফোরণ ও গাড়ি ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। বিএনপি জানিয়েছে, দুই দিনের হরতালকে কেন্দ্র করে ঢাকাসহ সারা দেশে দলটির এক হাজার ১০৬ জন নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। গতকাল রাজধানী থেকে ৭৪ জন নেতা-কর্মীকে আটক করেছে পুলিশ। তবে মহানগর পুলিশ সূত্র জানিয়েছে, তারা গতকাল বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান সেলিমা রহমানসহ ৪১ জনকে আটক বা গ্রেপ্তার করেছে।
বিশ্বনাথে নিহত যুবদলের কর্মীর নাম মনোয়ার হোসেন (২৬)। তিনি উপজেলার রাজনগর গ্রামের প্রয়াত আব্বাস আলীর ছেলে। নিহত অপর ব্যক্তির পরিচয় পাওয়া যায়নি। তাঁর বয়স আনুমানিক ২৮ বছর।
বিশ্বনাথ উপজেলা বিএনপির সভাপতি জালালউদ্দিন অভিযোগ করেন, নিরস্ত্র নেতা-কর্মীদের ওপর পুলিশ নির্বিচারে রাবার বুলেট ও গুলি ছোড়ে। যুবদলের কর্মী মনোয়ারসহ দুজন পুলিশের গুলিতেই নিহত হয়েছেন।
সংঘর্ষে আহত পুলিশ সদস্যদের মধ্যে ওসি (তদন্ত) চান মিয়া, উপপরিদর্শক (এসআই) সালাউদ্দিন ও এনামুল হক, নায়েক সাধন বিকাশ চাকমা, কনস্টেবল ফারুক, জামাল, মোহন, সেলিমকে ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। সাধন চাকমার অবস্থা গুরুতর। সন্ধ্যায় তাঁকে অস্ত্রোপচারকক্ষে নেওয়া হয়।
বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের ২০ জন নেতা-কর্মীকে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এর মধ্যে জাকির হোসেন (২৮), সায়েন (২৭), হানিফ (২৮), ফয়জুল ইসলাম (২৭) নামের চার ছাত্রদল ও যুবদল কর্মী এবং যুবলীগের কর্মী আজির উদ্দিনের অবস্থা গুরুতর। সন্ধ্যায় এক দফা অস্ত্রোপচারের পরও জাকিরের অবস্থার উন্নতি হয়নি বলে চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন।
প্রত্যক্ষদর্শী ও পুলিশ সূত্র জানায়, স্থানীয় বিএনপিসহ অঙ্গসংগঠন রোববার ঘোষণা দেয়, সোমবার থানা ও উপজেলা কমপ্লেক্স ঘেরাও করা হবে। এ জন্য গতকাল সকালেই উপজেলা কমপ্লেক্স ও থানার সামনে পুলিশ মোতায়েন করা হয়। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে সহস্রাধিক নেতা-কর্মী লাঠিসোঁটা ও দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে উপজেলা সদরে অবস্থান নেয়। বেলা দুইটার দিকে তারা উপজেলা কমপ্লেক্সের ভেতর ভারপ্রাপ্ত ইউএনও কামাল হোসেনের বাসভবনের সামনে তাঁর সরকারি জিপটি জ্বালিয়ে দেয়। এরপর বিক্ষোভকারীরা কয়েকটি ভাগে বিভক্ত হয়ে উপজেলার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সরকারি স্থাপনায় হামলা চালায়। উপজেলা কমপ্লেক্সের মধ্যে অবস্থিত মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয়, ভূমি কর্মকর্তার কার্যালয়, উপজেলা পরিষদ ভবন এবং বাইরে বিশ্বনাথ থানায় হামলা করে ভাঙচুর করে। অফিসের নথি ও ফাইলপত্র বাইরে নিয়ে এসে আগুন ধরিয়ে দেয়। আগুন দেওয়া হয় কর্মকর্তাদের সাতটিসহ ১৩টি মোটরসাইকেলে। হামলায় আহত হন উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা নির্মল চন্দ্র বণিক।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ কয়েক শ রাবার বুলেট ও কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপ করে। কিন্তু বিক্ষোভকারীদের তুলনায় পুলিশের সংখ্যা অনেক কম হওয়ায় পুলিশ একপর্যায়ে পিছু হটে। এ সময় উপজেলা কমপ্লেক্স এলাকায় পুলিশের নায়েক সাধন চাকমাকে ধরে বেধড়ক মারধর করে বিক্ষোভকারীরা। পরে তাঁকে পার্শ্ববর্তী বাসিয়া নদীতে ফেলে দেওয়া হয়। সংজ্ঞাহীন অবস্থায় স্থানীয় সাংবাদিকেরা তাঁকে উদ্ধার করেন। একই সময় বিক্ষোভকারীরা উপজেলা সদরে ইস্টার্ন ব্যাংক, জনতা ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ব্যাংক ও ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক এবং আল-বুরাক শপিং সিটি সেন্টার, দিদার শপিং সেন্টার, আবদুল খালিক মার্কেট, শাহ ম্যানসন, খুরশেদ আলী ম্যানশন, সেবা কমিউনিটি সেন্টার এবং আবদুল খালিক কমিউনিটি সেন্টারে ভাঙচুর চালায়।
পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ও রাবার বুলেট ছুড়েও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ব্যর্থ হয়। খবর পেয়ে জেলা সদর থেকে পুলিশ, আর্মড পুলিশ ও র্যাবের চার শতাধিক সদস্য বেলা তিনটার দিকে বিশ্বনাথ সদরে আসে। এরপর পুলিশ এলোপাতাড়ি গুলি করতে শুরু করে। তাদের সঙ্গে যোগ দেন ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীরা। পুরো শহর তখন রণক্ষেত্রে রূপ নেয়।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, পুলিশের এলোপাতাড়ি গুলির পর বেলা সাড়ে তিনটার দিকে উপজেলা সদরের মোহামঞ্চদিয়া আরাবিয়া মাদ্রাসার পাশে অজ্ঞাত এক যুবকের লাশ পড়ে থাকতে দেখা যায়। তাঁর শরীরের বিভিন্ন স্থানে জখমের চিহ্ন ছিল। পেটে গুলিবিদ্ধ হয়ে যুবদল কর্মী মনোয়ার হোসেন পড়ে ছিল বাসিয়া সেতুর ওপর।
সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কর্তব্যরত সার্জারি বিভাগের চিকিৎসক মোস্তফা তৌফিক প্রথম আলোকে বলেন, গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত বা নিহত হওয়ার ব্যাপারে তাৎক্ষণিকভাবে কিছু বলা যাচ্ছে না। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর জানা যাবে।
পুলিশের সঙ্গে আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা: বিএনপির নেতা-কর্মীদের অভিযোগ, দফায় দফায় সংঘর্ষে পুলিশ যখন হিমশিম খাচ্ছিল, তখন এগিয়ে আসেন আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের কর্মীরা। তাঁরা বিএনপি নেতা-কর্মীদের লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছোড়া শুরু করে। বাসিয়া নদীর দুই পারে ত্রিমুখী সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়। একপর্যায়ে যুবদলের কর্মী জাকির পায়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে বাসিয়া সেতুর ওপর লুটিয়ে পড়েন। তখন পুলিশ ও আওয়ামী লীগের কর্মীরা জাকিরকে বেধড়ক মারধর করেন। তাঁর অবস্থা আশঙ্কাজনক।
আওয়ামী লীগের বক্তব্য: পুলিশের সঙ্গে যোগ দিয়ে বিএনপির নেতা-কর্মীদের ওপর হামলার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন বিশ্বনাথ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বাবুল আখতার। তিনি বলেন, বিএনপি একের পর এক হরতাল ডেকে জনজীবন অস্থিতিশীল করে ফেলেছে। তাঁরা পরিকল্পিতভাবে পুলিশের ওপর হামলা চালিয়েছে। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে সাধারণ মানুষ বিক্ষোভকারীদের প্রতিরোধে মাঠে নেমেছিল।
পুলিশের ভাষ্য: পুলিশের সিলেট রেঞ্জের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) মকবুল হোসেন ভূঁইয়া বিকেল পাঁচটায় ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আহত পুলিশ সদস্যদের দেখতে যান। এ সময় আহত পুলিশ সদস্যরা তাঁকে জানান, প্রায় ১২ হাজার বিক্ষোভকারী হঠাৎ করে দেশীয় অস্ত্র নিয়ে পুলিশের ওপর চড়াও হয়। বিক্ষোভকারীদের তুলনায় পুলিশের সংখ্যা ছিল নগণ্য। উপজেলা কমপ্লেক্স এলাকায় কর্তব্যরত ২০ জন পুলিশ সদস্যকে ঘিরে ধরে মারধর শুরু করে বিক্ষোভকারীরা। তখন আত্মরক্ষার্থে পুলিশ ফাঁকা গুলি ছোড়ে।
যুবদলের কর্মী মনোয়ার হোসেন পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছেন কি না, জানতে চাইলে উপমহাপরিদর্শক সাংবাদিকদের বলেন, ‘এ নিয়ে আমরা পরে কথা বলব।’ সিলেটের পুলিশ সুপার মোহামঞ্চদ সাখাওয়াত হোসাইন সন্ধ্যায় প্রথম আলোকে বলেন, পরিস্থিতি এখন শান্ত। অতিরিক্ত পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একাধিক দল উপজেলা সদরে অবস্থান করছে।
No comments